ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা ইনিংস! যন্ত্রণা-বিপদের মুখে জয়ধ্বজা ম্যাক্সওয়েলের
Glenn Maxwell Match : ৪০ তম ওভারে ব্যথা এতটাই তীব্রতর হয় যে এক রান নিয়েই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ম্যাক্সওয়েল।
মার্ভেল কমিকসের হাল্ক কিংবা ক্যাপ্টেন আমেরিকা, কিংবা গল্পের পাতায় থাকা কোনও এক অতি মানব। গ্লেন ম্যাক্সওয়েলকে ঠিক কোন চরিত্রের সঙ্গে মেলানো যায়, সেটাও চিন্তার বিষয়। যা কিছু অভাবনীয়, তার সবকিছুরি যেন সমার্থক হয়ে উঠেছেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। আফগানিস্তানের এ বছরের বিশ্বকাপরূপকথার থেকে কম কিছু নয়। প্রথমবার বিশ্বকাপে তারা উঠে এসেছিল সেমিফাইনালের দৌড়ে। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচটি ছিল তাদের জন্য একেবারে 'মাস্ট উইন'। মুম্বইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে ২৯২ রানের লক্ষ্যমাত্রা ছিল অস্ট্রেলিয়ার সামনে। মাইটি অস্ট্রেলিয়ার জন্য খুব একটা দুষ্কর ছিল না সেই টার্গেট। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে এর আগেও বহু এরকম রান চেজ করেছে অস্ট্রেলিয়া। তবে এই ম্যাচের লাগাম যে আফগানরা শক্ত করে টেনে ধরবে তা রীতিমতো অপ্রত্যাশিত ছিল অস্ট্রেলিয়ার কাছে।
একটা সময় উইন প্রেডিকটরে অস্ট্রেলিয়ার জেতার সম্ভাবনা ছিল মাত্র ৬%। পুরো ম্যাচটাই নিজেদের দখলে নিয়েছিল আফগানিস্তান। সেমিফাইনালের দরজা খোলাই ছিল। ঘুণাক্ষরেও কেউ টের পায়নি, তখনও এক অতিমানবের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসা বাকি। আর সেই অতি মানব গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। পাহাড়সম সমুদ্র হয়ে যেন ভাসিয়ে নিয়ে গেলেন আফগানিস্তানকে। অভূতপূর্ব ইনিংস খেলে তামাম ক্রিকেট বিশ্বকে চমকে দিলেন এই অসি খেলোয়াড়।
এর আগে কেউ কোনওদিন রান তাড়া করতে নেমে ২০০ রান করেননি। কেউ এর আগে কোনওদিন ক্রাম্প নিয়ে দলকে গভীর কুয়ো থেকে তুলে আনেননি। কিন্তু ম্যাক্সওয়েল তা করে দেখিয়েছেন। অদম্য এক শক্তি যেন ভরসা জুগিয়েছিল ম্যাক্সওয়েলকে। ৯১ রানে সাতটা উইকেট হারানো দল শেষ অবধি ২৯২ রান অতিক্রম করে যায়। আর উইকেট সংখ্যা সেই সাতটি। ম্যাক্সোয়ালের এরকম দুর্দান্ত ইনিংসের বর্ণনায় বিশেষণের ঘাটতি হওয়াটাই স্বাভাবিক।
আরও পড়ুন- টাইমড আউট হতে পারতেন সৌরভ গাঙ্গুলিও! ১৬ বছর আগে কীভাবে বেঁচে যান তিনি?
তবে, এমনটা হয়তো কোনওদিনই হতো না যদি মুজিবুর রহমান ম্যাক্সওয়েলের ক্যাচ ড্রপ না করতেন। ব্যক্তিগত ৩৩ রানের মাথায় স্কোয়ার লেগ ও শর্ট ফাইন লেগের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা মুজিবুর রহমানের হাতে ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। ক্যাচটি ফেলে দেন মুজিব। ভবিষ্যৎ দেখতে পেলে হয়তো জীবন বাজি রেখেও সেই ক্যাচ দখলে রাখতে চাইতেন মুজিবুর রহমান। সেই ৩৩ রান থেকে ম্যাক্সওয়েল শেষ অব্দি ছিলেন ২০১ রানে অপরাজিত। ভাগ্যও যেন বারবার সঙ্গী হয় ম্যাক্সওয়েলের। লেগ বিফোর আউট হওয়া থেকে বাঁচলেন তিনি, পুরো ইনিংসে দৌড়াতে পারছিলেন না ম্যাক্সওয়েল, তবুও তাঁকে বিশেষ কষ্ট করতে হলো না।
৩৪ তম ওভার শেষে শরীরের বাম পাশের মাংসপেশিতে টান অনুভব করেন ম্যাক্সওয়েল। ৪০ তম ওভারে ব্যথা এতটাই তীব্রতর হয় যে এক রান নিয়েই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ম্যাক্সওয়েল। রীতিমতো কাতরাতে থাকেন ব্যথায়। তবে মাঠ থেকে উঠে যাবার প্রশ্নই আসে না। ব্যথা নিয়েই স্রেফ ঠায় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে বড় বড় শট খেললেন ম্যাক্সওয়েল। দু'বার ড্রেসিং রুম থেকে নেমে এসেছিলেন পরবর্তী ব্যাটার অ্যাডাম যাম্পা। তবে তাঁকে দুবারই ফিরে যেতে হলো। ম্যাচ শেষ হওয়া অবধি মাঠেই দাঁড়িয়ে রইলেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। ১২৮ বলে ২০১ রানের অপরাজিত ইনিংস খেললেন ম্যাক্সি। ২১টা চার আর ১০টা ছয় মেরে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সমস্ত অভিযোগকে ধূলিসাৎ করে দিলেন তিনি।
অপর প্রান্ত থেকে অবাক বিস্ময় চোখে নিয়ে তাকিয়ে রইলেন প্যাট কামিন্স। ব্যাট চালাতে তিনিও পারেন। কিন্তু ম্যাক্সওয়েলের ওই ইনিংসের পর প্যাট কামিন্সের ব্যাট চালানোর দরকার পড়েনি আর। ৬৮ বলে মাত্র ১২ রান করলেন কামিন্স। দু'জন মিলে তৈরি করলেন ২০২ রানের জুটি। আর তাতে ম্যাক্সওয়েল নামক আগ্নেয়গিরি থেকে এল ১০২ বলে ১৭৯ রান। শেষ বলে ছয় মেরে দলের জয় আর নিজের দ্বিশতক নিশ্চিত করেন ম্যাক্সওয়েল।
একালের ক্রিকেটে যেকোনও ম্যাচ উইনিং ইনিংসকেই অতিমানবীয় তকমা দিয়ে দেওয়া হয়। ৫০ পেরনো কিংবা সেঞ্চুরি করা ইনিংস নিয়ে গল্পও হয় আকছার। কিন্তু ম্যাক্সওয়েলের এই ১২৮ বলে ২০১ রানের ইনিংসকে স্রেফ 'অতিমানবীয়' শব্দেও ধরা যায় না। শুধুমাত্র ইতিহাসের দ্রুততম ডাবল সেঞ্চুরির রেকর্ডই নয়, ওয়ানডে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ রানের ইনিংস নয়, ম্যাক্সওয়েলের এই ইনিংস নিঃসন্দেহে ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ইনিংস।
আরও পড়ুন- বিশ্বকাপ খেলার মাশুল, আড়াই হাজার সিগারেট ‘খেতে’ বাধ্য হল শ্রীলঙ্কা-বাংলাদেশ ক্রিকেট দল
একটা সময় ক্র্যাম্পিংয়ে কাতরাতে থাকা ম্যাক্সওয়েলকে দেখে মনে হয়েছিল, এই বুঝি সব শেষ। কিন্তু, এক কব্জির জাদুতে মোহনীয় সব ছক্কা মেরেও যে জয়ের পথ রচনা করা যায় সেই প্রামাণ্য দৃশ্যেরই সাক্ষী হয়ে রইল গোটা ক্রিকেট বিশ্ব। ম্যাচ শেষে ধারাভাষ্যকার তথা ভারতের প্রাক্তন খেলোয়াড় মহাম্মদ কাইফ বললেন, আগামী ১০০ বছর যখনই কোনও দল এরকম বিপদে পড়বে, তখনই হয়তো কোনও এক ম্যাক্সওয়েলের স্মরণ করবে।
ক'জনই বা আজ অবধি ওয়ানডে ক্রিকেটে ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন? ম্যাক্সওয়েলকে নিয়ে এই সংখ্যাটা মাত্র ৮। তবে, ম্যাক্সওয়েল অনন্য কেন? এর আগে যে সাতজন ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন তারা সবাই প্রথমে ব্যাট করার সময় এই ইনিংস খেলেছিলেন। কিন্তু ম্যাক্সওয়েল হলেন ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম ব্যাটসম্যান যিনি রান তাড়া করার সময় ডাবল সেঞ্চুরি করলেন।
ওয়ান ডে-তে ছয় বা তার নিচে নেমে খেলা সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত স্কোর এতদিন ছিল ১৯৮৩ বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে কপিল দেবের ১৭৫ রানের ইনিংস। ম্যাক্সওয়েল সেটিকে তো ছাড়িয়ে গেছেনই, এক দিবসীয় ক্রিকেটের ইতিহাসের সেরা ইনিংসের মালিকও হয়ে উঠেছেন। ক্রিকেটের আর্কাইভে ম্যাক্সওয়েলের এই ইনিংস সোনায় মোড়া থাকবেই। ৭ নভেম্বরের রাতে যে বিজয়গাথা তিনি ২২ গজের এই ময়দানে রচনা করলেন, তার বিশ্লেষণ সম্ভব না, এ শুধু উপলব্ধির, অপার্থিব উপলব্ধির।