শিশুর তেষ্টা মেটানোর শাস্তি মৃত্যু! স্বাধীনতার ৭৫ ও লজ্জার দলিত ভারত
একদিকে যখন ভারতের আদিবাসী সমাজের একজন দেশের রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হয়েছেন, সেখানে শুধুমাত্র জল খাওয়ার জন্য শিক্ষকের অকথ্য অত্যাচার সহ্য করতে হলো ৯ বছরের এক প্রান্তিক শিশুকে।
স্বাধীন দেশ হিসেবে ৭৫ বছর কাটিয়ে ফেলল ভারত। ধুমধাম করে পালিত হচ্ছে আজাদি কা অমৃত মহোৎসব। চতুর্দিকে রোশনাইয়ের মেলা। ভারতের ঘরে ঘরে উড়ছে তিরঙ্গা। কিন্তু কিছু ঘটনা সরাসরি প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে এই ব্যাপক উৎসব-আয়োজনের যৌক্তিকতা নিয়ে। রাজস্থানে স্রেফ দলিত হওয়ার অপরাধে শিক্ষকের হাতে মার খেয়ে প্রাণ গেল ৯ বছরের এক পড়ুয়ার। ছেলেটির 'অপরাধ' ছিল, শুধুমাত্র সে খেতে চেয়েছিল জল। তবে শুধুমাত্র তার দলিত শ্রেণিভুক্ত হওয়া যে তার মৃত্যু ডেকে আনবে, এটা হয়তো কোনওদিন ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি ওই শিশুটি।
ঘটনাটির ব্যাপারে একটু জেনে নেওয়া যাক আগে। আদতে মূল ঘটনাটি ঘটেছিল ২০ জুলাই তারিখে। রাজস্থানের জালোর জেলার সায়লা গ্রামের একটি বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকের বিরুদ্ধে এক দলিত পড়ুয়াকে বেধড়ক মারধরের অভিযোগ ওঠে। শিশুটির চোখে এবং কানে গুরুতর চোট লাগে। স্কুলের অন্য পড়ুয়াদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায়, আক্রান্ত ওই পড়ুয়া কেবলমাত্র শিক্ষকের বোতল থেকে জল খেয়েছিল। কেবলমাত্র এই অভিযোগেই ওই পড়ুয়াকে পেটানো শুরু করেন অভিযুক্ত শিক্ষক। অতর্কিতে মারধর খেয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে ওই শিশুটি। পরিস্থিতি এমনই খারাপ অবস্থায় পৌঁছয় যে, পড়ুয়াকে চিকিৎসার জন্য সরাসরি আমেদাবাদে পাঠানো হয়। সেখানে প্রায় ২০ দিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ার পর শনিবার ওই পড়ুয়ার মৃত্যু ঘটেছে। ঘটনায় নিন্দার ঝড় উঠেছে গোটা ভারতে।
পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, এই ঘটনার জেরে ওই এলাকায় দলিত এবং উচ্চবর্ণের মানুষের মধ্যে হিংসা ছড়ানোর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। অভিযুক্ত শিক্ষক অর্থের জোরে এই নিহত দলিত শিশুটির পরিবারের মুখ বন্ধ করারও চেষ্টা করেছে বলে জানা যাচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে এলাকায় ইন্টারনেট বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজস্থান সরকার। মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলট ঘটনায় দুঃখপ্রকাশ করে জানিয়েছেন, দ্রুত এই ঘটনার সুবিচার করা হবে এবং আক্রান্ত পড়ুয়ার পরিবার সুবিচার পাবেই। স্থানীয় আধিকারিকদের এই ঘটনায় দ্রুত তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি এবং আক্রান্তের পরিবারকে ৫ লক্ষ টাকা আর্থিক সাহায্য করার ঘোষণা করেছেন।
আরও পড়ুন: খাঁচাবন্দি জীবন, রান্নাঘরে বারুদের গন্ধ! কেমন আছেন কাশ্মীরের মেয়েরা?
কিন্তু সত্যিই কি এই তদন্ত আর আর্থিক সাহায্যের ঘোষণা ভারতের এই দলিত সমাজের নিপীড়নের মানচিত্রে একচিলতে দাগ কাটতে পারবে? একদিকে যখন ভারতের আদিবাসী সমাজের একজন দেশের রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হয়েছেন, সেখানে শুধুমাত্র জল খাওয়ার জন্য শিক্ষকের অকথ্য অত্যাচার সহ্য করতে হলো ৯ বছরের একজন প্রান্তিক শিশুকে। সংবিধান বলে, ভারতে সমস্ত সম্প্রদায়ের বা বর্ণের অধিকার সমান। হয়তো শহুরে এলাকার জন্য কিছুটা হলেও সত্যি তা। কিন্তু ভারতের গ্রামীণ অঞ্চলে কি সংবিধানের এই নিদান আদৌ বলবৎ হয়? নানা সময় ভারতে এভাবেই দলিত সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নেমে এসেছে আক্রমণ। নির্লজ্জ সাম্প্রদায়িক মানসিকতা, বর্ণবৈষম্য ও বর্ণভিত্তিক লিঙ্গবৈষম্যের উদাহরণও কিন্তু সৃষ্টি করেছে এই ভারতই। এই সমস্ত ঘটনাই বারবার কালিমালিপ্ত করে ভারতের গরিমাকে। প্রশ্ন তোলে, ব্রিটিশ শৃঙ্খলামুক্ত ভারত ৭৬ বছরে পা দিয়ে কি সেকেলে ধ্যানধারণা ভুলতে পেরেছে? প্রাপ্তির ভাঁড়ার কি সত্যিই একেবারে টইটম্বুর?
ভারতে এই মুহূর্তে হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও ভারতে কিন্তু একটি বহুবিশ্বাসী গণতন্ত্র রয়েছে। ২০১১ সালের আদমশুমারির তথ্য অনুযায়ী, ভারতের জনসংখ্যার ৭৯.৮ শতাংশ হিন্দু। তবে এছাড়াও ১৪.২৩ শতাংশ মুসলিম, ২.৩০ শতাংশ খ্রিস্টান, ১.৭২ শতাংশ শিখ, ০.৭০ শতাংশ বৌদ্ধ এবং ০.৩৭ শতাংশ জৈন রয়েছে। ভারতের সংবিধান এদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে থাকে। সংবিধানের পরতে পরতে এদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও ভারতীয় সংবিধান প্রত্যেকটি জাতি, ধর্ম এবং বিশ্বাসের স্বাধীনতা রক্ষা করে।
তবে ভারতীয় গণতন্ত্র ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই অবস্থার অবনতি হয়েছে বহু মাত্রায়। ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মানুষের ওপরে নিপীড়ণ এবং বৈষম্য মাত্রাতিরিক্ত ভাবে বেড়েছে। ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস দাবি করছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ৮ বছরের শাসনকালে দেশে সাম্প্রদায়িক হিংসার ১০ হাজারটি ঘটনা ঘটেছে। মুম্বই মিরর-এর একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, সাম্প্রতিক ইতিহাসে যে ক'টি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে, সেখানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপির ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। রামনবমীর মিছিলে সহিংসতা থেকে শুরু করে জ্ঞানবাপী মসজিদ মামলার মতো ঘটনাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে এই রিপোর্ট তৈরি করেছিল মুম্বই মিরর।
এই সমস্ত ঘটনা যে ভারতের সাম্প্রদায়িক বিভাজন বৃদ্ধি করতে শুরু করেছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ২০২০ সালে ৮৫৭টি সাম্প্রদায়িক বা ধর্মীয় দাঙ্গার মামলা নথিভুক্ত হয়েছে সারা ভারতে। ২০১৯ সালে এই সংখ্যাটা ৪৩৮। ২০১৮ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ৫১২টি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। ২০১৭ সালে ৭২৩টি এবং ২০১৬ সালে ৮৬৯টি সাম্প্রদায়িক বা ধর্মীয় দাঙ্গার মামলা নথিভুক্ত করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তরফ থেকে। এরপরেও রয়েছে দলিত শ্রেণির ওপর আক্রমণের ঘটনা। ২০১৩ সালের উত্তরপ্রদেশে দলিত নারীদের গণধর্ষণের ঘটনা আজকেও নাড়িয়ে দেয় গোটা ভারতকে। এছাড়াও মাঝেমধ্যেই খবরে ওঠে দলিতদের নগ্ন করে মিছিল করানোর মতো ঘটনাও। উত্তরপ্রদেশে আজও এমন বেশ কিছু মন্দির রয়েছে, যেখানে দলিতদের প্রবেশ নিষেধ। তথাকথিত উচ্চবর্ণের মানুষ যে আচরণ তাদের সঙ্গে করে, তাকে পাশবিক বললেও অর্ধেক বলা হয়। রাজস্থান এবং মধ্যপ্রদেশের গ্রামীণ অঞ্চলেও ছবিটা কিছুটা একইরকম।
সংখ্যালঘুদের সুরক্ষায় যথেষ্ট কাজ না করার জন্য ২০১৪ সাল থেকেই ভারতীয় জনতা পার্টি-র সরকারের সমালোচনা করেছে মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলি। 'হিউম্যান রাইটস ওয়াচ' ২০১৯ সালের একটি প্রতিবেদনে দাবি করেছে, "ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং অন্যান্য দুর্বল সম্প্রদায়ের ওপর সংখ্যাগুরু হিন্দু তথা বিজেপি সম্প্রদায়ের নেতারা প্রায়শই আক্রমণ করে থাকে। তবে এই সমস্ত ঘটনার সঠিক তদন্ত করতে অপারগ ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। এমনকী, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশাবলী পর্যন্ত যথাযথভাবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার।" ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, ডিসেম্বর ২০১৯ সালে সংসদে পাস হওয়ার পরেও দেশে ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে একটা উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। এই আইনটি পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান এই তিনটি দেশের অ-মুসলিম অভিবাসীদের, অন্যদিকে হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারসি এবং খ্রিস্টান- এই ছয়টি ধর্মের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের জন্য ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়ার পথ উন্মুক্ত করছে। এই আইনের বৈষম্য স্পষ্টত দৃশ্যমান। মোদি সরকার যুক্তি দেয়, তিনটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে দুর্বল ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য এই আইন তৈরি করা হয়েছে। এই বিষয়টা সর্বৈব সত্য যে, উপরিউক্ত তিনটি দেশে হিন্দুদের ওপর আক্রমণের ঘটনাও নেহাত কম নয়। কিন্তু, একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের আইনের ঘেরাটোপ থেকে একটি বিশেষ ধর্মকে বাদ দিয়ে দেওয়া ভারতের অবস্থান কোথায় নিয়ে যায়, তা শাসক ভেবে দেখছে কি?
একটি সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমের একটি সমীক্ষা থেকে উঠে আসে, ২০১৭ থেকে ভারতীয় জনতা পার্টি-র নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স সরকারের অধীনে ভারতের সাম্প্রদায়িক হিংসা প্রতি তিন বছর অন্তর ২৮ শতাংশ করে বৃদ্ধি পেয়েছিল। ২০১৭ সালে ভারতে ৮২২টি এই ধরনের সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছিল। ২০০৮ সালে সর্বোচ্চ ৯৪৩টি ঘটনা ঘটেছিল, যে-সময় কেন্দ্রের ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস। তবে ২০২০ সালে সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা ২০১৯-এর প্রায় দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়ায়। ২০২০ সালের জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারিতে উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে নাগরিকত্ব আইন এবং সাম্প্রদায়িক হত্যার ক্ষত এখনও দগদগে। দিল্লির জাহাঙ্গিরপুর এলাকায় ধর্মভিত্তিক সংঘর্ষের ঘটনায় বেশ কয়েকজন সাধারণ মানুষ এবং পুলিশ কর্মকর্তা আহত হন। হনুমান জয়ন্তী উপলক্ষে একটি মিছিলে হিন্দু এবং মুসলিম গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়। মধ্যপ্রদেশে হিন্দু এবং মুসলিম গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ হলে সরকারি কর্মকর্তারা মুসলিম দাঙ্গাকারীদের বাড়িঘর ভেঙে দেয়। উত্তরপ্রদেশে কার্যত বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেওয়া হয় সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি। মোদির নিজের রাজ্যে অর্থাৎ গুজরাতে দাঙ্গাবাজরা সংঘর্ষের সময় সাধারণ মানুষের দোকানে ভাঙচুর চালায়। একজন মারাও যান সেই ঘটনায়।
ব্রাউন ইউনিভার্সিটি ভারতীয় আন্তঃসাম্প্রদায়িক সংঘাত বিষয়ে বিশেষজ্ঞ আশুতোষ ভার্সনি বলছেন, "হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা যত বেশি সময় ক্ষমতায় থাকবেন, তত বেশি পরিবর্তন হবে মুসলমানদের মর্যাদা। আর যত বেশি মর্যাদাহানি হবে মুসলমানদের, ততই কঠিন হবে এই ধরনের পরিবর্তনকে শোধন করা। তার সঙ্গে সঙ্গেই বৃদ্ধি পাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা।"
তবে এই হিন্দু এবং মুসলিম সমস্যা ছাড়াও ভারতে আরও একটা সাম্প্রদায়িক সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে বিগত কয়েক বছরে। এই মুহূর্তে ভারতে প্রায় ১৬০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষকে 'অমঙ্গল' হিসেবে বিবেচনা করা হয়, এই ২০২২ সালেও। তথাকথিত উচ্চবর্ণের মানুষেরা তাদের জন্মকে অশুদ্ধ বলে দাগিয়ে দেন। এই মানুষদেরই চিহ্নিত করা হয় দলিত নামে। এই মানুষগুলোর বিরুদ্ধে বিগত কয়েক বছরে ঘটেছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের একাধিক ঘটনা। কোথাও ফুল তোলার জন্য দলিত ছেলেকে পিটিয়ে হত্যা করা, কোথাও আবার তিনদিন ধরে পুলিশের হাতে দলিত নির্যাতন, আবার ডাইনি অপবাদে বিহারে দলিত মহিলার নগ্ন প্যারেড, মূলধারার ভারতীয় সংবাদপত্রের শিরোনামে স্থান পেয়েছে এই খবরগুলি। এর পাশাপাশি কুর্নুলে লকাপে দলিত সম্প্রদায়ের মানুষদের অকথ্য অত্যাচার করে হত্যা করা, সংঘর্ষে ৭ জন দলিতকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা, হরিয়ানায় পাঁচ জন দলিতকে পিটিয়ে হত্যা করা, দলিত মহিলার গণধর্ষণ, সবকিছুই দেখেছে ভারত। হিউমান রাইটস ওয়াচ-এর একজন সিনিয়র গবেষক স্মিতা নারুলা বলছেন, "আমরা ২০২২ সালে এসে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু এখনও ভারতে এমন কিছু জায়গা রয়েছে, যেখানে দলিতদের একঘরে করে রাখার প্রথা চলে। তারা একই মন্দিরে যেতে পারেন না, উচ্চবর্ণের লোকের উপস্থিতিতে জুতো পরতে বা চায়ের স্টলে একই সঙ্গে চা পান করার অনুমতি পান না। ভারতের অস্পৃশ্যদের সর্বনিম্ন চাকরিতে নিযুক্ত করা হয়। তবে শুধুমাত্র যে ভারতের দলিত সম্প্রদায় এই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন, তা বলা ভুল হবে। ভারতে আরও কিছু নিম্ন সম্প্রদায়ের এবং নিম্নবর্ণের মানুষ রয়েছেন, যাঁরা কিনা উচ্চবর্ণের মানুষের সঙ্গে একসঙ্গে হাঁটাচলা করারও অনুমতি পান না।"
ভারতের গ্রামীণ অঞ্চলে জাতপাতের বৈষম্য এতটাই প্রকট যে, উচ্চবর্ণের মানুষ, নিম্ন সম্প্রদায়ের মানুষের হাত থেকে জল পান করতে পর্যন্ত আপত্তি করে থাকেন। আদমশুমারির তথ্য অনুসারে ভারতের নিম্নবর্ণের জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি এখনো ভূমিহীন। আর এই জনসংখ্যার মধ্যে একটা বড় অংশ বাল্মিকী সম্প্রদায়ের মানুষ। গ্রামের দিকে বাল্মিকী সম্প্রদায়ের একটা বড় জনঘনত্ব রয়েছে। ভারতের মেথররা বেশিরভাগই বাল্মিকী সম্প্রদায়ের মানুষ হন। উচ্চবর্ণের পুরুষদের জন্য, একজন বাল্মিকী নারীকে ধর্ষণ করা শুধুমাত্র তার বর্ণের বিশেষ অধিকারের লক্ষণ হয়ে উঠেছে ভারতের বেশ কিছু জায়গায়। বিভিন্ন জায়গায় অস্পৃশ্যদের ওপরে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করার এক দীর্ঘলালিত প্রবণতা তৈরি হয়েছে উচ্চবর্ণের মানুষের। আর এই প্রবণতাই পরবর্তীতে তথাকথিত নিম্নবর্ণের নারীদের শরীরের ওপরে অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রবণতায় পর্যবসিত হয়।
গভীর সাম্প্রদায়িক মানসিকতা, ধর্ম এবং বর্ণভিত্তিক হিংসা ভারতের নিয়তি রয়ে গিয়েছে সেই স্বাধীনতার সময় থেকেই। আসলে ভারতে কখনওই তেমনভাবে সব ধর্মের মধ্যে সার্বভৌমত্ব ছিল না। নিম্নবর্ণে জন্মগ্রহণ করলে উচ্চবর্ণের ছায়াতেও হাঁটতে পারবে না, এটা আগাগোড়াই ছিল ভারতের ধর্মীয় ডিএনএ-র মধ্যে। অন্যদিকে, উচ্চবর্ণের পরিবারের জন্ম নেওয়ার কারণে সেঁটে যায় পবিত্রতার লেবেল। কিছুদিন আগে একটা ঘটনা ঘটেছিল একটি স্কুলের মিড ডে মিল দেওয়ার সময়। সেখানে রাঁধুনি দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত হওয়ার কারণে উচ্চবর্ণের পড়ুয়ারা তার হাতে রান্না করা মিড ডে মিল খেতে রাজি হয়নি। ভারতের এই সাম্প্রদায়িক মানসিকতা এতটাই ভারতীয়দের মননকে আঁকড়ে ধরেছে যে, স্কুলের পড়ুয়ারাও বর্ণবিভাজনের সমীকরণে বিশ্বাসী, অবশ্য তা কেবল আজ নয়, ইতিহাসেও এর দৃষ্টান্ত আছে। আম্বেদকরের স্কুলজীবনের গল্প স্মর্তব্য এক্ষেত্রে।
আন্তর্জাতিক মানচিত্রে ভারত নির্লজ্জ সাম্প্রদায়িক মানসিকতা এবং বর্ণভিত্তিক বৈষম্যের একটি দেশ হয়ে উঠেছে ক্রমে। আসলে এই বৈষম্যের শিকড় অনেকটাই গভীরে। আর এই শিকড় উপড়ে ফেলা খুব একটা সহজ কখনওই না। তাই স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষপূর্তিতে এই প্রশ্ন বারবার ওঠে, আর্থিক সাহায্য, আদিবাসী রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, বা অপরাধের তদন্ত করে সত্যিই কি ভারতের সাম্প্রদায়িক এবং বর্ণভিত্তিক বৈষম্যকে দূর করা যাবে? না কি আবারও হবে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা?