বিনা দোষে গেছে প্রাণ! বাংলাদেশে 'চাকরি চাওয়া কি অপরাধ', ছেলেহারা মা-কে উত্তর দেবে কে?
Bangladesh Quota Protest Deaths: পুলিশ রাবার বুলেট ছুড়তে শুরু করলেও সাঈদ দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে থাকেন। তাঁর এক হাতে ছিল লাঠি।
রাজনীতিতে নেই, আন্দোলনে নেই, কোনও বিক্ষোভেও নেই। তবু প্রাণ গেল শাহজাহানের। বাংলাদেশের ঢাকার শাহজাহান সামান্য এক বিক্রেতা, ফুটপাথেই দোকান। কোটা সংশোধনের আন্দোলনে উত্তাল বাংলাদেশে প্রাণ গিয়েছে ৬ জনের। শাহজাহান তাঁদেরই একজন। মঙ্গলবার দুপুর থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় কোটা সংশোধন আন্দোলনে যুক্ত পড়ুয়াদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ হয়। আন্দোলনে শামিল না হয়েও, ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকার দরুন মারধরের শিকার হয়ে দুই যুবকের মৃত্যু হয় সেখানে। তাঁদেরই একজন ২৫ বছরের মহম্মদ শাহজাহান। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, সন্ধে নাগাদ শাহজাহানকে সিটি কলেজের সামনের রাস্তায় আহত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। সেখান থেকে তাঁকে উদ্ধার করে পাশের পপুলার মেডিকেল ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নেওয়া হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা করিয়ে শাহজাহানকে অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয় ঠিকই কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি।
আরও পড়ুন- বাংলাদেশের কোটা ব্যবস্থা ঠিক কী? কেন এর বিরোধিতায় প্রাণ হারালেন পড়ুয়ারা?
ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের সামনে বসে ডুকরে কেঁদে ওঠেন শাহজাহানের মা আয়েশা খাতুন। ছেলেহারা মায়ের একটাই প্রশ্ন, "আমার ছেলে তো কোনও রাজনীতি করত না। ফুটপাতে ব্যবসা করত। আমার নিরীহ ছেলেকে মারল কে?” উত্তর নেই এই প্রশ্নের। এমন মৃত্যু স্তব্ধ করে দিয়েছে শাহজাহানের স্ত্রী ফাতিহা খাতুনকেও। ঢাকা মেডিকেলে যখন শাহজাহানের দেহ নিয়ে আসা হয়, তখনও তাঁর পরিচয় 'অজ্ঞাতপরিচয় যুবক'। বেশ কিছুক্ষণ মা আয়েশা খাতুন এসে ছেলের লাশ শনাক্ত করেন। বহু ঝড়ঝাপ্টা সয়ে যে ছেলেকে বড় করেছেন তাঁর অকালমৃত্যুতে বিচার চাইছেন পুত্রহারা মা।
শাহজাহানের বয়স যখন দুই বছর, তখনই স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয় আয়েশা খাতুনের। দুই বছরের ছোট্ট শাহজাহানসহ চার সন্তান নিয়ে আয়েশার জীবনসংগ্রাম শুরু হয়। বুটিকের কাজ করে যে আয় করতেন, তাই দিয়েই সংসার চলত। ছোট ছেলে শাহজাহানের বিয়ে হয় দুই বছর আগে। স্ত্রী ফাতিহা খাতুনকে নিয়ে কামরাঙ্গীরচরে বাড়িভাড়া নিয়ে থাকতেন শাহজাহান, পাশেই একটি বাসায় থাকেন তাঁর মা।
আয়েশা খাতুন জানিয়েছেন, নিউমার্কেটের বলাকা সিনেমা হলের সামনের ফুটপাতে পাপোশ বিক্রি করতেন শাহজাহান। মাস কয়েক আগে ফুটপাত থেকে তাঁদের উঠিয়ে দেওয়া হয়। বেকার হয়ে পড়েন। তারপর ছোটখাটো নানা কাজ করে সংসার চালাচ্ছিলেন। এদিন সকালেও কাজের উদ্দেশেই বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন। দুপুরে মায়ের সঙ্গে ফোনে কথাও হয় শাহজাহানের। কথা ছিল তাড়াতাড়ি ফিরবেন।
শাহজাহানের স্ত্রী ফাতিহা খাতুন টিভিতে প্রথম গন্ডগোলের খবর দেখেন। দুপুরে স্বামীর সঙ্গে কথাও হয়। তখনও সব ঠিকঠাক। এরপর সন্ধ্যায় আয়েশা খাতুনের মোবাইলে শাহজাহানের নম্বর থেকেই ফোন আসে। অন্য একজন ফোনের ওপ্রান্ত থেকে বলেন, শাহজাহানের মাথায় গুলি লেগেছে। পপুলার মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাঁকে। পরে আয়েশা জানেন, ছেলেকে গুলি করে মারা হয়েছে।
গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ (২২)। কোরবানির ইদের ছুটিতে শেষবার বাড়ি ফিরেছিলেন। তারপর বাড়ি ফিরেছে ছেলের লাশ। মা মনোয়ারা বেগম পুত্রহারা, দিশেহারা। কোটা সংস্কার আন্দোলনে সামনের সারিতে নেতৃত্বে ছিলেন আবু সাঈদ। রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে পশ্চিমে ১১ কিলোমিটার দূরে মদনখালি ইউনিয়ন পরিষদের বাবনপুর নালিপাড়া গ্রামে আবু সাঈদের বাড়ি। 'ভালো ছেলে' বলেই চেনে পাড়ার সকলে। 'ভালো ছেলে' তখন মৃত। 'ভালো ছেলে' তখন গুলি খাওয়া লাশ।
আরও পড়ুন- গুলি, রক্ত, মৃত্যু! কোটা আন্দোলনে উত্তাল বাংলাদেশে শহিদ ৬ জন কারা?
মা মনোয়ারা বেগমের আছাড়িপিছাড়ি কান্নার মাঝে ভেসে আসে একটাই প্রশ্ন, "মোর বাবাটাক পুলিশ গুলি কইরা মারল ক্যান? ও তো কাউকে মারতে যায় নাই। চাকরি চাওয়াটা কি অপরাধ?” সারাজীবন কষ্ট করে ছেলেকে মানুষ করেছেন আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন, মা মনোয়ারা। আশা ছিল, ছেলে চাকরি করলে শেষ বয়সে শান্তিতে বাঁচবেন। ছেলের মৃত্যুতে অনাথ হলেন মা-বাবা।
রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া আবু সাঈদ ছিলেন কোটা সংশোধন আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক। পড়ুয়াদের মিছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পার্কের মোড়ে এলে তিনিই ছিলেন সবার আগে। পুলিশ রাবার বুলেট ছুড়তে শুরু করলেও সাঈদ দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে থাকেন। তাঁর এক হাতে ছিল লাঠি।
হতদরিদ্র পরিবারে ৯ ভাইবোনের মধ্যে পঞ্চম ছিলেন সাঈদ। রংপুরে প্রাইভেট টিউশনি পড়িয়ে নিজের পড়াশোনা চলতেন, বৃদ্ধ বাবা-মাকে দেখতেন। তাঁর উদ্যোগেই এলাকায় গড়ে উঠেছে, ‘বাবনপুর স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। সদস্যরা মাসিক চাঁদা দিয়ে এলাকার গরিবদের বিপদে পাশে দাঁড়ান। সেই নিরীহ আবু সাঈদের দেহ আসে রাতে, বাড়িতে। দরিদ্র, মেধাবী আবু সাঈদ শুধুই 'লাশ' এখন। ২২ বছর, ২৫ বছরের কত কত মৃতদেহের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কোটা আন্দোলন।