নেতাজির অন্তর্ধানের পর চুরি যায় আজাদ হিন্দের ২৫০ কোটির সম্পত্তি! নেপথ্যে ছিলেন কারা?
Netaji INA Treasure: বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী আইএনএ-র চুরি যাওয়া সম্পত্তির মোট পরিমাণ ছিল প্রায় ২৫০ কোটি টাকা! এই এত বিপুল পরিমাণ ধন-সম্পত্তি কোথায় গেল?
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। এই নাম আমাদের কাছে যেমন আবেগের, তেমনই রহস্যেরও। এই মানুষটিকে ঘিরে বোনা হয়েছে কতই না রহস্যের জাল, তৈরি হয়েছে কতই না কিংবদন্তি। এরকমই একটি কিংবদন্তি রয়েছে আজাদ হিন্দ ফৌজের সম্পত্তি নিয়ে। তাদের সেই সম্পত্তির পরিমাণ বর্তমান বাজার মূল্যের হিসেবে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা! শোনা যায়, সুভাষচন্দ্র বসু যখন ভাষণ দিতেন, সভাস্থলে উপস্থিত মহিলারা নিজেদের গায়ের গয়না খুলে দিয়ে দিতেন দেশের স্বাধীনতার উদ্দেশ্যে। ১৯৪৪-এর এক রিপোর্ট অনুযায়ী, হাবিব নামক ধনী ব্যাবসায়ী আজাদ হিন্দ ফৌজের তহবিলে এক কোটি টাকা দান করেন। ওই বছরই প্রকাশিত আরেকটি রিপোর্টে জানা যায়, রেঙ্গুনের ব্যবসায়ী বি কে নাদর আজাদ হিন্দ ব্যাঙ্কে প্রায় ৪০ কোটি টাকা নগদ এবং সোনা জমা করিয়েছিলেন।
নেতাজি কখনই চাইতেন না আজাদ হিন্দ ফৌজ জাপানি সেনার উপর নির্ভর হয়ে পড়ুক। আজাদ হিন্দ ফৌজের অন্তর্বর্তী সরকার যেন স্বাধীনভাবে চলতে পারে তাই শুরু থেকেই চাঁদা তোলায় বিশ্বাসী ছিলেন নেতাজি। এরকমভাবেই চাঁদা তোলা হয়েছিল ১৯৪৫ সালের জানুয়ারি মাসে। নেতাজির জন্মদিনে সেই প্রক্রিয়া শেষ হলে দেখা যায়, ২ কোটি টাকা নগদ এবং ৮০ কেজি সোনা জমা হয়েছে (টাকার অঙ্ক বর্তমান বাজার দরের ভিত্তিতে উল্লিখিত)। আট মাস পর, ১৮ অগাস্ট ১৯৪৫-এ যখন বিমান ভেঙে পড়ে, তখন এই বিপুল ধন সম্পত্তি সেই বিমানেই ছিল। সেই বিমান ধ্বংস হয়ে নেতাজির মৃত্যু হয়েছিল কিনা তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, আজাদ হিন্দ ফৌজ বা ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির সেই বিপুল পরিমাণ ধনরাশি গেল কোথায়?
ফিরে যাওয়া যাক ১৫ অগাস্ট, ১৯৪৫-এ। এই দিন জাপানের সম্রাট হিরোহিতো সরকারিভাবে ঘোষণা করে দেন যে জাপান আত্মসমর্পণ করছে। হিরোশিমা এবং নাগাসাকির পর জাপানের কাছে আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কোনও উপায়ও ছিল না। নেতাজি এই সময় ছিলেন সিঙ্গাপুরে। জাপানের আত্মসমর্পণের খবর কানে আসতেই তিনি বুঝতে পারেন কয়েকদিনের মধ্যে ব্রিটিশরা দখল নেবে সিঙ্গাপুর। তিনি সিদ্ধান্ত নেন সিঙ্গাপুরে আইএনএ-র যা তহবিল আছে সব সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে। এই মর্মে পরদিন অর্থাৎ ১৬ অগাস্ট দেবনাথ দাসকে একটি টেলিগ্রাম করেন নেতাজি। এই দেবনাথ দাস ছিলেন ইন্ডিয়া ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগের সাধারণ সম্পাদক। দেবনাথ নেতাজির নির্দেশে আইএনএ-র সব তহবিল সিঙ্গাপুর থেকে ব্যাংকক পাঠিয়ে দেন। সেদিন বিকেলে সিঙ্গাপুর এসে পৌঁছন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। এসেই তিনি সোজা আইআইএল (ইন্ডিয়ান ইনডিপেন্ডেন্স লিগ) সদর দফতরে চলে যান। সেখানে গিয়ে আইআইএল এবং আইএনএ-র সকল কর্মী এবং সৈনিকদের আগাম তিন মাসের বেতন দিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। একইসঙ্গে একটা বিষয় পরিষ্কার করে দেন, যুদ্ধে জাপান আত্মসমর্পণ করলেও আইএনএ কিন্তু করেনি। সেদিন রাতের মধ্যে সব হিসেব মিটিয়ে আইএনএ-র সোনা এবং নগদ টাকাকে নেতাজি মোট চারটি ভাগে ভাগ করান।
আরও পড়ুন- বাগবাজারের পুজোয় ৫০০ টাকা চাঁদা দেন নেতাজি, লাঠিখেলার যে ইতিহাস অনেকেরই অজানা
সেই সময় নেতাজির ব্যক্তিগত সচিব কুন্দন সিং পরবর্তীকালে জানান, “আমাদের ওই সোনার মধ্যে একটা সোনার সিগারেট কেস ছিল। সেটা হিটলার নেতাজিকে উপহার দিয়েছিলেন। সেদিন রাতে সবার মাইনে মিটিয়ে আমরা হিসেব করতে বসি। আইএনএ-র সব তহবিল মোট চারটি বড় বড় বাক্সে ভরে রাখা হয়। ওই চারটি বাক্সের মোট ওজন ছিল আড়াই মণ।” কুন্দন সিং জানান, পরদিন সকালে অর্থাৎ ১৭ অগাস্ট ভোরে সেই চারটি বাক্স নিয়ে ব্যাংকক থেকে সাইগনের উদ্দেশ্যে উড়ে যান নেতাজি। তাঁর সঙ্গী ছিলেন- দেবনাথ দাস, এস এ আইয়ার, হাবিবুর রহমান, পাইলট গুলজারা সিং এবং আবিদ হাসান। সেদিনই সকাল ৯:০০ টা নাগাদ নেতাজি সাইগন পৌঁছে যান। তাঁর পরিকল্পনা ছিল সেখান থেকে মাঞ্চুরিয়া যাওয়ার। কিন্তু কিছু যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে প্লেনটি আর উড়তে পারে না। পরদিন, ১৮ অগাস্ট নেতাজি স্থানীয় ফিল্ড মার্শালকে অনেক অনুরোধ করে মিৎসুবিসি কে-২১ বিমানে দুটি আসনের ব্যবস্থা করেন। তিনি চেয়েছিলেন কর্নেল হাবিবুর রহমান যেন তাঁর সঙ্গী হন। কিন্তু পাইলট তা নাকচ করে দেন। নেতাজিকে জানিয়ে দেওয়া হয়, হয় তিনি হাবিবুর রহমানকে সঙ্গে আনুন নয় তিনি তার বাক্সগুলিকে আনুন। বাক্স এবং হাবিবুর রহমানকে একসঙ্গে আনা যাবে না, কেননা ওজন বেশি হয়ে যাবে। বাধ্য হয়ে বাক্সগুলি নিয়েই মাঞ্চুরিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেন নেতাজি। সাইগন থেকে ফোরমাসা (যাকে আমরা বর্তমানে তাইওয়ান নামে চিনি) পৌঁছয় বিমানটি। এখান থেকে ফের জ্বালানি ভরে মাঞ্চুরিয়া যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পুনরায় টেক অফ করতেই তাইহোকু বিমানবন্দরে ধ্বংস হয়ে যায় প্লেনটি।
সেই সময় ওই এয়ারস্ট্রিপে মেজর সাকাই এবং ক্যাপ্টেন নাকামুরা উপস্থিত ছিলেন। তারা তড়িঘড়ি আহতদের হাসপাতালে পৌঁছন, একই সঙ্গে দাবি করেন যে নেতাজি মারা গিয়েছেন। তারাই নেতাজির অন্ত্যষ্টি ক্রিয়া করেছিলেন। যদিও এই দাবির সপক্ষে প্রমাণ তারা দিতে পারেননি। তবে মানুষদের উদ্ধার করার পাশাপাশি তারা উদ্ধার করেছিলেন সেই বাক্সগুলিও। সাকাই বাক্সগুলিকে সিল করে দেন এবং নেতাজির অস্থির সঙ্গে সেগুলিকে টোকিও পাঠিয়ে দেন। ওই বছরই ৫ সেপ্টেম্বর সেই সোনা-দানা এবং টাকা-পয়সা আইআইএল-এর টোকিও প্রেসিডেন্ট এস রামমূর্তির হাতে তুলে দেওয়া হয়। এরপর ১৯৫২ সালে সেই সম্পত্তি ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এখানেই ঘটে বিপত্তি! জাপান থেকে যে সম্পত্তি এসেছিল, তার মধ্যে কোনও টাকা তো ছিলই না, ছিল না অনেকটা সোনাও। সেই সময় এক তদন্ত কমিটির সামনে কুন্দন সিং জানান, নেতাজি ব্যাংকক থেকে সাইগনের উদ্দেশ্যে যে বাক্স নিয়ে বেরিয়েছিলেন তাতে কিছু না হলেও ৮০ কিলো সোনা ছিল। কিন্তু ভারতে মাত্র ১১ কিলো সোনা আসে। বাকি সোনা এবং টাকা গেল কই? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে জাপান নিজেদের অনেক গোপন নথি পুড়িয়ে দিয়েছিল। ফলত, নেতাজি আসলে ঠিক কত পরিমাণ সোনা নিয়ে প্লেনে উঠেছিলেন তা একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শীরাই জানত। তবে এর বছর পাঁচেক আগেই ইঙ্গিত মিলেছিল কিছু একটা গণ্ডগোল হচ্ছে। ১৯৪৭ সালে আইএনএ-র মোট ধনসম্পত্তি দেখে আসার জন্য একটি কমিটি গড়া হয় ভারতে। এর নেতৃত্বে ছিলেন রামারাও বেনেগাল। তিনি ফিরে এসে রিপোর্টে স্পষ্ট লিখেছিলেন, আইএনএ-র সম্পত্তি যথেচ্ছভাবে সরানো হচ্ছে এবং এর পিছনে হাত রয়েছে এস রামমূর্তির!
কেন্দ্রীয় কমিটির রিপোর্ট দেওয়া সত্ত্বেও কেন ভারত সরকার কোনও পদক্ষেপ করল না তা অজানা রয়ে গেছে আজও। তবে এর পরবর্তীতে ১৯৫১ সালে আরোও একটি তদন্তকারী কমিটি গড়া হয়। এই কমিটির নেতৃত্বে ছিলেন কে কে চিত্তুর। চিত্তুর নিজের রিপোর্টে জানান, নেতাজির অন্যতম ঘনিষ্ঠ এস এ আইয়ার আইএনএ-র ধন সম্পত্তি নিয়ে তছরুপ করছে। স্থানীয় লোকেরাও জানান, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত জাপানে যেরকম বিলাসে জীবন কাটাচ্ছেন আইয়ার এবং রামমূর্তি তা সন্দেহের উদ্রেক করে। উপরন্তু জানা যায়, বিগত চার পাঁচ বছরে আইয়ার এবং রামমূর্তির মধ্যে বিভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকটি মিটিং হয়েছে। চিত্তুর নিজের রিপোর্টে দাবি করেন, রামমূর্তির হাতে ওই ধনসম্পত্তি আসার পর তিনি এবিষয়ে আইয়ারকে জানান। তারপর দু'জনে মিলে সেগুলি ভাগাভাগি করে বহাল তবিয়তে জীবন কাটাচ্ছেন। এই সময় রামমূর্তির সঙ্গে এক ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স অফিসারের ঘনিষ্ঠতার খবর সামনে আসে। শোনা যায় যুদ্ধ পরবর্তী সময় ওই অফিসার রামমূর্তিকে ব্রিটেনে স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। এই খবর সামনে আসতেই হইচই পড়ে যায় দেশজুড়ে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে অনুরোধ করে যেন এই বিষয়টি নিয়ে অতি অবশ্যই তদন্ত করা হয়।
আরও পড়ুন- ‘প্রথম প্রেম’ বিদেশিনীর সঙ্গে || আড়ালে থেকে গেলেন প্রেমিক সুভাষচন্দ্র বসু
এর জবাবে ১৯৫৩ সালের ১৮ অক্টোবর, জওহরলাল নেহেরু একটি চিঠি লেখেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে। চিঠিতে নেহেরু লিখেছিলেন, ভারত সরকার জানে এবং মানে যে আইএনএ-র তহবিল তছরুপ করা হয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে আর কোনও রকম ভাবেই তদন্ত চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। উপরন্তু তারা একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সিঙ্গাপুর, বার্মা, থাইল্যান্ড এবং ব্যাংকক থেকে আইএনএ এবং আইআইএল-এর যে টাকা উদ্ধার করা হয়েছে তা স্থানীয় ছাত্রদের পড়াশোনার কাজে খরচ করা হবে। তবে নেহেরুর এই চিঠিতে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সেই বাক্সগুলির কথা উল্লেখ করা হয়নি যা নিয়ে তিনি প্লেনে উঠেছিলেন। মনে করা হয় এর পিছনে ছিল জওহরলাল নেহেরুর নীরব সম্মতি।
১৯৫৬ সালে বিরোধী এবং জনতার চাপে সরকার আরেকটি তদন্ত কমিটি গড়ে। তারাও এই ধন-সম্পত্তি নিয়ে বিশেষ কিছু সুরাহা করতে পারেনি। ফের ১৯৭১ সালে খোসলা কমিশন তৈরি হয় এই বিষয়ে তদন্তের জন্য। খোসলা কমিশন স্থানীয় মানুষজন এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানের ভিত্তিতে নিজেদের রিপোর্ট পেশ করে। তারা সাফ জানিয়ে দেন, আইএনএ-র তহবিল তছরুপ হয়েছে এবং এর পিছনে হাত রয়েছে এস রামমূর্তি এবং এস এ আইয়ারের। যদিও প্রমাণের অভাবে তাদের বিরুদ্ধে কোনও মামলা দায়ের করা যায়নি। রামমূর্তি এবং আইয়ারের পরিবার অবশ্য এই দাবিকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছে। ২০১৫ সালে এক সাক্ষাৎকারে এস এ আইয়ারের পুত্র ব্রিগেডিয়ার থ্যাগরাজন বলেন, “১৯৮০ সালে আমার বাবা মারা যান। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সম্বল ছিল পেনশন। সামান্য মাথা গোঁজার জন্য বাড়িও বানিয়ে যেতে পারেননি। এই অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।” বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী আইএনএ-র চুরি যাওয়া সম্পত্তির মোট পরিমাণ ছিল প্রায় ২৫০ কোটি টাকা! এই এত বিপুল পরিমাণ ধন-সম্পত্তি কোথায় গেল বা শেষ পর্যন্ত কী হল, সবকিছুরই উত্তর আজও ধোঁয়াশায় ঘেরা।