অনুব্রত মন্ডলের বেনামি সম্পত্তির আড়ালে আসলে তিনি, কে এই আবদুল লতিফ?
এবার সিবিআইয়ের স্ক্যানারে আবদুল লতিফ। অনুব্রতর বেনামি সম্পত্তির হদিশ পেতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই ব্যক্তি। কে এই লতিফ?
সকালে ঘুম ভাঙে রাজ্যবাসীর, নতুন সূর্যোদয় দেখার জন্য নয়, দেখতে হয় দুর্নীতির পাঁকে আরও কতটা নিমজ্জিত হলো রাজ্য! খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে, কাল হল তার এঁড়ে গরু কিনে। অবলা গরু যে এঁড়ে হয়ে উঠবে, তা সম্ভবত বুঝতে পারেননি বীরভূমবাসী, যাঁরা একদিন বাহুবলী বানিয়েছিলেন অনুব্রত মন্ডলকে। কুবেরের থুড়ি পার্থর বিষয়আশয় দেখে চোখে কপালে উঠেছিল রাজ্যবাসীর। সেই অধ্যায় এখনও শেষ হয়নি। তার আগেই গরু পাচারকাণ্ডে বীরভূমের তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মন্ডলকে ধরে টানাটানি। তদন্ত যত এগোচ্ছে, একের পর এক উঠে আসছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। দুর্নীতির জাল কতদূর বিস্তৃত! ভেবে কুলকিনারা পাওয়া বোধহয় এই আবহে অসম্ভব। এবার সিবিআইয়ের স্ক্যানারে আবদুল লতিফ। অনুব্রতর বেনামি সম্পত্তির হদিশ পেতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই ব্যক্তি। কে এই লতিফ?
আবদুলই ট্রাম্প কার্ড?
সকল বেনামী সম্পত্তির খোঁজে এবার বীরভূমের অন্যতম গরু ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত আবদুল লতিফকে হাতে পেতে চাইছেন তদন্তকারী গোয়েন্দারা, দাবি সিবিআইয়ের।
সিবিআই সূত্রে খবর, এই সকল বেনামী সম্পত্তির হদিশ দিতে পারেন এই আবদুল লতিফ। সিবিআইয়ের দাবি, যে তথ্য সামনে এসেছে, তাতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে গরু পাচার থেকে আসা লাভের টাকার যে ভাগ অনুব্রত মন্ডলের জন্য বরাদ্দ থাকত, তা অনেক সময় নিজের হাতে নিতেন না অনুব্রত মন্ডল। আবদুল লতিফ মারফত বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেই টাকা লগ্নি হয়েছে বলে জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা। এমনকী, অনুব্রতর দেহরক্ষী সায়গল হোসেনকে জেরা করেও এই সকল বিনিয়োগের কথা জানা গিয়েছে বলে দাবি করছে সিবিআই। তাই বেনামে কোথায় কত বিনিয়োগ হয়েছে, জানতে এই আবদুল লতিফকে হাতে পেতে চাইছেন গোয়েন্দারা।
আরও পড়ুন: ঠিক কী কারণে সিবিআই-এর র্যাডারে অনুব্রত কন্যা! অভিযোগ জানলে স্তম্ভিত হবেন
সিবিআই সূত্রে খবর, গত সপ্তাহে দেওয়া গরু পাচার মামলায় দ্বিতীয় সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিটে আবদুল লতিফের নাম রয়েছে। তাতে গরু পাচার ও লাভের টাকা কীভাবে আবদুল মারফত প্রভাবশালীদের কাছে গিয়েছে, তা উল্লেখ রয়েছে বলে সিবিআই সূত্রে খবর। তদন্তকারী সংস্থার আরও দাবি, অনুব্রত মন্ডলের নির্দেশ মেনেই আবদুল লতিফ অনুব্রতর হয়ে সরাসরি বিনিয়োগ করেছেন। তাই জেরা পর্বে অনুব্রত মন্ডল যখন পুরোপুরি চুপ, তখন বেনামী সম্পত্তির হদিশ পেতে আবদুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করা শ্রেয় বলে মনে করছেন তদন্তকারী আধিকারিকরা। চার্জশিটে নাম থাকলেও এখনও পর্যন্ত আবদুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করে উঠতে পারেনি সিবিআই। তাই এই মুহূর্তে আবদুলের বয়ান হয়ে উঠতে পারে অনুব্রত মন্ডলের বিরুদ্ধে তদন্তকারী সংস্থার ট্রাম কার্ড।
কে এই লতিফ?
সূত্রের খবর, ইলামবাজারের বেলোয়া গ্রামে আদি বাড়ি এই লতিফের। পারিবারিক সূত্র ধরেই গরু ব্যবসার সঙ্গে যোগ আবদুল লতিফের। পরবর্তীতে বীরভূম জেলার ইলামবাজার-সহ বিভিন্ন স্থানের পশুহাটের একছত্র নিয়ন্ত্রণ চলে আসে এই আবদুল লতিফের হাতে। প্রথমে এনামুল হকের এক কর্মী হয়ে বীরভূম জেলাকে গরু পাচারের করিডর হিসেবে ব্যবহার করতে সাহায্য করা ও পরবর্তীতে নিজেই এনামুলের অন্যতম পার্টনার হয়ে ওঠেন তিনি। চার্জশিটে নাম থাকলেও এখনও সিবিআইয়ের হাতে অধরা এই লতিফ শুধু গরুর ব্যবসা নয়, এলাকায় একাধিক মার্বেল ব্যবসার সঙ্গেও যুক্ত বলে জানা গিয়েছে। এই ব্যবসাগুলিতে গরু পাচারের থেকে আসা লাভের টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে বলে দাবি সিবিআইয়ের। কীভাবে যোগ অনুব্রত মন্ডলের সঙ্গে?
সিবিআই সূত্রে খবর, অনুব্রত মন্ডলের দেহরক্ষী সায়গল হোসেনের সূত্র ধরেই যোগাযোগ হয় অনুব্রত ও আবদুলের। এমনকী, সায়গল হোসেন মারফত অনুব্রতর নির্দেশ পৌঁছে যেত এই আবদুল লতিফের কাছে, দাবি গোয়েন্দাদের।
উদ্ধার কললিস্ট, চাঞ্চল্য
সিবিআইয়ের হাতে অনুব্রত মণ্ডলের গ্রেফতারির পর ৬ দিন পার হয়েছে। সিবিআই সূত্রে খবর, এরইমধ্যে নিত্য নতুন তথ্য হাতে পাচ্ছেন তদন্তকারীরা। সিবিআই সূত্রের দাবি, এবার তদন্তকারীদের হাতে উঠে এসেছে কললিস্ট। কাদের কথোপকথনের এই তথ্য? সূত্রের খবর, গরু পাচারকাণ্ডে মূল অভিযুক্ত এনামুল হক ও আবদুল লতিফের নিয়মিত ফোনে কথা হতো অনুব্রত মন্ডলের দেহরক্ষী সায়গল হোসেনের। সিবিআই সূত্রে খবর, অন্তত ১৬ বার ফোনে কথা হয়েছে সায়গল হোসেনের সঙ্গে গরু পাচার মামলায় অভিযুক্ত এনামুল ও আবদুল লতিফের। আদালত সূত্রে খবর, গরু পাচার মামলায় সিবিআই তাদের সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিটে যখন সায়গল হোসেনের নাম উল্লেখ করে, একই সঙ্গে সেখানে উল্লেখ করা হয়, কীভাবে এই ঘটনায় সায়গলের নাম জড়িয়েছে। সূত্রের দাবি, বিস্তারিতভাবে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা হয়।
সিবিআই তাদের তদন্তে এখনও অবধি এনামুল ও আবদুল লতিফের বিরুদ্ধে একাধিক তথ্য পেয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। ভিন রাজ্য থেকে বীরভূমে যে গরু আনা হতো, তা ইলামবাজারের গরুর হাটে নিয়ে যাওয়া হতো। এই হাটের দেখভালের দায়িত্বে আবদুল লতিফ ছিলেন বলেই জানা গিয়েছে। এখান থেকে মুর্শিদাবাদ হয়ে সীমান্ত পার করে গরু বাংলাদেশে পাচার হতো বলেও সিবিআই তদন্তে জানতে পেরেছে।
এক্ষেত্রে সায়গলের ভূমিকা কী?
সায়গল অনুব্রত মন্ডলের দেহরক্ষী শুধু নন, ছায়াসঙ্গীও। সিবিআই সূত্রের খবর, এই সম্পর্কের সমীকরণকে কাজে লাগাতে সায়গালের জন্য এনামুল ও লতিফের সঙ্গে যোগাযোগ। পাচার কাজ যাতে মসৃণ হয় তা নিশ্চিত করতেই সায়গলের সঙ্গে যোগাযোগ বলে সিবিআই সূত্রে জানা গেছে।
সূত্রের খবর, সিবিআই তাদের চার্জশিটে উল্লেখ করেছে ২০১৫ সাল থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে প্রায় ১৬ বার ফোনে কথা হয়েছে সায়গলের সঙ্গে এনামুল ও লতিফের। কোন কোন নম্বর থেকে ফোন হয়েছে, তার উল্লেখ রয়েছে চার্জশিটে। সূত্রের খবর, অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি বিষয় হলো, এই চার্জশিটে বলা হয়েছে, 'অন দ্য বিহাফ অফ অনুব্রত মন্ডল’, অর্থাৎ, অনুব্রতর হয়ে কাজ করতেন সায়গল। শুধু গরু পাচার নয়, বেশ কিছু জমির অর্থের লেনদেনের বিষয়ও সিবিআইয়ের স্ক্যানারে। সেই জমি হয় সায়গল হোসেনের নামে রয়েছে কিংবা আবদুল লতিফের নামে রয়েছে। এই সম্পত্তি বাড়ানোর জন্য তাঁরা সায়গলকে টাকা দিয়েছেন বলে খবর। সিবিআইয়ের বক্তব্য, অনুব্রতর প্রভাব খাটিয়ে সায়গল এভাবে তাঁর সম্পত্তি ও প্রতিপত্তি বিস্তার করেছে।
বলাই বাহুল্য, বীরভূমের বাহুবলীর হাত যাঁদের মাথা স্পর্শ করেছে, তা তিনি সায়গলই হোন কিংবা এনামুল, লতিফ, তাঁদের কারবারও ফুলেফেঁপে উঠেছিল। গরু ব্যবসার লাভের অঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছেন অন্য ব্যবসায়। এভাবে কতদিন ধরে দুর্নীতির বিষবৃক্ষ লালন করছে একটা সরকার? কী উত্তর দেবেন মুখ্যমন্ত্রী? অনেক স্বপ্ন বুকে নিয়েই তো ৩৪ বছরের ঘুণধরা সরকারটাকে সরিয়েছিল রাজ্যবাসী। সেটা কি এমন দিন দেখার অপেক্ষায়?