বাংলাদেশের সাংসদের দেহ টুকরো করতে আনা হয়েছিল ভাড়াটে ‘কসাই’! কে আসলে এই জিহাদ?
Bangladesh MP Murder Case: প্রাথমিক তদন্তের পর পুলিশের অনুমান, নিউ টাউনের ফ্ল্যাটে ডাকা হয়েছিল বাংলাদেশের সাংসদ আনওয়ারুলকে। সেখানেই তাঁকে খুন করে দেহ টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়।
বাংলাদেশের সাংসদ খুনে একের পর এক ভয়ঙ্কর তথ্য পুলিশের হাতে। খুনের পর নির্মম ভাবে টুকরো টুকরে করে কাটা হয়েছিল দেহ, পচন আটকাতে মাখানো হয় হলুদও। সেই দেহের অবশ্য এখনও খোঁজ মেলেনি। গত ১২ মে চিকিৎসা করাতে ভারতে আসেন ওপার বাংলার আওয়ামী লিগের সাংসদ আনওয়ারুল আজিম। উঠেছিলেন বরাহনগরের এক বন্ধুর বাড়িতে। তার পর সেখান থেকে উধাও হয়ে যান আনওয়ারুল। তার পর বেশ কয়েকদিন খোঁজ মেলেনি তাঁর। বাধ্য হয়েই পুলিশে খবর দেন বরাহনগরের ওই ব্যক্তি। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের সরকার যোগাযোগ করে ভারতের সঙ্গে। শুরু হয় আনওয়ারুলের খোঁজ। তবে খোঁজ মেলেনি সাংসদের। উদ্ধার হয়নি দেহও।
তবে তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পেরেছে আর বেঁচে নেই আনওয়ারুল। রীতিমতো পরিকল্পনা করে খুন করা হয়েছে বাংলাদেশের সাংসদকে। নিউটাউনের এক অভিজাত আবাসন থেকে মেলে রক্তের দাগ। যে ফ্ল্যাটে আনওয়ারুল ছিলেন বলে মনে করা হচ্ছে। সেই সূত্র ধরে এগোতে এগোতে একের পর এক সাড়া জাগানো মোড়ের সামনে হাজির হয় পুলিশ। ফরেন্সিক দল ওই আবাসন থেকে রক্তের নমুনা ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট সংগ্রহ করে।
আরও পড়ুন: ৪ বছরের সন্তানকে খুন মায়ের! ব্যাগে লাশ ভরে পালাতে গিয়ে যেভাবে ধরা পড়লেন কলকাতার মেধাবী
তদন্তে নেমে নিউটাউনের একমৃ্ত্যু রহস্যের তদন্তে নেমে একের পর এক ভয়ঙ্কর তথ্যের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে পুলিশ। যা হার মানাবে বাঘা বাঘা রহস্য রোমাঞ্চ গল্পকেও। বাংলাদেশের ওই সাংসদকে খুনের জন্য পরিকল্পনা চলেছে দীর্ঘদিন ধরে। আর সেই খুনের পরিকল্পনার নেপথ্যে রয়েছে আনওয়ারুলেরই এর বাল্যবন্ধু আখতারুজ্জামান শাহীন। যিনি এই খুনের মাস্টারমাইন্ড বলেই মনে করছে পুলিশ। বাংলাদেশি হলেও আদতে সে মার্কিন নাগরিক। আনওয়ারুলের পরিবারের সঙ্গে শাহীনের ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল বলেই জানা গিয়েছে। সেই ব্যবসায়িক সম্পর্কের জেরেই এই খুন কিনা উঠেছে প্রশ্ন।
প্রাথমিক তদন্তের পর পুলিশের অনুমান, নিউ টাউনের ফ্ল্যাটে ডাকা হয়েছিল বাংলাদেশের সাংসদ আনওয়ারুলকে। সেখানেই তাঁকে খুন করে দেহ টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়। তার জন্য মুম্বই থেকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল জিহাদ হাওয়ালাদার নামে এক কসাইকে। তাঁকে বনগাঁ থেকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। মাস দুয়েক আগেই তাকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয় বলে জানা গিয়েছে। জিহাদ নামে ওই ব্যক্তিও বাংলাদেশের বাসিন্দা। তবে সে অবৈধ ভাবে মুম্বইতে থাকছিল বলে জানা গিয়েছে। তার আদি বাস বাংলাদেশের খুলনা জেলার দিঘলিয়া থানা এলাকার বারাকপুরে। গ্রেফতারের পরে জিহাদকে একটানা জেরা করা হয়।
তাঁকে জেরা করেই পুলিশ জানতে পেরেছে ভাঙড়ের পোলেরহাটের একটি খালে দেহাংশ ফেলা হয় আনওয়ারুলের। শুধু তাই নয়, প্রমাণ লোপাটের জন্য শরীর থেকে তুলে ফেলা হয়েছিল চামড়াও। হাড় আলাদা করে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয় দেহ, সন্দেহ গোয়েন্দাদের। কিন্তু, এখনও দেহের কোনও অংশ উদ্ধার হয়নি। ক্যাব চালকের উপর সন্দেহ ছিল পুলিশের। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের পর বেশ কিছু তথ্য পায় পুলিশ। বৃহস্পতিবার রাতেই বৃহস্পতিবার রাতে কলকাতা পুলিশ এলাকার অন্তর্গত পোলেরহাট থানার কৃষ্ণবাটি সেতুর কাছে বাগজোলা খালে তল্লাশি চালায়। নিউ টাউন এলাকার যে ফ্ল্যাটে মি. আজীমকে খুন করা হয়, সেই আবাসিক কমপ্লেক্সের সামনে দিয়েই এই খালটি বয়ে গেছে। কিন্তু, কোনও দেহাংশ উদ্ধার হয়নি বলেই জানা গিয়েছে।
সিআইডি সূত্রে জানা গিয়েছে, জিহাদকে জেরা করে আনওয়ারুলকে খুনের পর কীভাবে তাঁর দেহ লোপাট করা হয়েছিল, তার ভয়ঙ্কর বর্ণনা জানতে পেরেছে পুলিশ। জিহাদ সিআইডি কর্তাদের কাছে স্বীকার করেছে, আখতারুজ্জামানের নির্দেশেই ওই ফ্ল্যাটে সে এবং আরও চারজন মিলে সাংসদকে খুনের পরিকল্পনা আঁটে। প্রথমে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে তারপর শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয় আনওয়ারুলকে। খুনের পর মৃতদেহ থেকে চামড়া ছাড়িয়ে শরীরের মাংস আলাদা করে নেয় তারা। শরীরের মাংস এমনভাবে টুকরো করা হয় যাতে তাকে চেনা না যায়। মাংস-খণ্ডগুলি পলি প্যাকেটে ভরা হয়। হাড়ও ছোট টুকরো করা হয়। সেগুলোকে হলুদ মাখানো হয়েছিল, যাতে পচতে সময় লাগে। সেই সব কাজ সারার পর রক্ত ও দেহাংশের প্রমাণ লোপাট করতে ভালো করে আবাসনটি অ্যাসিড দিয়ে পরিষ্কার করা হয়। ধৃত জিহাদকে শুক্রবার আদালতে তোলা হয়েছে।
তবে এই খুন রাগের বশে বা হঠাৎ করেই করে ফেলা হয়েছে ভাবলে কিন্তু ভুল হবে। বাংলাদেশি অর্থে চার থেকে পাঁচ কোটি টাকার বিনিময়ে সাংসদ খুনের সুপারি দেওয়া হয় বলে আঁচ করছে পুলিশ। খুনের আগে দীর্ঘদিন ধরে নজর রাখা হয়েছিস সাংসদের গতিবিধির উপর। আনওয়ারুল কবে কখন কলকাতায় আসেন, সেখান থেকে কোথায় যাতায়াত করেন, কাদের সঙ্গে মেশেন- সব কিছুই ছিল খুনের পরিকল্পনাকারীদের নখদর্পণে। গত ২৫ এপ্রিল জিহাদরা কলকাতার সঞ্জীভা গার্ডেন বলে একটি আবাসন ভাড়া করে থাকা শুরু করে। ৩০ এপ্রিল কলকাতায় আসে খুনের মাস্টারমাইন্ড। ফ্ল্যাট ভাড়া করার সময় স্থানীয় থানায় যে সব নথি জানানো হয়, সেখানে আখতারুজ্জামান নিউ ইয়র্কের ড্রাইভিং লাইসেন্সের নম্বর জমা দিয়েছিলেন। সেখানে নিজেকে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার বলে পরিচয় দেন তিনি। জমা দেন ছবিও। সিআইডি সূত্রের খবর, যে ফ্ল্যাটটি পশ্চিমবঙ্গের এক শুল্ককর্তার। প্রায় মাস দুয়েক ধরে আনওয়ারুলের উপর নজর রেখেছিল তাঁরা। বাংলাদেশ থেকেই নিয়ে আসা হয় ভাড়াটে খুনিদের। তাদের মধ্যে কয়েকজন খুনের একদিন আগে চিনার পার্কের একটি হোটেলে চেক-আউট করে ১৭ মে চেক আউট করে ওই দিনই দেশ ছেড়ে চলে যায়।
এরা ছাড়াও আনওয়ারুলের ঘটনায় জড়িয়ে রয়েছে আরও এক মহিলার গল্পে। বান্ধবী সেজে খুনের সময় ঘটনাস্থলে ছিলেন তিনি। ইতিমধ্যেই ঢাকা থেকে এক মহিলাকে গ্রেফতার করেছে বাংলাদেশ পুলিশ। শিলান্তী রহমান নামে ওই মহিলা কোনওরকম মধুচক্রের সঙ্গে যুক্ত কিনা খতিয়ে দেখা হয়েছে। যতদূর জানা গিয়েছে, আখতারুজ্জামান শাহিনের বান্ধবী ওই মহিলা। তবে তিনিই এই খুনের সময় উপস্থিত ছিলেন কিনা তা এখনও পরিষ্কার নয়। পুলিশের প্রাথমিক সন্দেহ অবশ্য বলছে, তিনিই সেই মহিলা। সাংসদকে খুনের পর ১৫ মে প্রধান সন্দেহভাজন খুনি আমানুল্লাহ আমানের সঙ্গে ঢাকায় ফিরে আসেন।
আরও পড়ুন: গাজর, মূলোর মতোই স্যুপে ভাসছে কাটা মাথা! যে বীভৎস খুনের ঘটনায় স্তব্ধ বিশ্ব
শুধু খুন করেই খান্ত হয়নি খুনিরা। এই হত্যাকাণ্ডকে ঢাকতে যথাযথ চেষ্টা করে গিয়েছে এই খুনিরা। আনোয়ারুল আজিম কলকাতায় এসে যে বন্ধুর বাড়িতে উঠেছিলেন, সেই গোপাল বিশ্বাসকে বিভ্রান্ত করতে লাগাতার সাংসদের মোবাইল থেকে লাগাতার মেসেজ পাঠিয়ে গিয়েছে খুনিরা। কখনও লিখে পাঠানো হয়েছে, তিনি দিল্লি যাচ্ছেন। কখনও দিল্লি পৌঁছনোর খবর দেওয়া হয়েছে মোবাইল থেকে। কলকাতা পুলিশ ও সিআইডি-র পাশাপাশি বাংলাদেশের পুলিশও এই ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে। পুলিশের সন্দেহ, ওই মহিলাই কোনও প্রলোভন দেখিয়ে সাংসদকে নিউ টাউনের ওই আবাসনে নিয়ে যায়, যেখানে তাঁর জন্য আগে থেকেই হত্যার ষড়যন্ত্র বুনেছিল আখতারুজ্জমান ও তার দলবল। ঠিক কী কারণে এই খুন, তা এখনও স্পষ্ট নয়। দেহাংশের খোঁজে তল্লাশি জারি রেখেছে পুলিশ।