ছবি জাল ও শিল্পীর প্রতিভা

Art Forgers: গোরিং-এর কাছে থাকা সেই অসাধারণ ছবিটি আর্ট কমিশন যখন উদ্ধার করে হাতে নিল, তখন সামনে এল চমকে যাওয়ার মতো সত্যি। ছবিটি আদৌ ভারমিরের আঁকা নয়।

ততদিনে শেষ হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। দেশ থেকে নাৎসিদের দ্বারা বেহাত হওয়া ছবিগুলি উদ্ধার করতে ততদিনে আর্ট কমিশন বসিয়েছে মিত্রশক্তি। কুখ্যাত নাৎসি হেরম্যান গোরিং ছিলেন শিল্পকলার বিশেষ ভক্ত। যে কোনও সুন্দর সৃষ্টি সহজেই মনোহরণ করত তাঁর। সেগুলি নানা উপায়ে জোগাড় করে নিজের সংগ্রহে রাখতেন তিনি। এহেন নাৎসি নেতার বাড়িতে তল্লাশি চালাতে গিয়ে উদ্ধার হল ‘ক্রাইস্ট অ্যান্ড দ্য ওম্যান’ নামক একটা ছবি। ছবিটির নীচে বিখ্যাত ডাচ শিল্পী জোনাথন ভারমিরের স্বাক্ষর। ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন শিল্প সমালোচকেরা। কী অসাধারণ তুলির টান! কী দৃপ্ত রং নির্বাচন। তাঁরা বললেন, এই ছবি মাস্টারপিস। এমন ছবি দেখতে পাওয়াও ভাগ্যের ব্যাপার!

এই প্রসঙ্গেই কিছু বছর পিছিয়ে যেতে হয়।। ১৯৩৭ সালে বিখ্যাত শিল্প সমালোচক আব্রাহাম ব্রেডিয়াসের কাছে এক উকিল গেলেন একটি ছবি দেখার প্রস্তাব নিয়ে। যিনি কিনা আসলে এক ধনী ডাচ পরিবারের ট্রাস্টি। তাঁর ক্লয়েন্টের কাছে ভারমিরের আঁকা একটি ছবি রয়েছে। সেটা যদি অনুগ্রহ করে আব্রাহাম দেখে দেন! ভারমির এবং তাঁর শিল্প আব্রাহামের বিশেষ পছন্দের বিষয়। তাছাড়া ছবির ব্যাপারে তাঁর জ্ঞান এতটাই, যে তাঁকে এই জগতের পোপ বলা হয়। আব্রাহামের বিশ্লেষণ, বিচার শিল্প জগতে চূড়ান্ত। ছবিটি দেখে স্তম্ভিত এবং মুগ্ধ শিল্পবিশেষজ্ঞ বার্লিংটন ম্যাগাজিনে লিখলেন, বিখ্যাত শিল্পীর অজানা এই ছবি দেখতে পাওয়া এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। ছবিটি এমনই যে দেখে মনে হবে কোনও রকম সংরক্ষণ ছাড়াই সেটি চমৎকার রয়ে গিয়েছে। হঠাৎ দেখলে মনে হবে যেন এইমাত্র শিল্পী সেটা শেষ করলেন। শিল্পীর স্বাক্ষর থেকে ছবির টান সবটাই অসম্ভব শৈল্পিক। তিনি বললেন, ভারমিরের বাকি ছবিগুলির থেকে এই ছবিটি আলাদা। কিন্তু প্রতিটি ইঞ্চিতে এটি ভারমিরের-ই ছবি। কয়েকজন বিষয়টি নিয়ে খানিক সন্দেহপ্রকাশ করেছিলেন, কিন্ত ওই যে, আব্রাহামের কথাই ছবির জগতে শেষ কথা।

আরও পড়ুন: শিল্পসম্মত নয়, ‘বিচ্ছিরি’ ছবিকেই বিশ্বের সামনে তুলে ধরে ‘মিউজিয়াম ফর ব্যাড আর্টস’

গোরিং-এর কাছে থাকা সেই অসাধারণ ছবিটি আর্ট কমিশন যখন উদ্ধার করে হাতে নিল, তখন সামনে এল চমকে যাওয়ার মতো সত্যি। ছবিটি আদৌ ভারমিরের আঁকা নয়। নিখুঁত দক্ষতায় ডাচ শিল্পীর নকল করা ছবিটি এঁকেছেন হ্যান ভ্যান মিগেরেন নামে এক ব্যক্তি। কে ছিলেন এই মিগেরেন? এক অনামী ডাচ শিল্পী, যিনি তাঁর নিজের আঁকার স্বীকৃতি কোনওদিন পাননি। অথচ প্রতিভার অভাব ছিল না তাঁর। কিন্ত বারবার শিল্প বোদ্ধারা প্রত্যাখ্যান করেছেন তাঁর শৈলীকে। বেপরোয়া মিগেরেন শেষমেশ ঠিক করলেন, সপ্তদশ শতকের বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা নকল করে নজর কাড়বেন তিনি। কিন্ত নতুন আঁকা ছবি আর পুরনো ছবির মধ্যে তো সহজেই ফারাক করে ফেলবে বিশেষজ্ঞদের চোখ। কী করা যায়? ৬ বছর ধরে নানা রকম চেষ্টা-চরিত্রের পর এক অভিনব পন্থা নিলেন মিগেরেন। ছবি আঁকার মাধ্যম হিসাবে তেলের বদলে নিলেন ঘন চিটচিটে গাছের রস যা বার্নিশ তৈরিতে ব্যবহার হয়। ছবি আঁকা শেষ হওয়ার পর সেটিকে দিয়ে দিলেন ওভেনে। এর ফলে ক্যানভাসের মধ্যে সূক্ষ ফাটলের মতো দাগ চলে এল, যেগুলি পুরনো তৈলচিত্রে দেখা যায়।

গোরিংকে ছবি বিক্রয়ের সূত্র ধরে ক্রমে উঠে এল মিগেরেনের নাম। এবং স্বাভাবিক ভাবেই নাৎসিদের সহযোগী হওয়ার অপরাধে শুরু হল তাঁর বিচার। জানা গেল ভারমির তো বটেই, আরও বেশ কিছু শিল্পীর ছবি নকল করেছেন তিনি। তাঁর আঁকা বহু জাল ছবি বিভিন্ন আর্ট গ্যালারি থেকে শুরু করে বহু মানুষের ব্যক্তিগত সংগ্রহে রয়েছে। দুই বছর ধরে চলা বিচারে মিগেরেন স্বপক্ষে বললেন, তাঁকে নাৎসিদের সহযোগী তো নয়ই বরং নায়ক হিসাবে ভাবা হোক। কারণ নাৎসিদের জাল ছবি বিক্রি করে তিনি বহু আসল ছবি বাঁচিয়ে দিয়েছেন। ভারমিরের অনুকরণে আঁকা ‘ক্রাইস্ট উইথ দ্য ওম্যান টেকেন ইন অ্যাডালটারি’ তিনি গোরিংয়ের চুরি করা ১৫০টি ছবির বিনিময়ে বেচেছেন।

এই ঘটনা নিয়েই পরবর্তী কালে ব্রুস গ্রাহামের নাটক ‘দ্য ক্রাফটস ম্যান’ মঞ্চস্থ হয়। সেখানে দেখানো হয় ছবি জালের নানা দিক। ঠিক কী কী কারণে ছবি জাল করা হয়? প্রাথমিক উত্তর অবশ্যই টাকা। কিন্তু সেখানে শিল্পী থেকে যায় অন্তরালে। যত দক্ষই হোন না কেন, তিনি শেষমেশ একা, আলোকহীন। এই কারণেই সম্ভবত অন্যের ছবি জাল করে নিজে আঁকেন যাঁরা, তাঁদের অবদমিত ইচ্ছা থেকে যায় ধরা পড়ার। মনস্তত্ব বলছে, শেষ পর্যন্ত কোথাও একটা গিয়ে তাঁরা চান, তাঁদের নাম লোকে জানুক। তাঁদের দক্ষতা স্বীকৃতি পাক। মিগেরেনের নকল এক ধরনের চ্যালেঞ্জ ছিল শিল্পী সমাজের প্রতি। যাঁরা কোনওদিন তাঁর প্রতিভাকে স্বীকার করেনি। তবে জার্মান প্রতারক উলফগ্যাং বেলত্রাচি প্রায় ৩০০ ছবি জাল করেছিলেন অর্থলোভেই। তাঁর লাভ হয়েছিল ৮৫ কোটি টাকার কাছাকাছি। পিরিয়ড ছবিগুলি যাতে যথাযথ মনে হয় সে দিকে তীক্ষ্ণ নজর ছিল তাঁর। ফ্রেম বাজার থেকে কিনে তিনি ইচ্ছা করে ধুলো ঢুকিয়ে দিতেন তাতে। যাতে ছবিটি পুরনো মনে হয়। শেষে ছবিতে টাইটেনিয়াম হোয়াইট অক্সাইড ব্যবহার করতে গিয়ে ধরা পড়ে যান উলফগ্যাং। শিল্পী টম কেটিং কিন্তু তাঁর প্রতারণাকে ‘টাইম বম্ব’ বলতেন। তিনি ইচ্ছা করে ছবিতে এমন সব মাধ্যম ব্যবহার করতেন, যাতে একটু চেষ্টা করলেই ছবিটি যে জাল ধরা যাবে। নিজেকে বিখ্যাত অথবা কুখ্যাত করার এর চেয়ে সহজ উপায় জানা ছিল না তাঁর। প্রতারক মার্ক ল্যান্ডিস আবার ছবির মাধ্যম বা বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে আদপেই চিন্তিত ছিলেন না। ছবি নকল করে টাকা রোজগার করার কথাও কখনও ভাবেননি তিনি। তাঁর আনন্দ ছিল ক্রেতা এবং আর্ট গ্যালারির লোকজনকে বোকা বানানোয়। লোক ঠকিয়ে উত্তেজনা বোধ করতেন মার্ক। বুদাপেস্টের শিল্পী অ্যালমের ডি হোরির কাহিনি আবার অনেকটাই আলাদা। নিজের আঁকা ছবি বিক্রি করতে ব্যর্থ হয়ে তিনি ছবি জাল করার সিদ্ধান্ত নেন। পিকাসো, মেটিস এবং মোদিলিয়ানির ছবি নকল করতে শুরু করেন তিনি। সেই সঙ্গে নিজেকে আমেরিকান কূটনীতিবিদের ছেলে হিসেবেও দাবি করেন, সমাজের উঁচু মহলে যাঁর নাকি অবাধ যাতায়াত। এরপর এক আর্ট ডিলারের সঙ্গে যৌথভাবে নকল ছবির ব্যবসা ফাঁদেন তিনি। যতদিনে সেই আর্ট ডিলার ধরা পড়ে, ততদিনে মিউজিয়াম থেকে ব্যক্তিগত সংগ্রহ— সর্বত্র ছড়িয়ে গিয়েছে নকল ছবি।

এদেশেও জাল ছবির বাজার চলছে রমরমিয়ে। বছর কয়েক আগে অভিযোগ ওঠে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার পুনিত ভাটিয়াকে জাল ছবি বিক্রি করা হয়েছে ১৭ কোটি টাকার বিনিময়ে। ২০০৯ সালে শিল্পী এস রাজা নিজের ছবির প্রদর্শনী দেখতে দিল্লির ধুমিমাল আর্ট গ্যালারিতে গিয়ে আবিষ্কার করেন সেখানে প্রদর্শিত অধিকাংশ ছবিই জাল। ২০০৮-এ মুম্বাইয়ের এক আর্ট গ্যালারির মালিক সুবোধ গুপ্তর জাল ছবি বিক্রি করতে গিয়ে ধরা পড়েন। এর কয়েক বছর আগেই অঞ্জলি ইলা মেননের নকল ছবি বিক্রির অভিযোগ ওঠে দক্ষিণ মুম্বইয়ের এক গ্যালারির বিরুদ্ধে। মুম্বইয়ের এক শিল্প বিনিয়োগ সংস্থার কর্তৃপক্ষ মনে করেন, যত জাল ছবি বিক্রির ঘটনা নজরে আসে, তার থেকে অনেক বেশি অন্তরালে থেকে যায়। কারণ প্রতারিতরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয় বোঝেন না যে তাঁরা ঠকে গিয়েছেন, নয়তো লজ্জায় অভিযোগ দায়ের করেন না। এমনকি মিউজিয়াম বা আর্ট গ্যালারিগুলিও সুনাম নষ্ট হওয়ার ভয়ে স্বীকার করতে চায় না যে তারা ঠকে গিয়েছে। নেদারল্যান্ডের বয়েমানস ভ্যান মিউজিয়াম প্রথমে জানাতে চায়নি যে তাদের কাছে ভারমির নয়, মিগেরেনের আঁকা নকল ‘সাপার অ্যাট ইম্যায়ুস’ আছে। মিগেরেন নিজে স্বীকার করার পরই ঘটনাটি সামনে আসে।

আরও পড়ুন: দিনের আলোয় শিল্প ‘চুরি’! যেসব প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে দেবজ্যোতি মিশ্রের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ

শিল্প সমালোচকেরা বলছেন ,দেশের মধ্যে জাল ছবির বাজার সবথেকে ভাল কলকাতায়। যামিনী রায় সম্ভবত সর্বাধিক জাল হয় এখনও। এখানে চোরাবাজারে বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি এমন ক্যানভাস পাওয়া যায় যে যাতে নির্দিষ্ট মাধ্যম ব্যবহার করে ছবি আঁকলে বোঝার উপায় থাকবে না ছবিটি কত পুরনো। অতএব শুধুমাত্র আর্ট গ্যালারির ওপর ভরসা না করে ক্রেতাদের উচিত বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলা। সেই সঙ্গে শিল্প জগতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, নিয়মিত গ্যালারিতে গিয়ে ছবি দেখার চোখ তৈরি করাও দরকার। যাতে ছবি জাল হলে তাঁরা নিজেরাও তা খানিকটা আন্দাজ করতে পারেন। এছাড়াও ছবির ‘প্রোভেনানস চেক’ করা যায় যাতে আঁকা শুরুর থেকে ডিলারের হাতে ছবি আসা পর্যন্ত সবটার সময়কালই জানা যায় । এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন শিল্প সংরক্ষণ সংস্থা, তাঁদেরকে দিয়ে কেনার আগে ছবি পরীক্ষা করে নেওয়া যায়।

More Articles