মেসি বনাম ভ্যান ডিক, ভয়ংকর 'খেলা হবে', পাল্লা ভারী কোন দিকে
FIFA World Cup 2022: বিশ্বকাপে এর আগেও পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছে এই দু’টি দল। লাতিন আমেরিকা আর ইউরোপের এই যুদ্ধও হয়েছে সেয়ানে সেয়ানে।
২০১৪ সালে ঠিক যে সিটটিতে বসে বিশ্বকাপ সেমি ফাইনালের খেলা দেখেছিলেন আর্জেন্টিনার সমর্থকরা, সেই জায়গাটি ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করে রাখছেন তাঁরা। সমস্ত কাজ সামলে রাখছেন আগেভাগে। অন্যদিকে কমলা জার্সি পরে গুটি কয়েকজন ক্রুয়েফ, রবেন, ভ্যান পার্সিদের প্রার্থনায় মগ্ন। সেইসঙ্গে একটাই মন্ত্র, ২০১৪-র সেই দিনটি যেন ফিরে না আসে। যেন না আসে ১৯৭৮-এর ফাইনাল। দু'পক্ষের মুখে একটাই লব্জ - 'খেলা হবে! ভয়ংকর খেলা হবে!'
কলকাতা, ভারত তো বটেই, গোটা বিশ্ব ৯ ডিসেম্বরের রাতের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে। কাতারের মাটিতে মেসি, ভ্যান ডিকদের পাশে অদৃশ্য হয়ে লড়াইয়ে নামবেন তাঁরাও। ২০২২ বিশ্বকাপ ফুটবলের আবহাওয়া ইতিমধ্যেই টানটান উত্তেজনায় ভরা। তার মধ্যে কয়েক ঘণ্টা পেরলেই শুরু হচ্ছে কোয়ার্টার ফাইনালের প্রথম ম্যাচ। মেসির আর্জেন্টিনার মুখোমুখি নেদারল্যান্ড। নিজের শেষ বিশ্বকাপে এই বাধাও কি অনায়াসে পেরবেন লিওনেল মেসি? নাকি বুদ্ধির জোরে বাজিমাত করবেন ভার্জিল ভ্যান ডিক?
বিশ্বকাপ ফুটবল মানেই ইতিহাসের খনি। সেখানে লুকিয়ে আছে লড়াই, দুঃখ, পরাজিত সম্রাটের চোখের জল, অথবা চোট নিয়েও সমানে লড়ে যাওয়া সৈন্য – রূপকথা যেন ছত্রে ছত্রে ধরা। সেই রূপকথারই অঙ্গ হয়ে গিয়েছে আর্জেন্টিনা ও নেদারল্যান্ড। কোপা আমেরিকা জেতার পর একটি দল বিশ্বকাপ হাতে নিতে বদ্ধপরিকর। আরেকটি দল মরিয়া নিজেদের বিশ্বকাপ ভাগ্য বদলাতে। ১৯৭৪, ১৯৭৮, ২০১০ – তিন তিনটে বিশ্বকাপের ফাইনালে পৌঁছে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে ডাচদের। যোহান ক্রুয়েফ, রবিন ভ্যান পার্সি, ওয়েসলি স্নেইডার, আর্জেন রবেনের মতো ফুটবলারদের উপহার দিয়েছে নেদারল্যান্ড। কিন্তু বিশ্বকাপে তারা ‘পরাজিত সম্রাট’।
আরও পড়ুন : মেসিকে পাত্তাই দিচ্ছে না নেদারল্যান্ড! আজ হতাশ হবেন আর্জেন্টিনা ভক্তকূল?
অন্যদিকে মেসির হাত ধরে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে আর্জেন্টিনার নীল-সাদা ব্রিগেড। এই মুহূর্তে বিশ্বের তিন নম্বর দলের মূল স্তম্ভই হলেন ১০ নম্বর জার্সিধারী কিংবদন্তি। ৩৬ বছর আগে এই ১০ নম্বর জার্সি পরেই দানবিক পারফরমেন্স উপহার দিয়েছিলেন দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা নামের এক ব্যক্তি। সঙ্গে দিয়েছিলেন বিশ্বকাপ। তার আট বছর আগে মারিও কেম্পেস, ড্যানিয়েল পাসারেল্লার হাত ধরে বিশ্বকাপ এসেছিল লা আলবিসেলেস্তেদের ঘরে। এবার সেই স্বপ্ন ফের দেখতে শুরু করেছেন আর্জেন্টিনীয়রা।
বিশ্বকাপে এর আগেও পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছে এই দু’টি দল। লাতিন আমেরিকা আর ইউরোপের এই যুদ্ধও হয়েছে সেয়ানে সেয়ানে। মোলাকাত শুরু হয়েছিল ১৯৭৪ সালে, বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্যায়ের ম্যাচে। সেই ম্যাচটিতে বাজিমাত করে নেদারল্যান্ড। অবশ্য বাজিমাত বললে খানিক কমই বলা হয়। যোহান ক্রুয়েফের দৌলতে আর্জেন্টিনার ওপর দিয়ে কার্যত ঝড় বয়ে যায়। ৪-০ গোলে আর্জেন্টিনাকে পরাস্ত করে ডাচেরা। বিশ্ব ফুটবল সাক্ষী থাকে টোটাল ফুটবল নামের এক রূপকথার।
এর পরের বিশ্বকাপে ফের দু’টি দল মুখোমুখি হয়। তবে এবার আর গ্রুপ পর্যায়ে নয়, সরাসরি ফাইনালে। ১৯৭৮-এর হাই ভোল্টেজ সেই ম্যাচটি আবার হয়েছিল আর্জেন্টিনার বুয়েনস আয়রেসে। যদিও এই ম্যাচটিতে ছিলেন না যোহান ক্রুয়েফ। এই ম্যাচেই ৩-১ গোলে জিতে যায় আর্জেন্টিনা। কেবল আগের বিশ্বকাপের প্রতিশোধ নয়, বিশ্বকাপও জেতে আর্জেন্টিনা। মারিও কেম্পেস, বার্তোনির সামনে হার স্বীকার করতে হয় ডাচদের।
আরও পড়ুন : খুনোখুনি, সংঘর্ষ! বিশ্বকাপের মরশুমে যেভাবে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা শিবিরে দু’ভাগ বাংলাদেশ
১৯৯৮ বিশ্বকাপের পরিস্থিতি অনেকটা এবারের মতোই। বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল আর্জেন্টিনা ও নেদারল্যান্ড। সেখানেই ২-১ গোলে আর্জেন্টিনাকে পরাস্ত করে কমলা ব্রিগেড। এরপর ২০০৬ সালে গ্রুপ পর্যায়ের ম্যাচ ড্র হয়। ২০১৪ সালে ফের দু’টি দল মুখোমুখি হয়। এবার সেমি ফাইনালের লড়াই। দুই দলেই তারকার ছড়াছড়ি। মেসি, হিগুয়াইন, মাসচেরানোর নীল-সাদা ব্রিগেডের সামনে ভ্যান পার্সি, রবেন, টিম ক্রুলরা। হাড্ডাহাড্ডি সেই ম্যাচে গোলের মুখ দেখেনি কোনও দল। শেষমেশ পেনাল্টি শ্যুট আউটে আর্জেন্টিনার গোলরক্ষক সার্জিও রোমেরোর দৌলতে জিতে যায় আর্জেন্টিনা। কিন্তু সেই বিশ্বকাপেই ফাইনালে জার্মানির কাছে ১-০ গোলে পরাজিত হন মেসিরা। বিশ্বকাপ কাছে এসেও হাতছাড়া হয়ে যায়।
অর্থাৎ এবার ষষ্ঠবার দু’টি দল বিশ্বকাপের মঞ্চে মুখোমুখি। আর্জেন্টিনা, নেদারল্যান্ড দু’টি দলই ধারে ভারে যথেষ্ট শক্তিশালী। প্রথম ম্যাচে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে পরাজয়ের পর আর্জেন্টিনা নিজেদের গুছিয়ে নিয়েছে অনেকটা। তবে এই টিমের প্রাণভোমরা একজনই। লিওনেল মেসির দিকে এই বিশ্বকাপে সবার নজর। অস্ট্রেলিয়া ম্যাচে তাঁর পরিচিত ঝলক নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হয়েছিল। মেসি ম্যাজিকের পাশাপাশি কামাল দেখাচ্ছেন ডি মারিয়া, ডে পল, জুলিয়ান আলভারেজ, এমিলিয়ানো মার্তিনেজরা। তরুণ-নতুনের মেলবন্ধন একটু হলেও আশা জাগাচ্ছে আর্জেন্টিনাকে। কিন্তু নীল-সাদা ব্রিগেডকে চিন্তায় রেখেছে অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া ও রড্রিগো ডে পলের চোট। চোটের কারণে প্রি কোয়ার্টার ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে মাঠে নামেননি ডি মারিয়া। এই ম্যাচে নামবেন কিনা, তা নিয়ে চলছে সংশয়।
তবে আর্জেন্টিনার কোচ স্কালোনি এই দু’জনকে নিয়ে আশাবাদী। সম্প্রতি তাঁদের দলের সঙ্গে প্র্যাকটিসেও দেখা গিয়েছে। ভক্তদের আশা, হয়তো তাঁরা মাঠে নামবেন। সেইসঙ্গে তাঁদের প্রশ্ন, পাওলো ডিবালার মতো একজন খেলোয়াড়কে এখনও কেন বেঞ্চে বসিয়ে রাখা হচ্ছে? সুযোগ তৈরির পরও গোল নষ্টের ‘ট্র্যাডিশন’-এ ভুগছে আর্জেন্টিনা। সেই জায়গায় ডিবালাকে কেন খেলানো হচ্ছে না, সেই প্রশ্ন বারবার তুলছেন ফুটবল ভক্তরা।
আরও পড়ুন : ইতিহাসে বারবার পরাজিত! মেসির আর্জেন্টিনাকে কি এবার টেক্কা দেবে হল্যান্ড
অন্যদিকে এখনও অবধি এই বিশ্বকাপে অপরাজিত ডাচ ব্রিগেড। ক্যাপ্টেন ভার্জিল ভ্যান ডিকের দল মাঠে নিজের কাজ ঠিকই করে যাচ্ছেন। সেইসঙ্গে রয়েছে মাঠের বাইরে লুই ভ্যান গলের মতো কোচ। মাঠের ভেতরে রয়েছেন ভ্যান ডিক, মেম্ফিস ডিপে, কোডি গাকপো, ডে জংরা। কাউন্টার অ্যাটাকের ফুটবলে বিপক্ষকে পরাজয়ের ক্ষমতা দেখিয়ে দিয়েছে তাঁরা। ধারে ভারে আর্জেন্টিনাকে টেক্কা দেওয়ার মতো যথেষ্ট ক্ষমতাও রয়েছে ডাচদের।
মনে রাখতে হবে, এই ডাচরাই ২০১৪-র বিশ্বকাপ সেমি ফাইনালে মেসিকে আটকে দিয়েছিল। সেই ম্যাচে মেসির জাদু দেখা যায়নি। এবারও কি সেরকমই ছক নেদারল্যান্ডদের? ২০১৪-র হারের প্রতিশোধ, না নীল-সাদার দৌরাত্ম্য? লাতিন আমেরিকার শিল্প, না ইউরোপের দুর্দমনীয় ফুটবল? দুই দলের কোচই সুন্দর ফুটবল উপহার দেওয়ার কথা বলেছেন। আপাতত লুসাইল স্টেডিয়ামে বাঁশি বাজার অপেক্ষা। আর? 'খেলা হবে'।