‘কুরুক্ষেত্র’ ব্যারাকপুরে দিনভর প্রত্যাখ্যাত অর্জুন! শেষমেশ বাজি জিতবেন পার্থই?

Arjun Singh: লোকসভা ভোটকে কেন্দ্র করে দিনভর উত্তপ্ত রইল ব্যারাকপুর কেন্দ্র। বিভিন্ন বুথ থেকে এল অশান্তির খবর। দিনভর বিভিন্ন জায়গায় উঠল ছাপ্পা ভোট, বুথ জ্যাম বা এজেন্ট বসতে না দেওয়ার অভিযোগ।

ব্যারাকপুর। লোকসভা ভোটে বাংলার অন্যতম হাই ভোল্টেজ কেন্দ্র। হবে না-ই বা কেন, একদিকে তৃণমূল-বিজেপি ডেলি প্যাসেঞ্জারি করা নেতা অর্জুন সিং, অন্যদিকে তাঁর বিপরীতে তৃণমূলের বিশ্বস্ত সৈনিক পার্থ ভৌমিক। এই লোকসভা ভোটের আগে টিকিট না পেয়ে বিজেপিতে গিয়েছেন অর্জুন, শুধু যে গিয়েছেন, তা-ই নয়। বিজেপির টিকিটে এই লোকসভা ভোটে লড়াইও করছেন ব্যারাকপুর কেন্দ্র থেকে। একদা ব্যারাকপুরের ত্রাস অর্জুন সিংয়ের সমর্থনে কখনও এসেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, কখনও বা বিজেপির রাজ্যসভাপতি গিয়েছেন অর্জুনের হয়ে গলা ফাটাতে। তৃণমূলের দুর্নীতির হয়ে প্রচারে গলা ফাটিয়েছেন দুদিন আগেই তৃণমূলে থাকা অর্জুন সিং খোদ। লোকসভা ভোটের ফলাফল নিয়ে সেই অর্জুন যে ঠিক কতটা আত্মবিশ্বাসী, তা টের পাওয়া গেল ভোটের দিন বেলা বাড়তেই।

ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রের ১৫৯১টি ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের মধ্যে ৫৫৪টি বুথই স্পর্শকাতর। শান্তিপূর্ণ ভোট করাতে গোড়া থেকেই তাই কোমর বেঁধেছিল প্রশাসন। মোতায়েন হয়েছিল প্রচুর পুলিশও। কিন্তু সোমবার ভোটের শেষবেলাতেই ভঙ্গ হল সেই শান্তি। হেরে গেলে অবসর নাচছে কপালে। আর সেই হার নিশ্চিত বুঝতে পেরেই কি দিনের শেষে ধস্তাধস্তিতে জড়ালেন অর্জুন সিং? ব্যারাকপুরের মানুষ কতটা অর্জুনকে চান, তা সকাল থেকেই ভালো টের পেয়েছেন তিনি।

আরও পড়ুন: বাহুবলে ব্যারাকপুর দখল করতে পারবেন তৃণমূল-বিজেপি ডেইলি প্যাসেঞ্জার অর্জুন সিং?

সকাল থেকেই ব্যারাকপুরের বিভিন্ন বুথে বুথে ঘুরেছেন বিজেপি প্রার্থী অর্জুন সিং। টিটাগড়ের একটি বুথে গেলে তৃণমূল কর্মীরা তাকে কালো পতাকা দেখায়। সেখানে উত্তেজনা ছড়ায় অর্জুনের উপস্থিতিতে। এমনকী তৃণমূল কর্মীদের দিকে তেড়ে যান তিনি। ব্যারাকপুরের বীজপুরে অর্জুন সিংকে ঘিরে তীব্র উত্তেজনা ছড়ায়। ঘটনাস্থলে অর্জুন যেতেই গো ব্যাক স্লোগান। গুলি করে দেওয়ার হুমকি ব্যারাকপুরের বিজেপি প্রার্থীকে। মহিলা কর্মীকে মেরে মাথা ফাটিয়ে দেওয়ার অভিযোগ করেন অর্জুন সিং। নির্বাচন কমিশনে সে নিয়ে অভিযোগও লেখান তিনি। শুধু টিটাগড় বা বীজপুর নয়, কাঁচরাপাড়াতেও একই রকম বিরুদ্ধতার মুখে পড়লেন বিজেপি প্রার্থী। সেখানে বিক্ষোভকারীদের দিকে তেড়ে যান অর্জুনও৷ চলে চেয়ার ভাঙচুর৷ কোনওক্রমে পরিস্থিতি সামাল দেয় কেন্দ্রীয় বাহিনী৷ ব্যারাকপুরের কাওগাছির বুথে থাকা প্রিসাইডিং অফিসারের ‘চাকরি খেয়ে নেওয়ার’ হুমকি দিতে দেখা গিয়েছে অর্জুন সিংকে৷ না এখনও শেষ হয় নি অর্জুন-কারনামার। দিনের শেষে অর্জুনকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ব্যারাকপুরের মনিরামপুর এলাকা। বিজেপি জেলা সভাপতি মনোজ ব্যানার্জির হেনস্থার খবর পেয়েই নাকি ছুটে যান অর্জুন। আগে থেকেই সেখানে ছিলেন তৃণমূল কংগ্রেস কাউন্সিলর রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ও তার দলবল। সেখানেই অর্জুন সিংকে দেখে তাঁরা গো ব্যাক স্লোগান দিতে শুরু করেন। সেখানেও তৃণমূল সমর্থকদের দিকে তেড়ে যেতে দেখা যায় অর্জুনকে।

লোকসভা ভোটকে কেন্দ্র করে দিনভর উত্তপ্ত রইল ব্যারাকপুর কেন্দ্র। বিভিন্ন বুথ থেকে এল অশান্তির খবর। দিনভর বিভিন্ন জায়গায় উঠল ছাপ্পা ভোট, বুথ জ্যাম বা এজেন্ট বসতে না দেওয়ার অভিযোগ। আর এদিকে, তৃণমূল প্রার্থী পার্থ ভৌমিককে রীতিমতো 'মিঃ কুল' সেজেই ঘুরে বেড়াতে দেখা গেল তাঁর লোকসভা কেন্দ্রের বিভিন্ন বুথে বুথে। এদিন সকালে নৈহাটির বড়মার মন্দিরে পুজো দিয়ে দিনটা শুরু করেন তৃণমূল প্রার্থী পার্থ ভৌমিক। পরবর্তীতে ভোটাধিকার প্রয়োগ করে বিভিন্ন বুখ পরিদর্শনে বের হন পার্থ। বিভিন্ন বুথে গিয়ে ভোট কেমন পরিচালনা হচ্ছে খতিয়ে দেখেন তিনি। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশ মনে করছেন কার্যত ফুরফুরে মেজাজেই ভোটের দিনে দেখা গেল ব্যারাকপুরের তৃণমূল প্রার্থীকে। এই লোকসভা ভোটে নিজের জয় নিয়ে যে বেশ নিশ্চিত তিনি, তা দিব্য়ি মালুম পাওয়া গেল তাঁর ব্যবহারে। অন্যদিকে, দিনভর অর্জুন যা যা করলেন, তাতে অনেকটাই পরিষ্কার ব্যারাকপুরের মানুষ আদতে কোনখানে বেশি আস্থা দেখাচ্ছেন।

তৃণমূল থেকে বিজেপি, বিজেপি থেকে ফের তৃণমূল, আর লোকসভার টিকিট না পেতেই ফের বিজেপিতে যাত্রা। দল বদলে বদলে এতদিন ধরে ব্যারাকপুরের গড় ভালোমতোই রক্ষা করে গিয়েছেন অর্জুন। এলাকার রীতিমতো ত্রাস হিসেবে পরিচিত অর্জুনকে নিয়ে কম অভিযোগ নেই এলাকাবাসীর। তবে ভক্তি কি ভয় বলা কঠিন, অর্জুনের বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস হয়নি ব্যারাকপুরবাসীর। একসময় বামেদের গড় ছিল এই ব্যারাকপুর। দীর্ঘদিন ধরে সেখানে লাল দুর্গ ধরে রেখেছিল সিপিএম। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেই জায়গা গিয়েছিল তৃণমূলের দখলে। এই লোকসভা ভোটে হারানো গড় দখলে সবরকম ভাবে চেষ্টা করেছে সিপিআইএম। তাঁরা এবার প্রার্থী করেছিল অভিনেতা-প্রার্থী দেবদূত ঘোষকে। প্রচারের জন্য ব্যারাকপুরের আনাচে-কানাচে ঢুঁ মারতে দেখা গিয়েছে দেবদূতকে। ব্যারাকপুরে যে শান্তির দূত হতে চান দেবদূত, সেই বার্তা আগেই বারবার দিয়েছেন তিনি। ব্যারাকপুরের ত্রিমুখী এই লড়াইয়ে ভালোই টক্কর দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি।

এদিকে তৃণমূল প্রার্থী পার্থ ভৌমিক ওই কেন্দ্রের ভূমিপুত্র বলা যায়। নৈহাটি থেকে তিন-তিন বার বিধানসভা ভোটে জিতেছেন তিনি। তৃণমূলের উত্তর চব্বিশ পরগনার সর্বভারতীয় তৃণমূল যুব কংগ্রেসের জেলা সভাপতিও বটে। ভূমিপুত্র হওয়ার দৌলতে ব্যারাকপুরকে তিনি জানেন, বোঝেন। অন্যদিকে, বাহুবলী অর্জুনের বিরুদ্ধে অভিযোহের তালিকা লম্বা। একদিন তৃণমূল দখলের জন্য যে অর্জুনে ভরসা রেখেছিলেন দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সেই অর্জুনের সময় যে ডুবতে বসেছে, তা কি ভালোই টের পাচ্ছেন ব্যারাকপুরের ত্রাস। একসময় ব্যারাকপুরের শিল্পাঞ্চলের নেতা বিকাশ বসুর খুনে নাম জড়ায় অর্জুনের। সেই মামলায় কারাবাস পর্যন্ত করেন অর্জুন সিং। তা সত্ত্বেও দলে ঠাঁই পেতে অসুবিধা হয়নি তাঁর। বরং তৃণমূল সে ব্যাপারটি নিয়ে বেশ বিতর্কে জড়ায়।

আরও পড়ুন: ভোটে শুধু সারথি বদলান অর্জুন সিং! বাস্তবে কেমন আছেন ব্যারাকপুরের মজদুররা?

তার পরেও দিদির হাত ছিল অর্জুনের মাথায়। তবে সেই কৃতজ্ঞতা ভুলে টিকিট না পেতেই বিজেপিতে নাম লেখান গিয়ে অর্জুন। এক বার নয়, একাধিক বার এই কাণ্ড ঘটিয়েছেন অর্জুন। তবে এ বার লোকসভা ভোট ঘিরে অর্জুনের অস্থিরতা যেন ঠিক ছন্দে ঠেকছে না অনেকেরই। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ মনে করছেন, তবে কি শেষের বাঁশি শুনতে পেয়েই এ হেন ছটফটানি অর্জুনের। ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের দখল শেষপর্যন্ত কি হাত ফস্কেই যেতে চলেছে বাহুবলী নেতার। হারলে কি ফের তাঁকে দলে নেবে তৃণমূল? না এবার হারলে অবসরই কপালে নাচছে ব্যারাকপুরের ত্রাস অর্জুন সিংয়ের? উত্তর মিলতে চলেছে আগামী চার তারিখেই।

More Articles