গাজার হাসপাতালে রকেট হামলার দায় কার? কেন যুদ্ধের বলি নিরীহ শিশুরা?

Israel Gaza War : গাজার হাসপাতালে মেঝেতে শুইয়ে অ্যানাস্থেশিয়া ছাড়াই অস্ত্রোপচার। রকেট হামলার দায় কার?

স্কুলের পর এবার হাসপাতাল। যুদ্ধের সফট টার্গেট শিশু, অসুস্থ মানুষ। মঙ্গলবার গাজায় রাষ্ট্রসঙ্ঘ পরিচালিত শরণার্থী শিবিরের স্কুল আল-মাগাঝিতে হামলা। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই গাজা শহরের আল-আহলি আরবিতে রকেট হামলা। প্রাণ গিয়েছে অসংখ্য নিরীহ সাধারণ অসুস্থ মানুষের। অ্যাম্বুলেন্স আর গাড়িতে আহত, অসুস্থ মানুষদের কোনও রকমে নিয়ে যাওয়া গিয়েছে গাজার অন্য আর এক হাসপাতাল আল-শিফায়। যেখানে এমনিতেই কোনও শয্যা খালি নেই। ইজরায়েলের রকেট হামলায় অসংখ্য আহত, জখম গাজাবাসী এই হাসপাতালে ভরতি। হাসপাতালের মত এমন একটি জরুরি পরিষেবায় এই ভয়াবহ রকেট হামলার দায় কার? কেন বারবার যুদ্ধের সফট টার্গেট শিশু আর অসুস্থ মানুষ?

অসংখ্য শিশু, মৃত মানুষের শব ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে যুদ্ধের বারো দিন পর শেষ পর্যন্ত টনক নড়েছে রাষ্ট্রসঙ্ঘের। খাবার, ত্রাণ সামগ্রী, পৌঁছে দিতে অবিলম্বে অস্ত্র বিরতির কথা বলেছেন রাষ্ট্রসঙ্ঘের মহাসচিব আন্তোনিয়ো গুতেরেস। অর্থাত হাসপাতালে রকেট হামলায় কম করে ৫০০ মানুষের মৃত্যুর পর ঘুম ভেঙেছে পশ্চিম দুনিয়ার। ইজরায়েল কি রাষ্ট্রসঙ্ঘের আবেদনে সাড়া দেবে? সাড়া দেবে হামাস?

আরও পড়ুন: কফিতে রক্তের দাগ! ইজরায়েল প্যালেস্তাইনের যুদ্ধে কেন স্টারবাকস বয়কটের ডাক?

বুধবার ভারতীয় সময় দুপুর একটা কুড়ি। ইজরায়েলে অবতরণ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের এয়ারফোর্স ওয়ান। ততক্ষণে অবশ্য জর্ডন সামিট বাতিল হয়ে গিয়েছে। কেন বাতিল হল? সে কথা পরে লিখছি। বাইডেন ইজরায়েলে পা রাখছেন, আর গাজার আল-শিফা হাসপাতালে এসে পৌঁছচ্ছে ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত আহতেরা। রকেট হামলায় কারও পা উড়ে গিয়েছে। কারও হাত। কে মৃত আর কার প্রাণ রয়েছে, বোঝা দায়। আবু সেলমিয়া, আল-শিফা হাসপাতালের প্রধান। বলছেন, কোনও বেড খালি নেই, আহতদের মেঝেতে শুইয়ে বা হাসপাতালের হলঘরে চিকিৎসা করতে হচ্ছে। অনেক সময় অস্ত্রোপচার করতে হচ্ছে কোনও রকম অ্যানেসথেশিয়া ছাড়াই।

ইজরায়েল সেনা একটি ভিডিয়ো পোস্ট করেছে। স্যাটেলাইটে তোলা ছবির মাধ্যমে রকেট হামলার আগে আল-আহলি হাসপাতাল এবং হামলার পরের হাসপাতালের চেহারা কতটা বদলে গিয়েছে, তা দেখিয়েছে। একইসঙ্গে দাবি করেছে, প্যালেস্তিনিয়ান ইসলামিক জিহাদ-এর ছোড়া রকেট লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েই হাসপাতালে গিয়ে পড়েছে। হাসপাতাল হামলার পিছনে ইজরায়েলের কোনও হাত নেই। রকেট যেখান থেকে ছোড়া হয় তার কতটা দূরত্বের মধ্যে হাসপাতাল সেটা সাংবাদিক সম্মেলনে ছবি দেখিয়ে প্রমাণের চেষ্টা করেছে। দুই স্বাধীন ফটোগ্রাফারের তোলা ছবিকে তথ্যপ্রমাণ হিসেবে হাতিয়ার করেছে। একইসঙ্গে সন্ত্রাসবাদীদের ভিতর টেলিফোনিক কথোপকথনের অডিয়ো শুনিয়ে ইজরায়েল সেনা দাবি করেছে, আল-আহলি হাসপাতালে রকেট হামলার পিছনে রয়েছে প্যালেস্তিনিয়ান ইসলামিক জিহাদ। পিআইজি-র শিকার হয়েছেন প্যালেস্তাইনের সাধারণ মানুষ। পালটা প্যালেস্তাইন বিদেশ মন্ত্রকের সরকারি এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডল থেকে টেলিভিশন চ্যানেলের ভিডিয়ো ফুটেজের ক্লিপিংস পোস্ট করে দাবি করা হয়েছে, ইজরায়েলই হাসপাতালে রকেট হামলা চালিয়েছে।

আরও পড়ুন: Hamas vs Israel: গাজার মৃত শিশুদের আঙুল সব আমার দিকে তাক করা

ঘাসান আবু সিত্তা পেশায় একজন চিকিৎসক। প্লাস্টিক সার্জেন। কর্মক্ষেত্র লন্ডনে। যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় পৌঁছন গত সপ্তাহের সোমবার। তারপর থেকে অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। দিনরাত এক করে দিয়েছেন আহত আর্তের সেবায়। বিশেষ করে শিশুদের সেবায়। ফেসবুকে লিখেছেন তাঁর ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা। সকালে তিনি আল-আহলি হাসপাতালে পৌঁছন। হাসপাতাল আহতদের ভিড়ে একেবারে ঠাসা। গাজার স্থানীয় সময় বিকেল সাড়ে পাঁচটা হবে। দুটো অস্ত্রোপচারের মাঝের সময়ে ক্ষেপণাস্ত্র পড়ার তীক্ষ্ণ শব্দ শুনতে পান। তারপরেই ভয়াবহ বিস্ফোরণের বিকট আওয়াজ। শব্দের অভিঘাতে অপারেশন থিয়েটরের ফলস-সিলিং ভেঙে পড়ে। ছুটে বেরিয়ে এসে দেখেন মিসাইল সোজা হাসপাতালে এসে পড়েছে। হাসপাতাল চত্বর দাউদাউ করে জ্বলছে। প্রাণভয়ে আহতরা চিৎকার করছেন। চিকিৎসক সিত্তা লিখছেন, এরপর দেরি না করে তিনি জরুরি বিভাগে পৌঁছন। আহতেরা সেখানে ততক্ষণে ভিড় করেছেন। গুরুতর ভাবে জখম তাঁরা। একজনের পা উড়ে গিয়েছে। আহতের থাইয়ে শক্ত করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দেন তিনি। একজনের ঘাড় ভয়াবহ ভাবে জখম। এরপর অ্যাম্বুলেন্স পৌঁছলে আহতদের শিফা হাসপাতালে পৌঁছনর ব্যবস্থা করেন। ফোন হারিয়ে গিয়েছে, তাই ফেসবুকে লিখছেন তিনি অক্ষত আছেন। কিন্তু এ এক ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড।

আরও পড়ুন: যুদ্ধ মিলিয়ে দিয়েছে আমাকে আর আমার প্রাক্তনকে! 

ডক্টর ঘাসান আবু সিত্তার পোস্ট পড়তে পড়তে ভয় আতঙ্ক অসহায় বোধ মাথার রগ চেপে ধরে। আল-আহলি আরব হাসপাতালে তবে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ল কারা? ক্রিস গানেশ রাষ্ট্রসঙ্ঘে ত্রাণবন্টন বিলি বিভাগের প্রাক্তন মুখপাত্র বলছেন, ইজরায়েলে দাবি শুনে তিনি একেবারেই বিষ্মিত হচ্ছেন না। হামলার দায় যে ইজরায়েল নেবে না, সেটাই স্বাভাবিক।সংবাদ মাধ্যম আল-জাজিরাকে তাঁর প্রশ্ন, 'হামাসের তৈরি করা রকেট শেষ কবে গাজার গোটা একটা বিল্ডিং ধ্বংস করে দিয়েছে বলুন তো? তিনি তদন্তের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন, আবার একই সঙ্গে মনে করিয়ে দিয়েছেন ইজরায়েলের ধারাবাহিক মিথ্যাচারের কথা। 'ভুল তথ্য, অসত্য খবর ছড়িয়ে দেওয়ার ইতিহাস রয়েছে ইজরায়েলের', বলছেন রাষ্ট্রসঙ্ঘের ওই প্রাক্তন মুখপাত্র। এমনকি রাষ্ট্রসঙ্ঘের বিরুদ্ধেও যে ইজরায়েল ভুল তথ্য দিয়ে থাকে, তারও উল্লেখ করেছেন। এর আগেও রাষ্ট্রসঙ্ঘ পরিচালিত স্কুল থেকে সন্ত্রাসবাদীরা রকেট হামলা করে বলে ইজরায়েল দাবি করে। রাষ্ট্রসঙ্ঘ সেই ঘটনার তদন্ত করে জানায় ইজরায়েলের দাবির কোনও রকম ভিত্তি নেই।

More Articles