শেষ পঞ্চাশ বছরে বেশিরভাগ কবিই রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ার আকর্ষণ বোধ করেননি
১৯৬৫ সাল, যখন হাংরি জেনারেশন আন্দোলন শুরু হলো, তখন থেকেই যদি ধরি, তাহলে দেখব, রবীন্দ্রনাথের কবিতার আকর্ষণ ক্ষীয়মান হতে হতে আজ তিন-চার শতাংশ কবির মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের কবিতার প্রতি অনুরাগ বজায় রয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের কবি-পরিচয় বিগত পঞ্চাশ বছরের অধিক সময় ধরে ক্রমশ ম্লান হয়ে এসেছে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে তাঁর যে কবিতাগুলি রয়েছে, অথবা তাঁর কাব্যে প্রকৃতি, মানবতা, উপনিষদের উপস্থিতি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে যেসব গবেষণা হয় বা হয়েছে- সেগুলির বাইরে রবীন্দ্রনাথের কবিতার অস্তিত্ব অনেকটা ক্ষীণ হয়ে এসেছে বলে আমি অন্তত গত পাঁচ দশকে দেখতে পেয়েছি।
আমি নিজে কবিতা লেখার চেষ্টা করে চলেছি ১৩ বছর বয়স থেকে, এখন আমার বয়স আটষট্টি। আমি এখনও নিয়মিত রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ি। কিন্তু আমি লক্ষ করেছি একটা বিষয়। ১৯৬৫ সাল থেকে যাঁরা কবিতা লিখতে এসেছেন, তাঁদের সকলের লেখা আমি পড়েছি। কারও কারও সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় হয়েছে আমার। এই পরিচিতজনদের অনেকের কাছেই তাঁর প্রথম পরিচয়, রবীন্দ্রসংগীতের স্রষ্টা তিনি। এই পরিচয়টি সর্বাপেক্ষা উচ্চতর পর্যায়ে অবস্থিত, এবং রবীন্দ্রসংগীতের স্রষ্টা হিসেবে সকল মানুষের অন্তরে স্থান পেয়েছেন তিনি। আমি কিছু প্রবীণ মানুষের মুখে শুনেছি, এবং পড়েওছি, ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষর পর থেকে, রবীন্দ্রসংগীত প্রসার লাভ করতে শুরু করে। সংগীতস্রষ্টা হিসেবে রবীন্দ্রনাথের যে অপ্রতিরোধ্য যাত্রা, বাঙালি হৃদয়ে, তার কোনও তুলনা নেই। পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ, দুই বাংলার ক্ষেত্রেই এই কথা বলা চলে।
এছাড়া রয়েছে নাটক। ১৯৫৪ সালে যখন শম্ভু মিত্রর নির্দেশনায় এবং শম্ভু মিত্র-তৃপ্তি মিত্রর অভিনয়ে 'রক্তকরবী' মঞ্চস্থ হয়, তখন, 'রক্তকরবী' নাটক অভিনেয় নয় বলে যে ধারণা ছিল, তা ভেঙে যায়। নতুন একটা পথ দেখান শম্ভু মিত্র, রবীন্দ্রনাটকের প্রযোজনার ক্ষেত্রে। শাঁওলি মিত্রর লেখা ও অন্যান্য নথি থেকে জানা যায়, যেসময় এই নাটক প্রযোজনা হয়, সেসময় আপত্তি এসেছিল বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষর তরফে, বলা হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথের নাটকের অর্থবিকৃতি ঘটানো হচ্ছে। সেই আপত্তি যদিও শেষাবধি বহাল থাকেনি। ১৯৫৪ সালের 'রক্তকরবী' প্রযোজনা একটি উল্লেখযোগ্য নাট্যবাঁক হিসেবে থেকে গেছে। সাতের দশকে এই অভিনয় আমি দেখি। এরপরও থেমে যান না শম্ভু মিত্র, তিনি 'ডাকঘর' মঞ্চস্থ করেন। সেই প্রযোজনায় শাঁওলি মিত্র, তাঁর বয়স তখন দশও হয়নি, বালক অমলের চরিত্রটি করেন। তা পাঁচের দশকে অভিনীত হয়, সেই অভিনয় আমি দেখিনি। আমি দেখেছি সাতের দশকে 'বহুরূপী' প্রযোজিত 'ডাকঘর'। আজকের দিনের প্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রী চৈতি ঘোষাল ছিলেন অমল, ঠাকুরদা অথবা ফকিরের চরিত্রে ছিলেন স্বয়ং শম্ভু মিত্র, সেই মঞ্চায়নে সেই চরিত্রর উপস্থিতি ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও 'বিসর্জন' করেছিলেন শম্ভু মিত্র। সেই প্রযোজনা আমি দেখিনি, কিন্তু তাঁর মূল চরিত্রাভিনেতা দেবতোষ ঘোষের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ আলাপ ছিল, একানব্বই বছর বয়সে তিনি প্রয়াত হলেন গত বছর। হয়েছে 'রাজা', এই নাটক যে অভিনয় করা যায়, তা তখনও পর্যন্ত ভাবা যায়নি। আমি যখন দেখি, তখন সেই নাটকে সুরঙ্গমা হয়েছিলেন পঁচিশ বছরের শাঁওলি মিত্র, সুদর্শনা ছিলেন তৃপ্তি মিত্র। রাজা, যাকে কখনও দেখা যায় না, সেই চরিত্রে কণ্ঠদান করেছিলেন শম্ভু মিত্র। অর্থাৎ, 'বহুরূপী' নাট্যগোষ্ঠী রবীন্দ্রনাটকের মঞ্চায়নে বড় ভূমিকা নিয়েছিল। পরবর্তীতে যখন কুমার রায় 'বহুরূপী'-র হাল ধরেন, তখন তিনি তাঁর নির্দেশনায় আরেকবার মঞ্চস্থ করেন 'মুক্তধারা'। সেখানে তিনি অভিনয় করেন হুব্বা-র চরিত্রে, দেবেশ রায়চৌধুরী করেন অভিজিতের চরিত্র। 'বহুরূপী'-র চেষ্টায় রবীন্দ্রনাথের রূপক-সাংকেতিক নাটকগুলি গুরুত্ব পেতে থাকে। এই শতকের শুরুর দিকে ব্রাত্য বসুর নির্দেশনায় 'পূর্ব পশ্চিম' নাট্যগোষ্ঠী করে 'চতুরঙ্গ'। শাঁওলি মিত্র প্রতিষ্ঠিত 'পঞ্চম বৈদিক'-এর তরফে 'অচলায়তন' নির্দেশনা দেন অর্পিতা ঘোষ। শুনেছি 'পিএলটি'-র আগে যখন 'এলটিজি' বা লিটল থিয়েটার গ্রুপ ছিল, তখন উৎপল দত্তর নির্দেশনায় হয়েছিল 'অচলায়তন'।
আরও পড়ুন: বইমেলায় অনন্য রায় বললেন, ‘আপনাকে একটু একটু নকল করি’
অর্থাৎ, যাঁরা রবীন্দ্রনাথের গান গেয়েছেন, রবীন্দ্রনাথের নাটক করেছেন, তাঁরা রবীন্দ্রনাথের গান ও নাটককে উচ্চস্তরে নিয়ে গিয়েছেন। তাঁর গল্প-উপন্যাস নিয়েও চর্চা হয়েছে। কিন্তু কবি রবীন্দ্রনাথ, তাঁর বাহান্নটি কাব্যগ্রন্থ নিয়ে তেমনটা ঘটেনি। ১৯৬৫ সাল, যখন হাংরি জেনারেশন আন্দোলন শুরু হলো, তখন থেকেই যদি ধরি, তাহলে দেখব, রবীন্দ্রনাথের কবিতার আকর্ষণ ক্ষীয়মান হতে হতে আজ তিন-চার শতাংশ কবির মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের কবিতার প্রতি অনুরাগ বজায় রয়েছে। আমার অভিজ্ঞতা তাই বলছে। আমি বলতে পারি প্রসিদ্ধ কবি অনির্বাণ ধরিত্রীপুত্রর কথা, প্রয়াত গৌতম বসুর কথা, তাঁদের কাছে রবীন্দ্রনাথের সামগ্রিক কাব্যর মূল্য ছিল বা আছে। শেষ চার দশকে যাঁরা কবিতা লিখতে এলেন, আমি কথা বলে বা তাঁদের লেখা পড়ে দেখেছি, রবীন্দ্রনাথের কবিতা নিয়ে বিশেষ আগ্রহ যে তাঁদের বেঁচে আছে, তা নয়। রবীন্দ্রকাব্যের ব্যাপকতার সম্পর্কে এই শেষ চারটি দশকের কবিদের তেমন ভাবনাচিন্তা নেই। রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবর্ষ যখন বিরাট উদ্দীপনার সঙ্গে এ-রাজ্যে পালিত হলো, তখন কবি রণজিৎ দাশ একটি প্রবন্ধ লেখেন 'চতুরঙ্গ' পত্রিকায়। সেই প্রবন্ধে তিনি আবু সয়ীদ আইয়ুবকে 'স্যর' বলে সম্বোধন করেছিলেন। কিন্তু স্মার্টনেসে ভরা সেই প্রবন্ধে রবীন্দ্রকবিতার মধ্যে প্রবেশ করার কোনও অভিপ্রায় চোখে পড়ে না। আমার কাছে রবীন্দ্রনাথের কবিতার আবেদন কেন বেঁচে আছে, তা বলি।
রবীন্দ্রনাথের প্রথম বই প্রকাশিত হয় ১৮৭৮ সালে। 'কবিকাহিনী'। সেই বইতে এমন সব কবিতা ছিল, যার বিষয়বস্তু আরও বিস্তারিত ও পরিবর্তিত হয়ে তাঁর অন্য কাব্যগ্রন্থে মহাকায়ে অনুধ্যান করেছে। এই গ্রন্থে তা বীজের আকারে ছিল। কেন আমি রবীন্দ্রনাথ এখনও পড়ি? প্রথম কারণ হলো, জীবন। দ্বিতীয়ত, আমি অবাক হয়ে ভাবি, আর একজন কবি কি বাংলায় আমরা পাব, যিনি এতবার নিজেকে ভাঙতে ভাঙতে গেছেন? আমরা যদি তাঁর সূচনাপর্ব দেখি, ১৮৭৮ থেকে ১৮৮১ পর্যন্ত, তাহলে তিনটি কাব্যগ্রন্থ পাব, 'কবিকাহিনী', ১৮৮০-তে 'বনফুল', ১৮৮১-তে 'ভগ্নহৃদয়'। 'কবিকাহিনী'-র আগে 'বনফুল' লেখা হয়েছে, কিন্তু বেরিয়েছে দু'বছর পর। এই পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেমে গেলে তাঁর কাব্যজগতের পরিধি, চিন্তাজগতের বিরাটত্বর হদিশ আমরা পেতাম না।
এরপর আমরা পাই তাঁর উন্মেষপর্ব। ১৮৮২ থেকে ১৮৮৬। এই সময় রবীন্দ্রনাথ কী লিখছেন? 'সন্ধ্যাসংগীত', 'প্রভাতসংগীত', 'শৈশবসংগীত', 'ছবি ও গান'। ১৮৮৪ সালে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর 'ছবি ও গান', তার সঙ্গে সেই বছর প্রকাশিত হলো, 'ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী'। এই বইয়ের কবিতা জনপ্রিয় হয়েছে গান হিসেবে, কারণ শক্তিশালী ও প্রবাদপ্রতিম কণ্ঠশিল্পীরা সেই গান গেয়েছেন, যেমন সুচিত্রা মিত্র গেয়েছেন 'মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম সমান', কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় গেয়েছেন 'শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা'। এছাড়াও বাঙালি আজ বিস্মৃত হয়েছে সন্তোষ সেনগুপ্তর বিষয়ে। রবীন্দ্রসংগীত ও অতুলপ্রসাদের গান খুবই ভাল গাইতেন তিনি। তিনি এই 'ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী', 'চিত্রাঙ্গদা', 'শ্যামা', 'বাল্মীকি প্রতিভা'- এগুলি নির্দেশনা দিয়ে রেকর্ড করান গ্রামোফোন কোম্পানিতে। ফলে, এর প্রচার ছিল। কিন্তু 'ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী' প্রধানত কাব্যগ্রন্থ। এবং আমরা দেখব, কীভাবে নতুন এক অপূর্ব ভাষা তিনি নিয়ে আসছেন এই কাব্যগ্রন্থে। তার আগে বাংলায় এই ভাষায় কবিতা লেখা হয়নি। তখন তাঁর বয়স তেইশ। তখন তিনি সেই প্রবল শোকটি পেয়ে গেছেন। কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি বিখ্যাত কবিতা আছে 'রবীন্দ্রনাথের তেইশ বছরের শোক' নামে। তারপর ১৮৮৬ সালে লিখছেন 'কড়ি ও কোমল'।
এরপর ১৮৯০ সালে 'মানসী'-তে এসে রবীন্দ্রনাথ একটা বিপ্লব ঘটাচ্ছেন আঙ্গিকের নিরিখে। মাত্রাবৃত্ত ছন্দ আজ যে মান্যতা পায়, তা পায় 'মানসী'-র কারণে। এর আগে ছিল 'প্রত্নমাত্রাবৃত্ত' ছন্দ। 'মানসী' যেন একটা বিস্ফোরণ ঘটাল। তখন তাঁর বয়স ২৯। এরপর তিনি লিখলেন 'সোনার তরী'। এর অর্থ তৎকালে মানুষ বুঝতে পারেনি। আজও আমরা অনুধাবন করে উঠতে পারিনি। ১২৯ বছর পেরিয়ে গেছে এই কাব্যের পর, এই সময়ভ্রমণের পরে আজও তার অর্থ অপ্রমেয়।
পাঁচের দশকের কবিদের কবিতা পড়েই একটা প্রজন্ম কবিতা লিখতে শুরু করে দিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ পড়ার তেমন প্রয়োজন তাঁরা বোধ করেননি। ভাস্কর চক্রবর্তী, ষাট দশকের উজ্জ্বলতম কবি বলে যাঁকে আমি মনে করি, তিনি কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়তেন।
এরপর রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, 'নদী', 'চিত্রা', 'চৈতালি', 'কণিকা'। এই 'কণিকা' কাব্যগ্রন্থের যে ফর্ম, তা দেখলে বিস্মিত হতে হয়, যিনি 'মানসী' লিখেছেন, 'সোনার তরী' লিখেছেন তারপর, সেই একই লোক লিখছে 'কণিকা', তা আশ্চর্য করে দেয় না? তারপর তিনি লিখছেন 'কথা ও কাহিনী'। হ্যাঁ, যে কবিতা কাহিনিমূলক, তাকে তুচ্ছ করার প্রবণতা ষাটের পরের কবিদের মধ্যে আছে, যদিও তাঁদের মধ্যে অনেকেই জনপ্রিয়তা লাভ করার কারণে কাহিনিমূলক কবিতা লিখে গেছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বাংলা কবিতাকে যদি মঙ্গলকাব্য থেকে ধরি, তাহলে দেখা যাবে কাহিনিমূলক কবিতার পরিসর আছে, কবিতার সেও এক ধার্য আঙ্গিক। তাকে বাদ দেওয়া চলে না। ১৯০০ সালে এই 'কথা ও কাহিনী'-র সঙ্গেই রবীন্দ্রনাথ লিখছেন 'কল্পনা' ও 'ক্ষণিকা', 'কথা ও কাহিনী'-র সঙ্গে 'কল্পনা' ও 'ক্ষণিকা'-র কি কোনও মিল আছে?
এরপর তিনি আসছেন এক অপূর্ব ধরনের কবিতার মধ্যে। 'নৈবেদ্য', যা এক পূজারীর রচনা বলে মনে হয়। এরপর আসছে 'স্মরণ', এরপর আসছে 'উৎসর্গ'। এরপর তিনি 'খেয়া' পেরিয়ে এসে পড়ছেন 'গীতাঞ্জলি'-তে। 'গীতাঞ্জলি' চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করল। কেবল তা নোবেল পুরস্কার পেল বলে নয়। অন্তত তিন জন নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত, অর্থাৎ পরবর্তীতে পাবেন এই পুরস্কার, পৃথিবীর এমন তিন জন কবির মধ্যে দু'জন এই বই অনুবাদ করলেন, একজন অনুবাদে সাহায্য করলেন। অনুবাদ করলেন স্পেনীয় কবি হুয়ান রামোন হিমেনেথ, যাঁর বিখ্যাত বই 'আমি ও প্লাতেরো'। তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ করতেন। স্পেনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের এই যোগাযোগের কথা এই শঙ্খ ঘোষের লেখায় রয়েছে, আর রয়েছে শ্যামাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় বলে একজন একটি বই লিখেছিলেন, যা 'প্যাপিরাস' থেকে প্রকাশিত। আর অনুবাদ করলেন বিখ্যাত ফরাসি ঔপন্যাসিক-গদ্যলেখক আঁদ্রে জিঁদ, যিনি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর জঁ পল সার্ত্র তাঁকে বলেছিলেন, "আপনি এখন কত স্বাধীন, আপনি এখন যা খুশি লিখতে পারেন।" আঁদ্রে জিঁদকে 'গীতাঞ্জলি' অনুবাদ করার জন্য ইংরেজি ভাষায় গীতাঞ্জলি কে এনে দিলেন? সঁ জন পিয়ার্স, যিনি বইটি এনে দিয়ে বলেছিলেন, "এই কবিকে আমাদের পাশ্চাত্যে দরকার।" তিনি ১৯৬০ সালে নোবেল পুরস্কার পান। তার মানে তিন জন নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-লেখক চেয়েছিলেন 'গীতাঞ্জলি' অনুবাদ হোক। স্পেনীয় পত্রিকা 'সুর'-এ তাঁর কবিতার অনুবাদ প্রকাশিত হলো। বিশ্বব্যাপী খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল তাঁর।
এখন, ১৯১৩ সালে এই নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর তাঁর তো সব পাওয়া হয়ে গেল! পরাধীন দেশে এসে পৌঁছল নোবেল পুরস্কার। তারপর তিনি কী করছেন? 'গীতাঞ্জলি'-র এই বিশ্বব্যাপী প্রসার এবং খ্যাতি, পরাধীন ভারতের জন্য যা এত বড় সম্মান এনে দিল, তা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ কী বললেন? শঙ্খ ঘোষের 'এ আমির আবরণ' পড়লে দেখা যাবে, রবীন্দ্রনাথ মনে করছেন, সেই কবিতা যেন নিজেরই প্রয়োজনে নিজের জন্য লেখা, অন্যর জন্য নয়।
এরপর 'গীতাঞ্জলি'-র সূত্রে লিখেছেন 'গীতিমাল্য', 'গীতালি', এরপর কী লিখছেন? এখানেই আমি আশ্চর্য হই। ১৯১৬ সালে আমরা পাচ্ছি 'বলাকা'। 'গীতাঞ্জলি' লিখে যিনি এত খ্যাতি পেয়েছেন, তিনি সব ভেঙেচুরে দিয়ে 'বলাকা'-য় সম্পূর্ণ নতুন এক আঙ্গিকে চলে গেলেন। লিখলেন, 'মেলিতেছে অঙ্কুরের পাখা/ লক্ষ লক্ষ বীজের বলাকা'। নতুন আঙ্গিক, নতুন এক ভাবনা। এখানেই তিনি থেমে গেলেন না। ১৯২৫ সালে লিখলেন 'পূরবী', ১৯২৭-এ 'লেখন'। 'লেখন' কীভাবে লেখা হয়? তিনি তখন ভ্রমণ করছেন, কখনও চিনে, কখনও জাপানে, রাশিয়ায়, নানা জায়গায়। ওঁর কাছে এসে বিভিন্ন মানুষ কাগজ এগিয়ে দিয়ে কয়েক লাইন লিখে দিতে বলছেন, তিনি সেই আবদার মেটাতে ছোট ছোট কবিতা লিখছেন। ওঁর লেখায় পাওয়া যায়, ওভাবে লিখতে লিখতে ওঁর আঁটো, সংহত পরিসরে লিখতে ইচ্ছে হলো। 'বলাকা'-য় ছিল বিস্তৃতি, 'লেখন'-এ অল্প কথার মধ্যে ধরা রইল কাব্যভাবনা।
এখানে একটি বইয়ের কথা বলা প্রয়োজন, তা কবিতার বই হিসেবে ধার্য হয় না বটে, কিন্তু তা উল্লেখ্য। বইটির নাম 'লিপিকা', যা প্রকাশিত হচ্ছে ১৯২২ সালে। এই ১৯২২ সালে আবার নজরুলও লিখছেন 'বিদ্রোহী'। যা হোক, 'লিপিকা' সম্পর্কে মৈত্রেয়ী দেবীকে এক জায়গায় রবীন্দ্রনাথ বলছেন, তার লিখিত সাক্ষ্য আছে, "একে কি তোমরা গদ্যকবিতা বলবে না? Vers Libre কি একে বলা যায় না?" সরাসরি গদ্যকবিতা রবীন্দ্রনাথ লিখবেন এর পরে। তখনও পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ যা লিখছেন, তা ছন্দে লিখছেন, কবিতার ছন্দে লিখছেন 'বিসর্জন' নাটক, লিখছেন 'কর্ণকুন্তীসংবাদ'। এরপর তিনি চলে গেলেন সম্পূর্ণ গদ্যকবিতায়।
আজ অনেক কবি আছেন, তাঁরা ঘোষণা দেন, রবীন্দ্রনাথের গদ্যকবিতা খুব খারাপ, প্রকাশ্যেই বলেন। এঁরা নিজেরা যদিও গদ্যকবিতা লেখেন, তা জনপ্রিয়ও হয়ে থাকে। কিন্তু গদ্যে যে কবিতা লেখা যায়, তার সূচনাটা যে রবীন্দ্রনাথ করে দিয়েছিলেন, সেই কৃতজ্ঞতা এই অর্ধশতাব্দীর মধ্যে যে কবিরা এসেছেন, তাঁদের মধ্যে দেখা যায়নি, তিন-চার শতাংশ বাদে।
আমি বিস্মিত হই, ১৯৩২ থেকে ১৯৩৬-এর মধ্যে চারটি গদ্যকবিতার বই লিখলেন রবীন্দ্রনাথ। যিনি 'মানসী' লিখেছেন, তিনি ছন্দ ফেলে লিখতে থাকলেন গদ্যে। কল্পনা করা যাক, 'শিশুতীর্থ' কবিতাটির কথা বা 'পৃথিবী' বা 'আফ্রিকা' কবিতার কথা। নিজেকে তিনি কীভাবে ভাঙছেন, তা লক্ষ করার মতো। সাফল্য কিন্তু প্রথম থেকেই পাচ্ছেন। নিন্দা ওর সঙ্গী হয়েছে, একথা একশোবার ঠিক। 'নিন্দা পরব ভূষণ করে গলার কণ্ঠহার', একথা তিনি বলেছেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, সুরেশচন্দ্র সমাজপতি 'সোনার তরী' নিয়ে আক্রমণাত্মক হয়েছেন, কিন্তু 'সোনার তরী' একটি চিরজীবী কবিতা হয়ে রয়ে গেল বাংলা কবিতার ইতিহাসে। কিন্তু 'সোনার তরী'-তে তাঁর কাব্যজীবন থমকে যায়নি মোটেও। নিজেকে ভাঙতে ভাঙতে কোথায় চলে গিয়েছেন, তার ইয়ত্তা নেই।
এই চারটি গদ্যকবিতার বই, 'পুনশ্চ', 'শেষ সপ্তক', 'পত্রপুট' ও 'শ্যামলী' প্রকাশিত যখন হচ্ছে, তখন ওঁর ভক্তরা বলছে 'গবিতা', গদ্য আর কবিতার মিশেলে। রবীন্দ্রনাথ তা সহ্য করলেন। ১৯৩৭ সালে বড় অসুখে পড়লেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯৩৮-এ লিখলেন 'প্রান্তিক'। 'প্রান্তিক' কাব্যগ্রন্থে সনেটের ধাঁচে লেখা হয়েছে কবিতা, কিন্তু কোনও অন্ত্যমিল নেই। লিখছেন এই কাব্যগ্রন্থে,
দেখিলাম... অবসন্ন চেতনার গোধূলিবেলায়দেহ মোর ভেসে যায় কালো কালিন্দীর স্রোত বাহি
নিয়ে অনুভূতিপুঞ্জ
প্যারিসে ততদিনে শুরু হয়ে গেছে সুররিয়ালিস্ট আন্দোলন। দালি তখন কাজ করছেন। এই যে নিজের মৃতদেহ নিজে দেখা, এও কি সুররিয়ালিজম নয়? রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর অনেক পরে ইঙ্গমার বার্গম্যান করবেন 'ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিজ' নামে একটি ছবি, যেখানে কফিনের মধ্যে নিজের শরীর শায়িত দেখতে পাবে এক পথচারী। আর রবীন্দ্রনাথ এই লাইন লেখার অনেক আগে রাশিয়ান ভাষার ঔপন্যাসিক ফিওদোর দস্তয়েভস্কির 'দ্য ডাবল'-এ এক সত্তা আরেক সত্তাকে দেখতে পাচ্ছে।
'প্রান্তিক' লেখার আগে তিনি লিখছেন 'ছড়ার ছবি'। তখন তিনি ছবি আঁকতে আরম্ভ করে দিয়েছেন। তারপর লিখছেন 'আকাশপ্রদীপ', 'নবজাতক', 'সানাই'। 'সানাই'-এর লেখাগুলি ছোট ছোট। মনে পড়ছে,
দূর পথে তার দীপশিখা
একটি রক্তিম মরীচিকা
এরপর ১৯৪০ সালে পৌঁছে, যখন তাঁর জীবন একদম প্রান্তে। তখন লিখেছেন 'রোগশয্যায়', 'আরোগ্য', 'জন্মদিনে'। আর যে লেখাগুলো লিখতে লিখতে মারা যাচ্ছেন, 'শেষ লেখা'।
এই বাহান্নটি, মৈত্রেয়ী দেবীকে বলা রবীন্দ্রনাথের কথা অনুযায়ী 'লিপিকা'-কে ধরলে ৫৩টি বই রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, এবং বারবার ভাঙছেন নিজেকে। 'শেষ লেখা'-র একটি কবিতা আছে, যা তাঁর শেষ তিনটি কবিতার একটি, 'প্রথম দিনের সূর্য'। মুখে মুখে বলেছেন, যাঁরা তাঁর সেবা করছেন, তাঁরা লিখে নিচ্ছেন, এবং সেই খাতা বুকে ধরে সংশোধন করে দিচ্ছেন তিনটি জায়গা। রাণী চন্দর সাক্ষ্যতেই সম্ভবত আছে সেকথা।
শেষ চারটে বই সম্পর্কে তিনি বলছেন 'প্রথম শিথিল ছন্দমালা'। তিনি অনেকদিন ধরেই তখন বলতে শুরু করেছেন, 'আমি ব্রাত্য, আমি মন্ত্রহীন'। 'আমার কবিতা গেলেও বিচিত্র পথে হয় নাই সর্বত্রগামী', একথা বলছেন নিজেই। পরাজয় স্বীকার করছেন, কিন্তু বারবার আনছেন নতুনত্ব।
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর ৩৬ বছর পর শঙ্খ ঘোষ 'দেশ' পত্রিকার সাহিত্য সংখ্যায় লিখছেন 'প্রথম শিথিল ছন্দমালা' নামে একটি প্রবন্ধ। সাগরময় ঘোষ তখন সম্পাদক। শঙ্খ ঘোষের 'ছন্দের বারান্দা' গ্রন্থে সেই প্রবন্ধ পাওয়া যাবে। 'দিব্য কার্পণ্যগুণ' শব্দটা রবীন্দ্রনাথ নিজেই ব্যবহার করেছেন, অল্প কথায় কবিতা লেখা প্রসঙ্গে। কবিতাকে বারবার ভাঙার এই ব্যাকরণ বুঝতে হলে প্রয়োজন রবীন্দ্রনাথের কবিতার নিবিড় অনুশীলন। এবং তা হয়নি বলেই এই শেষ কয়েক দশকের কবিদের কবিতা জনপ্রিয় ও সুখপাঠ্য হলেও তা প্রধানত এক অর্থস্তর-পরিবাহী। এর ব্যতিক্রম চার-পাঁচ জন আছেন, যাঁদের কবিতা বহুস্তরীয় অর্থ বহন করে। কিন্তু বিবরণধর্মী কবিতার দিকেই শেষ ৩২ বছরের কাব্যচর্চার ঝোঁক, সংকেতধর্মী কবিতা রচনার প্রবণতা ধীরে ধীরে মিলিয়ে এসেছে। সংকেতধর্মী কবিতার ক্ষেত্রে, আবারও চার-পাঁচ জন ব্যতিক্রম ছিলেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, শঙ্খ ঘোষ, আলোক সরকার, বিনয় মজুমদারদের কবিতায় একাধিক অর্থস্তর পাওয়া যায়, যা শেষ কয়েকটি প্রজন্মের কবিদের মধ্যে নেই। রবীন্দ্রনাথ যখন তাঁর রীতিমতো জনপ্রিয় গান 'এই আকাশে আমার মুক্তি'-র মাঝে লিখছেন, 'দেহমনের সুদূরপারে/হারিয়ে ফেলি আপনারে', আমরা কি বুঝতে পারছি, 'দেহমনের সুদূরপারে' কোথায়? আমরা ভেবে কুলকিনারা পাই না। এক কবিতায় বলেছিলেন, 'অত চুপিচুপি কেন কথা কও/ ওগো মরণ ও মোর মরণ... যেথা অকূল হইতে বায়ু বয়/ করি আঁধারের অনুসরণ', এই অকূল কোথায়? তা কি আমরা বুঝতে পারি? এই অকূলের ব্যাপ্তিতে আর কে আমাদের নিয়ে যেতে পারেন? শঙ্খ ঘোষ যেন সেজন্যই বলেছিলেন, তাঁর মধ্যে ছিল এক 'কসমিক আই' বা মহাজাগতিক আমি।
রবীন্দ্রনাথ ১৮৭৫ সালে 'হিন্দুমেলার উপহার' লিখছেন, তাঁর প্রথম কবিতা। সেই বছর ২৬ ফেব্রুয়ারি 'অমৃতবাজার পত্রিকা'-য় তা প্রকাশিত হলো। তখন তাঁর বয়স চোদ্দ। 'বনফুল' লিখছেন তাঁর পরের বছর। আমি নবীন কবিদের অনুরোধ করব, সেই সময় বাংলা কবিতার অবস্থাটা ঠিক কী ছিল? বিহারীলাল, নবীনচন্দ্র, হেমচন্দ্ররা লিখছেন তখন। আর ১৯৪১-এ তিনি যখন চলে যাচ্ছেন, তখন 'ধূসর পাণ্ডুলিপি' নিয়ে চলে এসেছেন জীবনানন্দ, 'ঊর্বশী ও আর্টেমিস', 'চোরাবালি' নিয়ে এসেছেন বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, প্রেমেন্দ্র মিত্ররা এসে গেছেন, এসে গেছেন 'পদাতিক' নিয়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও, এসে গেছেন সমর সেনও। অর্থাৎ, একা হাতে বাংলা কবিতাকে কতটা মানুষ করে দিয়ে গেলেন রবীন্দ্রনাথ, যেমন বাচ্চা মানুষ করে, তা ভেবে বিস্ময় জাগেই। নবীন কবিদের অনুরোধ করব, একবার বিবেচনা করতে এর গুরুত্ব, একবার ভেবে দেখতে, বারবার সাফল্য পেয়েও একজন কবি যখন নিজেকে এতবার ভাঙেন, তখন তাঁর অবদানকে স্বীকার না করে উপায় আছে কি?
দ্বিতীয় বিশ্বমহাযুদ্ধর দামামা যখন বেজে গেছে, ১৯৩৯ সাল, সেসময় রবীন্দ্রনাথের একদিন মধ্যরাতে ঘুম ভাঙল, দেখলেন ঘরে কেউ বসে পশম বুনছেন, যাঁরা তাঁর পরিচর্যায় থাকতেন, তেমনই কেউ, রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, 'দেখি তুমি নতশিরে বুনিছ পশম মোর পাশে/ সৃষ্টির অমোঘ শান্তি সমর্থন করি।' তিনি জানেন, নাগিনীরা চারদিকে বিষাক্ত নিঃশ্বাস ফেলছে, তাও তিনি এই পংক্তি লিখলেন। ভাষাটা শেখার জন্য নয়, ক্ষুদ্রের মধ্যে বৃহৎকে দেখার এই অন্তর্দৃষ্টি অনুধাবন করার জন্য নিবিড়ভাবে পড়া প্রয়োজন রবীন্দ্রনাথের কবিতা। এর গভীরতা কি নবীন কবিরা অনুভব করবেন না?
আমি নিজে জীবনভর রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কবিতা লেখার চেষ্টা করে গেছি। এবারের শারদীয়া 'দেশ' পত্রিকাতেও একটি কবিতা প্রকাশিত হবে, যা আসলে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা। যদিও 'আমি' দিয়ে তার বয়ান, কিন্তু আসলে তা যেন রবীন্দ্রনাথেরই ভাষ্য। এভাবেই রবীন্দ্রনাথ আমাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। ছেড়ে যাননি কখনওই।