দুর্গ, প্রাসাদ আর চোখ ধাঁধানো আরশিমহল! শীতে জমজমাট গন্তব্য বাঙালির এই 'দ্বিতীয় বাড়ি'
Bangalore Tour: ইংল্যান্ডের উইন্ডসর প্রাসাদের অনুকরণে ১৮৮৭ সালে রাজা চামারাজা ওয়াদিয়ের তৈরি করিয়েছিলেন বেঙ্গালুরু প্রাসাদ।
পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া এককালে বাঙালির দ্বিতীয় বাড়ি বলা হতো কাশীকে। কালের নিয়মে এবং কাজের খোঁজে বাঙালির দ্বিতীয় বাড়ি এখন হয়ে উঠেছে বেঙ্গালুরু। ভারতের আইটি হাব অথবা ভারতের সিলিকন ভ্যালি নামে পরিচিত বেঙ্গালুরুতে অসংখ্য বহুজাতিক সংস্থা এবং ইসরোর দপ্তর ছাড়াও রয়েছে বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান। ট্রেন অথবা বিমান যোগে খুব সহজেই বেঙ্গালুরু পৌঁছনো যায়। বেঙ্গালুরু ঘুরতে যাওয়া যথেষ্ট ব্যয় সাপেক্ষ মনে হতে পারে। কিন্তু একটু বুদ্ধি খাটালেই বেশি খরচ না করেও এক থেকে দুইদিনের মধ্যে এই সব দর্শনীয় স্থান খুব সহজেই ঘুরে দেখে নেওয়া যেতে পারে।
লালবাগ বোটানিক্যাল গার্ডেন
দক্ষিণ বেঙ্গালুরুর প্রায় চল্লিশ একর এলাকা জুড়ে রয়েছে লালবাগ বোটানিক্যাল গার্ডেন। এই বাগানে অনেকগুলি প্রবেশদ্বার থাকলেও নর্থ গেট অর্থাৎ উত্তর দিকের দরজা এবং প্রধান দরজা দিয়ে প্রবেশ করা উচিৎ। সকাল ছ’টা থেকে সন্ধ্যা সাতটা অবধি এই বাগানে প্রবেশ করা যায়। মাথাপিছু কুড়ি টাকা মূল্যের টিকিটের বিনিময়ে এই বাগানে প্রবেশের অনুমতি মেলে। যদিও শিশুদের জন্য কোনও প্রবেশ মূল্য দিতে হয় না। বিশাল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকার দরুণ যাঁরা পায়ে হেঁটে পুরো বাগান ঘুরতে চান না তাঁদের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা থাকে। উত্তর দিকের দরজা দিয়ে প্রবেশ করলে সামনে বড় গল্ফ কার্টের আকারের গাড়ি থাকে। সেই গাড়িতে করে মাথাপিছু একশো টাকার বিনিময়ে বাগান ঘুরিয়ে দেখানো হয়। এই বাগানে এক হাজারের বেশি ফুল গাছের প্রজাতি রয়েছে। বাগানের উত্তর দিকের দরজার কাছে একটি প্রাচীন টিলা রয়েছে, যার চূড়ায় একটি মন্দির রয়েছে। মিনিট তিন চারেকের মধ্যে পায়ে হেঁটেই সেই টিলার চূড়ায় পৌঁছনো সম্ভব। টিলার বিপরীত দিকেই রয়েছে একটি বনসাইয়ের বাগান। সেই বাগানে বহু বনসাইয়ের মধ্যে অনায়াসে কিছুক্ষণ সময় কাটানো যায়।
এই বাগানের অন্যতম দর্শনীয় স্থান গ্লাস হাউজ। লালবাগ বোটানিক্যাল গার্ডেনের গ্লাস হাউজ আসলে লন্ডনের ক্রিস্টাল প্যালেসের অনুকরণে তৈরি হয়েছিল। দৃষ্টিনন্দন এই স্থাপত্য ছবি শিকারিদের অন্যতম পছন্দ। গ্লাস হাউজের কাছেই রয়েছে ব্যান্ড স্ট্যান্ড। এই ব্যান্ড স্ট্যান্ড ১৮৭০ সালে নির্মিত হয়েছিল। এছাড়া প্রধান দরজা থেকে হেঁটে একটু এগোলেই দেখতে পাওয়া যায় ফুল ঘড়ি। ১৯৮৩ সালে এইচ. এম. টি কোম্পানি ফুল এবং গাছ দিয়ে এই ঘড়ি নির্মাণ করিয়েছিল। বাগানের একটি অংশে লোহার খাঁচার মধ্যে বিভিন্ন গাছ দিয়ে হাতি, বাঘ, ময়ূরের আকৃতি তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া এই বাগানের একটি অংশে তামিলনাড়ু থেকে নিয়ে আসা প্রাগৈতিহাসিক যুগের একটি গাছের ফসিলও রাখা হয়েছে।
আরও পড়ুন- সিকিম, সিটং অনেক হল! এই শীতে হাতের নাগালেই রয়েছে ‘ভারতের স্কটল্যান্ড’
টিপু সুলতানের গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ
লালবাগ বোটানিক্যাল গার্ডেন থেকে স্বল্প দূরত্বের মধ্যে রয়েছে টিপু সুলতানের গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ অথবা টিপু সুলতান সামার প্যালেস। সকাল সাড়ে আটটা থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা অবধি এই প্রাসাদে প্রবেশের অনুমতি পাওয়া যায়। মাথাপিছু কুড়ি টাকা মূল্যের টিকিটের বিনিময়ে এই প্রাসাদে প্রবেশ করা যায়। প্রবেশদ্বার থেকে একটি মাঝারি আকারের বাগান পেরিয়ে প্রধান প্রাসাদে প্রবেশ করা যায়। যদিও আকারের দিক থেকে অন্যান্য প্রাসাদের তুলনায় এটি খুবই ছোট। আকারের তুলনা করতে গেলে উত্তর কলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়ির সঙ্গে এই প্রাসাদের তুলনা করা যায়। গাইডের সঙ্গে অথবা গাইড ছাড়াই প্রাসাদের বিভিন্ন ঘরে প্রবেশ করা যায়। এই প্রাসাদের দু’টি ঘরে ছবি তোলার অনুমতি নেই। যদিও এই প্রাসাদ ভ্রমণের প্রধান সমস্যা হলো প্রাসাদের প্রবেশ পদ্ধতি। এখানে আর্কিওলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার তরফ থেকে একটি কিউআর কোড দেওয়া রয়েছে। সেই কোড স্ক্যান করার পরে প্রবেশ করতে ইচ্ছুক সকলের কোনও একটি সরকারি পরিচয়পত্রের নম্বর দেওয়ার পরে টিকিট কাটা যায়। যদিও প্রবেশের টিকিট সেই কোড স্ক্যান করেই কাটতে হয়।
বেঙ্গালুরু ফোর্ট
টিপু সুলতানের গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ থেকে হাঁটা দূরত্বে অবস্থিত বেঙ্গালুরু ফোর্ট। আকারে উত্তর অথবা পশ্চিম ভারতের যে কোনও কেল্লার সামনে এই কেল্লা নেহাতই শিশু। ১৫৩৭ সালে রাজা প্রথম কেম্পেগোড়া এই কেল্লা নির্মাণ করিয়েছিলেন। তিনি বেঙ্গালুরুর পত্তন করেছিলেন। পরবর্তীকালে হায়দার আলি মাটির বদলে পাথর দিয়ে এই কেল্লার পুনঃনির্মাণ করিয়েছিলেন। সকাল সাড়ে আটটা থেকে বিকেল পাঁচটার মধ্যে এই কেল্লায় প্রবেশের অনুমতি পাওয়া যায়। এই কেল্লায় সাধারণ মানুষ বিনামূল্যেই প্রবেশ করতে পারেন।
আরও পড়ুন- প্রাচীন চোখ ধাঁধানো প্রাসাদ, সাদা ময়ূর আর শীতের ছুটি! বাঙালির নয়া ঠিকানা এই শহর
বেঙ্গালুরু প্রাসাদ
ইংল্যান্ডের উইন্ডসর প্রাসাদের অনুকরণে ১৮৮৭ সালে রাজা চামারাজা ওয়াদিয়ের তৈরি করিয়েছিলেন বেঙ্গালুরু প্রাসাদ। মূল প্রবেশদ্বার থেকে এক সুবিশাল লন পেরিয়ে প্রধান প্রাসাদে পৌঁছনো সম্ভব। রাজা এবং রাজ বংশের ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিস এই প্রাসাদে দেখতে পাওয়া যায়। সোমবার বাদে সপ্তাহের বাকি দিনগুলোতে সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা অবধি এই প্রাসাদ এবং প্রাসাদ সংলগ্ন বাগানে প্রবেশ করা যায়। ভারতীয়দের ক্ষেত্রে মাথাপিছু ২৩০ টাকা মূল্যের টিকিটের বিনিময়ে এই প্রাসাদে প্রবেশের অনুমতি পাওয়া যায়। যদিও ক্যামেরা ব্যবহার করে ছবি অথবা ভিডিও তোলার জন্য অতিরিক্ত মূল্য দিতে হবে। সেই মূল্য ২৫০-১২০০ টাকা অবধি হতে পারে। মোবাইলের ক্যামেরার ব্যবহারের ক্ষেত্রেও এই নিয়ম বলবৎ হবে।
এই চারটে স্থান ছাড়াও বেঙ্গালুরু শহরের মধ্যে অবস্থিত কাবন পার্ক, বুল টেম্পল দেখতেও প্রচুর মানুষ ভিড় জমান। বেঙ্গালুরুর বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ঘুরে বেড়ানোর প্রধান মাধ্যম হিসাবে ভাড়া করা গাড়িই মূল হলেও যদি তিন অথবা তার কম সংখ্যক মানুষ শহর ঘুরে দেখতে চান তাহলে অটো ভাড়া করা যেতে পারে। বেঙ্গালুরু অটো আসলে ট্যাক্সির মতো পদ্ধতিতে ভাড়া নেয়। অটোতে তিনজনের বেশি বসার অনুমতি নেই। তাই সামনে শুধু চালক বসতে পারেন। তবে কম ভাড়ার বদলে একটি ঝক্কি সহ্য করতে হতে পারে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা অটো চালকদের সঙ্গে দরদাম করা দরকার এবং গন্তব্য নিশ্চিত করে বলে সেটা ছাড়া অন্য কোথাও যাওয়া যাবে না সেটাও বোঝানো দরকার। সেই ঝামেলা থেকে রেহাই পেতে চাইলে অ্যাপ থেকে অটো বুক করা যায়। বিভিন্ন অ্যাপ ক্যাবের সংস্থার সঙ্গে বহু অটো চালক যুক্ত রয়েছেন। তাই অটো পেতে খুব একটা সমস্যা হয় না। বেঙ্গালুরু ঘুরতে বেরোনোর আগে গুগল অথবা অন্যত্র থেকে একবার শহরের মানচিত্র বুঝে নেওয়া দরকার। তার ফলে কিছু অতিরিক্ত সুবিধা পাওয়া যায়। উদাহরণ স্বরূপ, টিপু সুলতানের গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ এবং বেঙ্গালুরু কেল্লার দূরত্ব হেঁটে দশ মিনিটে অতিক্রম করা যায়। এই দূরত্ব যেতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা অটো চালক যাত্রীদের থেকে পঞ্চাশ থেকে একশো টাকা অবধি ভাড়া চাইতে পারে। অ্যাপ থেকেও অটোর জন্য চল্লিশ টাকা ভাড়া দেখাতে পারে। যদিও বাস্তবে এই রাস্তা হেঁটে পার হওয়া যায়। যদিও বেঙ্গালুরুতে সীমিত এলাকায় মেট্রো চলাচল করে তবুও সেই মেট্রোকে পরিবহণ হিসাবে ব্যবহার করে কাবন পার্ক, টিপু সুলতানের গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদের কাছাকাছি সহজেই পৌঁছে যাওয়া সম্ভব। আধুনিকতার মোড়কে মোড়া উঁচু উঁচু বাড়ি এবং বহুজাতিক সংস্থার অফিসের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে এক প্রাচীন শহর। সেই শহরকে খোঁজ করতে বাঙালি ঘুরতে যেতেই পারে বেঙ্গালুরু শহরে।