পানীয় জলের জীবাণু চিনতে পারবেন আপনিও! যুগান্তকারী আবিষ্কার বিজ্ঞানীদের
এই মুহূর্তে এই ওয়াটার টেস্ট কিটটি পাওয়া যাবে ১৯৯ টাকা মূল্যের বিনিময়ে এবং খুব শিগগির বাজার থেকেও কিনতে পারবেন সাধারণ মানুষ। একটি প্যাকেটে এখন দু'টি কিট পাওয়া যাচ্ছে। এবং প্রতিটি টেস্ট কিট একবারই ব্যবহার করা যাবে।
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি, কানপুর এবং আই.আই.টি কানপুরের অধীনস্থ (IIT Kanpur Incubated) বেসরকারি সংস্থা আর্থফেস প্রাইভেট লিমিটেড (EarthFace Private Limited) সংঘবদ্ধ হয়ে একটি কিট বানিয়েছে, যা খুব সহজেই পানীয় জলে ই.কোলাইয়ের (E. coli.) উপস্থিতি জানিয়ে দেবে।
PadmaBio নামের এই টেস্ট কিটটি যে কোনও ব্যক্তি প্রযুক্তিগত জ্ঞান ছাড়া খুব সহজেই ব্যবহার করতে পারবেন। প্রযুক্তিগত দিক থেকে এই টেস্ট কিট বাজারচলতি একই ধরনের অন্যান্য টেস্ট কিটের থেকে অনেক বেশি এগিয়ে। শুধু তাই নয়, পানীয় জল পরীক্ষার পর নির্ভুল ফল পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি এই টেস্ট কিটের ক্ষেত্রে।
এই গবেষণাটি আইআইটি কানপুরের আর্থ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. ইন্দ্রশেখর সেনের তত্ত্বাবধানে করা হয়েছে। “টেস্ট কিটটি দিয়ে উড়িষ্যার পানীয় জলেও ই.কোলাইয়ের উপস্থিতি পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। সম্প্রতি আমাদের তৈরি এই টেস্ট কিটটি ন্যাশনাল অ্যাক্রেডিটেশন বোর্ড ফর টেস্টিং অ্যান্ড ক্যালিবারেশন ল্যাবোরেটসিজ় (National Accreditation Board for Testing and Calibration Laboratories) বা এন.এ.বি.এল-এর (NABL) স্বীকৃতিও পেয়েছে," ইনস্ক্রিপ্ট-কে জানিয়েছেন ড. সেন।
আরও পড়ুন: আবর্জনামুক্ত জীবন, পৃথিবীকে বাঁচাতে আপনাকে যে দায়িত্ব এখনই নিতে হবে
তিনি আরও জানিয়েছেন, "পানীয় জলে ই.কোলাইয়ের উপস্থিতি প্রমাণ করে সেই জলে নর্দমার জল এসে মিশেছে। এবং ভারতের মতো দেশে, গ্রাম-শহর নির্বিশেষে এটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি সমস্যা।"
ই.কোলাই একাধিক জল (Water-borne) ও খাদ্যবাহিত রোগের (Food-borne Disease) কারণ। পানীয় জলে ই.কোলাইয়ের উপস্থিতির ফলে প্রায়শই পেটের সমস্যায় ভুগতে হয় বাচ্চা থেকে বড় সবাইকে। বারেবারে পেটের সমস্যায় ভুগলে সবথেকে বেশি শারীরিক ক্ষতি হয় শিশুদের। এর প্রভাব প্রত্যক্ষভাবে পড়ে তাদের শারীরিক বৃদ্ধি ও বিকাশে। পাশাপাশি লাগাতার পেটের সমস্যা ভারতের মতো আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া দেশে অপুষ্টির (Malnutrition) একটি অন্যতম কারণ।
ভারতে এমনিতেই পরিশ্রুত পানীয় জলের অভাব একটি অন্যতম সমস্যা। অজান্তে বহু মানুষ প্রতিনিয়ত ই.কোলাই-সংক্রমিত জল পান করেন। "এই টেস্ট কিটটির সাহায্যে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে জানিয়ে দেওয়া সম্ভব পানীয় জলে ই.কোলাই আছে কি না", ইন্সক্রিপ্ট-কে জানিয়েছেন আর্থফেস প্রাইভেট লিমিটেডের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ড. অধিরাজ দাশগুপ্ত (Dr. Adhiraj Dasgupta)।
পানীয় জলে ই.কোলাই উপস্থিত থাকলে এই টেস্ট কিটে থাকা রাসায়নিক ধীরে ধীরে রং বদলাবে। ফ্লো (Flow) নামে একটি মোবাইলের অ্যাপের সাহায্যে পরীক্ষার ফল বিশ্লেষণ করতে সুবিধে হবে।
"ই.কোলাইয়ের উপস্থিতি বোঝার জন্য এখানে একটি সাবস্ট্রেট (Substrate) ব্যবহার করা হয়েছে টেস্ট কিটে। এটি একটি উৎসেচক-সাবস্ট্রেট নির্ভর রাসায়নিক বিক্রিয়া," জানাচ্ছেন ড. সেন, "ই.কোলাই বিটা-গ্যালাটোসাইডেজ (Beta-galactosidase enzyme) নামের একটি বিশেষ উৎসেচক তৈরি করে। আর সেই উৎসেচকের প্রভাবে এই সাবস্ট্রেটে রাসায়নিক পরিবর্তন হয়।"
এই প্রক্রিয়ার আরও বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে ড. দাশগুপ্ত জানাচ্ছেন, "এই রাসায়নিক পরিবর্তনের ফলে রং বদল করে টেস্ট কিটে থাকা সাবস্ট্রেট- এই ধরনের রাসায়নিক পরিবর্তনকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় colorimetric change । আর রঙের বদল দেখেই আমরা বুঝে যাই পানীয় জলে ই.কোলাই রয়েছে।"
বলা যেতে পারে এই বিটা-গ্যালাক্টোসাইডেজ় উৎসেচক ই.কোলাইয়ের উপস্থিতি চিহ্নিতকরণে কাজে লাগে। যার জন্য এই উৎসেচককে ইকোলাইয়ের বায়োমার্কার বলা হয়। তাই বিটা-গ্যালাক্টোসাইডেজ় উৎসেচকে ভিত্তি করেই বানানো হয়েছে এই ওয়াটার টেস্টিং কিট।
অন্যদিকে বাজারচলতি ওয়াটার টেস্ট কিটের সাহায্যে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি বুঝতে সম্পূর্ণ অন্য পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। সেক্ষেত্রে দেখা হয় পানীয় জলে হাইড্রোজেন সালফাইডের মতো রাসায়নিক উপস্থিত কি না, বা সেই রাসায়নিক তৈরি করে, এমন ব্যাকটেরিয়া জলে আছে কি না। কারণ অসংখ্য ক্ষতিকর ও রোগ-সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া হাইড্রোজেন সালফাইড তৈরি করে কোশ থেকে। যা আবার জলে গিয়ে মেশে। কিন্তু এই ধরনের ওয়াটার টেস্ট কিট বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ত্রুটিপূর্ণ ফলাফল দেখায়। ফলে বিশেষ ভরসাযোগ্য হয় না এই টেস্ট কিটগুলি।
তবে এই উৎসেচকটিকে আলাদা করে নিষ্কাশন (extraction) করতে গেলে সবার আগে ব্যাকটেরিয়ার কোশগুলিকে ভেঙে ফেলা প্রয়োজন। এই টেস্ট কিটটিতে সেই ধাপগুলির জন্যও প্রয়োজনীয় রাসায়নিক দেওয়া হয়েছে।
সম্পূর্ণ এই প্রকল্পে আর্থিক সাহায্য ও নির্দেশনার পিছনে রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের জল-জীবন মিশন (Jal Jeevan Mission), যা জল-শক্তি মন্ত্রকের (Ministry of Jal Shakti) ড্রিঙ্কিং ওয়াটার অ্যান্ড স্যানিটাইজে়স্শন বিভাগের (Department of Drinking Water and Sanitisation) আওতায় পড়ে।
এই মুহূর্তে এই ওয়াটার টেস্ট কিটটি পাওয়া যাবে ১৯৯ টাকা মূল্যের বিনিময়ে এবং খুব শিগগির বাজার থেকেও কিনতে পারবেন সাধারণ মানুষ। একটি প্যাকেটে এখন দু'টি কিট পাওয়া যাচ্ছে। এবং প্রতিটি টেস্ট কিট একবারই ব্যবহার করা যাবে।
ড. দাশগুপ্ত জানাচ্ছেন, "বিভিন্ন এনজিও ইতিমধ্যেই এই টেস্ট কিটের অর্ডার করছেন। আর বিপুল চাহিদা মেটানোর জন্য আমরা ইতিমধ্যেই লার্জ স্কেলে এই টেস্ট কিট তৈরি করা আরম্ভ করেছি। ইচ্ছে আছে, খুব দ্রুত আমাজ়ন (Amazon) বা ফ্লিপকার্টের (FlipKart) মতো অনলাইন মাধ্যমে এই কিটটির বিক্রি শুরু করার।"
আশা করা হচ্ছে , ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বিশুদ্ধ পানীয় জলের সরবরাহ নিশ্চিত করতে এবং সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যের সার্বিক উন্নতির পেছনে এই টেস্ট কিটটি দৃষ্টান্তমূলক ভূমিকা পালন করবে।