কুকুরের বিয়েতে খরচ এক লাখ! কলকাতার বাবুদের আশ্চর্য কিসসা
বাবু সম্পর্কে চমৎকার সব কথা লিখেছেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। বাবুমাত্রেই ধনী কিন্তু ধনী হলেই বাবু হয় না। রামদুলাল সরকারের টাকা ছিল, কিন্তু বাবু হননি। তিনি অতি দরিদ্র থেকে বাংলার শ্রেষ্ঠ ধনী হয়েছিলেন।
রাত কত হলো?
কখনও কখনও উত্তর মিলত না।
বড় ঘড়ির কাঁটা ঢং ঢং করে আওয়াজ করছে। এক একটা প্রহর গড়াল। প্রভাতের কপালে সূর্য উঠল। ঘরে ফিরল না `বাবু’।
তখন বাবুদের ছিল বাইজিবাড়ি। জুড়িগাড়ি হাঁকিয়ে, কবজিতে বেলফুলের মালা জড়িয়ে, আতর মেখে, গিলে করা পাঞ্জাবি আর জরিদার ধুতি পরে তারা বাইজিদের বাগানবাড়িতে যেত। তখন সূর্য ক্রমশ ঢলছে।
আরও পড়ুন: খাস কলকাতায় বাগানে ঘুরত জোড়া রয়্যাল বেঙ্গল, রইল ‘বাঘবাড়ি’-র গল্প
তাদের এক হাতে থাকত ধুতির খুঁট, অন্য হাতে সাদা রুমাল অথবা হাতির দাঁতের বাঁটওয়ালা ছড়ি। সবাই ছিল মেজাজি। ইয়ারদোস্ত নিয়ে, টাকা উড়িয়ে, মদ-মাংস খেয়ে গভীর রাতে নেশায় বুঁদ হয়ে তবেই বাড়ি ফিরত। কখনও কখনও বারাঙ্গনা বা বিশ্বস্ত ভৃত্যকে নিজের আঙুল থেকে হিরের আংটি খুলে দিয়ে দিত। কেউ কেউ থেকে যেত বাইজির সঙ্গে। লখনউ বা বেনারস থেকে আনা হতো বিখ্যাত বাইজি। আসত সারেঙ্গি, সানাই। জলসা চলত রাতভর। বাদ্যযন্ত্রে বাজত কখনও মালকোষ, বাগেশ্রী বা দরবারি কানাড়া। বারাঙ্গনাদের দেওয়া হতো মোহর, বেনারসি ও অন্যান্য মূল্যবান উপহার। বৈঠকখানায় ঝুলত বেলোয়ারি ঝাড়, তাতে জ্বলত বিদেশ থেকে আনা মোমবাতি। এগুলি ছিল বাবু কালচারেরই অংশ।
মূলত কলকাতার বনেদি অঞ্চলেই বাবুদের উত্থান ঘটেছিল। বাগবাজার, শোভাবাজার, চিৎপুর— এসব এলাকার জমিদার বা ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে থেকেই বাবুদের আবির্ভাব।
প্রমথনাথ শর্মা ওরফে ভবাণীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা থেকে আন্দাজ করা যায়। সাধারণের পক্ষে বাবু হওয়া সম্ভব ছিল না। তা হতে গেলে কুকুরের বিয়েতে লাখ টাকা খরচ করতে হয়। চার ঘোড়ায় টানা গাড়ি হাঁকিয়ে ভেঁপু বাজিয়ে গঙ্গাস্নানে যাওয়া, দু'-একটা রক্ষিতা রাখা, তাদের বাড়ি বানিয়ে দেওয়া, কবুতর ওড়ানো, বাইজিদের আসর বসানো ইত্যাদিও করতে হত। এসব পাল্লা দিয়ে করতে গিয়ে অনেকেই সর্বস্বান্ত হয়েছে। কিন্তু যার এসব শৌখিনতা করার সামর্থ ছিল না, সে আর যা-ই হোক বাবু হতে পারত না।
'হুতোম প্যাঁচার নকশা' উনিশ শতকের প্রথমার্ধে কলকাতার বাবু-কালচার এবং বাংলার অবক্ষয়িত সমাজজীবনের এক অসাধারণ ও জীবন্ত দলিল। গ্রন্থের ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে সমকালীন কলকাতার সমাজ জীবনের দুর্নীতি, কপটতা ও ভণ্ডামির বিরুদ্ধে শাণিত ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ।
ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ী এবং গ্রাম থেকে কলকাতায় চলে আসা জমিদাররা যে বিলাসবহুল এবং দেখনদারি সংস্কৃতি সূচনা করেছিল, তা হুতোমের নকশা গ্রন্থে বাবু সংস্কৃতি নামে ফুটে উঠেছে।
'হুতোম প্যাঁচার নকশা' গ্রন্থে কলকাতার বিভিন্ন সংস্কৃতি লেখক তুলে ধরেছেন। যেমন নীলের ব্রত, গাজনের সন্ন্যাসী, যাত্রা গান, বুলবুলের গান, আখড়াই, হাফ আখড়াই ইত্যাদি। আবার মদ্যপানের সংস্কৃতিও কলকাতার বাবু সমাজে তখনকার দিনে বেশ প্রচলিত ছিল।
উনিশ শতকে ইংরেজের আগমনে এই কলকাতার বুকে যে পরিবর্তন, উত্থান ও পতন ঘটেছিল তা কালীপ্রসন্ন সিংহ 'হুতোম প্যাঁচার নকশা' গ্রন্থে বেশ ভালোভাবে উপস্থাপিত করেছেন। এই সময় বাঙালিরা ইংরেজের অনুকরণে কখনও কখনও পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করেছে, নানা ভাবে তারা সাহেবিয়ানার প্রকাশ ঘটিয়েছে।
বাবু সম্পর্কে চমৎকার সব কথা লিখেছেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। বাবুমাত্রেই ধনী কিন্তু ধনী হলেই বাবু হয় না। রামদুলাল সরকারের টাকা ছিল, কিন্তু বাবু হননি। তিনি অতি দরিদ্র থেকে বাংলার শ্রেষ্ঠ ধনী হয়েছিলেন। খুব সাধারণ জীবনযাপন করতেন। রামদুলাল দু'বেলা নিরামিষ খেতেন। দুপুরবেলা ভাত-দুধ আর দু'-একটি মিঠাই আর রাতে আটার রুটি। খুব সাধারণ পোশাক পড়তেন। নিজের ছেলের বিয়েতে তিনি শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কয়েকদিনের জন্য একজন প্রহরীকে নিয়োগ করেন। সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত রামদুলাল সাধারণ বেশে বিবাহ-সংক্রান্ত কাজ দেখাশোনা করতে গিয়ে কাজ-শেষে পুনরায় গৃহে প্রবেশ করতে চাইলে প্রহরীটি রামদুলালকে চিনতে না পেরে পথরোধ করে। কারণ ধনী লোকদের জীবনযাপন এত সাধারণ হতে পারে, প্রহরীটি ভাবতেই পারেনি। সাদাসিধে জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত মানুষ ‘বাবু’ হতে পারে না। রামদুলালের মতো বাংলার সবচেয়ে ধনী মানুষটিকে তাই তাঁর বাড়ির ভাড়াটে প্রহরী বাবু বলে চিনতে পারেনি।
বাবু হতে গেলে কুকুরের বিয়েতে লাখ টাকা খরচ করা, চার ঘোড়ার গাড়ি চড়ে ভেঁপু বাজিয়ে স্নান করতে যাওয়া, দু'-একটি 'রাঁঢ়' রাখা, রক্ষিতাদের দালান কোটা করে দেওয়া, পায়রা ওড়ানো, বিদ্যাসুন্দরের আসর বসানো, শনিবারের রাতে 'বাঈ-বেশ্যা' নিয়ে আসর বসানো- ইত্যাদি করতে হয়। বহু বাবু পাল্লা দিয়ে লোক দেখানো এসব করতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছিলেন। মোট কথা বাবু শুধু ভোগ করতে চান না, খ্যাতি চান; সকলের সঙ্গে টাকা ওড়ানোর প্রতিযোগিতা করে সবার ওপরে থাকতে চান। কলকাতার বিখ্যাত আট বাবু ছিলেন এর মধ্যে অগ্রগণ্য। কলকাতার আট বাবুর মধ্যে ছিলেন নীলমণি হালদার, রামতনু দত্ত, গোকুলচন্দ্র মিত্র, রাজা রাজকৃষ্ণ, কালীপ্রসন্ন সিংহর পূর্বপুরুষ ছাতু সিংহ, দর্পনারায়ণ ঠাকুর, রাজা সুখময় রায় এবং চোরাবাগান মিত্রবংশের এক বাবু; এঁরাই ছিলেন আটবাবু। পরবর্তীকালে নামডাক-সম্পন্ন আরও বাবু এসেছিলেন, কিন্তু এই আটবাবুই হলেন ‘কলিকাতার প্রথম বাবু’।
উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ‘নববাবুবিলাস’ বইয়ে প্রমথনাথ শর্মা ছদ্মনামে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতার বাবুদের পরিচয় দিয়েছেন। তখন অবশ্য ধনী ও শিক্ষিতদের নামের আগে ‘বাবু’ শব্দটি ব্যবহৃত হতো। আগে থেকে এটি ব্যবহারের অধিকার কারও ছিল না। এটা ছিল নবাবদের দেওয়া উপাধি। সম্মানিত ধনাঢ্য ব্যক্তি ছাড়া কাউকে তারা এই পদবি দিত না। তবে ইংরেজ শাসন শুরুর পর ‘বাবু’ নামে নতুন এক শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। সবাই যেখানে-সেখানে বাবু বনে গেল। পুরনো ধনী সম্প্রদায় বিদায় নিল। আবির্ভূত হলো নব্য ধনিক শ্রেণি। এরাই তখন ‘বাবু’।
বাবু স্বভাব ও অভ্যাসের বর্ণনা দিতে তাঁর রচনায় বাবু চরিত্রের বর্ণনা দিয়েছেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
যাঁহারা বাক্যে অজেয়, পরভাষাপারদর্শী, মাতৃভাষাবিরোধী, তাহারাই বাবু। মহারাজ। এমন অনেক মহাবুদ্ধিসম্পন্ন বাবু জন্মিবেন যে, তাঁহারা মাতৃভাষায় বাক্যালাপে অসমর্থ হইবেন। যাঁহাদিগের দশেন্দ্রিয় প্রকৃতিস্থ, অতএব অপরিশুদ্ধ, যাঁহাদিগের কেবল রসনেন্দ্রিয় পরজাতিনিষ্ঠীবনে পবিত্র, তাঁহারাই বাবু।
তাই বাবু আর কোনও উপাধিতে সীমাবদ্ধ থাকল না, হয়ে উঠল আদ্যন্ত `রসেন্দ্রিয়’ তুষ্টকারী এক অবক্ষয়িত সমাজের প্রতিনিধি।