জোর দিতেন গবেষণায়, বাংলা পড়ারও সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিলেন বাংলার বাঘ
সাক্ষর সেনগুপ্ত: সেনেটের কনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে ১৮৯১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারকে চিঠিতে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন— এম এ স্তর পর্যন্ত দেশীয় ভাষার ব্যবহার শুরু হোক। সভায় সেই প্রস্তাব নিয়ে ভোটাভুটি হল, ১১-১৭ ভোটে হেরে প্রস্তাব বাতিল হল! কিন্তু তাঁর প্রস্তাব অনুযায়ী বাংলা ভাষা শুরুর পক্ষে মত দিয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, আনন্দমোহন বসু। অনেক পরে নিজে উপাচার্য হয়ে ব্রাত্য বাংলা ভাষাকে যোগ্য মর্যাদায় বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে এনেছিলেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। দীনেশচন্দ্র সিংহের বর্ণনায়, রবীন্দ্রনাথের নোবেল পাওয়ার প্রাক্কালে ম্যাট্রিকের সিলেবাসে বাংলা বলতে ছিল ‘বেঙ্গলি কম্পোজ়িশন’, কোনওমতে খানিকটা ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদ আর সাধু-চলিত, চলিত-সাধু রূপান্তর, ব্যাকরণের টুকিটাকি। বি এ ক্লাসেও ‘কম্পোজ়িশন’ ছিল, কিন্তু তাতে পড়ুয়ারা পাশ করুক কি ফেল, রেজ়াল্টে কোনও সমস্যা হত না। এই জায়গা থেকে আশুতোষ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা পড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ছেলে শ্যামাপ্রসাদ ইংরেজিতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট, বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় এম এ চালু হলে আশুতোষ তাঁকে বাংলার ছাত্র করে ক্লাসে পাঠিয়েছিলেন!
১৮৮৫ সালে গণিতে, পরের বছর পদার্থবিদ্যায় এম এ হলেন। এরকম মেধাবী ছাত্রের আগাগোড়া ভাল ফল দেখে শিক্ষা বিভাগের তৎকালীন ব্রিটিশ অধিকর্তা আশুতোষকে প্রেসিডেন্সি কলেজে চাকরির প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আর আশুতোষ বললেন, ‘চাকরি করতে পারি, তবে আমার পদমর্যাদা ও বেতন ইত্যাদি সাহেব শিক্ষকদের সমান হতে হবে, প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে আমাকে অন্য কোথাও বদলি করা যাবে না, আর সবচেয়ে বড় কথা, গবেষণার সুযোগ ও পরিকাঠামো দিতে হবে।’ তরুণের কথা শুনে অধিকর্তা তো হতভম্ব! তদানীন্তন উপাচার্যও ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ!’ আশুতোষ জানালেন— ‘আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেটের সদস্য করে নিন।’ একুশ বছর বয়সের একটা ছেলে ঢুকতে চায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেটে, যেখানকার সব সদস্যই কি না আদতে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক নিযুক্ত বা অনুমোদিত। আর তার মধ্যে সেনেট সদস্য হয়েই ছাড়লেন আশুতোষ। পঁচিশ বছর বয়স তখন! তারও পর আছে। আইন পড়লেন, ১৮৮৮ সালে, কলকাতা হাইকোর্টের উকিল হলেন, আর তারই বিচারপতি হলেন যখন, তখন তাঁর বয়স চল্লিশ। আর সেই তিনিই ১৯২৩-এ যখন অবসর নিচ্ছেন, বিচারপতি হিসাবে রায়ের সংখ্যা দু’হাজারের বেশি।
১৯০৬-এ তাঁকে যখন উপাচার্য করা হল তখন বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। লর্ড কার্জ়নের ইউনিভার্সিটি কমিশন আর ইউনিভার্সিটি অ্যাক্টের তীব্র প্রতিক্রিয়া বাংলার বিশিষ্ট জনেদের মধ্যে। জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হয়েছে, ব্রিটিশ বিরোধিতা তুঙ্গে। বাংলার প্রায় সমস্ত গণ্যমান্য ব্যক্তিত্ব কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে আক্রমণ করে বলছেন ‘গোলদিঘির গোলামখানা’, ব্রিটিশদের চাকর তৈরির জায়গা। এই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভার হাতে নেওয়া মানে তো অগ্নিপরীক্ষা! ঘরের লোক আর পরের লোক— দুয়েরই চক্ষুশূল হওয়া সময়ের অপেক্ষা মাত্র। কিন্তু তিনি আশুতোষ মুখোপাধ্যায়! উপাচার্য হয়ে শুধু নিয়ন্ত্রণ হাতে নিলেন না, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পঠ নিয়মিত ক্লাস, পড়াশোন পঠনপাঠনের আবহেও আপাদমস্তক বদল আনলেন। পরীক্ষার ব্যবস্থা করলেন। যে প্রতিষ্ঠান ছিল শুধু ইস্কুল-কলেজের পরীক্ষার ভারবাহী কেজো যন্ত্র, তাকে উচ্চশিক্ষা আর গবেষণা চর্চায় অনেক বেশি উপযোগী হয়ে ওঠার ব্যবস্থা করলেন।
কোনও সংস্কার মানে তো কারণ ছাড়া দেওয়া নয়। একটু ভাঙা তো অনেকটা গড়া। উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা দুটোতেই অর্থের প্রয়োজন। তারকনাথ পালিত, রাসবিহারী ঘোষ-সহ বহু বিদ্যোৎসাহী ও অর্থবান মানুষের থেকে দান-অনুদান জোগাড় করলেন আশুতোষ। পাঠ্যসূচি সংস্কার করলেন, স্নাতকোত্তরে খুললেন নতুন নতুন বিষয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব, ফলিত রসায়ন, প্রাচীন ভারত ও ইসলামিক ইতিহাস ও সংস্কৃতির মতো বিষয়ের শুরু তাঁর চেষ্টাতেই। শুধু তো নতুন বিভাগ খুললেই হল না, উপযুক্ত শিক্ষকও চাই। পদার্থবিদ্যায় সি ভি রমন, রসায়নে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়কে নিয়ে এলেন পড়াতে। গণেশ প্রসাদ, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, হাসান সুরাবর্দি... কে না ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে? সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে এম এ পাশ করার পরেই এম এ ক্লাসে পড়ানোর ভার দিয়েছেন। দর্শনের চেয়ার-অধ্যাপক করে বসিয়ে দিয়েছেন এক দক্ষিণী তরুণকে— নাম সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণণ! অক্সফোর্ডের অধ্যাপক পল ভিনোগ্রাডফ, বন ইউনিভার্সিটির সংস্কৃতের প্রফেসর হার্মান জেকবি, বিখ্যাত ফরাসি অধ্যাপক সিলভাঁ লেভি— সবাই এসেছেন আশুতোষের ডাকে সাড়া দিয়ে। সাধে কি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের আত্মশ্রদ্ধার প্রবর্তন হয়েছে এইখানেই’!
সেনেট হলে আইনের ছাত্রদের পরীক্ষা, ও দিকে কলকাতা অশান্ত অসহযোগ আন্দোলনে। সুকুমার সেনের স্মৃতিচারণায় আছে, আশুতোষ পরীক্ষার্থীদের বাড়ি যেতে দিলেন না। রেখে দিলেন হার্ডিঞ্জ হস্টেলে, পাছে ঘরে ফিরলে রাজনৈতিক নেতারা তাদের পরীক্ষা দিতে না দেন! আবার এই ব্রিটিশ সরকারই যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্বশাসিত সংস্থার উপরে ছড়ি ঘোরাতে শুরু করল, আশুতোষ তীব্র ভাষায় তার সমালোচনা করেছেন। সব থেকে বেশি গুরুত্ব দিতেন গবেষণাকে। প্রেসিডেন্সি কলেজের লাইব্রেরিতে বিখ্যাত সব গণিত বিষয়ক গবেষণা পত্রিকা আসত, পড়তেন মন দিয়ে। এম এ পাশের আগেই তাঁর তিনটে পেপার প্রকাশিত। ১৮৮৪-১৯০০, এই ক’বছরের মধ্যে তিনি লন্ডন ম্যাথমেটিক্যাল সোসাইটি, রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি, এডিনবরা রয়্যাল সোসাইটি, লন্ডন ফিজ়িক্যাল সোসাইটি, প্যারিস ম্যাথমেটিক্যাল সোসাইটি, রয়্যাল আইরিশ অ্যাকাডেমি, আমেরিকান ম্যাথমেটিক্যাল সোসাইটির সভ্য! প্রচুর লিখেছেন এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল জার্নালে। মহেন্দ্রলাল সরকারের ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’-এ সাম্মানিক অধ্যাপক পদেও ছিলেন।
১৯০৮-এ তৈরি করেন ক্যালকাটা ম্যাথমেটিক্যাল সোসাইটি। ওই সোসাইটির জার্নালেই পরে বেরিয়েছিল সি ভি রমন, মেঘনাদ সাহার গবেষণাপত্র! সি ভি রমন আক্ষেপ করেছিলেন, বাংলা আইনজীবী ও বিচারক আশুতোষকে পেয়েছে বটে, কিন্তু হারিয়েছে এক গণিত-নক্ষত্রকে! শুধু গণিত নিয়ে থাকলেই মানুষটা হইচই ফেলে দিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পিছনে লেগে থাকতেন, যাতে তাঁরা গবেষণায় মন দেন। ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র সম্পাদনার কাজ দীনেশ সেন করেছেন তাঁরই প্রেরণায়। রমেশচন্দ্র মজুমদার আত্মকথায় লিখেছেন, গবেষণা করতেন যে শিক্ষকেরা, আশুতোষ তাঁদের ক্লাস কমিয়ে দিতেন। শিক্ষকদের রক্ষাও করতেন ঈর্ষাপরায়ণ সহকর্মীদের কাছ থেকে। এক বার মর্নিং ওয়াকে দেখা হলে আশুতোষ তরুণ রমেশচন্দ্রকে বলেন, ‘তোমার চাকুরি হওয়াতে বুড়োরা খুব চটেছে।’ ‘বুড়ো’দের বলা কথা যে তিনি বিশ্বাস করেননি, জানিয়ে তাঁকে বলেছেন, ‘খুব সাবধানে এদের সঙ্গে চলবে।’ ১৯০৮ সালেই ইউনিভার্সিটি ল কলেজ, দু’বছর পরে রাজাবাজারে সায়েন্স কলেজের দুয়ার খুলে গিয়েছিল, যুক্ত হয়েছিল একের পর এক, সৌজন্য বাংলার বাঘ স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়।
তথ্যসূত্র:
- স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, জীবন ও সমকাল - সম্পাদনা, ড: রীনা ভাদুড়ী
- আনন্দবাজার পত্রিকা - 02.03.2019