'জয় তারা' বলে আটকেছিলেন বৃষ্টি, অলৌকিক কাহিনিতে ভরপুর বামাক্ষ্যাপার জীবন

সংসার ত্যাগ করলেও মাতৃভক্তি ছিল তাঁর অসীম। ভরা বর্ষায় তিনি মাকে হারিয়েছিলেন।

কালীর প্রিয় সন্তানদের কথা বলতে গেলে প্রথমেই দু'জনের নাম সামনে আসে। একজন পরমপুরুষ রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব এবং অন্যজন হলেন সাধক বামাক্ষ্যাপা। কালীর চরণে নিবেদিতপ্রাণ অনেক মহাপুরুষের অলৌকিক কার্যকলাপের সঙ্গে আমরা পরিচিত। তাঁরা হলেন, সাধক কমলাকান্ত, সাধক রামপ্রসাদ, সাধক পুরুষ ভবাপাগলা এবং আরও অনেকে।

১৮৩৮ সালের (১২৪৪ বঙ্গাব্দ) ২২ ফ্রেব্রুয়ারি ফাল্গুন মাসের মহাশিবরাত্রির দিন বীরভূম জেলার তা‌রাপুরের কাছে আটলা গ্রামে বামাক্ষ্যাপার জন্ম হয়। তাঁর পিতা সর্বানন্দ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ। তিনি গ্রামের ঘরে ঘরে নিত্যপূজা করতেন। এছাড়া সামান্য কিছু চাষের জমি ছিল, তার থেকে যা ফসল পাওয়া যেত, তাতে কোনওক্রমে দিনাতিপাত করতেন।মাতা রাজকুমারী দেবী সামান্যা গৃহবধূ ছিলেন। ছোটবেলায় বামাক্ষ্যাপার নাম ছিল 'বামাচরণ'। তাঁর একটি ছোট ভাই ছিল, নাম 'রামচরণ'। বোনের নাম ছিল 'জয়কালী' (কেউ কেউ বলেন, তাঁর দুই বোন ছিল,কারও মতে চার বোন)। বামাক্ষ্যাপার যখন মাত্র আঠারো বছর বয়স, তখন হঠাৎ একদিন তাঁর পিতা সর্বানন্দ চট্টোপাধ্যায় প্রয়াত হলেন। ফলস্বরূপ সমস্ত সংসারের দায়িত্ব বামা-র কাঁধে এসে পড়ে, কাজের সন্ধানে বামা হন্যে হয়ে ঘুরতে লাগলেন, কিন্তু লেখাপড়া কিছুই না শেখার ফলে তেমন কোনও কাজ তাঁকে কেউ দিল না। অবশেষে মালুটি গ্রামের জমিদারবাড়ির কালী মন্দিরের ফুল তোলার কাজ পেলেন তিনি। কিন্তু কাজে কিছুতেই মন বসাতে পারেন না বামাচরণ। তাঁর অন্যমনস্কতা লক্ষ্য করে মন্দিরের কর্তৃপক্ষ তাঁকে ফুল তোলার কাজ থেকে ছাড়িয়ে ঠাকুরের ভোগ রান্নার কাজে নিয়োগ করলেন। কিন্তু সেখানেও প্রতিদিন কিছু না কিছু ভুল হতেই থাকল। তাঁর আচার-আচরণে অবাক হয়ে সবাই তাঁকে 'পাগল' বলতে লাগল। শেষ পর্যন্ত জমিদারমশাই তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করলেন।

পরবর্তীকালে এই মালুটিতেই মৌলিক্ষা মন্দিরে তিনি সিদ্ধিলাভ করেন এবং তারপরে তারাপীঠ মহাশ্মশানে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। যাই হোক, বামাচরণ বাড়ি ফিরে এলেন এবং পৈতৃক সম্পত্তি হিসেবে পাওয়া যৎসামান্য জমিটুকুতে চাষ করতে লাগলেন। কিন্তু সেই বছর অসম্ভব প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসল ভালো হলো না। ঘরে অন্নাভাব। মাতা রাজকুমারী দেবী দুই ভাই বামাচরণ এবং রামচরণকে মামাবাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। সেখানে দু'ভাই গরু চড়ানোর কাজ পেল। কিন্তু মামা ও মামির ভয়ানক অত্যাচারে দু'ভাই অতিষ্ট হয়ে উঠল। এরপর তারাপীঠ মহাশ্মশানে বামাচরণের সাক্ষাৎ হলো তান্ত্রিক-সাধক ব্রজবাসী কৈলাসপতি বাবা এবং বেদজ্ঞব্রাহ্মণ মোক্ষদানন্দের সঙ্গে। কৈলাসপতি তাঁকে পঞ্চমুন্ডির আসনে বসিয়ে তান্ত্রিক মতে দীক্ষা দিলেন। সাধনায় সিদ্ধিলাভ করার পর তিনি পরিচিত হলেন 'বামাক্ষ্যাপা' নামে। জনশ্রুতি শোনা যায়, তাঁর ইষ্টদেবী স্বয়ং আবির্ভূতা হন তাঁর সামনে। এরপর একদিন মাতার অনুমতি নিয়ে বামা চিরদিনের জন্য গৃহসংসার ত্যাগ করে তারাপীঠের মহাশ্মশানে শ্মশানবাসী হলেন।

বামাক্ষ্যাপার নানান অলৌকিক কাহিনির জনশ্রুতি রয়েছে। তারাপীঠে তারার নিত্য পূজার ভোগ নিবেদনের সময় বামাক্ষ্যাপা আগেই সেই ভোগ খেয়ে ফেললেন, ফলে মন্দিরের সেবাইত, পুরোহিত সকলেই মারমুখী হয়ে উঠল এবং বামাকে মেরে মন্দির থেকে দূর করে দিল। তখন তারাপীঠের মাতৃমন্দিরের সেবার ভার ছিল নাটোরের রাজবংশের ওপর। সেই রাতে নাটোরের ছোট রানিমা স্বপ্নে তারা মায়ের দর্শন পেলেন, স্বপ্নাদেশ পেলেন, বামা আমার প্রিয় সন্তান, ওকে তোদের লোকেরা মেরেছে। এখন থেকে আগে বামার ভোগ নিবেদন, পরে আমি খাব। ওর যখন যা মনে হবে, তাই-ই করবে, কেউ যেন বাধা না দেয়। সেই থেকে বামাক্ষ্যাপা মন্দিরে যখন খুশি আসতেন এবং তারা মায়ের সঙ্গে মান-অভিমানের সুরে কথা বলতেন।

আরও পড়ুন: কেন অসম্পূর্ণ জগন্নাথ মূর্তির হাত-পা? অলৌকিক সেই কাহিনি আজও রোমহর্ষক

তারাপীঠে সেইসময় নগেন পান্ডার খ্যাতি খুব ছড়িয়ে পড়েছিল। তাঁরই খুব পরিচিত স্থানীয় এক জমিদার, নাম 'পূর্ণচন্দ্র সরকার' হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। নানা ডাক্তার,কবিরাজ দেখিয়েও কোনও ফল হলো না।তখন নগেন পান্ডা এসে বামাক্ষ্যাপা-কে পায়ে ধরলেন।অনুনয় করে বললেন, ক্ষ্যাপাবাবা যেন মুখে রোগীকে উঠে বসতে বলেন, তাহলেই রোগী ভালো হয়ে যাবে।কারণ বামাচরণ ছিলেন বাকসিদ্ধ মহাপুরুষ। এরপর নগেন পান্ডা খুব আদর করে পালকিতে চাপিয়ে বামদেবকে নিয়ে গিয়ে হাজির করলেন জমিদারবাড়ির অন্দরে, রোগীর কাছে। অনুরোধ করে বাবাকে বলতে বললেন, "তোর রোগ ভালো হয়ে গেছে, তুই উঠে বস।" এইটুকু বামদের বললেই সব ঠিক হয়ে যাবে। শিশুর সারল্যে বামদেব বললেন, "তুই যা বলতে বলছিস আমি তাই-ই বলবো, কিন্তু যদি ভুলে যাই,মনে করিয়ে দিস।" কিন্তু রোগীর শয্যার পাশে গিয়েই উনি যা বললেন তাতে সকলেই হতবাক হয়ে গেল। বামদেব রোগীকে দেখেই বলে উঠলেন,"ওরে,ও নগেন কাকা। এ কার কাছে আনলি রে! এ তো এখনই ফট্ (অর্থাৎ 'শেষ', রোগীর আর আশা নেই)। একথা বলেই বামদেবে সেখানে আর দাঁড়ালেন না, তিনি পালকিতে গিয়ে বসলেন। ততক্ষণে ওদিকে রোগী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। নগেন পান্ডা রেগে বললেন, "আপনাকে বলতে বললাম এককথা আর আপনি বললেন আরেক কথা?" বামাক্ষ্যাপা বললেন, "আমি কি আর এমনি বলেছি রে, আমি তো তোর শেখানো কথাই বলতে চেয়েছিলাম। মা আমাকে বলতে দিল কই? মা বলল বলে দে ফট। আমিও তাই ওকথা বললুম।"

সংসার ত্যাগ করলেও মাতৃভক্তি ছিল তাঁর অসীম। ভরা বর্ষায় তিনি মাকে হারিয়েছিলেন। পারলৌকিক ক্রিয়ার ঠিক দু'দিন আগে ভাই রামচরণ এসে দাদাকে নিমন্ত্রণ করে ক্রিয়াকর্মের সময় উপস্থিত থাকতে বললেন। আপনভোলা বামাখ্যাপা তখন বলে উঠলেন, দু'-চারখানা গ্রামের মানুষকে নেমন্তন্ন করে তৃপ্তিসহকারে খাওয়াবি কিন্তু। ভাই রামচরণ তো থতমত খেয়ে গেল। নিজেদের জন্য দু'মুঠো জোগাড় করতেই যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়, তাদের দু'-দশজনকে খাওয়ানো কি মুখের কথা! তবু দাদার আদেশ মানতেই হবে। কিন্তু কী করেই বা তা সম্ভব হবে! এদিকে চিন্তান্বিত ভাইকে দেখে বামদেব অলক্ষে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলেন। এরপর এল শ্রাদ্ধের দিন। আর সেদিনই ঘটে গেল এক বিস্ময়কর কাণ্ড। সকাল হতে না হতেই রামচরণ দেখলেন, দলে দলে মানুষ আসছে। কারও মাথায় চালের ধামা, কারও বা ফলের ঝুড়ি, কারও হাতে মিষ্টির হাঁড়ি, আবার কারও হাতে শাকসবজি। জিনিসপত্র যা জমা হল, তাতে অনায়াসে তিন থেকে চার হাজার লোক পেট ভরে খেতে পারবে। কিছুক্ষণ পরেই বামদেব এসে হাজির হলেন। বললেন, 'সব ঠিক আছে তো ভাই?' রামচরনের বুঝতে বাকি রইল না, এসমস্ত সিদ্ধপুরুষ তাঁর দাদারই কীর্তি। কিন্তু বিপদ তো পিছু ছাড়ে না। সেই দিনই দুপুর থেকে আকাশে কালো মেঘ ঘনিয়ে এল। বাড়ির মুক্ত চত্বরে ভোজের আয়োজন করা হয়েছিল। অনেক লোকের সেখানে বসে আহার করতে কোনও অসুবিধে হবে না, কিন্তু এমন ভয়ানক এবং ভয়াল আবহাওয়া দেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে সকলেই প্রমাদ গুণলেন। ভাই রামচরণ দাদার কাছে এসে বললেন সব কথা। বামদেব আত্মমগ্ন হয়ে বললেন, "ওরে ভয় পাস না, কিচ্ছু হবে না।" এরপর তিনি একটি কাঠি দিয়ে বাড়ির চারিদিকে গণ্ডি কেটে দিলেন, বললেন, "যতই বৃষ্টি হোক, মায়ের কৃপায় এই গণ্ডি ভেতরে ঢুকতে পারবে না।" হলোও তাই! সবাই অবাক হয়ে দেখল, আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল, আকাশ যত গর্জায়, বামদেব যত জোরে জোরে বলেন, 'জয় তারা, জয় তারা', একফোঁটা বৃষ্টির জলও নাকি গন্ডির ভেতরে ঢোকেনি। অতিথিরা খাওয়া ভুলে এই অলৌকিক দৃশ্য ভয়ার্ত চোখে দেখতে লাগল‌। সকলে জয়ধ্বনি দিতে লাগল, 'জয় বামাক্ষ্যাপার জয়'।

মাত্র ১৯ বছর বয়সে স্বামী বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণদেবের সংস্পর্শে আসেন। বামাক্ষ্যাপার অলৌকিক কার্যকলাপ সন্বন্ধে নানা কথা শুনে তিনি তাঁর কলেজ-সহপাঠী শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীর সঙ্গে তারাপীঠ যান। সেখানে বামাক্ষ্যাপা ও নরেন্দ্রনাথের দেখা হয়। তাঁর সম্পর্কে বামাক্ষ্যাপা তাঁর বন্ধু শরৎচন্দ্রকে বলেন, এই যুবক একদিন ধর্মের মুখ উজ্জ্বল করবে।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্ম হলেও, তিনি বামাক্ষ্যাপাকে দেখার জন্য তারাপীঠ গিয়েছিলেন। সেখানে দু'জনের অনেকক্ষণ কথা হয়। এরপর বামাক্ষ্যাপা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথকে বলেন,

ফেরার পথে ট্রেন থেকে দেখতে পাবে একটা বিশাল মাঠ।

সেই মাঠের মাঝখানে আছে একটা ছাতিম গাছ। তার নিচে বসে ধ্যান করবে ।

দেখবে মনের ভেতর আনন্দের জ্যোতি জ্বলে উঠছে।

ওখানে একটা আশ্রম বানাও দেখি আহা, কি শান্তি! কি শান্তি!

ফেরার পথে সেই মাঠ এবং ছাতিম গাছ দেখে তিনি আশ্চর্য হন এবং সেখানে বসে ধ্যানও করেন। এরপর তিনি ঠিক করেন, যেখানে একটি আশ্রম স্থাপন করবেন। পরবর্তীকালে ওখানেই শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠিত হয় বলে কথিত।

আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মা এবং স্ত্রীকে নিয়ে তারাপীঠের বামাক্ষ্যাপাকে দর্শন করার জন্য গিয়েছিলেন। বামাক্ষ্যাপাকে ভক্তিভরে প্রণাম করে উঠতেই বামাক্ষ্যাপা বললেন,

তুই তো দেখছি বাংলার বাঘ, যা যা তোর মনের ইচ্ছা পূর্ণ হবে। তুই শালা হাই কোর্টের জজ হবি।

স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তখন ছিলেন হাই কোর্টের আইনজীবী। মনের মধ্যে বাসনা ছিল জজ হওয়ার।এরপর ১৯০৪ সালে তিনি হাই কোর্টের জজ হন।

একবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও চারণকবি মুকুন্দদাস গিয়েছিলেন তারাপীঠে বামাক্ষ্যাপার দর্শনের জন্য। সন্ধ্যার সময় বামাক্ষ্যাপার সঙ্গে তাদের দেখা হয়। তাদের দেখেই বামাক্ষ্যাপা মুকুন্দ দাসকে বললেন,

তোর ফুটুস কলটা নদীতে ফেলে দিয়ে আয় তো

তখন চারণকবির কোমরে একটা রিভলভার গোঁজা ছিল। রবীন্দ্রনাথের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোর খুব নামডাক হবে।

বামাক্ষ্যাপার অলৌকিক কার্যকলাপের বিবরণ ব্যাখ্যা করা সহজ নয়। তারাপীঠ সাধনপীঠ হয়েছে শুধু তাঁরই জন্য।

More Articles