'ম্যারেজ পলিসি'-র মিশ্র সন্তান! কীভাবে তৈরি হলো কোচিনের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সমাজ?

Anglo Indians of Cochin: পর্তুগিজ সেনাদের বিধিনিষেধ ছিল ভারতীয় মেয়েদের সঙ্গে বিবাহের ক্ষেত্রে। কিন্তু আর্থিক সঙ্গতিহীন স্থানীয় মহিলাদের সঙ্গে বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে সেনারা।

কোচিন। কেরলের এরনাকুলাম জেলার একটি জায়গা। চারিদিক থেকে ঘিরে আছে সমুদ্র। ঝাউ ও বাদাম বৃক্ষের মাঝখানে ছোট-ছোট বাদামি ঘর, আর্চ শেপের ছাদ। ফাঁকা-ফাঁকা, নিরিবিলি ঘরগুলির মাথায় লাল ক্রুস। আকাশ থেকে কোচিনকে দেখে ভুল হয় কোনও ইউরোপিয় গ্রাম ভেবে। শহর জুড়ে বড় বড় ইন্দো-ইউরোপিয় চার্চ। নানাবিধ বেকারি। গথিক আর্কিটেকচার। সন্ধে হলেই শুরু হয় স্থানীয় মালায়লি-ইউরোপিয় ডায়লেক্টে উপাসনা। পুরু বার্মাটিকের রেলিং। ঝুলছে সুদৃশ্য ঝাড়বাতি। কেকের দোকানের মধ্যেই পেল্লাই মলিন পিয়ানোর মৃদু সুর। আর শহরের মানুষজন নম্র-মৃদুভাষী। কোচিনে বরাবরই মিশ্র জাতির সহবাস। এখানকার ভাষা-খাবার-পোশাক-সুর- সবেতেই ইন্দো-ইউরোপিয় ছাপ। কোচিনে বিভিন্ন সময়পর্বে ছিল পর্তুগিজ-ডাচ ও ব্রিটিশ উপনিবেশ। রেলওয়ে নয়, এই শহরে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান কলোনি তৈরি হয়েছিল সমুদ্র-বন্দরকে ঘিরে।

পর্তুগিজ সময়পর্ব

১৫০২ সালে দ্বিতীয়বার ভারতবর্ষে আসেন ভাস্কো-ডা-গামা। কোচিনের রাজাকে উপহার দেন দামী সিল্ক, মূল্যবান পাথরের গয়না ও ইউরোপিয় কাঠের আসবাবপত্র। ভারতে পর্তুগিজ উপনিবেশ গঠন শুরু হয় ১৪৯৮ সাল থেকে। ভাস্কো-ডা-গামা ঘুরে গেছিলেন ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের মালাবার উপকূল। মালাবার উপকূলে এর অনেক আগে থেকেই বাণিজ্য করতে এসেছেন আরব এবং চিনা ব্যবসায়ীরা। মালাবার বরাবরই বিখ্যাত ছিল মশলার জন্য। দারুচিনি, তুলো, গোলমরিচ এবং টিক-কাঠের সরবরাহ চলত এদেশ থেকে ওদেশে। সেই সময়ের আরেকটি বিখ্যাত বন্দর ছিল কালিকট। কিন্তু কালিকটের রাজবংশ জামোরিনদের সমর্থন ছিল আরবদের প্রতি। আরবদের সঙ্গে লড়াইয়ে পেরে ওঠে না পর্তুগিজরা। তাই তারা বেছে নেয় কোচিন। কোচিনের রাজার সঙ্গে তৈরি করে সুসম্পর্ক। শুরু হয় কলোনি নির্মাণ। ১৫০৫-১৫৩০ অবধি কোচিন ছিল পর্তুগিজ উপনিবেশের রাজধানী। এরপর পর্তুগিজরা সরে যায় গোয়ায়।

তবে ভাস্কো-ডা-গামা ও তাঁর দেশের লোকজনদের বাণিজ্যই একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল, তা নয়। পর্তুগালের ক্যাথলিক রাজা প্রথম ডম ম্যানুএলের ছিল একটি ধর্মীয় বিশ্বাস। প্রিস্তার জন নামে এক সাধক মধ্যযুগে ভারতবর্ষের কিছু মানুষকে খ্রিস্টিয় ধর্মে দীক্ষা দেন। রাজার বিশ্বাস, তখনও সেই মানুষরা থাকেন কোচিনে। তাই তিনি বণিকদের সঙ্গে পাঠান খ্রিস্টিয় মিশনারিদের এক দল। যারা খুঁজে আনবে তাঁর ধর্মভাইদের। রাজার প্রচেষ্টা বিফলে যায়নি। মিশিনারিরা অল্পদিনের মধ্যেই খুঁজে ফেলল এক বিশেষ গোত্রের খ্রিস্টান, যারা নিজেদের মনে করে অ্যাপোস্টল থমাসের বংশধর। তারা উপাসনা করে ‘সিরিয়ান অর্থোডক্স চার্চে’। পর্তুগালের রয়াল হাই কমিশনকে জানানো হয় এই কথা। এই ধর্মীয় ব্যখাকে সামনে রেখে কোচিন উপকূলকে পর্তুগালের অংশ বলে দাবি জানায় তারা। গ্রান্টেড হয় ‘প্যাডরোদো রিয়াল’। ভারতবর্ষের ‘পবিত্র’ সমুদ্রের ধারে তৈরি হয় কিছু চার্চ, সম্পূর্ণ পর্তুগালের রাজার নিজস্ব নিয়ন্ত্রণে। চার্চের রক্ষণাবেক্ষণ, বিশপদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, উপাসনা, আর্থিক সাহায্য— এবার সবই দেখবে পর্তুগাল। মিশনারিরা ছড়িয়ে পড়েন কোচিন শহরের দিকে দিকে। এরপর আইন, রাজস্ব ব্যবস্থা, যুদ্ধ— সবেতেই শুরু হয় পর্তুগিজ হস্তক্ষেপ। এরপর ১৫০৪ সালে ভয়ানক যুদ্ধ বাধে কোচিনের রাজা ও কালিকটের জামোরিনদের মধ্যে। পর্তুগিজ বাহিনীর সহায়তায় যুদ্ধে হেরে যায় জামোরিনরা। যুদ্ধ জয়ের পর রাজা তাঁর ঐতিহ্যবাহী মুকুট পরেন পর্তুগালের রাজা প্রেরিত দূতেদের হাতে। বণিকদের রাজনৈতিক ক্ষমতা আরও শক্তপোক্ত হয়। যদিও কালিকটই ছিল তাঁদের প্রথম পছন্দ কিন্তু কোচিনও মন্দ নয়।

আরও পড়ুন- ডার্ক লিপস্টিক, ছোট স্কার্ট! অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মেয়ে মানেই যৌন উন্মাদনা?

ভাস্কো দা গামা চার্চ

ভারতের দক্ষিণপূর্ব দিকে ছিল অনেকগুলি ছোট বন্দর। কয়েকটি খুব উপযোগী নৌ-চলাচলের জন্য। কোচিন পছন্দ হল তাঁদের। অনেক অংশ তখনও জঙ্গলাকীর্ণ-ব্যাকওয়াটারে ঘেরা। এই জায়গাকে তৈরি করে শুরু করা যায় বসতি, চাষবাসের খামার। আর শহর ঘিরে তৈরি হবে চার্চ, মূল বাণিজ্যকেন্দ্র। ষোলো শতকেই দারুচিনি ও গোলমরিচ উৎপাদনে কোচিন ছাপিয়ে গেল কালিকটকে। এরপর স্বয়ং পর্তুগালের রাজার সমর্থন থাকায় ফুলে ফেঁপে উঠল বাণিজ্য।

সমাজে তৈরি হলো তিনটি শ্রেণি। ‘জাম্মাকারনাস’ অর্থাৎ জমির মালিক, যাদের মধ্যে কিছু ছিল হিন্দু ব্রাহ্মণরা। আর ‘ভেরমপত্তকারনাস’-রা ছিল কৃষক। আর কৃষকদের থেকে খাজনা আদায় করত ‘কানামকারানাস’-রা। শুরু হলো এই ভেরমপত্তকারনদের ধর্মান্তরিত করা, যারা মূলত কেরলে মরিচ চাষ করত। এদের মধ্যে কেউ কেউ ছিল সেন্ট থমাস ক্রিস্টান, যাদের জন্ম হয় ব্রাহ্মণ ও পর্তুগিজদের বিবাহের মাধ্যমে। স্থানীয় জাতি হায়ারার্কিতে এরা ছিল খানিকটা ওপরে।

কোচিনে সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতা ইউরেশিয়ানদের জন্য একটু কম ছিল। কারণ পতুগিজ হস্তক্ষেপের আগে কোচিন শহরের বেশিরভাগ অংশই অনাবিষ্কৃত। এ শহরের সাংস্কৃতিক জীবনবোধ তৈরি করে ইওরোপিওরাই। ১৫০৯ সালে এখানকার ভাইসরয় ছিলেন অ্যালফ্যান্সো-দ্য-আলব্যুকারকে। তাঁর আমলে তিনি তৈরি করেন একটি নীতি, যা পর্তুগিজ ও ভারতীয়দের বিবাহে উৎসাহ দেয়। নব্যবিবাহিত ইউরেশিয়ান দম্পতিদের খানিকটা সাহায্য করে কোম্পানি। কোচিন ফোর্টের আশেপাশে থাকার জায়গাও মিলত। আলব্যুকারকের এই ম্যারেজ পলিসির উদ্দেশ্য ছিল কোম্পানির প্রয়োজনে একটু অনুগত বাহিনী তৈরি করা। যারা কাজে আসবে যুদ্ধ বিগ্রহের সময়। ভারতবর্ষে থাকলেও এরা অনুগত থাকবে পর্তুগিজ সরকার ও সংস্কৃতির। কোচিনের নিজস্ব বণিকরা অনেকেই ছিল সম্ভ্রান্ত মুসলিম। স্থানীয় বণিকদের সঙ্গে বিবাহ সম্পর্ক তৈরি হলে ব্যবসা বাণিজ্যেরও উন্নতি হবে।

১৫১৪ সালের একটি তালিকা থেকে দেখা যায়, পর্তুগিজদের সঙ্গে বিবাহ সম্পর্ক তৈরি করেছে মুসলিম, মালাবারি, নায়ার, ব্রাহ্মণ এমনকী জাভানিস ও কানারিয়ানরাও। দেখা গেল, পলিসির দু’বছরের মধ্যেই ভারতীয় মেয়েদের বিবাহ করলেন ৪৫০ জন পর্তুগিজ যুবা। এদের বলা হতে লাগল ‘কাসাডোস’। আরেকদল ছিল ‘সোলডাডোস’। আগেকার নীতি অনুযায়ী, পর্তুগিজ সেনাদের বিধিনিষেধ ছিল ভারতীয় মেয়েদের সঙ্গে বিবাহের ক্ষেত্রে। কিন্তু অনেকক্ষেত্রেই আর্থিক সঙ্গতিহীন স্থানীয় মহিলাদের সঙ্গে বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে সেনারা। তারা থাকত কোচিন ফোর্টের আশেপাশেই। অবশেষে ১৫০৬ সাল নাগাদ কোম্পানি সম্মতি দেয় এদের বিবাহে। আলব্যুকারকের বিবাহনীতি সবদিক থেকে সফল হলো। তিনি শহরে তৈরি করতে চেয়েছিলেন সুষ্ঠ শৃঙ্খলা, যার নিয়ন্ত্রণ থাকবে পর্তুগিজ বাহিনীর হাতে। এরা থাকত ফোর্টের আশেপাশেই আর এদের সন্তানদের বলা হতো ‘মেস্টিকো’ বা মিশ্র।

পরবর্তীতে এক বিরাট অংশের ‘মেস্টিকো অরফ্যান’-দের দায়িত্ব নিয়েছিল কোম্পানি। তাদের জন্য রাজার অনুগ্রহে তৈরি হয় প্রতিষ্ঠান, ‘মিসেরিকরডিয়া’। ১৫২০ সালে তৈরি হয় প্রথম ‘মিসেরিকরডিয়া’। এখানে অরফ্যানদের পাশাপাশি দেখভাল করা হতো অসুস্থ ও রুগ্ন মেস্টিকোদেরও। মিসেরিকরডিয়া দায়িত্ব নিত এদের পড়াশোনারও।

আগেই বলেছি, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সংস্কৃতি তৈরির ক্ষেত্রে মিশ্র জাতির বিবাহ একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। অ্যাংলো সংস্কৃতি তাই বরাবরই প্রাণখোলা, যাতে মিশে আছে নানা ভাষা-সুর-শৈলী। আর এতবছর ধরে যেখানকার অধিবাসী ছিল মূলত ইওরোপিয়রাই সেখানে অ্যাংলো সংস্কৃতি তৈরিতে বাধা কোথায়? কেরলের এই জায়গাটির গায়ে তাই এখনও মালায়লি সংস্কৃতির চেয়ে বেশি অ্যাংলো সংস্কৃতির ছাপ। সামরিক-ঔপনিবেশিক শক্তি এই অনাবিষ্কৃত হিন্টারল্যান্ডে নিজে থেকেই তৈরি করেছিল এক মিশ্র জাতির জনবসতি। তালাল আসাদের ‘অ্যান্থ্রোপোলজি অ্যান্ড দ্য কলোনিয়াল এনকাউন্টার’ বইটি পড়লে আমরা সহজেই বুঝতে পারি ঔপনিবেশিক দেশগুলির নগর পরিকল্পনা, জ্ঞানচর্চা ও সমাজে প্রতিষ্ঠান নির্মাণে সাম্রজ্যবাদী দলগুলির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা অনেকটাই ছিল, তা সে উদ্দেশ্য তাদের যা-ই থাক।

আরও পড়ুন- ম্যাকল্যাস্কিগঞ্জ, অ্যাংলো স্মৃতিবেদনার এক হারিয়ে যাওয়া শহর

সিনাগগ

ডাচ সময়পর্ব

১৬৩০ সালে মুঘলরা আধিপত্য বিস্তার করে হুগলি এবং বাংলায়। বাংলার বিখ্যাত বন্দরগুলির সঙ্গে কোচিনের ব্যবসার যা সম্পর্ক ছিল, তা অনেকখানি কমে যায়। দেখা দেয় অন্যরকম রাজনৈতিক-ঔপনিবেশিক অস্থির‍তা। কমে যায় রাজস্ব ও কাস্টম চার্জ থেকে আয়। স্তিমিত হয়ে আসে কোচিনের রাজপরিবারের সঙ্গে পর্তুগিজদের বাণিজ্যিক ও বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনও। রাজাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সামরিক উত্থানরত ডাচ শক্তি।

ডাচদের সমর্থন যদিও বরাবরই ছিল কালিকটের জামোরিনদের প্রতি। ১৬৩৬ সাল নাগাদ ডাচরা ভীষণভাবে আক্রমণ করতে থাকে পর্তুগিজদের। তাদের বাণিজ্যে আঘাত করার জন্য ডাচরা বন্ধ করে কোচিন ও গোয়ার মাঝখানের সমুদ্রপথ। ১৬৪১ সালে ডাচরা পর্তুগিজদের থেকে মালাক্কা দখল করে নেয়। রাজারা বিপদে পড়ে ডাচদের সঙ্গে হাত মেলায়। ১৬৬৩ সাল থেকে কোচিনে ডাচ উপনিবেশবাদ শুরু হয়। পর্তুগিজ ও মেস্টিকোদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় গোয়ায়। কোচিনে থাকতে শুরু করে ‘টোপাসেস’-রা। যাদের বলা হচ্ছে- ‘সেমি অ্যাসিমিলেটেড হাফ কাস্ট’।

কোচিনের ইউরেশিয়ানদের দুইভাগে ভাগ করা হলো এই সময়— মেস্টিকো এবং টোপাসেস। এদের মধ্যে টোপাসেসদের মধ্যে মূলত ভারতীয় সংস্কৃতির প্রাধান্য ছিল। শুরু হয় মিশ্র জাতিদের মধ্যে সাংস্কৃতিক অস্থিরতা ও লড়াই। ডাচরা ছিল মূলত সামরিক জাতি। পর্তুগিজদের মতো উদার ও সংস্কৃতিপ্রাণ মন ছিল না তাদের। এর ফলে আবহাওয়া পালটে যায় শান্তিপূর্ণ কোচিনের। এছাড়াও বেশিরভাগ ডাচরা ছিল অ্যান্টি-ক্যাথলিক। শহরের এই অস্থির রাজনৈতিক পরিবেশ থেকে সরে এসে অনাবিষ্কৃত হিন্টারল্যান্ডে থাকতে শুরু করে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা। শুরু করে মশলার চাষ।

ছোট শহরের অ্যাংলো-লিভিংয়ের ইতিহাসে বরাবরই আমরা দেখেছি, এই মিশ্র জাতি অনেকক্ষেত্রেই নিজস্ব সংস্কৃতি তৈরি করেছিল মূল শহর থেকে দূরে- নিরিবিলি গ্রাম্য পরিবেশে। এদের সঙ্গে আসেন কিছু মিশনারিরাও। তৈরি হয় অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান চার্চ এবং স্কুল। অ্যাংলোরা ছড়িয়ে পড়েছিল অনেক জায়গাতেই। উত্তর কোচিন থেকে ৫০ কিমি দূরে কাড়ুকুঁতিতে ছিল প্রচুর অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। এখানে তৈরি হয় ‘সেন্ট পল’স মিশন’, যেখানে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতে থাকে জেস্যুইটসদের। আবার গ্রাম্য পরিবেশে তৈরি হয় ‘অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান কালচারাল মিউজিয়াম’। অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা শুরু করে তুলো এবং বাদামের চাষও। শহরের মানুষদের অর্থনৈতিক এবং শ্রমের চাহিদা মেটাতে প্রয়োজনীয় ছিল এই হিন্টারল্যান্ড। হিন্টারল্যান্ডের সম্পদ বেড়ে যাওয়ায় ডাচরা অবশেষে ক্যাথলিক চার্চ নির্মাণেরও সম্মতি দেয়। তৈরি হয় আজকের ‘আওয়ার লেডি অব হোপ’ চার্চ, যা গুরুত্বপূর্ণ ছিল ‘মেস্টিকো’দের পুনরুত্থানের জন্য।

আরও পড়ুন- ব্রিটিশদের ‘বর্জ্য’! খড়গপুর রেল কলোনিতে মুছে গেছে অ্যাংলো জীবনের ঘ্রাণ

জিউ'স লেন

ব্রিটিশ সময়পর্ব

ডাচদের কোচিনে থাকার সময় থেকেই ভারতবর্ষে শুরু হয় আরেক ঔপনিবেশিক শক্তির মনোপলি— ‘দ্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’। অন্যান্য ইউরোপিয় জাতিদের থেকে যারা ছিল নৌ-শক্তিতে সবচেয়ে বেশি পটু। সমর্থন ছিল মুঘল রাজাদের। প্রথমেই ব্রিটিশদের নজরে আসে করমণ্ডল উপকূল। কোচিনে পর্তুগিজ ও বম্বেতে ডাচ শক্তিকে হারিয়ে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে শুরু করে তারা। আদায় করে বাণিজ্যিক মশলায় সমৃদ্ধ মালাবারের রাজাদের সমর্থন। ১৭৯৫ সালে কোচিন দখল করে ব্রিটিশরা। ১৮১৪ সালে ‘অ্যাংলো-ডাচ ট্রিটি’ স্বাক্ষরিত হওয়ার পর কোচিন পুরোপুরি ব্রিটিশদের হাতে চলে যায়। আঠারোশো শতকের মধ্যভাগ থেকে কোচিন ও ত্রিভাঙ্কোরে দ্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক মোনোপলি চলতে থাকে।

ঔপনিবেশিক সামরিক শক্তি নিজস্ব প্রয়োজনে কখনও সাজিয়ে দেয় শহর, নির্মাণ করে বসতি। এক জাতির হাত থেকে অন্য জাতি ক্ষমতা কেড়ে নিলে পাল্টে যায় শহরের নিয়ম-নীতি। মিশ্র জাতি বরাবরই তার ‘হাফ-অ্যান্ড-হাফ’ অবস্থা নিয়ে অ্যাডাপ্ট করতে থাকে। খুঁজে বেড়ায় তার নিজের হোম-দেশ-লিনিয়েজ। উপকথার বুনন তৈরি হয় লস্ট হেরিটেজকে ঘিরে। এরই মাঝে সে গেয়ে চলে গান, বিকেলে বেকারি পাড়ায় ছড়িয়ে পড়ে উষ্ণ-নরম গন্ধ। নস্টালজিয়ার চাদর বিছিয়ে আজও কোচিনের রেস্তরাঁ সাজিয়ে তোলে ইন্দো-ইউরোপিয় খাবার। এই দোলাচলেই স্বাধীন ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বেঁচে থাকে নানা ভাষা-নানা পরিধানের অ্যাংলো সংস্কৃতি।

More Articles