মরা আলোর সিম্ফনি: একটি অকিঞ্চিৎকর পাঠ

Anirban Bhattacharya Book Review: অনির্বাণ কিছুতেই বড় হতে চান না। এই বই তাদের সবার যারা কিছুতেই বড় হতে চায় না।

বইমেলা এলে বই নিয়ে হইচই হবে, সেটাই দস্তুর। পাঠকের কাছে নানাবিধ পয়গাম যাবে, কাগজে জায়গা পাবে বইয়ের ছবি, বইয়ের কথা। সেসব দেখে বই কিনবেনও লোকে। তক্ষুনি পড়বেন অথবা ফেলে রাখবেন। ব্যস্ততায় ডুবে যাবেন। হঠাৎ এক রাতে বলা নেই কওয়া নেই, সেই বই ডেকে নেবে, নিশিডাক। তখন মুখোমুখি কথা। ফেসবুক কাঁপানো পুশ সেল আর কাগজের পাতা ভরানো ক্ষমতাপ্রবণ বর্ণমালা পেরিয়ে এই যে সংলাপ, তা নিতান্ত ব্যক্তিগত, এখানে আর অসততা চলে না, লেখাটি পাঠককে পরীক্ষা করে, পাঠকও লেখার আড়বহর মাপতে চায়। এভাবে প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র পাঠক লেখার সম্ভবনাকে নতুন দিগন্তে নিয়ে যায়, প্রতিটি পাঠক নিভৃতঘরে লেখার শরীরে যেন ছেনি হাতুড়ি নিয়ে ভাস্করের নিবিষ্ট নীরিক্ষা চালায়, লেখা আসলে তাই-ই চায়। এই যে ছাপার অক্ষর আমার সামনে ভাসছে সাদা পাতায়, এর সঙ্গে লেখকের যশ খ্যাতি, নিন্দা কিচ্ছুর সম্পর্ক নেই। বরং ঘুরিয়ে বললে, ক্ষমতার আলোর থেকে অনেক দূরে আস্তাকুঁড়েও যদি কোনও সম্ভাবনা পড়ে থাকে তবে পাঠক তাকে খুঁজে নেবেই। আজ না হোক কাল, লেখা সেই জন্যই অপেক্ষা করে। দশ বছর, কুড়ি বছর, এক শতাব্দী। আবার পাঠকও অপেক্ষা করে দশ বছর, কুড়ি বছর, এক শতাব্দী।

উপরের লেখাগুলি আমার সচেতন ভাবনা। আমার বিশ্বাস। কাজেই আমার এই লেখা সেই বিশ্বাসের কক্ষ থেকে চ্যুত নয়। ইনস্ক্রিপ্টের বই পরব সংখ্যায় কী লিখব ভাবছি যখন, তখন হাতে একটি বই। সেই বই নিয়েই লিখব। বইটিকে প্রচার দিতে নয়, পুশ সেলের উদ্দেশ্যেও নয়। বলা যেতে পারে নিভৃতপাঠ সংক্রমণের অভীপ্সায়। আমার আবিষ্কারের দিগন্তটা মেলে দিতে।

ক'দিন আগেই হাতে এসেছে অনির্বাণ ভট্টাচার্যের গদ্য সংকলন 'মরা আলোর সিম্ফনি'। লেখকের কর্মস্থলে লেখা দশ বছরের লেখালেখির সংকলন। এই ধরনের বিবিধার্থে লেখা এক জায়গায় করলে সাধারণত তার কোনও অভিমুখ থাকে না। দশটি লেখা দশ রকম হয়, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অনির্বাণ ভট্টাচার্যের এই গদ্য সংকলনের বৈশিষ্ট্যই এই যে, লেখক দশ বছর দশ রকমের আছিলায় যা লিখেছেন তা আসলে পরস্পরবোধে একশরীরী। অভিমুখ একক।

কী সেই অভিমুখ? একজন অনুভূতিপ্রবণ মানুষ কাচের বয়ামে রাখা জীবনকে নানা ভঙ্গিমায় ঘুরে ঘুরে দেখছে। যেমন ভাবে রঙিন লজেন্স দেখে শিশু, যে ভাবে চশমা মুছে তাকায় প্রৌঢ়, তেমনই নানামাত্রিক দৃষ্টিতে। আর কোন জীবন? অর্থের? কীর্তির? সাফল্যের? না। এই বইয়ের সমস্ত লেখাই মহৎ অপচয় নিয়ে। ছিল বিচ্ছিন্ন নানা লেখা, কিন্তু বইয়ের আছিলায় একটি লেখার পিঠে অন্য লেখা বসে যে রোজারির মালা গাঁথা হলো দেখা গেল সে মালায় কে যেন জপে যাচ্ছে জীবনের না দেখতে চাওয়া, রবাহুত গান। এ বই একার্থে ডিলিরিয়াম সংকলন, আবার অন্য দিকে দেখলে আত্মজীবনী। আমাকে অবাক করছে যে বিষয়টা, একজন লেখক নানা তাড়নায় পেশার জগতে নানা লেখা লিখছেন, তার সময়তট আলাদা, কার্যকারণ আলাদা। অথচ অবচেতনে তিনি একটিই লেখা লিখে চলেছেন, নিজের জীবনকে ভেঙে ছড়িয়ে দিচ্ছেন অক্ষরের অভিসন্ধিমালায়। তিনি নিশ্চয়ই দশ বছর আগে লেখা শুরুর দিনগুলিতে জানতেন না এইসব লেখা জুড়ে একদিন বই হবে। অবচেতন তাকে দিয়ে জীবন ভগ্নাংশ লিখিয়ে যাচ্ছে বারবার। সেইখানে আছে তার শৈশব, কৈশোর, শিকড় ছেড়ে চলে আসা, বন্ধুরা, ক্রিকেট, প্রতিটি বয়সের চারপাশ, পরিবার, গাছ-হাওয়া-জলের অদীন ভুবন। প্রত্যেককে লেখক ট্রিবিউট দিচ্ছেন, ছুঁয়ে দেখতে চাইছেন। স্মৃতির ট্রেনে টাইম ট্রাভেল করছেন, আবার ফিরেও আসছেন। ১৫৯ পাতায় এমন গমনাগমন ধরতে আমি শেষ কবে কাউকে দেখেছি, এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। জীবনের আপাত তুচ্ছতাগুলি কত যে মহৎ, এই লেখার পাশে দু'দণ্ড বসলে অনুভব করা যায়। এই লেখায় কোথাও কোনও ভড়ং নেই, কোনও মাস্তানি নেই, আমাকে দেখো-নেই।

বই থেকে দু'একটা লেখার কথা বলি। এই বইয়ের মাঝবরাবর একটি লেখা রাখা আছে। লেখাটির নাম, হাওয়া হাওয়া খুশবু লওটা দে প্লিজ। সেখানে অফিস থেকে প্রতিদিন মেয়ের কাছে ফেরা মানে আসলে তার নিজের ফেলে আসা শৈশব-কৈশোরের কাছে সমস্ত দিনমানের শেষে ফিরে আসা। সেই ফেরার তাগিদটা লেখক ধরছেন এভাবে-

"জানি এটা ক্লিশে, তাতেই বা আমার কী! কারও চরম ন্যাকাও মনে হতে পারে। সত্যি তাতেও আমার ঘণ্টা। তবুও আমার কাছে ওই ওড়িশার বড়বিল বলে জায়গায়, আমাদের বাড়ির পাশের রাস্তার বাড়ির ধারের রেললাইন, যেটা দিয়ে তখন শুধু মালগাড়ি যেত, নিমগাছ লাগোয়া ওই পুকুর যে নিমগাছে নিশ্চিতভাবেই একানড়ে থাকত, আর শীতকালে যে জল পেরিয়ে আসত সার্কাসের তাঁবু থেকে সিংহের বিশাল হাইয়ের শব্দ, আর সেটা পেরিয়ে খেত, যেখান অবধি শিয়ালের ডাকগুলো আসত ওই শীতকালেই আর সেটাও ডিঙিয়ে দূর ঠাকুরানি পাহাড়ের ওই জঙ্গলে ধরানো আলোর দিনকাল- হ্যাঁ ওগুলোই আজও রোজ ফেরে, ভগ্নাংশে, অফিস আসি যখন বা ফিরি মেয়ের কাছে।"

এখানে এই 'অফিস আসি যখন বা ফিরি মেয়ের কাছে' এই কথাটির দিকে তাকাতে অনুরোধ করব। যাতায়াতের মধ্যেই তো আমরা চিনি আমাদের চারপাশকে, আমাদের যাতায়াতেই তো ছবিগুলি মগজে ছাপ রেখে যায়। লেখক একদিন অহেতুক যাওয়া আসার মধ্যে আবিষ্কার করা দৃশ্যশ্রাব্য পৃথিবীকে, ফেলে আসা কৈশোরকে এত বছর পর খুঁজছেন অভ্যাসের যাওয়া আসায়।

একবার সে জুতোয় পা গলালে আর নিস্তার নেই। লেখক ক্রমে জাল কেটে আরও এগোতে থাকেন। বড়বিলের জীবনের পুজোর দিনগুলির স্মৃতি ফিরে আসে। যেখানে হাসান জাহাঙ্গীর গাইছে, হাওয়া হাওয়া, অ্যায় হাওয়া, খুশবু লুটা দে। জীবন কত কত বসন্ত পার করে, কত নতুন চপল গান আসে, টুনির মা আসে, লেখকের মন পড়ে থাকে সেই গানে। অনির্বাণ লেখেন, "এই হাওয়া একান্তভাবেই আমাদের। হ্যাঁ, বাবার জমিদারি, কার কী বলার?"

মিতায়তন লেখাটা শেষ হয় আর একটা অভ্যাসে, গাড়ির কাচ খুলে হাওয়ায় আঙুল ঘোরানোর অভ্যাসে। চকিতে আমার মনে পড়ে এই বইয়ের প্রথম দিকের লেখাতে, সেই লেখাটা একটা ঝড়ের দিন নিয়ে, অনির্বাণ লিখেছিলেন, "অনভ্যস্ত হাতের দখল নেয় একাধিক কু-অভ্যাস"। আমি এই কারণেই শুরুতেই বলেছি এই বইয়ের সব লেখাই একশরীরী। লেখা শেষ হয়, অনিবার্ণ বুঝিয়ে ছাড়েন ওঁর যেমন হাওয়া, ওঁর স্ত্রীর যেমন একটি বিশেষ দোকানের জিলিপি, আমরা সবাই খুঁজে চলি, আজীবন খুঁজে মরি ব্যক্তিগত, হারিয়ে ফেলা একটা অনুভূতিকে। আমি এ লেখা পড়ার পরে খুঁজছি আমার অসংখ্য হাওয়াই চটি, যা বাবার সাইকেলে বসে ফেরার পথে বারবার খসে গেছে পা থেকে, আপনি খুঁজতেই পারেন কোনও মানুষী ছায়া। এখানে, এই শেষ বিন্দুতে এসে লেখাটা সবার হয়ে যায়।

এই যে কিশোর মন ফিরে গিয়েছিল বড়বিল, এবার তার রিয়েলিটি চেক, চলে আসতে হবে,কলকাতা, ট্রেনে অসুস্থ বাবাকে নিয়ে। কীভাবে রাত পার হবে সেই চিন্তায় মা মগ্ন, সাহস দিতে ছেলেটিকে তার গোড়াকাকু বলে, "ব্যাটা বড় হয়েছিস তো, যা বাবাকে নিয়ে যা সাবধানে, তুই না মোহনবাগান..."। মানুষ বিশ্বাসার্থী। কিছু একটা ধরে সে বাঁচে। তুই না মোহনবাগান-টা সেই বাঁচার আয়ুধ, এই মন্ত্রের শক্তিতে কুচোমাছ সাগরে চলে আসে। অনির্বাণ এলেন, আর যাওয়া হলো না ফিরে। তবু মন পড়ে রয়, স্মৃতির সুতো ঘুড়ির বুক ধরে টানে। তাই লেখা যখন শেষ হয় অনির্বাণ কুড়ি বছর পর ট্রেনে করে ফিরছেন বড়বিল। যে ট্রেন একদিন তাকে কলকাতায় নিয়ে এসছিল। সঙ্গে ছিল মা, বাবা। এবার আজ ফেরার দিনে সঙ্গে আছে ওর সন্তান, অনির্বাণ তাকে ওঁর স্কুলটা দেখাতে চায়।

আরও একটি লেখার কথা বলতে চাই এই পরিসরে। লেখাটির নাম, যে গাছে পরম মায়া নিয়ে থাকত মধ্যবিত্ত এক একা... এই একা একানড়ে, ছোটছেলে মেয়েদের ভয় দেখাতেই যে একানড়েকে গাছের ডাল থেকে যখন তখন নামিয়ে আনতেন ঠাকুমা-দিদিমারা। এই বইয়ের অন্য লেখাতেও সেই একানড়ে এসেছে, অনির্বাণের বাল্যস্মৃতির ভূত হয়ে। কিন্তু এই গদ্যে একানড়ে থাকে উল্টোদিকের দুটো আমগাছে, অনির্বাণ দেখেও দেখেন না। একদিন আমফান আসে। সব গাছ উপড়ে যায়। সংহারক প্রকৃতির রুদ্ররূপকে ছোট ছোট আঁচড়ে ধরেছেন লেখক। এই ঝড়বাদলের শেষে তিনি আশ্চর্য হয়ে দেখেন বটগাছও উপড়ে গেছে, কিন্তু দাঁড়িয়ে আছে ওই আমগাছ দুটো? তাহলে কি একানড়ে আছে, তার মায়াই কি গাছগুলিকে বাঁচিয়ে রেখেছে? অনির্বাণ জানেন না। ভাবেন নিশ্চয়ই মা জানে আর মেয়ে জানে। যাদের কাছে গল্পটা আছে। আমি দেখি, ভূত আর গাছ, দুটো আপাত অকার‍ণ তিনটে প্রজন্মকে জুড়ে রেখেছে। আমি দেখি, একজন মানুষ শৈশবকে, কৈশোরকে পরম আদরে সংরক্ষণ করছে। যে মানুষ আজও ভাবে, ভূত কি তবে আছে? সে তো বড় হয়নি আজও। অনির্বাণ কিছুতেই বড় হতে চান না। এই বই তাদের সবার যারা কিছুতেই বড় হতে চায় না।

-----


মরা আলোর সিম্ফনি
অনির্বাণ ভট্টাচার্য
চিন্তা গদ্য সিরিজ-২০
দাম- ৩৫০ টাকা

More Articles