আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন? এই ভারতীয় জাদু আজও বিস্ময়

বিশ্বের তাবড় তাবড় সব বিখ্যাত জাদুকররা এই দড়ির খেলার, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকমের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। জেসপার মেকারল্যানের মতে, দড়ির ভেতর ভাঁজ করে রাখা বাঁশ ব্যবহার করা হত, যার ফলে দড়িটি সোজা আকাশপথে উঠে যেতে পার...

“Now you’re looking for secret. But you won’t find it, because, of course, you are not really looking. You don’t really want to work it out. You want to be fooled.” আর এই বোকা হয়ে যাওয়ার মেধা, বিস্মিত হতে পারার গুণ জীবনের কাছে যতদিন আমরা বাঁচিয়ে রাখতে পারি, ততদিনই তো আমাদের জীবনে ম্যাজিক জেগে থাকে। প্রতি মুহূর্তের স্নায়ু টান করে রাখা জীবন প্রতিদিনের জন্য কে চায়, বলুন তো! তবে মাঝে মাঝে তো নিজেকে জিজ্ঞেস করে নেওয়াই যায়- “Are you watching closely?” তবু যত ‘closely’-ই দেখুন না কেন, পৃথিবীতে এখনও এমন কিছু আশ্চর্য বেঁচে আছে, যার কোনো ব্যাখ্যা লক্ষ মুদ্রার বকশিশের লোভেও এখনও অবধি কেউ দিতে পারেননি। তেমনই এক ম্যাজিকের নাম ‘The Great Indian Rope Trick’, যাকে একসময় ‘The World’s greatest illusion’ বলা হত। প্রাচীন জাদুর যে খেলায় ভারতীয় জাদুকরদের একটা মাত্র দড়ির কলাকৌশলের কাছে শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে বিশ্বের তামাম জাদুকরদের দল হার মেনেছিল।   

কেমন ছিল সেই জাদুর পদ্ধতি? জানলে চোখে ধাঁধাঁ আর কানে ভোঁভাঁ লেগে যায়। জাদু সম্বন্ধীয় নানারকম বই ঘাঁটাঘাঁটি না করেও, বর্তমান সিনেমার ম্যাজিশিয়ান ক্রিস্টোফার নোলানের ‘The Prestige’ সিনেমাটির দৌলতে অনেকেই হয়তো জানি একটি সম্পূর্ণ জাদুর তিনটি অংশ হিসাবে ‘The Pledge’, ‘The Turn’ এবং ‘The Prestige’-এর কথা। ভারতীয় এই দড়ির খেলায় প্রথম অংশ ‘The Pledge’ হিসাবে খালি মাঠে গোল করে ঘিরে থাকা সব দর্শকের সামনে জাদুকর একটি বড়ো ঝুড়িতে রাখা একটা খালি চোখে দেখতে সাধারণ মোটা দড়িকে, আকাশের দিকে উঠে যাওয়ার নির্দেশ দিতেন। কারও সাহায্য ছাড়াই দড়িটি তরতরিয়ে আকাশের দিকে উঠতে উঠতে একসময় মেঘের মাঝখানে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যেত। তারপর ফকির বা জাদুকর তাঁর সহকারীকে দড়িটি ধরে উপরের দিকে উঠে যেতে বলতেন। ছেলেটি সেই দড়ি বেয়ে উঠে একসময় দর্শকদের চোখের আড়ালে চলে যেত। এরপর জাদুকর ছেলেটিকে বারবার নীচে নেমে আসতে বললেও যখন ছেলেটির কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যেত না, তখন জাদুকর রাগতভাবে একটি ধারলো ছুরি বা তলোয়ার নিয়ে নিজেই সেই দড়ি ধরে আকাশপথে উঠে অদৃশ্য হয়ে যেতেন। কিছুক্ষণ পর দর্শকদের চিৎকার আর বিস্ময়ের মাঝখানে ছেলেটির রক্তাক্ত দেহের নানা কাটা অংশ মাটিতে এসে পড়ত। সেইসঙ্গে শোনা যেত সহকারী ছেলেটির বীভৎস চিৎকার। এই পর্যন্ত ছিল খেলাটির ‘The Turn’ অংশটি। “But you wouldn’t clap yet. Because making something disappear isn’t enough; you have to bring it back.” তাই এরপরেই আসত সেই ব্যাখ্যাতীত অংশ। রাগের প্রশমনে জাদুকর মাটিতে নেমে এসে ছেলেটির কাটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলিকে সেই দড়ির ঝুড়িটির মধ্যে রাখতেন। উপরে টেনে দিতেন এক পর্দার আড়াল। কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে জাদুকরের ডাকে ছেলেটি সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় আবার উঠে দাঁড়াত সেই ঝুড়ি থেকে। দর্শকের কানফাটানো হাততালি আর প্রশংসাবাক্যে তখন জাদুকর তাঁর জাদুর ‘The Prestige’ অংশটির সাফল্যের স্বাদ উপভোগ করছেন। 

ভারতীয় জাদুর এই বিখ্যাত খেলার উল্লেখ খ্রিষ্টীয় দশম শতকে লেখা আদি শঙ্করাচার্যের লেখায়, চতুর্দশ শতাব্দীতে ইবন বতুতার লেখায়, এমনকি সপ্তদশ শতকে লিখিত ‘জাহাঙ্গিরনামা’তেও পাওয়া যায়। আদি শঙ্করাচার্য তাঁর মাণ্ডুক্য উপনিষদের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে এবং অন্যত্র বেদান্ত সূত্রের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আকাশে উঠে যাওয়া এক ফকিরের কারসাজির বিষয়ে উল্লেখ করেন। তাঁর মতে, পুরো ঘটনাটিই ছিল দর্শকদের চোখের এক ভ্রম মাত্র। আসলে জাদুকর প্রথম থেকেই মাটিতে রাখা ঝুড়িতে লুকিয়ে থাকতেন। দড়ি ধরে আকাশে উঠে যাওয়া জাদুকর সম্পূর্ণত দর্শকদের কল্পনা– বলে তিনি মনে করেছিলেন। এই ব্যাখ্যার সঙ্গে পাঠক একমত হন বা না হন, শঙ্করাচার্যের লেখার উল্লেখ থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, দড়ির এই জাদুর ইতিহাস অত্যন্ত সুপ্রাচীন। জানা যায়, এই খেলার শেষাংশ দেখার আগেই ইবন বতুতা রীতিমতো অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। অ্যাংলো ডাচ পরিব্রাজক এডওয়ার্ড মেলটন ১৬৭০ সালে বাটাভিয়ায় এক চৈনিক দলের কাছে এমনই এক জাদুর খেলা দেখেছিলেন বলে উল্লেখ করেন। আবার পু সোংলিং-এর ‘Strange stories from Chinese Studio’-র বর্ণনা অনুযায়ী, স্বর্গের বানান থেকে একটি অনাস্বাদিত ফল চুরির জন্য জাদুকর তাঁর ছেলেকে আকাশে পাঠাতেন। স্বর্গের দ্বাররক্ষীর হাতে নিহত হওয়ার পর সেই ফলটি আবার স্বর্গের রক্ষীর হাতে ফিরিয়ে দিলে জাদুকরের ছেলেটি জীবন ফিরে পেত। কিন্তু এই খেলায় জাদুকর কখনোই দড়ি ধরে উপরে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যেতেন না। সোংলিং জানান, চীনের বিখ্যাত ‘White Lotus’ দলের কাছে এই জাদুটি সেকালে খুবই জনপ্রিয় ছিল। 

ভারতবর্ষের বুকে এই দড়ির খেলা সর্বাধিক খ্যাতি লাভ করে উনবিংশ শতাব্দীতে। এই জাদুর পিছনের কারসাজি শেখার জন্য বহু বিদেশি জাদুকরের আনাগোনা শুরু হয় তৎকালীন ভারতে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এই জাদু দেখানোর জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যা আয়ত্ত করার জন্য সেই সময়ের সাপেক্ষে ৫০০ পাউন্ড, আবার কেউ কেউ ২৫ হাজার টাকা পুরস্কার অবধি ঘোষণা করেছিলেন। আবার অন্যদিকে  এই জাদুর সত্যতা বিষয়েও অনেকের তীব্র সন্দেহ ছিল। ১৮৯০ সালে জন এলবার্ট উইকি তাঁর ‘Chicago Tribune’-এ এই দড়ির খেলা সম্বন্ধে প্রথম লিখেছিলেন। পরে, কর্ণেল বার্নাড একসময় এই জাদুর ছবি তোলেন বলে জানা যায়। কিন্তু এল এইচ ব্র্যানসনের লেখা বই, স্পেনসার হ্যামিলটন –এর মতামত থেকে জানা যায়, তাঁরা বহু চেষ্টাতেও দড়ির এই খেলা কোথাও দেখতে পাননি। শেষমেশ এই জাদুর খেলা তাদের কাছে এক ধাপ্পাবাজি বলে মনে হয়েছিল। আরও পরে ১৯৯৬ সালে রিচার্ড ওয়াইসম্যান ও পিটার লামন্ট ‘Nature’ পত্রিকায় ‘Unraveling the Indian Rope Trick’ নামে এক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন, যেখানে উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ও বিংশ শতাব্দীর গোড়ার সময়কালে এই দড়ির জাদুর প্রায় ৫০ জনের বেশি প্রত্যক্ষদর্শীর হদিশ পেয়েছেন বলে তাঁরা জানান। এই সব প্রত্যক্ষদর্শীদের দেখায় যেমন অনেক অমিল ছিল, তেমনই অন্য কোনো জাদুর খেলার সঙ্গে অনেকেই এই দড়ির খেলার বৈশিষ্ট্যগুলি গুলিয়ে ফেলেছেন বলে পরবর্তী অনেক ইতিহাসবিদরা মনে করেছিলেন। পরবর্তীকালের মনোবিদরা এই ঘটনার সঙ্গে ‘Misinformation Effect’-এর যোগ আছে বলেও মনে করেন। 

বিশ্বের তাবড় তাবড় সব বিখ্যাত জাদুকররা এই দড়ির খেলার, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকমের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। জেসপার মেকারল্যানের মতে, দড়ির ভেতর ভাঁজ করে রাখা বাঁশ ব্যবহার করা হত, যার ফলে দড়িটি সোজা আকাশপথে উঠে যেতে পারত। জন কীল জানান, যেখানে খেলা দেখানো হত, সেখানে অনেক উঁচুতে একটি তার মাটির সমান্তরালে আগে থেকেই আটকানো থাকত। উঠে যাওয়া দড়িটির অগ্রভাগে একটি আংটা লাগানো থাকত, যা ওই মাটির সমান্তরাল তারে আটকে গিয়ে দড়িটিকে টানটান করে রাখত। যদিও বেশিরভাগ যাদুকররাই সহকারীর রক্তাক্ত অংশ মাটিতে পড়ার অংশটিতে জাদুকরের অভূতপূর্ব অভিনয় ও দর্শকের উপর ব্যববহৃত শব্দের প্রভাবের কথা উল্লেখ করছেন। অনেক জাদুকর আবার দর্শকদের সম্পূর্নভাবে সম্মোহিত করার মতটাকেও পুরোপুরি উড়িয়ে দেননি। পরবর্তীতে অনেক জাদুকরদের মধ্যে এই দড়ির খেলা দেখানোর চেষ্টা জারী ছিল বলে জানা যায়। কিন্তু উইলিয়াম টমাসের মতে, “Many magicians have devised apparatus to perform the Indian Rope Trick on a stage. But, as Jasper Maskelyne says, that’s not quite the same trick as the one that’s been created in myth and legend.” 

জাদু কীভাবে কালক্রমে ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠতে পারে তার এক বিচিত্র উদাহরণ আমাদের ভারতবর্ষ। লেখক রাস্কিন বন্ড এই ভারতীয় দড়ির খেলার এক জীবন্ত প্রত্যক্ষদর্শী। উত্তর ভারতের চাক্রাতার কালসি নামক স্থানে একবার  এই খেলা দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি ‘The Times of India’-এর পাতাতেও লিখেছেন। জাদু দেখানো শেষ করে দর্শকের হাততালি আর স্তুতির ভিতর দিয়ে ভিড়ে মিশে যাওয়া জাদুকর আর তার শীর্ণকায় সহকারীটিকে দেখে তাঁর মনে হয়েছিল, রহস্যময়তা ও বহুজনমতের এমন একাঙ্গী মিলন হয়তো ভারতের বুকে বলেই আজও সম্ভবপর হয়। সত্যিই তো! আমাদের জীবনের বাঁকে বাঁকে যতদিন এমন এক প্রাচীন রহস্যের ছায়া দুলতে থাকে, ততদিনই তো আশা থাকে সেই এক ‘Bridge to Terabithia’-তে কোনো একদিন পৌঁছে যাওয়ার। রহস্যের পর্দা সরে গিয়ে দৈনন্দিনের সেই হাঁ করা একই চেহারাটা বেরিয়ে এলে কি আদৌ ভাল লাগত? আপনারাই বলুন… 

তথ্যসূত্রঃ 

  • https://edtimes.in/modern-magicians-rise-dont-ever-forget-indian-rope-trick/
  • https://timesofindia.indiatimes.com/home/sunday-times/why-the-great-indian-rope-trick-isnt-a-myth/articleshow/67004373.cms
  • https://en.wikipedia.org/wiki/Indian_rope_trick#:~:text=The%20Indian%20rope%20trick%20is,one%20or%20more%20boy%20assistants.

More Articles