বাংলা ভুলেছে তাঁকে, অথচ তিনি না থাকলে তৈরিই হতো না পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্র!
Atul Chandra Gupta: ১৯৪৭ সালের ২০ জুন ভোটগ্রহণের মাধ্যমে বাংলা ভাগ সুনিশ্চিত হওয়ার পর সব থেকে দুরূহ কাজ ছিল সীমানা কমিশনে দুই বাংলার সীমানা নির্ধারণ করা।
"বঙ্গ বিভাগ লইয়া আর মাথা ঘামাইয়া লাভ কী? লীগ বরঞ্চ সমগ্র বাংলায় নিরঙ্কুশভাবে রাজত্ব করিতে থাকুক।"
স্বাধীনতার ৭৫ বছর অতিক্রান্ত। স্বাধীনতা সংগ্রামী আমাদের পূর্বজদের ত্যাগ নতুন প্রজন্মকে স্বাধীন ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে শ্বাস নেওয়ার অধিকার দিয়েছে। কিন্তু আত্মবিস্মৃত সকলেই। নতুন প্রজন্মকে যদি প্রশ্ন করা হয়, উপরিউক্ত কথাগুলি কে কোন পরিপ্রেক্ষিতে বলেছিলেন, তাহলে হয়তো শতকরা আশি শতাংশের অধিক ব্যক্তিই নিজেদের অপারগতাই ব্যক্ত করবেন। এটি আমাদেরই ব্যর্থতা যে আমরা বাংলা সীমানা কমিশনে পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে ব্রিফ তৈরি করা এবং কংগ্রেস ও নিউ বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশনের তরফে সওয়াল করা অতুল চন্দ্র গুপ্তকে ভুলে গিয়েছি। গত ১২ মার্চ নীরবেই পেরিয়ে গিয়েছে অতুল চন্দ্রের জন্মদিন।
১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ মার্চ অবিভক্ত বাংলার টাঙ্গাইল জেলায় জন্মগ্রহণ করেন অতুল গুপ্ত। বাবা উমেশ চন্দ্র গুপ্ত ছিলেন পেশায় আইনজীবী। বাবার কর্মসূত্রে তাঁর বাল্যজীবন অতিবাহিত হয় রংপুরে। রংপুর জিলা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করার পর উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি চলে আসেন কলকাতায়। ১৯০৪ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজি ও দর্শনে স্নাতক হওয়ার পর ১৯০৬ সালে দর্শনে স্নাতকোত্তর ও ১৯০৭ সালে বিএল ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯১৪ সালে কলকাতা হাইকোর্টে প্র্যাকটিস শুরু করার আগে কিছুদিন তিনি রংপুর ন্যাশনাল স্কুলে শিক্ষকতাও করেছিলেন। এছাড়া ১৯১৮ থেকে ১৯২৮ পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রোমান ল ও ব্যবহারশাস্ত্রের অধ্যাপনাও করেছেন। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী অতুল গুপ্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে প্রদেয় 'অনাথনাথ দেব পুরস্কারও অর্জন করেছিলেন ১৯১৮ সালে লেখা তাঁর থিসিস 'ট্রেডিং উইথ দ্য এনিমি'র জন্য। আইনচর্চার পাশাপাশি সাহিত্য চর্চাতেও যে সমান দক্ষ অতুল গুপ্ত, তার প্রমাণ শিক্ষা ও সভ্যতা, কাব্যজিজ্ঞাসা,ইতিহাসের মুক্তির মতো রচনাগুলিই। তবে পশ্চিমবঙ্গের সীমানা নির্ধারণে তাঁর অবদানের জন্যই বাঙালির তাঁকে সবচেয়ে বেশি মনে রাখার কথা।
আরও পড়ুন- বিপ্লবী অজয় মুখোপাধ্যায়কে বাঙালি ভুলে গেল অথবা ভুলিয়ে দেওয়া হল
১৯৪৭ সালের ২০ জুন ভোটগ্রহণের মাধ্যমে বাংলা ভাগ সুনিশ্চিত হওয়ার পর সব থেকে দুরূহ কাজ ছিল সীমানা কমিশনে দুই বাংলার সীমানা নির্ধারণ করা।মনে রাখতে হবে, তার কয়েকমাস আগেই নস্যাৎ হয়েছে শহিদ সুরাবর্দি সাহেবের সাধের 'অখণ্ড বাংলার' স্বপ্ন। জোর গলায় মুসলিম প্রধান এলাকা নিয়ে পৃথক রাষ্ট্র গঠনের কথা বললেও মুসলিম লীগ নেতারা খুব ভালো করেই জানতেন দেশের পূর্ব দিকের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ শহর, ভারতের পূর্বতন রাজধানী কলকাতা সহ বিস্তীর্ণ সমৃদ্ধশালী অ-মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা ভারত থেকে কেড়ে নেওয়া যাবে না। আবার মুসলিম লীগের উর্দুভাষী পশ্চিমের নেতারা কলকাতা ব্যতীত বাংলা নিয়ে খুব একটা আগ্রহীও ছিলেন না। এমতাবস্থায় তৎকালীন বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহিদ সুরাবর্দি সার্বভৌম বাংলার নামে এক প্রস্তাব পেশ করলেন। সেই প্রস্তাব অনুযায়ী বাংলা ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হতো না ঠিকই কিন্তু পূর্ব বাংলার বদলে পুরো বাংলা প্রদেশই ভারতবর্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। বাঙালির ভারত ভেঙে বেরিয়ে যাওয়ার বিষয়টিকে সুনজরে দেখেননি মানুষই। এই প্রস্তাব জনসমক্ষে আসতেই প্রতিবাদে গর্জে ওঠে সমগ্র বাংলা। বাংলার বিভিন্ন মহল থেকেই নিন্দা করা হয় এই প্রস্তাবের। বর্ধমানের মহারাজাও এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন এবং পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ গঠনের আবশ্যকতা সম্পর্কে নিজের অভিমত ব্যক্ত করেন।
পণ্ডিত নেহরু, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সার্বভৌম অখণ্ড বাংলার নামে বৃহত্তর দেশভাগের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সরব হন। সেই সময় অমৃতবাজার পত্রিকা একটি গ্যালপ পোলের মাধ্যমে বাংলার মানুষের অভিমত নেয়। তাতে দেখা যায় শতকরা আটানব্বই শতাংশেরও অধিক মানুষ পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ গঠনে সম্মতি দেন। ইতিহাসবিদদের একাংশ বলেন, অখণ্ড বাংলার নামে বৃহত্তর দেশভাগের 'অপচেষ্টার' বিরুদ্ধে বাংলার মানুষের সম্মিলিত প্রতিরোধ ছিল এই মতামত। লীগ নেতারা বুঝতে পারেন সমগ্র বাংলা হাতে আনা সম্ভব নয়, শুধুমাত্র পূর্ব বাংলা নিয়েই সন্তুষ্ট হতে হবে। তখন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল ছাড়াও সমৃদ্ধশালী ও প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ অ-মুসলিম প্রধান এক বিস্তীর্ণ এলাকা দাবি করে বসেন লীগ নেতারা। হুগলি নদীর সম্পূর্ণ পূর্বপাড় পূর্ববঙ্গের অন্তর্গত করার প্রচেষ্টা শুরু হয় লীগের তরফে। লীগ নেতাদের কর্মকাণ্ড দেখেই সীমানা কমিশনে সকৌতুকে অতুল গুপ্ত বলেছিলেন "বাংলা ভাগের কোনও প্রয়োজন নেই।" লীগ বরঞ্চ পুরো বাংলা জুড়েই তাদের রাজত্ব কায়েম রাখুক।
সীমানা কমিশনে লীগের তরফে পাকিস্তানের পক্ষে সওয়াল করা জনাব হামিদুল হক চৌধুরীর একের পর এক দাবি নস্যাৎ করেছিলেন অতুল গুপ্ত। বর্তমানে দার্জিলিং থেকে মেদিনীপুর, বাঁকুড়া থেকে ২৪ পরগনা পর্যন্ত যে এলাকা আমরা পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে দেখতে পাই,সেগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করার পিছনে তাঁরই ভূমিকা রয়েছে। ১৯৬১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি প্রয়াণ হন অতুন গুপ্ত। পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রে তবু জেগে রয়েছেন অতুল চন্দ্র গুপ্ত।