কেউ কাঁদছেন রাস্তায় বসে, কেউ ল্যাম্পপোস্টের ওপরে, মেসিদের আগমনে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস আর্জেন্টিনায়

FIFA World Cup 2022 : আলো এখন আরও বেশি উজ্জ্বল। আর্জেন্টিনা যেন দিশাহারা হয়ে গিয়েছে। একটাই মন্ত্র, মেসি! মেসি! মেসি!

এমন লাগামছাড়া, ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া মানুষের ঢেউ শেষ কবে দেখেছে রোজারিও? বুয়েনস আইরেসের বিখ্যাত ওবেলিস্কের নিচে সারারাত, সারাদিন এমন ভিড়, এমন হল্লা কবে দেখেছে বিশ্ব? মনে করতে পারছেন না আর্জেন্টিনার তরুণ তরুণীরা। আর মাত্র কয়েকদিন পরেই ক্রিসমাস। আলোর মালায় এমনিতেই সেজে উঠেছে গোটা এলাকা। তবে ১৮ ডিসেম্বরের পর সেই আনন্দ যেন কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে। আলো এখন আরও বেশি উজ্জ্বল। আর্জেন্টিনা যেন দিশাহারা হয়ে গিয়েছে। একটাই মন্ত্র, মেসি! মেসি! মেসি!

এই দিনটির জন্য ৩৬ বছর ধরে অপেক্ষা করছিল একটা দেশ। লাতিন আমেরিকায় ব্রাজিলের প্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনা কখনই খুব ধনী দেশের তালিকায় পড়ে না। একটা মধ্যবিত্ত হাওয়া খেলা করে সেখানে। ফ্রান্সের মতো পরিকাঠামো, ঐশ্বর্য নেই। প্যারিসের মতো আভিজাত্য নেই। বদলে রয়েছে বিপ্লব। দেওয়ালে দেওয়ালে আঁকা অজস্র বড়ো ছবি। ম্যুরাল। স্টেনসিল। আর আছে ফুটবল। ব্রাজিলের মতোই আর্জেন্টিনার অলিতে গলিতে বল পায়ে দাপাদাপি করে ছেলে মেয়েরা। ফুটবল তাদের লড়াইয়ের মন্ত্র দিয়েছে। দিয়েছে বিপ্লবের মন্ত্র। দিয়েছে কবিতা। “To fall in love is to create a religion that has a fallible god.” জর্জ লুই বোর্হেসের এই লাইনটি যেন ঘুরে বেড়ায় আর্জেন্টিনার আকাশে বাতাসে। ‘বিদ্রোহ আর চুমুর দিব্যি…’ কবিতায় হোক বা ফুটবল – সেই বিপ্লবের ধর্ম আর রক্তমাংসের ঈশ্বরদের নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে শহর।

৩৬ বছর কেটে গেল, কথা রাখার থাকলেও সেটা পূরণ করতে পারছিলেন না মেসি। এই বুয়েনস আইরেসেই তাঁর ১০ নম্বর জার্সি পোড়ানো হয়েছিল। কান্নায় ভেঙে পড়েছিল লা আলবিসেলেস্তেরা। বারবার আশা জাগিয়ে ব্যর্থ হওয়া, বারবার। ২০১৪-এ ছুঁয়েও বেরিয়ে যেতে হল বিশ্বকাপ। আর্জেন্টিনার ধুঁকতে থাকা অর্থনীতি, দুর্নীতির ভিড়ের মাঝে এই সোনালি ট্রফিটা যেন খড়কুটো। কিন্তু মেসি…

আরও পড়ুন : কখনও বিশ্বজয়, আবার হতাশা, মারাদোনা-মেসির আর্জেন্টিনা যেন বিশ্বকাপের হাসি কান্নার ককটেল

পরিস্থিতি বদলাল ২০২১ সালে। নিউ নর্মালের পৃথিবীতে অনেক কিছুই দ্রুত বদলে যাচ্ছিল। লাতিন আমেরিকার শিল্পের জায়গায় চলে আসছিল ইউরোপীয় আগ্রাসন। তাদের গতি, টেকনিক সবই টেক্কা দিয়েছে লাতিনদের। দুর্ধর্ষ ব্রাজিল, সাম্বা মাদকতার ব্রাজিলও ব্যর্থ হয়েছে বারবার। কিন্তু আর্জেন্টিনার ভরসা ছিল ওই একজনের ওপর। ইউরোপ যার কাছে থমকে যায়, সেই লিওনেল আন্দ্রেস মেসির দিকে। নিউ নর্মালে ফাঁকা হয়ে গেল আর্জেন্টিনার ফুটবল মানচিত্র। মাত্র দুই বছর আগে সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন দিয়েগো মারাদোনা। গোটা পৃথিবীর নজর ছিল মেসি, বুড়ো মেসির দিকে। ২০২১-এর কোপা আমেরিকা সেই আশাটা আরও কয়েকগুণ বাড়াল।

১৯৮৬-র আগেও আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জিতেছিল। ১৯৭৮-এ মারিও কেম্পেস, পাসারেলার দৌলতে প্রথমবার বিশ্বকাপ ঢোকে বুয়েনস আইরেসে। কিন্তু গোটা বিশ্বে খুব একটা ঝড় আসেনি তখন। ঝড় এল ঠিক আট বছর পর। একটা ঝাঁকড়া চুলের বেঁটে, দস্যি পাগল সবকিছু ওলটপালট করে রেখে দিল। বেলজিয়ামের ছ’জন ডিফেন্ডারকে দাঁড় করিয়ে রেখে বল নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া, মারাদোনা একটা সাইক্লোন ছিল। ফকল্যান্ডের যুদ্ধের পর আর্জেন্টিনা আর ইংল্যান্ডের সাপে-নেউলে সম্পর্ক। ফুটবল মাঠ ছিল সেই কুরুক্ষেত্রের ময়দান। সেই ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধেই উত্তর এল আর্জেন্টিনার। উত্তরের নাম মারাদোনা। শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ গোল, হ্যান্ড অফ গড – আর্জেন্টিনা এই প্রথম ব্যাপকভাবে রূপকথা ছড়াল।

আরও পড়ুন : অলিম্পিকে সোনা থেকে বিশ্বকাপ, মেসি, দি মারিয়া যেন আর্জেন্টিনার ‘গুপি-বাঘা’

বুয়েনস আইরেসের ওবেলিস্কের সামনে সেবারও ছিল বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। মারাদোনা আর্জেন্টিনাকে দাপিয়ে বসিয়ে দিয়েছেন ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের মানচিত্রে। ব্রাজিলের পাশে প্রবল শক্তিধর দেশ আর্জেন্টিনা… হ্যাঁ আমরাও পারি। এই ‘আমরাও দাঁড় করিয়ে রাখতে পারি গোটা বিশ্বকে’ মার্কা মনোভাব বোধহয় মারাদোনাই এনেছিলেন নীল সাদার দেশে। তারপর কেটে গিয়েছে ৩৬ টি বছর। অবশেষে, আরেক ১০ নম্বর। ডিএম ১০-এর জায়গায় এলএম ১০। হাতে বিশ্বকাপ।

লুসাইল স্টেডিয়ামে ফাইনাল যখন শুরু হচ্ছে, আর্জেন্টিনায় তখন দুপুর। ভরা রোদে মেসি নামাঙ্কিত জার্সি পরে নেমে পড়েছেন কয়েক লাখ মানুষ। যারা বৃদ্ধ, প্রৌঢ় তাঁদের নিশ্চয়ই মনে পড়ছে ’৮৬ সালের সেই দিনটির কথা। মারাদোনা ঘরে ফেরার পর পতাকায় পতাকায় ঢেকে গিয়েছিল গোটা চত্বর। চোখের জলে ভেসেছিল অলি থেকে গলি। ৩-৩ হয়ে যাওয়ার পরও সেই বিশ্বাসটা ছিল তাঁদের। এবার মেসি একা নন, রয়েছেন এমি, দি মারিয়া, ডিবালা, দে পল, ম্যাক অ্যালিস্টার। রয়েছেন আলভারেজ, ওটামেন্ডি, এঞ্জো, পারাদেস। শেষমেশ পেনাল্টি শ্যুট আউটে মন্তিয়েলের শটের পর হারিয়ে গেল সবাই। এখনও তাদের কোনও খোঁজ নেই।

বিশ্বকাপ জিতে মেসিরা ফিরে আসার আগেই রাত জাগতে শুরু করেছেন আর্জেন্টিনীয়রা। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল একের পর এক ছবি, ভিডিও। বুয়েনস আইরেসের ওবেলিস্ক ঘিরে রাস্তার ছবি আর দেখা যাচ্ছে না। শুধু মাথা আর মাথা। উড়ে চলেছে নীল সাদা হাওয়া। গান বাজছে, গাড়ির হর্ন, ড্রাম, বাঁশি যে যা পারছে বাজাচ্ছে। প্রয়াত মারাদোনার বাড়ি অনেক আগেই নিজেদের দখলে নিয়ে নিয়েছে আর্জেন্টিনার সমর্থকরা। ফাইনাল জেতার পর সেই বাড়িতেও চলছে উল্লাস। মেসি, দি মারিয়ার জন্মস্থান রোজারিওর মানুষরা আর কিছু ভাবতেও পারছেন না। ঘরের দু'টি ছেলে এভাবে সমস্ত বাধা ভেঙে জিতে ফিরে আসবে! প্রার্থনা চলছে চার্চে। ক্রিসমাসের আগে এ যেন অকাল বোধন! বর্ষশেষের নয়, স্বপ্ন শুরুর আশা। এই দলটিকে ঘিরে স্বপ্ন দেখা যায়। ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে আলভারেজের ওই দৌড়, ওই গোল যে স্বপ্ন দেখায়। ইতিমধ্যেই আর্জেন্টিনায় ছুটি ঘোষণা হয়ে গিয়েছে। আর্জেন্টিনাও পাগল হয়ে গিয়েছে।

আরও পড়ুন : এখনও তাড়া করছে ফাইনালের রাত, জন্মদিনে এমবাপের মন একেবারেই ভালো নেই

ইতিমধ্যেই আর্জেন্টিনার মাটিতে পা পড়েছে লিওনেল মেসিদের। খোলা বাসে বিশ্বকাপ হাতে বুয়েনস আইরেস প্রদক্ষিণ করছেন সবাই। কেবলের তার তাঁদের মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। বেরোচ্ছে আলো, হাজার হাজার মানুষের আশার প্রদীপ। সবাই নাচছে, গাইছে, জড়িয়ে ধরছে একে অপরকে। দরিদ্র ঘরছাড়া মানুষটির গায়ে নীল সাদা জার্সি পরিয়ে দিলেন এক সমর্থক। আবেগে, আনন্দে, স্বপ্নপূরণের ঢেউয়ের সামনে দাঁড়িয়ে কেঁদে ফেললেন সেই অভাবী মানুষটি। আর্জেন্টিনা যেন নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছে। ৩৬ বছর আগে সেই স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন এক অতিমানব। তারপর আরেক অতিমানবের আবির্ভাব। এবার স্বপ্নপূরণ করলেন তিনি।

More Articles