বাংলাদেশকে কোন পথে নিয়ে যাবেন শেখ হাসিনা?

Bangladesh Election 2024 Sheikh Hasina : নির্বাচনে শেখ হাসিনা শেষ হাসি হেসেছেন বটে কিন্তু যে সরকার গঠন হতে চলেছে তার জন্য চ্যালেঞ্জের কোনও কমতি নেই। লিখলেন বাংলাদেশের সাংবাদিক সুশান্ত ঘোষ।

সুশান্ত ঘোষ:  এ এতক্ষণে পরিস্কার হয়ে গিয়েছে যে বাংলাদেশ সরকার বেশ ভালোভাবেই প্রস্তুতি নিয়েই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করেছে। নির্বাচনকে নিশ্ছিদ্র করতে গিয়ে প্রায় ৮ লাখ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য নিয়োজিত করেছিল। কিন্তু তারপরেও ভোট বানচাল করতে নাশকতার কমতি ছিল না। ট্রেনে-বাসে আগুন দিয়ে জ্যান্ত মানুষের পুড়ে যাওয়ার দৃশ্য বাংলাদেশের ইমেজকে যে ক্ষতিগ্রস্থ করছে তাতে সন্দেহ নেই। পৃথিবীর উদীয়মান অর্থনীতি ও অষ্টম জনবহুল এই দেশটিতে দীর্ঘসময় ধরে স্থিতিশীল সরকারের বিরুদ্ধে সহিংসতা এই ব্যাবস্থাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে। শুধু নির্বাচনী সময়েই নয়, এই ভয়াবহতার সঙ্গে দেশে নানা আঙ্গিকে আচমকা জঙ্গিদের তৎপরতাও দেশের ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে তাতে সন্দেহ নেই। বাংলাদেশে অর্থনীতির উল্লফনের সঙ্গে ব্যাপক হিংসা এই অর্জনকে যে কোন মূল্যে ম্লান করে দিতে পারে।

বাংলাদেশে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ৪৪ টি। এর মধ্যে ২০২৩ সালেই নিবন্ধিত ৫ টি রাজনৈতিক দল। এর মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করছে ২৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল আর এসব রাজনৈতিক দলগুলো থেকে ১ হাজার ৯৬৫ জন এবারে প্রার্থী হয়েছিলেন। এছাড়া আরও ৭৪৭ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন। এবারে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারা দেশে মোট ভোটার ছিল ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৯১ হাজার ৬৩৩ জন। এবারে প্রথমবার ভোট দিয়েছেন- এমন নবীনের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। এর বাইরে আরও এক কোটি ভোটার ছিলেন, যারা বয়সে তরুণ। সুতরাং এক পঞ্চমাংশ তরুণ ভোটারদের কাছে এবারেই ছিল তাদের পছন্দসই প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার সুযোগ।

আরও পড়ুন- লাখে লাখে মানুষ কেঁদে মুক্তি পান! কেন বাংলাদেশে বিতর্কের নাম দেলোয়ার হোসেন সাঈদী?

কিন্তু বিএনপি-সহ কয়েকটি দলের বর্জনে নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করে তুলতে হোঁচট খেয়েছে। তাদের পছন্দকে সীমিত করে তুলেছে। মূলত সংকটটা এখানেই ছিল। সবাই মনে করেছে, যেভাবেই হোক নির্বাচন হবে। নির্বাচন কমিশনার বিভিন্ন স্থানে গিয়ে বলেছিলেন, "একটি ভোটও যদি কারচুপি হয় তাহলে সেই কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হবে"। নির্বাচনে সমস্যা হতে পারে এই আশঙ্কায় কমিশন এক ডিসি সহ বহু পুলিশ কর্মকর্তাকে বদলিও করে দিয়েছিলেন। নির্বাচন কমিশনের এতসব তৎপরতা খুব বেশি তাৎপর্যপূর্ণ ছিল না একারণেই যে সব বড় দলগুলি নির্বাচনে আসেনি। আওয়ামী লীগ এবার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সরকার গঠন করবে আভাস ছিলই। সেইসঙ্গে তার বিরোধীও হচ্ছিল আওয়ামীগের স্বতন্ত্র কেউ। সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছিল বিএনপি নির্বাচনী ট্রেন মিস করেছে’-’ নির্বাচন কারও জন্য বসে থাকবে না’।

বিএনপির নির্বাচনে না আসা নিয়ে অনেকেই বলেছেন এটি দলের অস্তিত্বকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেবে। কিন্তু এর চেয়েও বড় ক্ষতি হচ্ছে দেশে গণতান্ত্রিক উপায়ে সরকারকে মোকাবিলা করতে বিরোধী শক্তির অভাব। বিএনপি যুদ্ধাপরাধীর দোষে দুষ্ট, নিববন্ধন হারানো জামায়াত ইসলামিকে নিয়ে গাটছড়া বাধতে চায় তা বাংলাদেশের সকল অর্জনকে এক অনির্দিষ্ট গন্তব্যে নিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। সব মিলিয়ে রাজনীতি-সমাজনীতি এমনকী সর্বত্রই মুক্তিযুদ্ধের পরে একটি মোটা দাগে বিভাজিত ধারা তৈরি হয়ে আছে। এখানে খুব কম পরিসরই তৈরি হয়েছে নানাভাবে সবার বক্তব্য মিলিয়ে দেখার। বাংলাদেশে নির্বাচনী ব্যবস্থার দুর্বলতা, ভঙ্গুর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির একটি দুষ্ট বলয় তৈরি করছে। অর্থনৈতিক উন্নতির পাশাপাশি এই ফাদ থেকে বেরনো না গেলে বাংলাদেশের পথ বারেবারেই কণ্টকাকীর্ণ হবে তাতে সন্দেহ নেই।

মূলত এই নির্বাচন ঘিরে যে আন্তজার্তিক তৎপরতা দেখা দিয়েছিল তা বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বাংলাদেশের এলিট ফোর্স ‌ র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটিলিয়নের (র‌্যাব) উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আমেরিকা। বাইডেন তার আমলে ২টি ‘সামিট ফর ডেমোক্রেসি’ থেকে বাদ দিয়ে দেয়। এছাড়া আমেরিকা বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রবাহ বিশেষ করে নির্বাচনী সময় সরকারের আচরণ উল্লেখ করে ‘স্যাংশন’ চাপিয়ে দেওয়ার প্রচার করে। হঠাৎ করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘স্যাংশন’ যে অভিঘাত তৈরি করে তা অভূতপূর্বই বলা চলে। বিগত বছর জুড়ে স্যাংশন নামে এই মানবাধিকার অস্ত্রটি ব্যবহারের পরেও সরকার দেখাতে চায় তারা এই ব্যবস্থাটি নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত নয়।

আরও পড়ুন- নোবেলজয়ী মহম্মদ ইউনূসের জেল! ঠিক কোন অভিযোগে কারাদণ্ড দিল বাংলাদেশের আদালত?

এর কারণও রয়েছে, বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ভূ রাজনৈতিক অবস্থান-অর্থনৈতিক উল্লফন ও বড় খোলোয়াড়দের সঙ্গে বাংলাদেশের গাটছড়া। বাংলাদেশ বিগত অর্থবছরে ২২ বিলিয়ন গার্মেন্টস রপ্তানি করে, যা তাকে এই সেক্টরে অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছে। এটি যে বাংলাদেশেরই একক লাভ তা নয়। বাংলাদেশ কম দামে যে বস্ত্র উৎপন্ন করে তার বেনিফিশিয়ারি মূলত আমেরিকাই। কেননা বাংলাদেশের জামাকাপড়ের সিংহভাগ যায় আমেরিকাতেই। বাংলাদেশকে স্যাংশন দিয়ে বসিয়ে রাখা আমেরিকার কোম্পানিগুলো অত্যন্ত লোকসানের এবং এটি যে আমেরিকার জনগণের জন্য আরেকটি দুর্বিসহ অবস্থা তৈরি করবে তা অনুমেয়। আমেরিকা শেষ পর্যযন্ত নির্বাচনী ব্যাবস্থা নিয়ে হুংকার ছাড়লেও এই বিষয়ে তাদের তাড়াহুড়োর লক্ষণ ছিল না। নির্বাচন কমিশনের তৎপরতায় আমেরিকা সহ ইউরোপিয় ইউনিয়নের গোঁসা হয়েছে এমন কোনও সংবাদও মেলেনি।

আরেকটি বিষয় হলো, সরকার শেষ পর্যন্ত ভারতকে বোঝাতে পেরেছে। ভারতীয় নেতৃত্বও মনে করছে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার বিকল্প বিএনপি–জামায়াত জোট নয়। এটি আরেকটি আশ্চর্যের বিষয়! সরকার একইসঙ্গে চিনকেও কাছে টানতে পেরেছে, বড় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে চিনের অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে এটি সম্ভব হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকেই।

নির্বাচন নিয়ে স্বীয় সিদ্ধান্তে এগিয়ে গিয়ে শক্ত অবস্থানে যাওয়ার ব্যাপারটি রাজনৈতিক সচেতন মহলের অনেকের হিসাবের বাইরে ছিল। আর এর ফলেই এই নির্বাচন নিয়ে আর্ন্তজাতিক মহলও কম কৌতুহলী ছিল না। নির্বাচন গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে উত্তরণে তাই সরকার ভোটার উপস্থিতিকে গুরুত্ব দিতে চেয়েছিল প্রবল। বিরোধী প্রচার সত্ত্বেও সরকার আশা করেছিল উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোটার ভোট দিতে যাবে। এ বিষয়ে তারা মাঠে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের উপস্থিতিকে আর্শীবাদ বলে মনে করেছিল। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের শক্তিশালী অবস্থান অনেক আসনে নির্বাচনকে জমজমাট করে তুলেছে তাতে সন্দেহ নেই। নির্বাচনে শেখ হাসিনা শেষ হাসি হেসেছেন বটে কিন্তু যে সরকার গঠন হতে চলেছে তার জন্য চ্যালেঞ্জের কোনও কমতি নেই। দেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বিরাট মূল্যস্ফীতি, কর্মসংস্থান, দুর্নীতি, প্রতিটি ক্ষেত্রে একটি নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের ইস্তেহারে বেশ লক্ষণীয়ভাবেই এই সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ১১ টি লক্ষ্যকে তুলে ধরেছে। আগামী বাংলাদেশে কোন পথে যাবে, তা এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার উপরেই নির্ভর করছে।

 

 

(লেখক পেশায় বাংলাদেশের সাংবাদিক)

More Articles