লাখো বাংলাদেশির স্বপ্ন, নজরকাড়া পদ্মা সেতু যে কারণে গোটা বিশ্বকে অবাক করছে
২৫ জুন স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন করবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রয়েছে জমকালো আয়োজনে। আবেগে থরো থরো সব বাংলাদেশি। সব গুজব, বাধা বিপত্তি পেরিয়ে পদ্মার উপর তৈরি হয়েছে ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পদ্মা বিশ্বে খরস্রোতা নদীগুলির তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। তাই এই নদীর প্রবল স্রোত উপেক্ষা করে সেতু নির্মাণের কাজ ছিল সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সাথে রাজধানীকে জুড়ে দিল পদ্মা সেতু। ফলে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার ৪ কোটি মানুষের জীবন আমূল বদলে দেবে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। প্রাথমিক পর্যায়ে এই সেতু নির্মাণের জন্য ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল। কিন্তু সবশেষে এই খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা।আর এই খরচ বহন করেছেন বাংলাদেশ সরকার। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের ইতিহাসে এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় নির্মাণ প্রকল্প।তবে এই সেতু নির্মাণের জন্য নানামুখী বাধার সম্মুখীন হয়েছেন সরকার সহ নির্মাণ কাজের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকেই। তাই উদ্বোধনের আগে এই সেতু নির্মাণের জন্য ব্যবহৃত নানা কৌশল নিয়ে আলোচনা চলছে মানুষের মধ্যে। জেনে নেওয়া যাক এই সেতু সম্পর্কিত বিভিন্ন খুঁটিনাটি তথ্য -
বিশ্বের সবচেয়ে বড় পেন্ডুলাম বিয়ারিংয়ের ব্যবহার
পদ্মা সেতুতে ‘ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং’-এর ক্ষমতা ১০ হাজার টন। এখন পর্যন্ত কোনো সেতুতে এত ক্ষমতাসম্পন্ন বিয়ারিং লাগানো হয়নি। রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা ৯ পেরিয়ে গেলেও টিকে থাকবে পদ্মা সেতু। ভূমিকম্পের পাশাপাশি মাটির ক্ষয় সহ সব ঘাত প্রতিঘাত সহ্য করেই দাঁড়িয়ে থাকবে এই পদ্মা সেতু। এছাড়া পিলার এবং স্প্যানের মধ্যে যে বিয়ারিংয়ের জন্য ১০ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন ওজনের বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়েছে। বিশ্বে আর কোথাও এর আগে কোনো সেতুতে এমন বড় বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়নি। ফলে এই ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং পদ্মা সেতুকে অন্য সেতুর তুলনায় আলাদা করেছে।
পাইলের গভীরতা
খরস্রোতা পদ্মা নদীর মাটির ১২০-১২৭ মিটার গভীর পর্যন্ত বসানো হয়েছে সেতুর পাইল। এর আগে পৃথিবীর অন্য কোনো সেতুর জন্য এত গভীরে গিয়ে পাইল বসাতে হয়নি, যা রেকর্ড।
আরও পড়ুন-পদ্মা সেতু আবেগে কাঁপছে বাংলাদেশ! কেন নাশকতার ভয় হাসিনার মনে?
প্রধান সেতুতে পাইল ২৬৪টি পাইল ব্যবহার করা হয়েছে। নদীর ভিতরে এবং দুই প্রান্তে সেতুর ৪০টি পিলারের নিচে পাইপের মতো দেখতে এই পাইলগুলি বসানো হয়েছে। নদীর পাইলগুলো ভিতর দিকে ফাঁকা এবং ইস্পাতের তৈরি। প্রতিটি পাইলের ব্যাসার্ধ তিন মিটার এবং ৬২ মিলিমিটার পুরু। প্রতিটি পিলারের নিচে ছয় থেকে সাতটি পাইল বসানো হয়েছে। এই পাইল নদীর তলদেশের মাটি থেকে সর্বোচ্চ ১২৫.৪৬ মিটার (প্রায় ৪১২ ফুট) গভীরে লাগানো হয়েছে।
সবচেয়ে বড় ক্রেনের ব্যবহার
সেতু নির্মাণে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রেন ব্যবহার নজিরবিহীন ঘটনা । পিলারের ওপর স্প্যান বসানোর কাজে যে ক্রেনটি ব্যবহৃত হয়েছে সেটি এসেছে চীন থেকে। ‘তিয়ান ই’ নামের এই ক্রেনটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ ভাসমান ক্রেনবাহী জাহাজ।
২০১৭ সালে বাংলাদেশে আনা হয় ‘তিয়ান ই’-কে। এই ক্রেনের সাহায্যে ৩ বছর ৯ মাসে ৪১টি স্প্যান বসানো হয়েছিল পদ্মা সেতুর ৪২টি পিলারের ওপর। প্রতি মাসে এর ভাড়া বাবদ খরচ হয় ৩০ লক্ষ টাকা। সাড়ে তিন বছরে মোট খরচ হয়েছে ১২ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা। বিশ্বে প্রথম কোনো সেতু তৈরিতে এত দীর্ঘদিন ক্রেনটি ভাড়ায় থেকেছে। ক্রেনটির বাজার দর ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
কংক্রিট ও স্টিলের ব্যবহার
পদ্মা সেতু নির্মাণে কংক্রিট এবং স্টিল উভয়ই ব্যবহার করা হয়েছে। বিশ্বে আর কোনো সেতু নির্মাণে কংক্রিট এবং স্টিল একসঙ্গে ব্যবহার করা হয়নি। অর্থাৎ এখনও পর্যন্ত বিশ্বে যে সেতুগুলি নির্মিত হয়েছে তাতে হয় স্টিল নাহয় কংক্রিট ব্যবহৃত হয়েছে। পদ্মা নদীর গতিপ্রকৃতি ও বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় এই এলাকায় যেকোনো সেতু নির্মাণ অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং একটি কাজ।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় এলাকাজুড়ে নদী শাসন
পদ্মা সেতুর কাজে আরেকটি উল্লেখযোগ্য প্রকল্প নদী শাসন। নদী ভাঙন রোধ এবং নদীর গতি প্রবাহ ঠিক রাখতে সেতুতে আলাদা করে নেওয়া এ প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০২১ সালের জুন মাস পর্যন্ত। এ প্রকল্পের বাজেট ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৮০০ কোটি টাকা, যা বিশ্বের আর কোনো নদী শাসন করতে ব্যয় করা হয়নি। এ প্রকল্পের মাধ্যমে নদীর দুই পাশে ১১৪ কিলোমিটার এলাকা শাসন করা হবে। প্রকল্পের জন্য ইতিমধ্যেই ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় করা হয়ে গিয়েছে। এছাড়াও নদীশাসনে চীনের ঠিকাদার সিনোহাইড্রো কর্পোরেশনের সঙ্গে ১১০ কোটি মার্কিন ডলারের চুক্তি সই করা হয়। অতীতে নদীশাসনে এককভাবে এত বড় দরপত্র বিশ্বে আর হয়নি। এ ছাড়া পদ্মা সেতুতে পাইলিং ও খুঁটির কিছু অংশে অত্যন্ত মিহি দানার (মাইক্রোফাইন) সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে। এই সিমেন্ট অস্ট্রেলিয়া থেকে আনা হয়েছে। এ ধরনের সূক্ষ্ম দানার সিমেন্ট সাধারণত সেতু নির্মাণে ব্যবহার করা হয় না।