বিদায় শেন ওয়ার্ন || স্পিনের জাদু থামল বড় অবেলায়
সারা জীবন জুড়ে কত শত ব্যাটারকে স্পিনের জাদুতে বোকা বানিয়ে প্যাভিলিয়নে ফেরত পাঠিয়ে ছিলেন তিনি। একইভাবে অসংখ্য ভক্তদের বোকা বানিয়ে নিজেই চলে গেলেন না ফেরার দেশে। শেন ওয়ার্নের মতো প্রতিভাবানরা সম্ভবত এ রকমই হয়। তাঁর কব্জির মোচড় থেকে লেগ স্পিন আসছে না গুগলি আসছে তা কোনও দিনই ঠিক বুঝে উঠতে পারেননি বিশ্বের নামজাদা ব্যাটারা। একই ভাবে শেন ওয়ার্ন ব্যক্তি জীবনে ছিলেন অনিশ্চয়তায় মোড়া। স্পিন বোলিং আর ব্যক্তিজীবনে বিতর্ক দুটোকেই যেনও সমানভাবে উপভোগ করেছেন স্পিনের জাদুকর। সুরা, নারীসঙ্গ, মাদক, বেটিং চক্র, ক্রিকেট থেকে নির্বাচনে সব কিছু এসেছে তার জীবনে সময়ে সময়ে। কিন্তু মাঠে ফিরে শেন ওয়ার্ন হাতে বল তুলে নিলে তালি দিতে বাধ্য হন তীব্র নিন্দুকেরা।
ছোটবেলায় ক্রিকেট ফুটবল দুটো একসঙ্গে খেলতেন। অনূর্ধ্ব ১৯ পর্যায়ে ফুটবলে তাঁর এতটাই ভালো পারফরম্যান্স ছিল যে চাইলে পেশাদার ফুটবলার হিসেবে জীবন শুরু করতে পারতেন। কিন্তু তাঁর নিয়তি ছিল আলাদা। এর মাত্র তিন বছর পর ১৯৯২ সালে ভারতের বিরুদ্ধে টেস্ট অভিষেক হয় শেন ওয়ার্নের। যদিও অভিষেক টেস্ট মোটেই সুখের হয়নি তার। প্রায়ই ক্যারিয়ারের শেষে পৌঁছে যাওয়া রবি শাস্ত্রী আর দীর্ঘ ক্রিকেট জীবনের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী সচিন তেন্ডুলকরের হাতে বেধড়ক ঠ্যাঙানি খেতে দেখেছিল সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে উপস্থিত দর্শকরা।
কিন্তু তিনি তো স্পিনের জাদুকর। জাত চেনাতে বেশি দিন লাগেনি। সেই বছর শ্রীলঙ্কা সফর থেকে শুরু হয়েছিল শেন ওয়ার্নের দুর্ধর্ষ এক বিজয় অভিযান। এক বছর হতে না হতেই করে ফেললেন শতাব্দীর সেরা বলটি। জার্মান বংশোদ্ভূত পিতার সন্তান শেন ওয়ার্ন ক্রিকেট মাঠে ছিলেন একজন হার না মানা যোদ্ধা। লাল বল ছিল যেন তাঁর হাতের ভৃত্য। আর সঙ্গে দুর্ধর্ষ ক্রিকেট মস্তিষ্ক। তাঁর বিরুদ্ধে রণকৌশল সাজাতে প্রতিপক্ষের সেরা ব্যাটারকেও ম্যাচের আগের রাত বিনানিদ্রায় কাটাতে হতো। কোনো পরিসংখ্যান এর প্রয়োজন পড়ে না, ওয়ার্নের কৃতিত্ব বোঝাতে শুধু একটা লাইনে যথেষ্ট। স্পিন বোলার হাওয়াই গ্লেন ম্যাকগ্রথ, জেসন গিলেস্পি এবং ব্রেট লির পরে বল করার সুযোগ পেতেন ওয়ার্ন। কিন্তু তারপরও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে উইকেটের সংখ্যা হাজারেরও বেশি। মাঠের বাইরের অভিন্নহৃদয় বন্ধু সচিন তেন্ডুলকর আর ব্রায়ান লারার সঙ্গে ছিল তাঁর চিরকালীন ক্রিকেটিয় যুদ্ধ। যে যুদ্ধের ইতিহাস লেখা হয়ে রয়েছে ক্রিকেটের প্রতিটা রেকর্ড বইয়ে পাতায় পাতায়। তাঁরা মুখোমুখি হলে টেলিভিশনের টিআরপি পৌঁছত এভারেস্টের শিখরে। মাঠে তাদের পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই ক্রিকেট অনুরাগী করে তুলেছে বহু ক্রিকেট বিমুখ মানুষ কেউ।
মাঠের মধ্যে তিনি যেমন ছিলেন উজ্জল নক্ষত্র, একই ভাবে মাঠের বাইরেও তাঁকে নিয়ে চর্চা কম হয়নি। যে ক্রিকেটের জন্য এত গরিমা, অভিযোগ উঠেছিল অর্থের বিনিময় ম্যাচের তথ্য বিক্রি করার। ২০০৩ সালের বিশ্বকাপের আগে নির্বাচনে যেতে হয়েছিল শেন ওয়ার্নকে। সেবার অভিযোগ ছিল নিষিদ্ধ মাদক সেবনের। এছাড়াও একাধিক নারীসঙ্গ, ব্রিটিশ নার্সকে কু-প্রস্তাবের মত বিতর্ক বারবার ফিরে ফিরে এসেছে তাঁর জীবনে। কিন্তু সব কিছু ঢাকা পড়ে গেছে তাঁর ২২ গজে দেখানো ভেলকিতে।
২০০৭ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়ে ছিলেন সর্বকালের সেরা এই লেগ স্পিনার। কিন্তু পরের বছর আইপিএল খেলতে নেমে পড়েন। প্রথম বছর আইপিএলের আসরে ক্যাপ্টেন শেন ওয়ার্ন জাদু দেখিয়ে ছিলেন। আনকোরা খেলোয়াড়দের নিয়ে তৈরি রাজস্থান রয়েলকে নিজের মস্তিষ্কের জোরে চাম্পিয়ান করেছিলেন তিনি।
ফুটবলের রাজপুত্রের সঙ্গে কোথাও যেন মিল রয়েছে ক্রিকেটের স্পিনের জাদুকরের। তারা দুজনেই ভুলতে চেয়েছেন তাঁদের দুর্বিষহ শৈশবকে। প্রতিভার জোরে জয় করেছেন সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। আর ব্যক্তিজীবনে বিতর্ক তাদের ছায়াসঙ্গী। তাঁরা দুজনেই চিরসবুজ। বার্ধক্য তাদের ছুঁতে পারেনি। ফুটবলের রাজপুত্র মারাদোনা চলে গেছিলেন ৬০ বছর বয়সে। আর স্পিনের জাদুকর শেন ওয়ার্ন চলে গেলেন ৫২ বছর বয়সে।