ভাঙা, অসহায় বাঙালিয়ানা নিজেকে খুঁজে পেল 'বল্লভপুরের রূপকথা'-য়
Ballavpurer Rupkatha: কীভাবে 'বল্লভপুরের রূপকথা' বাঙালিয়ানাকে উদ্যাপন করে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে?
পুঁজির ঠাট-ঠমকের ওপর নির্ভরশীল বলে মঞ্চ থিয়েটারের প্রতি বাদল সরকারের আপত্তি ছিল ঘোরতর। মঞ্চে জমেছে আলো, আর সেই আলোকিত মঞ্চের কেন্দ্র থেকে কত দূরে থাকবেন দর্শক, তা নির্ভর করছে কত টাকার টিকিট কেনার ক্ষমতা আছে তাঁর তারই ওপর। মঞ্চে যখন আলো তখন প্রেক্ষাগৃহ অন্ধকার– যদিও সেখানে বসে আছেন একদল মানুষ, তবু যেন সবাই একা, নিজের পুঁজির প্রতিপত্তিতে একা। এই একার অহমিকা, এই একার অসহায়ত্ব দুই নাটক দেখার অন্ধকার দেওয়াল ঘেরা ঘরে মাথা কুটে মরে। এই একাকিত্ব ফিরে ফিরে আসে, এ-সময়েও আসছে। সমূহের মধ্যে থেকেও একা। পুঁজির দাপটে একা।
এ-সময়টা যে খুব একটা সুবিধের নয়, তা বাংলাভাষী মাত্রেই জানেন। সংকট বহুবিধ, সংকটের কারণও সুজটিল। ভাষিক আত্মপরিচয় ঘেঁটে গেছে, আত্মপ্রত্যয় তলানিতে। বাংলা ভাষা ও বাঙালিত্বের চিহ্নগুলি বজায় রেখে করে-কম্মে খাওয়া যাবে কি না, সে জিজ্ঞাসা উঁকি দিচ্ছে। শুধু উঁকিই দিচ্ছে না, একদল আবার সেগুলি ঢেকে ফেলতে উঠে পড়ে লেগেছেন। তাঁরা উঠে-পড়ে লেগেছেন বলেই অন্য দল ‘আমরা বাঙালি’ ‘আমরা বাঙালি’ বলে ডাক ছাড়ছেন। দুই পক্ষেই ‘অস্বাভাবিক’ একের ক্রিয়া থেকে অন্যের প্রতিক্রিয়া জায়মান। ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দুই আত্মপরিচয়ের সংকট-সঞ্জাত। সংকট উচ্চ ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক বাঙালির মধ্যেই গভীরতর। কলকাতা ও শহরকেন্দ্রিকতার বাইরে থাকা বাঙালির মধ্যে সংকট যে একেবারে নেই, তা নয়, তবে সে সংকটের মাত্রাগত গুরুত্ব শহরের থেকে, মহানগরীর থেকে, খানিকটা কম বলেই মনে হয়।
এই সংকট থেকে একরকম একাকিত্বের অসহায়ত্ব জেগে উঠছে। কী হবে কী হবে ভয়।
আরও পড়ুন: ‘বল্লভপুরের রূপকথা’ ফিরিয়ে আনল বাংলা সিনেমার হারিয়ে যাওয়া ‘ভূত’
অসহায়ত্ব তো বল্লভপুরের ভাঙা-রাজবাড়ির মালিক ভূপতি রায়ের জীবনেও কম নেই। দাঁতের ডাক্তারি পাশ করেছে, চেম্বার নেই। আছে ভাঙা রাজবাড়ি আর চাল-ডাল-সিগারেটের দেনা। গামছা পরে ছাদে মাদুরের ওপর শুয়ে থাকে। মনোহর এসে পাজামা দিয়ে যায়। মনোহর এ-বাড়ির ‘পুরাতন ভৃত্য’। রাজা ভূপতির আসার খবর পাওয়ামাত্র সকালবেলায় হাজির তিন সুবিবেচক পাওনাদার। তারা একালের গলাকাটা কর্পোরেট পাওনাদার নয়– তাদের রাজা সম্বন্ধে সমমর্মিতা গভীর।
বাদল সরকারের নাটক থেকে অনির্বাণ যে ‘বল্লভপুরের রূপকথা’ বুনেছেন, তাতে সহজ-সরল প্রেম প্রসঙ্গ বাদ দিলে যা মন টানে, তা হলো বিভিন্ন শ্রেণির অসহায় মানুষগুলির পারস্পরিক সমমর্মিতা। রাজা তো নামেই রাজা, তার অহংকার নেই মোটে। ‘পুরাতন ভৃত্য’ মনোহরের সঙ্গে তার সম্পর্ক নির্ভরতার, মনোহর যুবক রাজাকে সস্নেহে লালন করে। যিশুর জন্মের পর তাঁকে দেখতে এসেছিলেন তিন জ্ঞানী। রাজার বাড়িতে প্রবেশের খবরে তাঁর কাছে হাজির তিন পাওনাদার। সেই তিন পাওনাদার রাজার সহায়। রাজা-মনোহর-তিন পাওনাদার সবাই মিলে বাড়িটিকে বিক্রয়যোগ্য করে তুলতে চায়। বিক্রয়যোগ্য করে তুললে বাঁচোয়া। যুবক বংশধর সেই টাকায় ধার শোধ করে চেম্বার খুলতে পারবেন। পাওনাদাররাও বেঁচে যাবে।
আরও পড়ুন: ‘দরকার হলে সারাজীবনে চারটে সিনেমা করব, কিন্তু সৎভাবে করব’: অনির্বাণ ভট্টাচার্য
ছবির এই পর্যন্ত এসে মনে হয়, বল্লভপুরের মানুষজনের অবস্থা হালের বাঙালির মতো। আত্মপ্রত্যয়হীন, অসহায় দশা। কী করি কী করি ভাব। কী রাখলে আর কী লুকোলে যে অস্তিত্ব বজায় থাকবে, তা নিয়ে ঘোরতর সন্দেহ। বল্লভপুরে বাড়ি দেখতে আসা বড়লোক ব্যবসায়ীদের জন্য সবাই মিলে ফিরিয়ে আনতে চাইল রাজবাড়ির ঠাট-ঠমক। ফলে তারা প্রকৃতপক্ষে যা, তা ঢাকা দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকায় অভিনয় করতে হলো। রাজার দাঁতের ডাক্তার বন্ধু বহুরূপীর কাছ থেকে ধার করা গোঁফ নিয়ে সাজলেন দেওয়ান। বাকি তিন পাওনাদার রাজ-কর্মচারী। রাজ্য পড়ছে, বাণিজ্য উঠছে। পুরনো বাড়ি সঙ্গে ভূত- দুয়ের সমন্বয় হলে সে-বাড়ির দাম তুঙ্গে। এ-বাড়ির ভূত কেবল ইতিহাসের পাতায় নেই, এ-বাড়িতে প্রেতযোনিপ্রাপ্ত আস্ত একখানা ভূতও আছে। সুতরাং, যারা কিনতে এল, তারা আহ্লাদে আটখানা। তারা ব্যবসাদার। কিন্তু ক্রমশ সে ব্যবসা-অর্থ-প্রতিপত্তির মধ্যে থেকে গেছে ভীতু অসহায় মন।
বেচাকেনার এই হিসেব একালে হলে কী হতো, বলা মুশকিল। রূপকথা বলে অন্যরকম হলো। ক্রেতারা বিক্রেতাদের সঙ্গে মিলে-মিশে সকলে মিলে বাঙালিয়ানার পরম্পরিত সহজ-সরল এক চালচিত্তির খাড়া করে ফেলে এ ছবিতে। সেই চালচিত্তিরে একই সঙ্গে পাশাপাশি আছে ভূত, তার দেনায় ডোবা বংশধর, মনোহর, তিন পাওনাদার এমনকী, দুই ক্রেতাও। সকলেই কোনও না কোনও ভাবে অসহায়।
এই রূপকথার জগৎ থেকে তখন জিজ্ঞাসা পুনশ্চ বর্তমানে ধাবমান।
বেঁচে থাকার, এই সংকটে বেঁচে থাকার তাহলে কি এইটাই উপায়? আত্মপরিচয় ঢাকা দেওয়া আর আত্মপরিচয় প্রকাশ করার খেলা এই ছবিতে আগাগোড়া চোখে পড়ছে। আত্মপরিচয় ঢাকছি প্রত্যয়হীনতা থেকে। তারপর যখন ক্রমশ বোঝা যাচ্ছে, যাঁর কাছে পরিচয় ঢাকছি, তিনি ততটা ভয়ানক নন, বরং খানিকটা অসহায় তখন নিজের ঢাকা খুলে ফেলার সময়। এই যে পারস্পরিক অসহায়ত্ব, সেটা জেনে-বুঝে-চিনে নিজেকে খুলে ফেলা গেল, তাতে বেশ ‘বেঁধে বেঁধে থাকা’ যাচ্ছে। এই রূপকথায় বেঁধে বেঁধে থাকার ফলে বেঁচেও গেল সকলে।
বেঁচে গেল ও থেকে গেল তাদের না-পারা ও যাবতীয় মুদ্রাদোষ নিয়ে।
বাস্তবে এমন হওয়ার নয়। পুঁজি, পুঁজির যুক্তি, সকলকেই কম-বেশি ছিলাটান করে রাখে। উপযোগবাদের রকমই তাই। 'মডার্ন টাইমস' ছবিতে চ্যাপলিন কারখানা থেকে বাইরে এলেন হাত ঘোরাতে ঘোরাতে। সারাদিন স্ক্রু-টাইট করে করে তাঁর হাতদু'টি সেই গতিজাড্যে (inertia) ঘূর্ণায়মান। এই ঘূর্ণি তাঁর হাতদু'টিকে স্ক্রু-টাইট দেওয়ার যন্ত্র করে তুলেছে। সেটাই যেন তাঁর হাতের এক ও অদ্বিতীয় পরিচয়। বল্লভপুরের দেনায় ডোবা রাজা ও তাঁর পাওনাদাররা নিজেদের দুর্বলতা ঢেকে যে পরিচয়ে বড় হয়ে উঠতে চাইছিল ক্রেতাদের কাছে, সেটা থেকে শেষ অবধি বাইরে আসতে পারে তারা। দুর্বলতা ও না-পারা প্রকাশ করতে পারে। এখানেই স্বস্তি, এখানেই জয়।
আমরা কি এই জয়ের সাধনায় যোগ দেব?
নিজেদের অসহায়ত্ব, না-পারা নিয়ে আমরা জাগিয়ে তুলব আমাদের সামূহিক অসহায়ত্বের পারস্পরিকতা? সেই অসহায়ত্ব স্বাভাবিক, সেই অসহায়ত্বই আমাদের সহায়।
সেজন্যই কি 'বল্লভপুরের রূপকথা' বাঙালিয়ানাকে উদ্যাপন করে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে? পর্দার এদিকে বসে দেখছেন যাঁরা, তাঁরা নিজেদের সঙ্গে, নিজেদের অসহায়ত্বের সঙ্গে ছবির মানুষগুলির অসহায়ত্বের যোগসূত্র টের পাচ্ছেন? ভেঙে পড়ছে প্রেক্ষাগৃহে পুঁজির অহমিকা ও পুঁজির অসহায়ত্ব! রাজা আর প্রজা একই তলে, ভাগ করে খাবার খাচ্ছেন। পরিচালক অনির্বাণ সকলের মধ্যমণি হয়ে ছবির যে চেয়ারটায় বসলেন, সেটা ভেঙে পড়ল। বোঝা গেল, সেটা রাজসিংহাসন নয়, ভাঙা চেয়ার। ভাঙা চেয়ারকে ভাঙা চেয়ার হিসেবেই পুনরায় দাঁড় করিয়ে দেওয়া গেল।
যা ভাঙা, তাকে মিথ্যে আত্মপরিচয়ে গোটা না বলে ভাঙা বলেই ডাকা হোক। ভাঙা বলে তো সে মূল্যহীন নয়। ভাঙার আপন ধর্মেই সে সরব ও স্বতন্ত্র। একথাটা বলার সময় এসেছে, রূপকথায় শুধু নয়– রূপকথার বাইরেও।