অ্যানিমেল : বন্দুক ও পুরুষাঙ্গের জান্তব আস্ফালন
Animal Movie : রণবিজয়ের ক্রোধ অ্যাংরি ইয়ং ম্যান অর্থাৎ বচ্চন পার্সোনার উত্তরসূরি নয়। বচ্চন পার্সোনার রাগের উৎস ছিল সামাজিক, অনেকক্ষেত্রে ওয়ার্কিং ক্লাস পরিসরে।
অ্যানিমেল কাহারে বলে?
যে সমস্ত মেলপ্রাণীদের রগে ও ধমনীতে রক্তের মধ্যে ফ্যাদা জমাট বাঁধিয়া একধরনের আত্মিক ও নৈতিক অ্যানিমিয়া সংক্রামিত হয়, তাহাদিগকে বলে অ্যানিমেল।
এর দৃষ্টান্তস্বরূপ সন্দীপ ভঙ্গ রেড্ডির সদ্যমুক্তিপ্রাপ্ত হিন্দি ছবিটির পোস্টার বা ট্রেলার দেখতে পারেন। দেখবেন, সেখানে রণবীর কাপুর ও ববি দেওলের মুখ ও শরীর থকথকে রক্তে ভেজা। আসলে ওগুলি রক্ত হতে চাইছে না, ওগুলো হতে চাইছে সিমেন-মিশ্রিত রক্ত। এই মেলপ্রাণীগুলি এতই যাকে বলে virile, যে এদের কোপালে ফিনকি দিয়ে রক্তবীর্য বেরিয়ে আসবে! রক্তে সিমেন জমলে এদের হ্যালুসিনেটরি হাই হয়, আর সেই প্রস্রবনে এরা নিজেরাই ভারি পুলকিত হয়। কিন্তু মেলপ্রাণীদের এই অসুখের প্রমাণটি যাতে অতিপ্রকট না হয়ে যায় তাই আপাতত সেই ফ্যান্টাসি স্থগিত, ইমেজে শুধু রক্তই সই। ছবিতে প্রচণ্ড অ্যাকশন! রীতিমত ধান্তব (ধাতু + জান্তব) তাণ্ডব!
'অ্যানিমেল' একধরনের পোস্ট-মিলেনিয়াল ভারতীয় পৌরুষের ফ্যান্টাসি। 'অ্যানিমেল' ঢাকঢোল পিটিয়ে বলেছে যে সে 'অ্যাডাল্ট' ছবি। কিন্তু আমার মনে হয় ছবিটিকে A-র বদলে M সার্টিফিকেট দেওয়া উচিত ছিল। M অর্থাৎ মেন, আর কারও জন্য ছবিটি নয়। মুশকিল হল M আবার mature-ও বোঝাতে পারে। 'অ্যানিমেল' পরিণতমনস্ক, প্রাপ্তমনস্ক পুরুষদের ছবি নয় মোটেও। 'অ্যানিমেল'-এর ভক্তদের প্রাপ্তমনস্কতা থাকতে পারে না, সেটার প্রমাণ যে তাদের ছবিটি দেখার পর উল্লাসে শিক্ষাজাত চেতনা নেই, নির্বোধ গামবাটপনা থিকথিক করছে এবং ম্যাচিওর সিনেমাবোধ তলানিতে ঠেকেছে!
সন্দীপ ভঙ্গ রেড্ডি এর আগে 'কবীর-অর্জুন' নামে একটা ছবি বানিয়েছিলেন, তারপর সেটাকে দুটো ছবি বলে রিলিজ করেছিলেন। ভঙ্গবাবু এরকম করে থাকেন। যেমন ওঁর 'অ্যানিমেল' ছবিটিও আসলে দু’টি ছবি। তা বলে দুটো আলাদা ছবি নয়। একই ছবি দু’বার তোলা। এইবার তিনি দুটো ছবিকে যুক্ত করে ফার্স্ট হাফ আর সেকেন্ড হাফ বলে চালিয়ে দিয়েছেন। ভঙ্গবাবু এরকম করে থাকেন। আবার ভালো করে দেখলে বুঝবেন, 'অ্যানিমেল' আসলে ওঁর আগের ছবিটিরই পুনরাবৃত্তি, শুধু ভালো করে রক্তবীর্য লেপে দেওয়া হয়েছে। ধরে নেওয়াই যায় যে ভঙ্গবাবু আজীবন ধরে একটা ছবিই করে যাবেন, এভাবে আপন ধনের মাধুরী মিশায়ে। 'অ্যানিমেল' একাধিক অর্থে ধনতান্ত্রিক ছবি।
'অ্যানিমেল' বিশাল হিট করেছে। এই বছর শাহরুখ খানের পাশে হিন্দু নামের একটি অভিনেতার এমন উত্থান দেখে অনেকে আপ্লুত, তাদের আমি ছোট করে ‘ভঙ্গভক্ত' নাম দিলাম। এর আগে তারা সানি দেওলের ‘গদর ২'-এ পাকিস্তান-ক্যালানো দেখে এরকম আপ্লুত হয়েছিল। কিন্তু একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখবেন, গুগলে সার্চ করুন 'অ্যানিমেল ২০২৩ রিভিউ', তাহলে যে ক’টা লেখা পাবেন সেগুলিতে দেখবেন সমালোচকেরা অত্যন্ত রুষ্ট ছবি দেখে। ক্রিটিকদের জীবিকা ছবি দেখা। তারা জানেন তাদের দেখা অধিকাংশ ছবিই নিম্ন ও মধ্যমানের হবে, তাতে তারা এতটা রুষ্ট হয়ে যান না। কিন্তু 'অ্যানিমেল' দেখে তারা রুষ্ট হয়েছেন। এইবার বিবিধ ইউটিউব রিভিউ বা ওয়েব রিভিউয়ে কমেন্ট সেকশনে দেখুন, ভঙ্গভক্তরা বিবিধ প্রাঞ্জল ভাষায় লিখেছেন, এই ছবি আসলে ক্রিটিকদের রুষ্ট করার জন্যই নির্মিত। এটি অতি চমকপ্রদ ব্যাপার! আরেকটা মজা হয়েছে। বাংলা ভাষায় আপাতত যত রিভিউ বেরিয়েছে তাতে দেড়খানা লেখা ছাড়া কোথাও সমালোচকদের এই সর্বসম্মত রোষের চিহ্ন নেই। সেটাও লক্ষণীয় ব্যাপার বটে। তাই এই ছবি নিয়ে দুটো কথা বলা যাক।
আমি 'অ্যানিমেল'-এর সারাংশ দেব না, তা অতি সহজেই লভ্য বলে। 'অ্যানিমেল' ফ্যাসিস্ট ছবি, অতএব এই ভারতবর্ষে সময়োপযোগী।
'অ্যানিমেল' ফ্যাসিস্ট ছবি কীভাবে?
হিটলার বা হিটলারের মতো উচ্চনাটুকে ফ্যাসিস্টরা যখন বক্তৃতা করে, যারা শোনে তাদের অনেকেই শোনে কারণ তারা মনে করে জননেতা ঠিক কথা বলছেন। কিন্তু একটা বিরাট সংখ্যার মানুষ থাকেন যারা এটা বোঝেন যে, লোকটা যা যা বলছে তা শুধু ভুলই নয়, অশুভ, ক্ষতিকর, কিন্তু তাও তারা মুগ্ধ, সম্মোহিত হয়ে যায়। মুগ্ধতার এই কাঠামোটা 'অ্যানিমেল'-এর টিজার ট্রেলার এবং গত ১ তারিখে ছবিটির মুক্তিপ্রাপ্তির পর চতুর্দিকে বিদ্যমান। ছবিটি দেখতে হবে না, ট্রেলারগুলির বেশিরভাগ শটেই দেখবেন রণবীর কাপুর রক্ত-টক্ত মেখে সোজা ক্যামেরার দিকে, অথবা দর্শকের দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি যে অত্যন্ত জোরালো অভিনয় করেছেন তা কয়েকটি শটেই প্রতিভাত, কিন্তু তিনি সোজা দর্শকের দিকে তাকিয়ে আছেন। অর্থাৎ তার এই উচ্চনাটুকেপনা ফ্যাসিস্ট নেতাদের মতোই মুগ্ধ সমর্পণ দাবি করে। ট্রেলারে একখানি দৃশ্যে তো ফ্যাসিস্ট ফর্ম সচেতনভাবে নেওয়া হয়েছে, স্বস্তিকা-টস্তিকা সহ, এই নিয়ে হিঁদুরা নানান কূটতর্কও শুরু করে দিয়েছেন। ছবিটি অতএব কাঠামোগতভাবে, 'ফর্ম'-এ ফ্যাসিস্ট। এবং 'কনটেন্ট'-এ আদ্যন্ত তামসিক, অশুভ, ক্ষতিকর। অথচ এই মুগ্ধতার মহামারী বলছে যে সবার চোখে ঝিলমিল লেগে গেছে। ব্রেনেও। সবাই ভঙ্গবাবুর daring-এ চমৎকৃত!
'অ্যানিমেল' অধুনা ভারতবর্ষের টক্সিক পৌরুষের ডিসকোর্সের একটা প্রোপাগান্ডা ছবি। অর্থাৎ গত এক দশক ধরে দেশে যে বিবিধ প্রতিরোধের রাজনৈতিক স্বর, তার মধ্যে নারীবাদী এবং ভিন্ন যৌনস্বভাববাদী ও দলিত কণ্ঠ যে মূলধারার সংস্কৃতিতে তার জায়গা করে নিচ্ছে, তার বিরোধিতা করা 'অ্যানিমেল'-এর উদ্দেশ্য। যাকে কেউ কেউ woke culture বা political correctness-এর সংস্কৃতি বলেন, তার বিবিধ অগভীরতা এবং বাড়াবাড়ি সত্ত্বেও (র্যাডিকাল কালচারের মূলধারায় আত্তীকরণ হয়ে 'লিবারাল' আকার ধারণ করলে যেমন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে) - সেই সংস্কৃতির ভায়োলেন্ট বিরোধিতার জন্যই এই ছবিটা বানানো হয়েছে। অতএব ছবিটি সংজ্ঞার্থে প্রতিক্রিয়াশীল - উক্ত রাজনৈতিক কণ্ঠস্বরগুলি সমাজে যে পরিবর্তন চায় তা আক্রোশে ধূলিস্যাৎ করে রক্ষণশীল পৌরুষের জয়ধ্বজার উত্থান করাই এই ছবির প্রাথমিক লক্ষ্য।
সেটা বোঝার জন্য এই ছবি দেখার প্রয়োজন নেই। ছবিটা আদতে একটি মেন্টালিটি বৈ কিছুই নয়। আপনার চারপাশে এরকম মানসিকতার অনেক পুরুষমানুষ দেখতে পাবেন। পশ্চিমবঙ্গে সেইসব পুরুষদের অনেকে কবিতা লেখেন, ছবি বানান, নাটক করেন বা করান; তাই এই মানসিকতাটা আপনাদের অচেনা নয়। এইটা এই জন্যই বলে রাখা প্রয়োজন যে, অনেকের মনে হতে পারে যে ছবির এই ফ্যাসিস্ট পৌরুষের ধরনটি আদতে উত্তরভারতীয় উচ্চবর্ণ হিন্দু বা শিখ পৌরুষের ধরন। এইটা ভাবলে বড় ভুল হয়ে যাবে, এই ফ্যাসিস্ট পৌরুষ সর্বত্র, ব্যাপ্ত; এর কোনও এথনিক-সাংস্কৃতিক উৎস নেই।
এই মেন্টালিটিতে কিছু মজার মাত্রা আছে। এই মেলপ্রাণীরা মূলত একটু 'আহত' ধরনের হয়, পাঁজরায় পোষা কষ্ট থাকে। 'অ্যানিমেল'-এ সেটা সোজাসাপ্টা, এই জন্তুটির বাবা নাকি তাকে যথেষ্ট ভালোবাসে না, সে সবসময়েই বাবার কাছে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে চায় এবং সেই প্রমাণের অছিলাতেই ছবিতে রক্তপাত, বীর্যপাত এবং অন্যান্য; এবং ভঙ্গভক্তরা "ভাই! কী করেছে! কী দিয়েছে!" ইত্যাদি শীৎকার শুরু করেছেন সিনেমাহল ও সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে। এইবার ছবিটা দেখলে আপনার অন্য একটা প্রশ্ন মনে আসা উচিত, বুঝলাম বাপে ভালোবাসে না যথেষ্ট, তাতে সিরিয়ালি মেয়েদের অপমান করার প্রয়োজন কী? বুঝবেন, সেটাই আসল উদ্দেশ্য; বাপ নিয়ে ছেঁদো কান্নাটা অছিলা। আসল প্রসঙ্গটা হলো, পৌরুষের প্রতাপকে ভায়োলেন্টলি প্রতিষ্ঠিত করা এবং নারীর আধুনিকতাকে গুঁড়িয়ে দেওয়া, সেটাই এই ছবির পুত্রসন্তানের পিতার পায়ে প্রধান প্রণাম - পিতৃতন্ত্র জিন্দাবাদ!
বাংলার টক্সিকরা আহত হয়ে অস্তিত্বের ধোঁয়াটে শত্রুদের ক্যালানোর ও ক্যালানি খাওয়ার কবিতা লেখেন, ক্যালানোর গান বাঁধেন, ক্যালানোর নাট্য করেন, তারপর বাস্তব পার্টনারকে হ্যারাস করেন। 'অ্যানিমেল'-এর নায়ক আহত হয়ে লোকেদের উদমা ক্যালায়, আরও ক্যালায়, চূড়ান্ত ক্যালায়, পার্টনারকে হ্যারাস করে। তফাতটা কোয়ালিটেটিভ নয়, কোয়ান্টিটেটিভ। আসল কাজটা হল উদোম ক্যালানোর আর ক্যালানি খাওয়ার হোমোএরোটিক 'ফাইট ক্লাব'-টি, এবং তারপর পার্টনারকে যৌনহেনস্থা করা। অতএব, রণবীর কাপুর যখন ইসলামি নামধারী ববি দেওল এবং অন্যান্যদের ক্যালাচ্ছে, তারা কিন্তু আসল শত্রু নয়, তারা তো আদতে ফাইট ক্লাবের বন্ধুলোগ! আসল শত্রুরা হলো ট্রেলারে যার গলা টিপে দেওয়া হয়, choke the woke, মহিলারা।
'মাসি' ছবির টক্সিক নন্দনতত্ত্ব
'অ্যানিমেল' অবধারিত ছিল। গত কিছু বছর ধরে মূলধারার ছবিতে একখানি ইয়ার্ডস্টিক উত্থিত হয়েছে - massy ছবির - এই ছবি না করতে পারলে নাকি ইন্ডাস্ট্রি বাঁচবে না। শব্দটার বাংলা প্রতিশব্দ তৈরি করতে পারবেন না। 'আর আর আর', 'পুষ্পা', 'কান্তারা' ইত্যাদি হল মাসি ছবি; যেরকমটা বাংলা বাজারে কিছুটা করার চেষ্টা করেন জিৎ। এই ছবির ধরনই এখন সমস্ত আঞ্চলিক ছবির কাছে বিপজ্জনকভাবে 'প্যান-ইন্ডিয়ান' (আরেকটা নতুন শব্দ!) ছবির একমাত্র মাত্রা হয়ে দাঁড়িয়েছে। 'বিপজ্জনক' কারণ বাংলা ছবি কখনই এই মাত্রা স্পর্শ করে উঠতে পারবে না, অথচ খুড়োর কলের মতো মুলোর পেছনে দৌড়ে মরবে। পারবে না কারণ এই ছবি অত্যন্ত পুঁজিনির্ভর, যে পুঁজি বাংলা ছবির মতো আঞ্চলিক ইন্ডাস্ট্রির নেই, এবং এই ছবি মূলত আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য থেকে ইমেজকে উপড়ে একরকম জাতীয় বায়বীয়তার উর্ধ্বে তুলতে চাইছে; যেখানে সব একইরকম। আপাতত ভারতীয় সংস্কৃতি হচ্ছে একজন আলফা মেলের গল্প, ক্যালাবেন যিনি ক্যালাবেন।
আমি নিজে অ্যাকশন ছবি ভালোবাসি। কিন্তু অ্যাকশন ছবিতে সিনেমার সমস্ত প্রকরণের যে উদযাপন ঘটে, নাটকের যে উদযাপন ঘটতে পারে সংঘাত, বিপন্নতা এবং সারভাইভালের খেলায় - মাসি ছবির এই অ্যাকশন-দৃশ্যে সেই জিনিস প্রায় পাওয়াই যায় না। এই ছবির অ্যাকশন-দৃশ্য সিজিআই ও অন্যান্য দৃশ্যশ্রাব্য চটকে আকীর্ণ থাকে, সংঘাতের বাস্তববাদ ত্যাজ্য হয়ে যায়, এতই অবাস্তব হয়ে যায় দৃশ্যগুলি যে নায়কের বিপন্নতার কোনও বোধ তৈরি হয় না, শরীর যেভাবে ফাংশন করে তাতে বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে না (নায়ক ঝটকা দিলেন, কুড়িটা লোক স্লোমোতে ছিটকে গেল), থাকে না বিপন্নতার বোধ, অতএব নায়ককে জিততে দেখতে চাওয়ার কোনও উৎকণ্ঠা তৈরি হয় না। সেখানে শুধু নায়কের সিরিয়ালি এফেক্টস-নির্ভর জিত জিত জিত, একইরকম, আখেরে বেশ বোরিং!
কিছু ক্ষেত্রে, এই ছবিতে অ্যাকশনও থাকে না! কারণ অ্যাকশন আর ব্রুটালিটির কৃত্রিম অনুকরণ এক নয়। ভায়োলেন্স অ্যাকশনের উপকরণ, অ্যাকশনের উপজীব্য নয়। এই ছবিগুলিতে মূলত কৃত্রিম মাথা ফাটানো, কৃত্রিম রক্তপাত, কৃত্রিম অঙ্গহানি, এইসব কৃত্রিমতার এমন বাহুল্য, যে তাতে প্রথম যে জিনিসটার বলি ঘটে তা হল মানবিক নাটকের। অমিতাভ বচ্চন কোনওদিনই ভালো অ্যাকশন করতে পারতেন না (টাইগার শ্রফের মতো), কিন্তু একটা ফাইট সিনের আগে ও পরে তাঁর যে অভিনয়, সেটাই দর্শকের আবেগকে এমন করে তৈরি করে দিত যে ফাইটের অ্যাথলেটিক প্রদর্শনটি না ঘটলেও চলত। অথবা যাদের সেই অ্যাথলেটিক ক্ষমতা আছে, হয়তো অভিনয় তেমন ভালো নয়, যেমন টম ক্রুজ বা কিনু রিভস, তাদের দেখার আনন্দটাই হলো সেই অ্যাথলেটিসিজম দেখা। কিন্তু মাসি ছবির অ্যাকশন দৃশ্যে সেই সমস্ত স্টান্টও যে আসলে সিজিআই, এই সন্দেহের বোধটাই অন্তত আমার আনন্দে ব্যাঘাত ঘটায়।
অ্যাকশন দৃশ্যে নায়ক যত ভালনারেবল হয়, বিপন্ন হয়, তত নাটকীয় অভিঘাত বাড়ে। মাসি ছবির নায়করা সে অর্থে এমন swag-সর্বস্ব অতিনায়ক যে এই বিপন্নতা তৈরি হয় না, তৈরি হয় না কোনও এম্প্যাথি, কারণ টানাপোড়েন আর চরিত্র তৈরি হয় না। এখানে আইডেন্টিফিকেশন একমাত্র ক্ষত্রিয় প্রতাপের সঙ্গে এবং এইখানেই এই নায়কদের কপাল ফাটালে যে রক্তমিশ্রিত বীর্যের ফিনকি বের হওয়ার সম্ভাবনা, সেভাবেই ফেটে বেরোয় ইডিওলজি। কোন মতাদর্শ? টক্সিক পৌরুষের মতাদর্শ। এবং এটা খুব আশ্চর্যের নয় যে, এই মাসি নায়কের ধারণা থেকেই রোহিত শেট্টি মার্কা cop universe-এর ধারণা তৈরি হয় - যার মাধ্যমে প্রতিভাত হয় সংশ্লিষ্ট নির্মাতা আর দর্শকদের police state-এর আকাঙ্খা, মিলিটারি রাষ্ট্রের আকাঙ্খা। দেশের বহিরাগত এবং রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিরোধীদের রাষ্ট্রীয় গুন্ডাদের দ্বারা কেলিয়ে পাট করে দেওয়ার বাসনাই হলো 'কপ ইউনিভার্স'-এর বাসনা।
এই ছবি একধরনের এস্থেটিক্স-নির্ভর। এই ছবির নন্দনতত্ত্বে exhibitionism প্রচণ্ড প্রকট। প্রতিটা ফ্রেমই দর্শকদের কাছে ডিসপ্লে। তাই এই ধরনের ছবির দৃশ্যের অন্যতম উপকরণ হলো, মাসি নায়ক কেত মেরে ঘন ঘন ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে থাকবে। তাকিয়ে থাকবে কোটি টাকার সেট আর এফেক্টস, বলবে আমায় দেখো, আমিই স্পেকট্যাকল! সেই স্পেকট্যাকলের সিংহভাগ হলো পুঁজির ডিসপ্লে। অতএব এইসব ছবিতে অত্যাধুনিক, এমনকী কাল্পনিক গ্যাজেট ও আগ্নেয়াস্ত্র ডিসপ্লে করা হয়। 'অ্যানিমেল'-এ যা একখানি রিডিকিউলাস স্তরে উন্নীত হয়েছে; 'অ্যানিমেল'-এ একটি অসম্ভব আগ্নেয়াস্ত্র (আসলে যা নায়কের উত্থিত পুরুষাঙ্গের মেটাফর ছাড়া আর কিছুই না, সব ছবিতেই তাই) এভাবে ডিসপ্লে করা হয় 'আত্মনির্ভর ভারত'-এর গর্ব হিসেবে। এইবার নায়ক যখন বন্দুক খাড়া করে ইজাকুলেট, থুড়ি, গুলি করেন তখন তাতে দক্ষিণপন্থার বীর্য আর কর্পোরেট প্রযুক্তিবাদের ধাতুর মেলবন্ধন ঘটে, আর সেই ছেটানো বীর্যে সিক্ত হয়ে ভঙ্গভক্তেরা তখন হলে উল্লাস করেন - "ভাই! কী দিচ্ছে!" এই state-of-the-art যন্ত্র আর বড়লোকদের জিম করা পেশির মেলবন্ধন হলো আরেক বাসনার মেটাফর - কর্পোরেট মিলিটারির।
মাসি ছবি আর বিগত মসালা ছবি এক নয়। মসালা ছবি একরকম মেলোড্রামার উপর নির্ভরশীল ছিল। সেখানে চরিত্র, গল্প, নাট্য প্যাথোস জরুরি ছিল। কিন্তু মাসি ছবি মূলত WWF জাতীয় শো, সেখানে একজন ভীম টাইপের পুরুষ আসবেন, দাড়ি-গোঁফ-পেশি-ক্ষত-ট্যাটু, ধুলো-কালি-রক্ত মাখা চামড়া, পোশাক, পাঞ্চলাইন যার পৌরুষের প্রতীক এবং তিনি একের পর এক সেট পিস দিয়ে যাবেন তাদের ফ্যানদের উদ্দেশ্যে। মসালা ছবির প্রধান দর্শক ছিলেন নিম্নবিত্ত শ্রমজীবি মানুষ, তাদের সংগ্রাম, আবেগ, আশা, আশঙ্কা, আকাঙ্খা প্রতিভাত হতো ছবির ফ্যান্টাসিতে। একবার মাসি ছবির ফ্যানপেজগুলো দেখুন, দেখে চমকে যাবেন - সেখানে পোস্টের পর পোস্ট জুড়ে খালি ৩০০ কোটি, ৬০০ কোটি, রেকর্ড অ্যাডভান্স বুকিং, এত দিনের আয়ের হিসেব, অত ফুটফল জাতীয় এমন সব পরিসংখ্যানের আস্ফালন, যেগুলি মিঠুন-বচ্চনের ফ্যানডমে ছিল না। আপনার মনে হবে আপনি শেয়ার মার্কেটের উত্থান-পতন দেখছেন। মাসি ছবির দর্শক হলো সেই জাতীয় কনজিউমার বুর্জোয়া টাইপেরই; যাদের কাজ হলো সংখ্যার উত্থান-পতন দেখা এবং চিৎকার করে ঘোষণা করতে থাকা, শেয়ার বাজারের দালালদের মতোই। এই ছবির সঙ্গে জনগণ, নিম্নবিত্ত, শ্রমজীবি মানুষদের আশা-আকাঙ্খা-বাসনার কোনও সম্পর্ক নেই। এই ছবির দর্শক হলো এই কর্পোরেট পুঁজিবাদের মাইক্রো-অংশীদার, শেয়ারহোল্ডার, স্টেকহোল্ডারদের মতোই। তাদের behaviour pattern-ও সেরকম। ৩০০ কোটির ছবি যে সাধারণ মানুষদের ছবি, এইরকম স্টুপিড মিথ্যাচারণ তারা নিয়মিত করে থাকেন, ঠিক যেভাবে আইটি সেল মিথ্যে তৈরি করে; কারণ তখন ভুলতে ও ভোলাতে হয় ওই বাজেটে ও প্রফিটে ক’টা প্রাইমারি স্কুল, ক’টা হেলথ সেন্টার, কতটা পানীয় জলের ব্যবস্থা করা যেতে পারে দেশজুড়ে। সারা ভারতের মূলধারা যে মাসি ছবির দিকে প্রাণপণে এগোতে চাইছে, সেই ছবির ফর্মে নিহিত আছে কর্পোরেট যুগে টক্সিক পৌরুষের ফ্যাসিস্ট সম্ভাবনা।
‘অ্যানিমেল'-এর বড়লোকি ক্রোধ
আবার 'অ্যানিমেল' এই massy ছবি থেকে ভিন্নও। মাসি ছবির নায়ক মূলত কমিউনিটির অভিভাবকসম হয়। সন্দীপ ভঙ্গ রেড্ডি, আমার আদরের ভাষায় ভঙ্গবাবু, যে চালাকিটি করেছেন সেটা হলো, মাসি ছবি মূলত যে একটি কমিউনিটি বা অঞ্চল বা দেশের প্রেক্ষাপটে নাটককে বিস্তারিত করে, তিনি সেই প্রেক্ষাপটকে ছোট করে দিয়েছেন। তার প্রেক্ষাপট হলো একটি কর্পোরেট-ফিউডাল হিন্দু পিতৃতান্ত্রিক পরিবার এবং সেই পরিবারের লো আইকিউ পুরুষবালকের ভূমিকা। 'অ্যানিমেল' অতএব massy ছবির একরকম অবধারিত এক্সটেনশন। এই ছবির নন্দনতত্ত্বেই যে নিহিত ফ্যাসিস্ট পৌরুষ ছিল, তিনি ছবিটিতে তা প্রকট, self-conscious করে তুলেছেন।
'অ্যানিমেল'-এর নায়ক রণবিজয় সাইকোপ্যাথ এবং ছবিটি ও ছবির নির্মাতা-দর্শক সেটি সেলিব্রেট করে। পুত্রের ভবিষ্যৎ সাইকোপ্যাথোলজিতেই; কারণ তার দ্বারা আর কিছু হবে না। অতএব, ব্যাপারটা দাঁড়ায় এরকম, আপনার পরিবারের কোনও সন্তান বা ভাই যদি টক্সিক পৌরুষ এবং মানসিক অসুস্থতার যুগপৎ রোগী হয়ে যায়, যে আপনাকে প্রতিনিয়ত বিপদে ফেলবে, ব্যতিব্যস্ত করবে, অথচ যাকে ফেলে দেওয়া যাবে না - রণবিজয়ের উপস্থিতিটা চার-দেওয়ালের বধ্যতায় খানিকটা সেরকমই সাফোকেটিং। যথারীতি, তার নিউরোসিসের প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠে পরিবারের সবচাইতে কোণঠাসা মানুষটি, তাঁর স্ত্রী। এই মাত্রাটি ছাড়া পিতৃভক্ত বালকের প্রতিশোধের গল্পটি ভালোই চলতে পারত, ছবির ৩ ঘণ্টা ২০ মিনিট দৈর্ঘ্য হতো না; কিন্তু উদ্দেশ্য তো মুখ্যত এটাই - রণবীরের গীতাঞ্জলিকে প্রতিনিয়ত হ্যারাস করা দেখানো। তাঁকে বিয়ের মঞ্চ থেকে তুলে নেওয়া্, বলা যে তাঁর নিতম্বের গঠন দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে একাধিক সন্তানের ভার বহন করতে পারবে, পরিচারিকার সামনে উর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত করতে বলা, প্যাড পালটানো নিয়ে খোঁটা দেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি যা অন্যান্য সরলতর মাসি ছবিতে আপনি প্রত্যাশা করবেন না, ভঙ্গবাবু সেই সাবটেক্সট প্রকট করেন। নায়কের মতে - বিবাহে "এক ডর, এক পকড়", অর্থাৎ নারীর আতঙ্ক এবং পুরুষের নিয়ন্ত্রণ থাকা জরুরি। হেলায় অন্য মহিলার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা (সেই মহিলাকে প্রেমের প্রমাণ দিতে তার জুতো চাটতে বলা) এবং একাধিকবার 'বাবা-নিয়ে-কথা-বলবি-না-মাগি' জাতীয় আঙুল তুলে স্ত্রীকে শাসানো ইত্যাদি আন্ডারলাইন করে মূল লড়াইয়ের ক্ষেত্র কল্পিত মুখোশপরা কমিকস্ট্রিপ গ্যাংস্টারদের টার্ফ নয়, বাস্তবের নারী-পুরুষ সম্পর্ক।
রণবিজয়ের ক্রোধ অ্যাংরি ইয়ং ম্যান অর্থাৎ বচ্চন পার্সোনার উত্তরসূরি নয়। বচ্চন পার্সোনার রাগের উৎস ছিল সামাজিক, অনেকক্ষেত্রে ওয়ার্কিং ক্লাস পরিসরে। রণবিজয় যাকে বলে উচ্চবিত্ত 'entitled brat', তার পিতা স্বস্তিক আইরন অ্যান্ড স্টিল নামক একটি কিছুর কর্ণধার (যাদের লোগোও স্বস্তিকার মতো দেখতে)। এই হয় ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট নয় গ্যাংস্টার (আখেরে তো দুটোই এক!) জাতীয় পরিবারের সাইকোপ্যাথ সন্তানের কাছে অর্থ, ভবিষ্যৎ, প্রতিপত্তি কোনওটাই বিপন্ন নয়, শুধুই পুরুষকার বিপন্ন। পুঁজি ও অর্থ ও প্রতিপত্তি এবং অবশ্যই উচ্চজাত হিন্দুবর্ণ তার রগে ধমনীতে (ওই রক্তমিশ্রিত বীর্যের সঙ্গেই) বিষ হয়ে জমে থাকে। এই প্রিভিলেজ এবং এনটাইটেলমেন্টই তার স্বভাবের বিষের উৎস। এতে রাজার মেজাজ আছে, বঞ্চনা থেকে আহরিত কোনও সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক রাগ নেই।
অতএব এই যে গত কয়েকদিন ধরে ভঙ্গভক্তরা রণবীরের দারুণ অভিনয় দেখে বাহবা বাহবা করছেন - এর ধরন আন্ডারডগ বচ্চন বা মিঠুনের ফ্যানডমের মতো নয় - একদম উলটো। ফ্যাসিস্ট নায়কের সঙ্গে ফ্যাসিস্ট ভক্তদের আইডেন্টিফিকেশন যেমন হয়, তেমনই।
আগেই বলেছি, রণবিজয়রা মূলত একটু 'আহত' ধরনের হয়, পাঁজরায় পোষা কষ্ট থাকে। এবং তাদের একধরনের মানসিক ডিলিউশন থাকে যে তারা কোণঠাসা, তারা একলা। এরা এতটাই মানসিক ইনসিকিউরিটিতে ভোগে যে সংখ্যাগুরুর মতাদর্শের সঙ্গে আইডেন্টিফাই না করলে এদের নিরাপত্তা ফেরে না। রণবিজয় যেরকম তার বাবার কাছে প্রমাণ করতে চায় যে সে যোগ্য, সেভাবেই এই দেশের হিন্দু যুবকেরা মোদির কাছে প্রমাণ দিতে চায় যে তারা যোগ্য সন্তান। এই বোধ থেকে জাত নিউরোসিসের লক্ষ্য হয় মূলত সংখ্যালঘুরা এবং মহিলারা। তাতে মনের আগুনে ঘি দেয় র্যাডিকাল এবং লিবারাল ডিসকোর্স, এদের মনে হয় যে মেয়েরা (এবং বিবিধ সংখ্যালঘুরা) বিশেষ পাত্তা পাচ্ছে সমাজে যা তাদের আরো কোণঠাসা করে দিচ্ছে। এটা ডিলিউশন তো বটেই কারণ এই 'নিম্নতর'-রা যে মূলধারার সংস্কৃতিতে 'পাত্তা' পাচ্ছে সেটা কয়েক দশক হলো মাত্র, টক্সিক পৌরুষের প্রাধান্য কয়েক হাজার বছরের। অতএব এদের মূল উৎকণ্ঠা হলো এই যে, আগের প্রজন্মের টক্সিক পৌরুষের যে প্রতিপত্তি, তা বোধহয় এদের জীবদ্দশায় আর থাকবে না। এই জন্যই এই ক্রোধ প্রতিক্রিয়াশীল, তারা পূর্বের স্থিতাবস্থা ফেরত চায়। কীসের স্থিতাবস্থা? যখন যারা তেমন পুরুষ নয় তারা গলা তুলে কথা বলত না। টক্সিক পৌরুষের স্থিতাবস্থা যে এই নতুন গজিয়ে ওঠা ভিন্ন মত সত্ত্বেও এখনও বহাল তবিয়তে আছে এদের আহত একাকীত্মের ডিলিউশন সেটা বুঝতে দেয় না, কল্পিত বিপন্নতা তৈরি করে। সোশ্যাল মিডিয়ার অগভীর ফেমিনিজম-চর্চা দেখে এরা তাবৎ ফেমিনিজমকে গাল দেয় (যে যুক্তিতে আমাদের শহুরে ব্যর্থ মার্ক্সিস্টদের অগভীরতা দেখে মার্ক্সকেই ফেলে দেওয়ার কথা!)। দলিত আর মুসলমানদের নিয়ে এদের ডিলিউশনগুলো কীরকম হয় তার পুনরাবৃত্তি করে নিজেকে তিক্ত করতে চাইছি না।
এতটুকু বলে রাখি, এইসব পুরুষদের সমস্ত উৎকণ্ঠা যৌন-উৎকণ্ঠায় পর্যবসিত হয়। তাই 'অ্যানিমেল'-এর মূল ভিলেন যে একইসঙ্গে তিনজন মহিলাকে বিয়ে করা এবং ধর্ষণ করা 'উন্নততর রোল মডেল' একজন মুসলমান – এই পার্ভার্ট কল্পনা কি আর খুব আশ্চর্যের? ববি দেওল আবির্ভূত হন একখানি গন্ধমাদনসম দীর্ঘ ছবির শেষ আধ ঘণ্টায়, যেভাবে গেমের লাস্ট লেভেলে বস ভিলেন আবির্ভূত হয়। 'ওরা' আমাদের চাইতে বেশি ভোগ করে, বেশি ভোগ করতে পারে - এইটাই তো সমস্ত হিঁদু ফ্যাসিস্ট পুরুষদের আকর উৎকণ্ঠা, যাকে বলে প্রায় কপিবুক অ্যাংজাইটি! আদতে, অবচেতনে এইরকম শত্রুদের প্রতি এই পুরুষদের একরকম অবদমিত মুগ্ধতা থাকে, যা সচেতনে পর্যবসিত হয় পৌরুষের প্রতিযোগিতায়।
'অ্যানিমেল'-এর বাবা কে?
ভঙ্গবাবু, ভঙ্গভক্তদের প্রতি আমার প্রধান রাগ অন্যত্র। এইসব জঞ্জালের মতো ছবি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তারা প্রধানত কয়েকটি ছবির রেফারেন্স দিতে থাকে। 'অর্জুন রেড্ডি'-র নায়ক বিজয় দেভেরাকোন্ডা এক জায়গায় বলেছেন যে, তিনিও ছবিটিতে অভিনয় করার সময়ে কিছু বিশেষ ছবি মাথায় রাখতেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো 'গডফাদার', 'স্কারফেস' এবং 'ট্যাক্সি ড্রাইভার'।
'গডফাদার'-এর মূল কনফ্লিক্ট কোথায়? ডন করলিওনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একজন সংখ্যালঘু (যেজন্য ভারতীয় চলচ্চিত্রে এই ছবির অ্যাডাপ্টেশনে কখনো একজন ডন হিন্দু হতে পারে না, তাতে ছবির রাজনৈতিক ভিত্তিই নড়ে যায়), তিনি মূলত ইতালিয় ইমিগ্রেন্ট কমিউনিটির রক্ষাকর্তা। তার প্রধান অবলম্বন হলো তার ইতালিয়-সিসিলিয় শিকড়ের প্রতি আনুগত্য, তার স্নেহ ও বাৎসল্য, এবং পরিবারের প্রতি মমতা। আবার তিনি চান যে, তার সন্তান যেন আমেরিকার যথার্থ সিটিজেন হয়ে ওঠে। এইবার মাইকেল করলিওনে যখন মাফিয়া রাজত্বের রাজকুমার হয়ে ওঠে, তার ট্র্যাজিক কনফ্লিক্ট হলো যে তার ডন করলিওনের ওই বৈশিষ্ট্যগুলোই নেই! তার মানসিকতা কর্পোরেট-ক্যাপিটালিস্টের, তার স্নেহ-মমতা নেই; তাই তার হাতে প্রধান ভিক্টিম হয় তার পরিবারই! যদি পর্দায় ভারতীয় মাইকেল করলিওনে করতেই হয় তাহলে কি ভঙ্গবাবুর ক্ষমতা আছে দেখানোর যে, এই আখ্যানের পরিণতিতে বৃদ্ধ রণবিজয়ের সামনে গুলিবিদ্ধ হচ্ছে তার কন্যা - এই দৃশ্যের? ক্ষমতা আছে সেই দৃশ্যে 'পথের পাঁচালি'-কে উদ্ধৃত করার? হরিহরের আর্তির সময় বেজে উঠেছিল তারসানাই, আমরা শুনতে পেয়েছিলাম শুধু শেষ কান্নার রেশ! সেভাবেই মাইকেলের কান্নার সময়ে তুঙ্গে ওঠে অপেরা, প্রায় কণ্ঠরুদ্ধ হাহাকারের শেষ রেশ শুধু আমরা শুনতে পাই, প্রায় আর্তনাদের মতো। এই হত্যার আর প্রতিশোধ নেওয়া যাবে না, কারণ সে এখন অশক্ত, অসহায় বৃদ্ধ - এই যে তার চোখের সামনে কন্যা এভাবে মরবে, সেটা যে তার পুরুষজীবনের কর্মফল! এই দৃশ্য দেখানোর আর দেখার ক্ষমতা আছে ভঙ্গবাবু ও ভঙ্গভক্তদের?
'ট্যাক্সি ড্রাইভার'-এর নিউরোটিক ট্র্যাভিস বিকলের সমর্থনে নেই মার্টিন স্করসেসে; এই হালেই তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমেরিকা দেখে বলেন যে, এখন তিনি চারিদিকে ট্র্যাভিস বিকলকে দেখতে পান। ট্র্যাভিস কে? একখানি প্রায় নির্বোধ গেঁয়ো আমেরিকান, যাকে ভিয়েতনামের যুদ্ধে পাঠানো হয়েছিল, যা হয়েছিল সেই ষাটের দশকে। আমেরিকার শতেক টিনএজারদের মতো ট্র্যাভিস একদম ভিন্ন মহাদেশে একটি ট্রপিকাল জঙ্গলে গিয়ে ভয় পেয়ে গেছিল, ঘাবড়ে গেছিল হয়তো। আরও ঘাবড়ে গেছিল যে তৃতীয় বিশ্বের চাষাভুষো কিছু ছেলেমেয়ে যেভাবে তাদের স্বদেশকে রক্ষা করছে, তার নিজের 'দেশপ্রেম'-এর পিছনে যে ইম্পিরিয়ালিজম, তা তো ঠিক সমধর্মী নয়; কার যুদ্ধ সে লড়ছে? সে ফেরে PTSD-র রোগী হিসেবে। কাজ নেই, চোখে ঘুম নেই; অতএব সে রাতে ট্যাক্সি চালায় এবং ট্যাক্সি চালানোর সময়ে সে শহরে কী দ্যাখে? দ্যাখে শহর জোড়া কালো মানুষ, ল্যাটিনো, ভিন্ন যৌনতার মানুষ, সিক্সটিজের হিপি মুভমেন্টের অবশেষ, নতুন নারী, নতুন যৌনস্বভাবের মানুষ। এইবার ট্র্যাভিসের ভিতর থেকে রেসিজম এবং টক্সিসিটি গুলিয়ে ওঠে। সে চায় এমন একটা ঝড়বাদল আসুক যখন শহর থেকে এই সমস্ত মানুষ ধুয়ে যাবে। আসলে সে ভাবছে, সে লড়ল কাদের জন্যে? দেশের জন্য। দেশ কী? সাদা চামড়ার রক্ষণশীল মানুষদের দেশ ছাড়া আর কিছু কি? এই ভিন্ন রঙ, ভিন্ন ফ্যাশন, ভিন্ন যৌনবোধের মানুষগুলো তো 'দেশ' না। তার মধ্যে, এইসব পুরুষদের হিলারিয়াস ট্র্যাজেডি যা হয় আর কী, সে তার কাঙ্খিত নারীর সঙ্গে শুতেও পারে না। এইবার তার নিজের লিঙ্গ/বন্দুক ছাড়া আর কি অবলম্বন হতে পারে? সে নিজেকে ডন কিহোতে ভাবে, মাথাটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে, নিজেকে তো 'ভ্যালুয়েবল' ভাবতে হবে – হত্যালীলা সাঙ্গ করা ছাড়া আর তার হাতে কিছু রইল না।
এই ছবি 'অ্যানিমেল'-এর পূর্বসূরি? এই ছবিগুলি সামাজিক-ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে টক্সিক ম্যাসকুলিনিটির ক্ষুরধার সমালোচনা! 'অ্যানিমেল'-এর ক্ষমতা আছে অভিনয়ের মাধ্যমে কীভাবে চরিত্রর সমালোচনা করতে হয় সেরকম রবার্ট ডি নিরোর মতো অভিনয় করানোর? নাকি ভঙ্গবাবু সেভাবে অভিনয়ের পরিচালনা করতে চান? আমার এই মাসি ছবি আর 'অ্যানিমেল'-ভক্তদের থার্ড-গ্রেড সিনেফিলিয়ার উপর রাগ এই কারণেই যে এই ছবিগুলি তারা ক্রমাগত পল্লবগ্রাহীতায় দ্যাখে। আদতে শিক্ষিত বা চেতনাসম্পন্ন তো এই মাসি ছবির কনজিউমাররা ননই কিন্তু সিনেমায় অশিক্ষিত থেকে ছবি বোঝা আর বানানোটাও অধুনা রোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে!
আর তারান্তিনো? ডিটেলে র্যাম্পেজ দেখালেই তারান্তিনো হয়ে গেল? তাহলে সেটা টুকলির স্তরেই থেকে যাবে। পুরুষতান্ত্রিক অ্যাবিউজ জাস্টিফাই করা নেই তারান্তিনোর কোনও ছবিতে। বরং ‘অ্যানিমেল’-এ যেমন দৃশ্যের পর দৃশ্যে পুরুষতন্ত্র ও পিতৃতন্ত্রের ‘তত্ত্ব’ দেওয়া আছে, ‘কিল বিল ২’-এর ক্লাইম্যাক্সের আগে দীর্ঘ ‘দাম্পত্য’-র সিকোয়েন্স হলো ওই জগতে পিতৃতন্ত্র ও পুরুষতন্ত্র কীভাবে কাজ করে তার ব্যাখ্যা এবং বিলকে কেন তার প্রেমিকার হাতেই মরতে হবে তার কারণ প্রতিষ্ঠা করা, এবং সেটা হলো এই - বিল একেবারে সংজ্ঞার্থে পিতৃতান্ত্রিক। ‘ডেথ প্রুফ’-এর প্রথম অর্ধে মেয়েদের বিরুদ্ধে ভায়োলেন্স দ্বিতীয় অর্ধে উলটে যায় এবং সেটা স্রেফ মেয়েদের ‘ম্যাসকুলিনাইজ’ করে নয়, রীতিমতো পুংবিরোধী প্রতিহিংসা তাত্ত্বিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। মেয়েদের বিরুদ্ধে কারা ভায়োলেন্ট হচ্ছে এবং কোন প্রেক্ষিত থেকে, তা নিয়ে তারান্তিনোর ছবির অবস্থান কী তা সবসময়ে স্পষ্ট। একজন মহিলাকে অ্যাবিউজ করে চলা ‘হেটফুল এইট’-এর প্রতিটা চরিত্র যে ঘৃণ্য, তা নিয়ে ছবির ধন্দ নেই। এইটাই ব্যাপার, চরিত্রকে কীভাবে ক্রিটিকালি দেখতে হয়, সেটা এই ছবির অগভীর দর্শকরা না জানলেও, ছবিগুলি জানে। ভঙ্গবাবুও জানেন। তিনি জানেন তিনি তার জন্তুটিকে ক্রিটিকালি দেখছেন না, সেলিব্রেট করছেন। 'অ্যানিমেল' আর পাঁচটা প্রতিক্রিয়াশীল ছবির থেকে এইখানেই আলাদা, ছবিটা তাত্ত্বিক। ঘ্যানঘ্যানে জ্ঞান দেওয়া আর্ট ফিল্মের চাইতেও বেশি কথা বলে জাস্টিফাই করা আছে ছবির বিবমিষাকে।
ভঙ্গবাবুর ব্যক্তিগত ছবি?
'অ্যানিমেল'-এর অনিল কাপুর এবং রণবীর কাপুর অভিনীত চরিত্রর নাটক রূপকার্থে জানায় যে মোদি অনেক হলো, এইবার বুলডোজার-যোগীনাথকে চান আমাদের আলফা হিঁদুরা। অনেক সফট রাজা সাজা হলো, এইবার হার্ডকোর লিঙ্গপ্রহার চাই। ঘরে এবং বাইরে শত্রু ক্যালাতে হবে, বাড়ির মেয়েদের কন্ট্রোল করতে হবে, প্রেমের প্রমাণ হিসেবে জুতো চাটাতে হবে।
দেশটা ইতরের হয়ে যাচ্ছে - ঋত্বিক ঘটক বলেছিলেন। সেই ইতরামি দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত হতে শিখছি। যে দেশটাকে ভালবেসে জীবন শুরু করেছিলাম, তার চরম অবমাননা দেখতে হচ্ছে দেশের সংখ্যাগুরু ফ্যাসিস্টদের হাতে। কিন্তু সে প্রসঙ্গ থাক। অন্য কথা বলি।
ভঙ্গবাবু অত্যন্ত ব্যক্তিগত ছবি করেন; ছবি করার ব্যাপারে তিনি আনকম্প্রোমাইজিং। তিনি তার ব্যক্তিগত ভিশন, বিশ্বাস থেকে নড়েন না, তিনি সাহসী। যে বৈশিষ্ট্যগুলি একদা আর্ট সিনেমার প্রধান উদ্দীষ্ট ছিল, সেই আপোষহীন ব্যক্তিগত শৈল্পিক অভিব্যক্তি ভঙ্গবাবু মূলধারায় করেন। সেটা কোটি কোটি টাকার ব্যবসা কীভাবে করে? করে কারণ ভঙ্গবাবুর ব্যক্তিগত নিউরোসিসের সঙ্গে এ দেশের সংখ্যাগুরু আম ডেকাডেন্ট পুরুষের নিউরোসিসের কোনও তফাত নেই। তাই তার প্রতিটা ছবি তার ও এ দেশের সংখ্যাগুরু পুরুষদের ম্যানিফেস্টো। সেই ম্যানিফেস্টোর ফর্ম হলো বাজে স্ট্যান্ড-আপ কমেডি আর প্রগলভ ফেসবুকারের পোস্টের মতো আসলে একগাদা চুটকি, বক্তৃতা, জ্ঞান আর বাতেলার সমাহার, যা থেকে রিল ও মিম ছড়াবে এবং WWF-এর মতো কিছু কদর্য ফাইট-ক্লাব সেট পিস - এইসবই দৃশ্যনির্মাণের মুন্সিয়ানায় বাঁধা। কিন্তু চিত্রনাট্যের বা আখ্যানের বাঁধুনি নেই। তিনি নিজের ছবি নিজেই এডিট করেন, তাই কিছু ফেলতে পারেন না, ছবি তিন ঘণ্টা ছাড়িয়ে যায়।
এই প্রসঙ্গে আবার থার্ড-গ্রেড সিনেফিলিয়া আঙুল তুলে বলে এইসব উৎকট ভায়োলেন্স নাকি কোরিয়ান ছবির প্রতি রেফারেন্স! জাপান ও চিনের মাঝখানের চিপায় দ্বিধাবিভক্ত কোরিয়ার ছবিতে ভায়োলেন্স, প্রতিশোধের চক্রাকার কুহক, সর্বনাশের আতঙ্ক একদম সেই দেশের ইতিহাসের রূপকার্থে প্রকাশ। এইগুলো বুঝতে হয়। কোরিয়ায় han নামে এক বিচিত্র জটিল বোধের ইতিহাস আছে, উইকিপিডিয়ার এন্ট্রিটা ভালো, পড়ে দেখতে পারেন। কোরিয়ান ছবির সবকিছু এই হান-এর প্রকাশ। এইরকম পাশের পরীক্ষার্থীর খাতা দেখে “তবুও রাণা প্রতাপ ভাঙিয়া পড়েননি”-কে “তবুও রাণা প্রতাপ জাঙিয়া পড়েননি” টুকে দেওয়া গোছের সিনেফিলিয়াই এ দেশে চলছে আজকাল!
তো ভঙ্গবাবু পর্দাজুড়ে আস্ফালন করেন। এইবার সেগুলি দ্যাখেন ভঙ্গভক্তরা, যাদের মধ্যে শ্রীধ্বজ, শ্রীবাঁকা, শ্রীবক্র, শ্রীশিথিল, শ্রীক্ষুদ্র জাতীয় যত পুরুষাঙ্গকুমাররা হইহই করে বলে ওঠেন যে এ আমার মনের কথা জানে! “এমন স্বপ্ন কখনও দেখিনি আগে” বলে একটু কেঁদেও ফেলেন তারা ইমোশনাল হয়ে, “ভাই! কী দেখলাম! একেবারে কেষ্টর মুখে বিশ্বরূপ!” যে কথা তারা একা একা ঘুমহীন অবস্থায় বিড়বিড় করে - তাই তো ছবির ভাষায় বলে দিয়েছেন সন্দীপ ভঙ্গ রেড্ডি আর রণবীর কাপুর!
আরও পড়ুন- অ্যানিমাল: এমন জান্তব সিনেমা কি শুধুই বিনোদন? কাদের জন্য?
অ্যানিমেল হওয়ার সম্ভাবনা কোন মেলপ্রাণীদের মধ্যে আছে?
চেতাবনি - any male ...
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির ফ্যাসিস্ট যোদ্ধারা যখন বিবিধ মানসিক রোগে জর্জরিত (যা যুদ্ধ না করলেও 'অ্যানিমেল'-এর নির্মাতা ও ভক্তদের ভবিতব্য, থেরাপি করান, পৌরুষ বড় ছেনাল হে, তৃপ্ত করে না, বয়স বেড়ে যায়!) - তখন তাদের উপর একরকম মনস্তাত্ত্বিক সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। একটি যুবক নাকি খালি শয়নে-জাগরণে একটি ইমেজে তাড়িত হতো। সে নাকি একটি কমিউনিস্ট যুবতীকে দেখেছিল একবার রাস্তায় প্ল্যাকার্ড হাতে; সে নাকি এখন মনঃচক্ষুতে খালি দ্যাখে যে সে মেয়েটির মুখে গুলি করছে, মাথাটা ভিতর থেকে ফেটে যাচ্ছে। সে এইভাবে গুলি করেছিল কি? না, হৃৎপিণ্ডে করেছিল। তাহলে এটা দেখে কেন? থেরাপির সময়ে অবদমিত সত্য ও বাসনা বেরিয়ে আসে - মেয়েটা বড্ড কথা বলছিল!
এই হলো 'অ্যানিমেল'-এর একরকম সারমর্ম। ভঙ্গবাবু টক্সিক পুরুষদের জন্য স্বপ্নের উপাদান পেশ করছেন, অর্থাৎ সেই রশ্মিকার গলা টিপে ধরার শটটা। ভঙ্গবাবু জানতেন রশ্মিকা চিবিয়ে চিবিয়ে ইংরেজি বলেন; এই শটটা ট্রেলারে থাকলে তিনি ট্রোলড হবেন। তিনি কেয়ার করেন না; কারণ শটটা ট্রেলারে রাখতেই হবে। এরকম আরও খান পাঁচেক লিখতে পারি। কিন্তু এখন সে থাক...। এখন আসল বোমাটা ছাড়ি।
আমি 'অ্যানিমেল' দেখিনি। কখনও দেখবও না।
আমি শুনতে পাচ্ছি, ভঙ্গভক্তট্রোলেরা হইহই করে "পেয়েছি! পেয়েছি! ঘাড় মটকাবো!" বলে উঠেছেন। তাদের জানাই, আপনাদের কাছেই শুনেছি যে 'অ্যানিমেল' হলো 'কবীর সিং'-এর নারীবিদ্বেষের সমালোচনা যারা করেছিলেন তাদের উদ্দেশ্যে ভঙ্গবাবুর সিনেমাটিক ‘fuck you all’ একখানি। তো ভঙ্গবাবু যদি ক্রিটিকদের ধূলিস্যাৎ করার জন্য ছবি বানাতে পারেন এবং ক্রিটিকদের এক একটা পয়েন্টকে মিডল ফিঙ্গার দেখানোর জন্য এক একটা দৃশ্য লিখতে থাকেন, প্লট, চিত্রনাট্য ঘেঁটে দিয়ে অপ্রয়োজনীয় দৃশ্য বাড়িয়ে ৩ ঘণ্টা ২০ মিনিট করতে পারেন ছবিকে (ওটিটি-তে ৩ ঘণ্টা ৪৯ মিনিট হবে), এবং ভক্ত মেলপ্রাণীরা বক্স অফিসে জুড়ে যদি সেই সমস্ত সমালোচকদের কাঁচকলা দেখাতে পারেন, মহিলা ক্রিটিককে "আন্টি, ট্রিগার্ড হবেন না" জাতীয় মন্তব্য করতে পারেন, নায়কও যদি 'যারা সেন্সিটিভ তারা দেখবেন না' জাতীয় ডিসক্লেমার দিতে পারেন ... তাহলে আমিও একটা সমালোচনা লিখতে পারি giving a grand ‘fuck’ to the film, অর্থাৎ না দেখে। আপনারা গুরুত্ব হাইপ করেছেন বলে দেখতে হবেই এটা মানছি না; আবার লিখতেও ছাড়ছি না! ভঙ্গবাবু তার vision-এর প্রতি যতটা সৎ, আমি সমালোচনায় ততটাই অসৎ।
এই লেখায় পুরুষাঙ্গ নিয়ে যা যা অশ্লীল মস্করা করেছি তা সচেতনভাবে করেছি কারণ 'অ্যানিমেল'-এও তা করা হয়েছে বারবার, অবশ্যই উলটো রাজনীতি থেকে। সেইসব অশ্লীলতা সেন্সর করা হয়নি। দিবাকর ব্যানার্জির শেষ রাজনৈতিক ছবিটির মুক্তির পথ বন্ধ করা হয়েছে, নেটফ্লিক্স ছবিটা প্রযোজনা করে ঠান্ডা ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। অনুরাগ কাশ্যপের 'ম্যাক্সিমাম সিটি' নেটফ্লিক্স করতে দেয়নি, অবশ্যই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে; তারপর তার দু’খানি হার্ট-অ্যাটাক হয়ে গেছে অবসাদে। প্রতিষ্ঠিতদেরই এই অবস্থা।
এহেন অবস্থায়, ইন্ডাস্ট্রি 'অ্যানিমেল'-এর মতো নিউরোটিক ব্যক্তিগত ম্যানিফেস্টো ছবি করার জন্য কোটি কোটি টাকা দিচ্ছেন নাকি আজকাল? বেশ। আমি একটা ছবি করব। সেখানে কেন্দ্রে থাকবে রণবিজয় টাইপের নামের একজন যুবক। বাবা ইন্ডাস্ট্রির বড় মাথা; তার সঙ্গে নায়কের সম্পর্কটা বিচিত্র, খুব প্যাশনেট। প্রেমটা কেটে যায়, নায়ক দুঃখ পায়। ভিলেনের নাম বাসুদেব। খুবই আবেগপ্রবণ ছবি হবে, এবং যা যা বলার আপোষহীনভাবে বলব, আমার নিজস্ব নিউরোসিস দিয়ে ম্যারিনেট করে বলব, পাগল ছবি হবে! তাতে পাঁচ ঘণ্টার মামলা হলে হবে, দুই ভলিউমে রিলিজ করব।
কিন্তু ছবিটা হবে একদম 'অ্যানিমেল'-এর রাজনৈতিক উলটো মেরুর। আমাকে সাপোর্ট করা হবে তো? আর এইসব লিখব না, ছবি বানিয়ে দেখাব। ক’ কোটি টাকা দেবেন?