শিল্পসম্মত নয়, 'বিচ্ছিরি' ছবিকেই বিশ্বের সামনে তুলে ধরে 'মিউজিয়াম ফর ব্যাড আর্টস'

Museum Of Bad Art: ত্যি বলতে যেসব ছবি একেবারেই পাতে দেওয়া যায় না, তেমনই বেশ কয়েকটি ছবি নিয়ে শুরু হয় MOBA-র পথ চলা। সেখান থেকে শুরু করে আজ হাজারটির কাছাকাছি ছবি রয়েছে ওই সংগ্রহশালায়।

মহাকবি কিটস বলেছিলেন, 'truth is beauty beauty is truth'। অর্থাৎ কিনা সুন্দরই সত্য। শুধু পাশ্চাত্যেই নয়, 'সত্য শিব সুন্দর'-এর ধারণা রয়েছে প্রাচ্যেও। কিন্তু এই ধারণার গোটাটা আমরা গ্রহণ করি না বাস্তবিক জীবনে। বরং আংশিক সত্যটাকে নিয়েই মেতে থাকি। সত্য সুন্দর হোক ছাই না-হোক, সুন্দরকেই সত্য বলে ধরে নিই আমরা। তাই জন্য সমাজের দেগে দেওয়া মানদণ্ডে নিজেকে আঁটানোর অহরহ চেষ্টা করে চলি। সেই হিসেবেই দেখি পৃথিবীকেও। যে সেই ধরা গতে খাপ খায় না, তাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা কৌতুক করি, কিংবা বুলি করি নির্দ্বিধায়।

কিন্তু সৌন্দর্যের যে উল্টোপিঠ, তা আসলে যে অসুন্দর বা কুৎসিত নয়। তা আসলে সত্য, সে কথা বেমালুম ভুলে যাই আমরা। শুধু মানুষকে দেখার মানদণ্ড নয়, শিল্পকেও সুন্দর হিসেবে দেখার চেষ্টা চলেছে যুগে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আন্দোলেন মাধ্যমে সেই মিথ ভাঙার চেষ্টা চলেছে। কিউবিজম, ডাডাইজম পেরিয়ে শিল্পে এসেছে অ্যাবস্ট্রাক্টের ধারণা। তবে মার্কিন এই রাজ্যে ভেঙে গিয়েছে তা-ও। ম্যাসাচুসেটসের সামারভিল শহর খুলে ফেলেছে এক আশ্চর্য মিউজিয়াম।

আরও পড়ুন: প‍্যারিসের মিউজিয়াম থেকে চুরি গেল মোনালিসা ছবি

মিউজিয়াম শব্দের অর্থ যেমন সংগ্রহশালা, তেমন অন্য একটি অর্থ যাদুঘরও। ম্যাসাচুসেটসের এই সংগ্রহশালা আক্ষরিক অর্থেই যাদুঘর। সত্যিই ম্যাজিক হয়ে যায় এই মিউজিয়ামে ঢুকলেই। কারণ যা কিছু শিল্পসম্মত, তার ঠাঁই হয়না এই মিউজিয়ামে। বরং যেসব ছবিকে কিছুতেই আঁকা বলা যায় না। যাকে কুৎসিত কিংবা বাজে ছবি বলতে দ্বিধা হবে না আপনারও, সেই ছবিকেই স্থান দেওয়া হয়েছে ম্য়াসাচুসেটসের এই MOBA-তে। MOBA অর্থাৎ 'মিউজিয়াম অব ব্যাড আর্ট'। বাজে-কে বাজে বলে স্বীকার করে নিয়ে তাকে স্বীকৃতি দেওয়া। এই উদ্দেশ্য নিয়েই রমরমিয়ে চলছে সামারভিলের এই মিউজিয়াম অব ব্যাড আর্ট।

ছোটবেলায় খাতায় রং-পেনসিল বুলিয়ে আজেবাজে ছবি আমরা সবাই এঁকেছি। আলগা হাতের তেমন কত ছবি দেখেই তো পিঠ চাপড়ে দিয়েছে বড়রা। কেউ কেউ আবার সন্তানের আলুথালু হাতে আঁকা সেই ছবি যত্ন করে তুলেও রেখেছেন স্মৃতি হিসেবে। আসলে পেন্টিং তো শুধুই আর্ট নয়। শিল্পীর সেই সময়ের মনের প্রতিফলন। তাকে শুধু আর্টের মানদণ্ডে মাপলেই বা চলবে কেন? এমনই একটা ধারণা থেকে শুরু হয়েছিল এই সংগ্রহশালা।
বেসরকারি এই মিউজিয়ামটির পথচলা শুরু হয় ১৯৯৪ সালে স্কট উইলসন নামে এক ব্যক্তির হাত ধরে। প্রাথমিক ভাবে তিনি ছিলেন অ্যান্টিক জিনিসপত্র বিক্রেতা। প্রথমে অবশ্য ম্যাসাচুসেটসের দেড়হাম শহরে তৈরি করা হয়েছিল সংগ্রহশালাটি। পরে সেখান থেকে সামারভিল শহরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় সেটিকে। মিউজিয়ামটি শুরু করার প্রাথমিক উদ্দেশ্যই ছিল, শিল্পীর পরিশ্রমকে স্বীকৃতি দেওয়া। যাঁদের আঁকা তথাকথিত 'সমঝদার মহলে' বা অন্য কোনও ফোরামে সমাদৃত হয় না, তাদের জন্য একটা আলাদা মঞ্চ তৈরি করে দেওয়া। বন্ধুদের ফেলে দেওয়া ছবির মধ্য থেকে প্রাথমিক ভাবে বেশ কয়েকটি ছবি বেছে নিয়েছিলেন স্কট। সত্যি বলতে যেসব ছবি একেবারেই পাতে দেওয়া যায় না, তেমনই বেশ কয়েকটি ছবি নিয়ে শুরু হয় MOBA-র পথ চলা। সেখান থেকে শুরু করে আজ হাজারটির কাছাকাছি ছবি রয়েছে ওই সংগ্রহশালায়। তবে দর্শকদের জন্য গ্যালারিতে সাজানো হয় মেরেকেটে কুড়ি থেকে পঁচিশটি ছবি। থাকে বিশ্রী দেখতে স্থাপত্যও।

 

স্কটের এই পাগলামীতে জুটে যান তাঁর বন্ধু জেরি রেইলি। হয়ে উঠলেন MOBA-র কো-ফাউন্ডার। তিনি মনে করেন, দেশ জুড়ে নানান শ্রেষ্ঠ কাজের, শ্রেষ্ঠ শিল্পের সংগ্রহশালার কোনও অভাব নেই। তবে খারাপ ছবির মিউজিয়াম, এমন আশ্চর্য ভাবনা তাঁদের আগে কেউ ভেবেছেন বলে মনে হয়না। সমাজের ঠিক করে দেওয়া ধারনাকে ভেঙে উল্টোপথে হাঁটার কাজটা তাই বেশ মজাদার ছিল দু'জনের জন্যই। তবে এই সংগ্রহশালায় যে কোনও বাজে ছবিকেই যে জায়গা দিয়ে দেওয়া হয়, তা কিন্তু নয়। বরং এই মিউজিয়ামে জায়গা পেতে হলে বেশ কয়েকটি শর্তপূরণ করতে হবে ছবিটিকে। প্রথমত, শিল্পকর্মটিকে হতে হবে একেবারে মৌলিক। তাই বলে যে কেউ যেমন খুশি এঁকে দিলেও কিন্তু চলবে না মোটেই। শিশুদের কচি হাতের জগাখিচুড়ি আঁকা হলেও তা বাতিল। বরং আপনার শিল্পকর্মটিকে হতে হবে আন্তরিক ভাবে খারাপ। মানে বাজে ছবিকে মন থেকে বাজে আঁকতে পারলে ঠাঁই নেই এই মিউজিয়ামে। সুন্দর জিনিস আমাদের চোখে লেগে থাকে। সুন্দরের উল্টোপিঠের সেই খারাপ জিনিসটিকেও হতে হবে এতটাই খারাপ, যে তা যেন দর্শকের চোখে লেগে থাকে।

সামারভিলের ওই মিউজিয়ামের ছবিগুলি দেখলেই তার প্রমাণ পাবেন। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আঁকা মোনালিসার সৌন্দর্যের কোনও তুলনা হয় না। কিন্তু সৌর্ন্দযের উল্টোপিঠে থাকা মোনালিসা কেমন? তাঁর দেখা মিলবে এই মিউজিয়ামে। ঠিক যেমন করে বড় বড় আর্ট মিউজিয়ামে বিভিন্ন নামে পরিচয় করানো হয় ছবিগুলিকে, তার ব্যতিক্রম নেই এখানেও। 'ফ্রিডম বিচ', 'হান্টিং ডগ', 'ব্লু ট্যাঙ্গো'-র মতো একাধিক 'খারাপ' ছবিতে ঠাসা এই মিউজিয়াম। সেইসব খারাপ ছবি যে কতটা খারাপ, তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।

আরও পড়ুন: বীভৎসতাকে এভাবেও আঁকা যায়! কেন আজও যুদ্ধবিরোধী সেরা শিল্প পিকাসোর ‘গুয়ের্নিকা’

শিল্প বলতে সাধারণ লোকে যা বোঝে, তেমন বেশ কিছু মিউজিয়ামই রয়েছে ম্যাসাচুসেটসে। তবে সেখানকার প্রধান আকর্ষণ কিন্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে এই MOBA। যা স্রোতের বিপরীত, যার দেখা মিলবে না কোথাও, তা দেখতেই ভিড় জমান পর্যটকেরা। কীসের টানে আসেন তাঁরা? অসুন্দরের খোঁজে? না, বরং তাঁরা আসেন ব্যতিক্রমের খোঁজে। যা বাধা গতের বাইরে গিয়ে সত্য কথা বলে। শিল্পীর মনের ভিতরের যে অংশটি বাস্তবের ধুলো লেগে একেবারে বানানো, সাজিয়ে তোলা হয়ে যায়নি, সেই সত্যের খোঁজে মিউজিয়াম অব ব্যাড আর্টস-এ ঘুরতে আসেন মানুষ।

More Articles