সময় পেরলেও মরচে পড়েনি এতটুকুও, ভারতের এই মন্দিরে আজও রয়েছে পরশুরামের কুঠার
Tanginath Dham Parshuram Axe : সিঁদুর, ফুল লাগানো এই লোহার অস্ত্রটি নাকি হাজার হাজার বছর ধরে এভাবেই এই জায়গায় রয়েছে। মরচে পড়েনি এতটুকুও।
ভারতের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে সভ্যতার নানা নিদর্শন। রয়েছে নানা ধর্মীয় স্থান, ঐতিহাসিক স্থাপত্য। আর সেরকমই বেশকিছু স্থাপত্য ঘিরে রয়েছে মিথ আর রহস্যের চাদর। সেসবের টানে আজও এই স্থানগুলিতে ভিড় করে সাধারণ মানুষ। সেই কাহিনি শুনলে চোখ কপালে উঠে যায় অনেকের। বাংলার পড়শি রাজ্য ঝাড়খণ্ডেও রয়েছে সেরকমই একটি জায়গা। যে মন্দির ঘিরে রয়েছে নানা ইতিহাস, নানা মিথ, আর পুরাণের বর্ণনা।
সেই জায়গায় পা দেওয়ার আগে আরেকজনের সম্পর্কে একটু আলোচনা করা যাক। তিনি পরশুরাম। শাস্ত্র অনুযায়ী, বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার পরশুরাম অমর। তাঁর মৃত্যু নেই; আজও তিনি এই পৃথিবীর বুকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কথিত আছে, বাবা ঋষি জমদগ্নির আদেশ মেনে তিনি নিজের মা-কে হত্যা করেন। তারপর ঋষি জমদগ্নি খুশি হয়ে বর দিতে চাইলে, তিনি ফের মা-কে জীবিত করার কথা বলেন। পুরাণ বলে, পরশুরামই প্রথম যোদ্ধা ব্রাহ্মণ। তাঁর সাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে মহাদেব শিব তাঁকে এই বিশাল কুঠার দিয়েছিলেন। সেই কুঠারই ছিল তাঁর অস্ত্র, তাই দিয়েই শত্রু সংহার করতেন তিনি।
আরও পড়ুন : ৯ ডিগ্রি কোণে হেলানো মন্দির! রহস্যময় এই শিবমন্দির কেন চলে যায় জলের তলে?
শাস্ত্র তো বলে, পরশুরাম অমর। আর তাঁর কুঠার? আজও নাকি সেই লোহার বিশালাকৃতির কুঠার রয়েছে এই দেশে। মাটিতে পোঁতা রয়েছে সেই কুঠার, স্রেফ তার শীর্ষভাগ বেরিয়ে আছে। এর জন্য আপনাকে যেতে হবে ঝাড়খণ্ডের গুমলা জেলায়। রাঁচি থেকে প্রায় ১৭৫ কিলোমিটার দূরের এই জেলাতেই অবস্থিত ডুমরি এলাকার একটি পাহাড়ের ওপর রয়েছে বিশেষ মন্দির। স্থানীয় মানুষ বলেন, এটি বাবা টাঙ্গিনাথ ধাম। মূলত শিবের মন্দির এটি। পাহাড়ের ওপরে গেলে দেখা যাবে, মন্দির চত্বরের বাইরেই অজস্র শিবলিঙ্গ ও অন্যান্য দেবদেবীর মূর্তি পড়ে রয়েছে। তবে আসল জিনিসটি মূল মন্দিরের ঠিক বাইরেই অবস্থিত।
মন্দিরের বাইরেই একটি জায়গায় মাটির ভেতর পোঁতা বেশ কয়েকটি ধারালো লোহার অংশ। দেখতে অনেকটা ত্রিশূলের মতো। তবে সেই ত্রিশূলের অন্যদিকে একটি সূচালো অংশ বেরিয়ে রয়েছে। যেন কোনও বিশাল বড় কুঠারের তীক্ষ্ণ অংশটির খানিকটা বেরিয়ে আছে। বলা হয়, এটিই নাকি পরশুরামের সেই কুঠার! সিঁদুর, ফুল লাগানো এই লোহার অস্ত্রটি নাকি হাজার হাজার বছর ধরে এভাবেই এই জায়গায় রয়েছে। মাটির ভেতরেও তার অনেকখানই অংশ রয়েছে।
ঠিক কত লম্বা এই ‘কুঠার’? ভক্তরা বলেন, তার পরিমাপ নাকি এখনও পাওয়া যায়নি। কেউই জানে না এই রহস্য। এই বিশেষ কুঠার বা টাঙ্গি থেকেই মন্দিরের নাম ‘টাঙ্গিনাথ’। তবে এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আরেকটি কাহিনি। তবে সেজন্য ফিরে যেতে হবে রামায়ণের যুগে। সেটা ছিল সীতার স্বয়ম্বর সভা। জনকরাজার দরবারে হাজির হয়েছেন বিভিন্ন জায়গার রাজা, রাজপুত্ররা। সেখানেই ছিলেন রামচন্দ্র। স্বয়ম্বর সভাতেই হরধনু ভঙ্গ করে সীতাকে বিয়ে করেন তিনি। এদিকে হয়ে যায় আরেকটি সমস্যা। হরধনু অর্থাৎ শিবের থেকে পাওয়া এই ধনুকটি আদতে পরশুরামের। তিনিই এটি জনকরাজকে দিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন : দেবদেবী নয়, পুজো করা হয় ব্যাঙকে! রহস্য-মিথে ভরা ভারতের ২০০ বছরের প্রাচীন এই মন্দির
এদিকে হরধনু ভেঙে ফেলায় পরশুরাম ভয়ংকর রেগে যান। তিনি সেখানে এলেই সামনে চলে আসেন স্বয়ং লক্ষ্মণ। দুজনের মধ্যেই চলে তীব্র বাদানুবাদ। একটা সময় পর হুঁশ ফেরে পরশুরামের। তিনি নিজের ভুল বুঝতে পারেন। তারপরই কোনও এক পাহাড়ের উপর তপস্যা করতে চলে যান। তার আগে পাহাড়ের ওপরই তাঁর বিশাল কুঠারটিকে পুঁতে দিয়ে যান। জনশ্রুতি, ঝাড়খণ্ডের টাঙ্গিনাথ ধামই হল সেই জায়গা। তাই আজও কুঠারটি রয়েছে। সেইসঙ্গে ভক্তরা মনে করেন, এই স্থানেই পরশুরাম শিবের আরাধনা করেন। তাঁর পায়ের ছাপ আজও নাকি দেখতে পাওয়া যায়।
এই লোহার কুঠার বা টাঙ্গি নিয়ে বিস্ময়ের শেষ নেই। হাজার হাজার বছর ধরে এভাবে খোলা হাওয়ায়, ঝড়-জলের মধ্যে পড়ে রয়েছে এটি। কিন্তু আজও এক ফোঁটাও মরচে পড়েনি এখানে! পাশাপাশি এই বিশেষ স্থানটিকে নিয়ে রয়েছে অজস্র মিথ। বলা হয়, এই কুঠারটি এর আগে অনেকেই নিয়ে যেতে চেয়েছে। খোঁড়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু যারা করেছে, তাদের কারও নাকি ভালো হয়নি! বলা হয়, একসময় লোহার উপজাতির মানুষেরা এই কুঠারটিকে না নিতে পেড়ে এর একটি অংশ কেটে নিয়ে যায়। তারপর থেকে ওই জাতির একের পর এক মানুষ মারা যেতে শুরু করে। ভয়ে লোহার উপজাতির মানুষেরা এই স্থান বরাবরের মতো ত্যাগ করে। এমনকী, আজও তাঁরা এই তল্লাটের ধারেকাছেও ঘেঁষে না।
সত্যি না মিথ্যে, সেটা জানা যায় না। এই লোককথা, মিথ, রহস্য – এসবই টাঙ্গিনাথ ধামের মাহাত্ম্যকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। পরশুরামের কুঠারও তাঁরই মতো অমর হয়ে আছে ভক্তদের মনে। মহাশিবরাত্রির মেলায় সবাই আসেন এখানে; তিনদিন ধরে চলা মেলায় অংশ নেন। ভারতের মতো প্রাচীন সভ্যতার বুকে এমনই মিথ, রহস্য, পুরাণ আর বাস্তব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় ঝাড়খণ্ডের টাঙ্গিনাথের এই মন্দিরে।