সশস্ত্র বিপ্লবী থেকে ঋষি, বিচিত্র জীবন ছিল অরবিন্দর! তাঁর জন্মদিনেই স্বাধীন হলো দেশ
সিভিল সার্ভিস পাস করে আরামের চাকরি করা চাকুরিজীবি, ক্ষুদিরাম বসুকে স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করা বিপ্লবী, আধ্যাত্মিক গুরু। ঋষি অরবিন্দ ঘোষের জীবন ছিল যেন এই দেশের মতোই বৈচিত্র্যময়।
অগাস্ট, ১৯৪৭। স্বাধীনতা তখন আর অলীক স্বপ্ন নেই, তা মানুষের প্রায় হাতের নাগালে চলে এসেছে। তিরুচিরাপল্লির অল ইন্ডিয়া রেডিও-র অনুরোধে ঋষি অরবিন্দ স্বাধীনতা সম্পর্কে তাঁর মতামত জানিয়ে একটা বক্তৃতা লিখেছিলেন। স্বাধীনতা দিবসের সঙ্গে ঋষি অরবিন্দর একটা যোগাযোগ রয়েছে। তিনি ১৮৭২ সালের ১৫ অগাস্ট জন্মগ্রহণ করেছিলেন। স্বাধীনতা সম্পর্কে তাঁর মতামত ১৪ অগাস্ট, ১৯৪৭ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিও-র তরফে সম্প্রচার করা হয়েছিল। বর্তমানে নেটমাধ্যমে তাঁর বক্তৃতার সম্প্রচার পাওয়া যায়।
ঋষি অরবিন্দ ঘোষের মতামত অনুবাদ করে বলা যায় যে, ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ সাল স্বাধীন ভারতের জন্মদিন। এটি পুরনো যুগের অবসান ঘটিয়ে এক নতুন যুগের সূচনা করেছিল। আমরা একটি মুক্ত জাতি হিসেবে এই তারিখটিকে সমগ্র বিশ্বের জন্য মানবতার সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং আধ্যাত্মিক ভবিষ্যতের জন্য একটি নতুন যুগের উন্মোচনের গুরুত্বপূর্ণ দিন বলে চিহ্নিত করতে পারি। ঋষি অরবিন্দ জানিয়েছিলেন যে, ১৫ অগাস্ট তাঁর নিজের জন্মদিন। সেই একই দিনে স্বাধীনতালাভ তাঁর কাছে তৃপ্তিদায়ক মনে হলেও তিনি এই ঘটনাকে কাকতালীয় ঘটনা মনে করেন না। তিনি এই ঘটনাকে ঐশ্বরিক শক্তির অনুমোদন এবং সিলমোহর হিসেবেই গ্রহণ করেছেন। তাঁর বহু স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে চলেছে, যা একসময় বহু মানুষের কাছে অবাস্তব কল্পনার মতো শোনাত। একইসঙ্গে তাঁর বহু স্বপ্ন ভবিষ্যতে বাস্তবায়িত হতে পারে। সেই স্বপ্নের মধ্যে অন্যতম হলো বিপ্লবের মাধ্যমে অখণ্ডতা বজায় রেখে স্বাধীনতা অর্জন। স্বাধীনতা অর্জিত হলেও অখণ্ডতা বজায় না থাকার জন্য তিনি দুঃখ পেয়েছেন। সাম্প্রদায়িক বিভাজন যে ক্রমে রাজনৈতিক রূপ নিয়ে চলেছে, সেই ঘটনায় তিনি নিজের দুঃখ এবং চিন্তা প্রকাশ করতে চেয়েছেন। মানুষের একতাই যে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, সেই কথাও তিনি জানিয়েছিলেন। তাঁর আরও একটি স্বপ্ন ছিল বিবর্তনের এমন একটি ধাপ, যা মানুষকে বৃহত্তর এবং উচ্চতর চেতনায় উন্নীত করবে। তার ফলে মানুষ সেই সব সমস্যার সমাধান শুরু করবে, যে সমস্যা মানুষকে একটি সুন্দর সমাজ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখার ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। সব শেষ, তিনি জানিয়েছিলেন যে তাঁর আশা কতটা ন্যায়সংগত হবে, তা এই নতুন স্বাধীন দেশের মানুষের ওপর নির্ভর করবে।
ঋষি অরবিন্দ ঘোষের স্বাধীনতা-সংক্রান্ত এই মতামত থেকেই মানুষটির চিন্তাধারার কিছুটা আভাস পাওয়া যায়। এই দার্শনিক চিন্তাভাবনা দীর্ঘদিনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের ফসল বলা যেতে পারে। ঋষি অরবিন্দ তাঁর একটি জীবনের মধ্যেই আলাদা আলাদা ধরনের যাপনে অভ্যস্ত হয়েছিলেন। অরবিন্দ ঘোষ ১৮৭২ সালে ১৫ অগাস্ট কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ইংল্যান্ডের কিংস কলেজ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন। ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার কারণে দেশে ফিরে আসার পরে বরোদার মহারাজের অধীনে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিযুক্ত ছিলেন। সেই সময় তিনি ধীরে ধীরে জাতীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। বিপ্লবী চিন্তাধারায় বিশ্বাসী অরবিন্দ ঘোষ তাঁর ভাই বারীন্দ্রকুমার ঘোষ এবং প্রমথনাথ মিত্রর সঙ্গে অনুশীলন সমিতির গঠন এবং প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। সাধারণ মানুষ এবং পুলিশের জন্য এই সমিতি ছিল শরীরচর্চার কেন্দ্র। যদিও শরীরচর্চার কেন্দ্রের আড়ালে এই সমিতি ছিল বিপ্লবীদের সশস্ত্র সংগঠন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গর সময় থেকেই অনুশীলন সমিতির ব্রিটিশবিরোধী কার্যকলাপের গতি বেড়ে গিয়েছিল। এই কারণেই এই সংগঠন পুলিশের নজরে এসেছিল।
আরও পড়ুন: আজ ধ্বংসস্তূপ, এই বাড়িতেই একদিন লেখা হয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামের মহাকাব্য
অরবিন্দ ঘোষ অনুশীলন সমিতির সংবাদপত্র 'যুগান্তর'-এ নিজের বিভিন্ন মতামত লিখতেন। এই সময় মুরারিপুকুরে এক বাড়িতে পুলিশি অভিযানে বহু বিপ্লবী পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন। ব্রিটিশ-বিরোধী ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকার অপরাধে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছিল। এই মামলা আলিপুর বোমার মামলা নামে পরিচিত। অরবিন্দ ঘোষ এই মামলার মূল অভিযুক্ত ছিলেন। মামলার শুরুতে অরবিন্দ ঘোষের বিরুদ্ধে পোক্ত প্রমাণ ছিল না। তাঁদের কাছে যুগান্তর এবং 'বন্দেমাতরম' পত্রিকায় অরবিন্দ ঘোষের কিছু লেখা এবং বারীন্দ্রকুমার ঘোষের কাছ থেকে উদ্ধার করা কয়েকটা চিঠি ছিল। সেই চিঠিগুলোর মধ্যে একটিতে এ. জি নামে কারও সঙ্গে সারা দেশে মিষ্টি বিতরণ করার আলোচনা হয়েছিল। পুলিশের দাবি ছিল যে, এ. জি আসলে অরবিন্দ ঘোষ এবং সারা দেশে মিষ্টি বিতরণ মানে সন্ত্রাসের আলোচনা করা হয়েছিল।
মামলা চলাকালীন নরেন্দ্র গোস্বামী নামে অনুশীলন সমিতির এক সদস্য মামলা থেকে অব্যাহতির পরিবর্তে অরবিন্দ ঘোষের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে রাজি হয়ে গিয়েছিল। সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং কানাইলাল দত্ত নরেন্দ্র গোস্বামীকে হত্যা করার পরে প্রমাণের অভাব এবং দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সওয়ালের ফলে অরবিন্দ ঘোষ এই মামলা থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছিলেন। যদিও বিপ্লবীদের পত্রিকায় লেখার জন্য তাঁকে কারাবাসের আদেশ দেওয়া হয়েছিল। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে অরবিন্দ ঘোষ আধ্যাত্মিক পথ গ্রহণ করে পণ্ডিচেরিতে আশ্রমে চলে গিয়েছিলেন। ১৯৫০ সালের ৫ ডিসেম্বর ঋষি অরবিন্দ ঘোষ দেহত্যাগ করেছিলেন।
সিভিল সার্ভিস পাস করে আরামের চাকরি করা চাকুরিজীবি, ক্ষুদিরাম বসুকে স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করা বিপ্লবী, আধ্যাত্মিক গুরু। ঋষি অরবিন্দ ঘোষের জীবন ছিল যেন এই দেশের মতো বৈচিত্র্যময়।