কোটা সংস্কার হিমশৈলের চূড়া, আন্দোলনের মধ্যে আছে শত সহস্র ঢেউ

Bangladesh Quota Protest: অর্থ থাকলে সিভিল সার্ভিসের পদ কিনে নেওয়া যায়। কোটা থাকলে এগনো যাবে জীবনে। সৎ-দরিদ্র-মেধাবীদের সামনে কোনও সুযোগ নেই।

সাদিয়া নূসরাত সিদ্দিকা: ২০১৮ সালে কোটা আন্দোলন যখন হয়, আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইনাল ইয়ারে পড়ি। স্বাভাবিকভাবেই কোটা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি আমরা, যা পরবর্তীতে দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়ায়। কীভাবে, তা বলার আগে কোটা ছোট নিয়ে ভূমিকার প্রয়োজন, যা এড়িয়ে যান অনেকেই।

বাংলাদেশের কোটা ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে সবাই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, শতাংশের হিসেব-নিকেশ করতে বসেন, যা চাইলেই গুগলে পাওয়া যেতে পারে। আসলে যেটা জানা দরকার, তা হল, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন ভারতে। মেলাঘরের কথা, ভারতের প্রশিক্ষণ শিবিরগুলির কথা সর্বজনবিদিত। শুধু গল্প বা উপন্যাসের পাতাতেই নয়, প্রামাণ্য সব দলিলে বার বার করে লেখা রয়েছে কীভাবে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষকে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে, অস্ত্র দিয়ে ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর সেই সঙ্গে আর একটি কথাও বারংবার লেখা হয়েছে যে, ভারত যাঁদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিল, তাঁদের সকলের নাম-ঠিকানা, এমনকি বংশ পরিচয়, সবকিছুর তালিকাও তৈরি করেছিল ভারত।

ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিসেনারাই তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে এসে অন্যদের প্রশিক্ষিত করে তোলেন। এর পর, বাংলাদেশের স্বাধীনতাপ্রাপ্তিতে যখন মুক্তিযোদ্ধাদের সার্টিফিকেটের প্রসঙ্গ ওঠে। সেই সময় ভারত সরকারের থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে সার্টিফিকেট বিতরণ করাই কাম্য ছিল। কিন্তু তা হয়নি, যা এই কোটা আন্দোলনকে ঘিরে সবচেয়ে বড় ভুল বোঝাবুঝির কারণ হয়ে উঠেছে।
ভারত সরকারের থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ এমন কোনও তালিকা নিয়েছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। যাঁরা মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নিয়েছিলেন, তাঁদের অর্ধেকও আসলে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন কি না, মেলেনি তার প্রমাণও। মুক্তিযুদ্ধের সময় তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের যে সমস্ত বাঙালি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সাহায্য করেন, মুক্তিসেনাদের ধরিয়ে দেন, তাঁদেরকেই 'রাজাকার' বলে কটাক্ষ করা হয়। এমন বহু প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে 'রাজাকারে'র ভূমিকা পালন করা অনেকের কাছেই মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট রয়েছে।

ভেবে দেখুন, যাঁদের এই সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে, তাঁরা, তাঁদের উত্তরাধিকারীরা গত ৫২ বছর ধরে বাংলাদেশে কোটার ভিত্তিতে প্রাপ্ত যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা আদায় করে চলেছেন। সেই বাংলাদেশে, যেখানে ছোট্ট পরিসরে এত বেশি মানুষ থাকেন যে কোনও দিনই সকলের জায়গা কুলনোর নয়। সেই বাংলাদেশে, যেখানে ছেলেমেয়েকে স্নাতক করার সাধ্য সব পরিবারের থাকে না। পরিবারের একজনকে স্নাতক করতে যেখানে সর্বস্ব বিক্রি করে দিতে হয় বহু মানুষকে, সেখানে স্নাতক পাশ করা ছেলেমেয়েদের চাকরি নেই। আবার, নেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি থামার কোন লক্ষণও।

সেই আবহহেই এবছর জুন মাস থেকে নতুন খেলা শুরু হয় সোশ্যাল মিডিয়া, ‘দুর্নীতির এক্সপোজার’। বাংলা ভাষায় ছোটদের লেখা বই বলতে আমরা ছোটবেলায় কলকাতার বই-ই বুঝতাম। ফেলুদা, ঘনাদা, পার্বণী, ঝিলিমিলি, ননী ভৌমিকের রুশ দেশের উপকথা, এইসব। কিন্তু বাংলাদেশে আমাদের জন্মের এক-দুই দশক আগে থেকে প্রকাশনা জগতে একটি জাতীয়তাবাদী বিপ্লব শুরু হয়, যার এক দিকে ছিল কট্টর মুসলিম জাতীয়তাবাদ। এর অর্থ হল, হিন্দু লেখক এবং অন্য দেশ, অর্থাৎ কলকাতার বই টাকা দিয়ে কিনে না পড়ার মানসিকতা। আর অন্য দিকে ছিল, মুক্তিযুদ্ধের মহিমা উদ্ভাসিত করার প্রবল বাসনা। এতেই আমরা নাকাল হলাম। বাংলাদেশের ছোটদের পড়ার বই, যেখানে যৌনতা নেই, আছে মুক্তিযুদ্ধ, বিজ্ঞান, ’৭১-এর চেতনা। এই ঘরানায় একজন লেখকই রাজা হলেন। মা-বাবারা আমাদের মুহম্মদ জাফর ইকবালের বই কিনে দিলেন। তাঁর বই পড়ে ছোটবেলা কেটে গেল আমাদের। আমরা সবকিছুর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ পেতাম। ভাবতাম, একবার দেশের জন্য কিছু করার সুযোগ পেলে ঝাঁপিয়ে পড়ব।

এই চেতনা-ব্যবসা করতে গিয়েই তিনি এবং তাঁর মতো আরও অনেকে আমাদের প্রতিবাদী করে তুললেন। আমরা যাঁরা তখন স্কুল-কলেজে পড়তাম, রাজনীতির মারপ্যাঁচ না বুঝেই ২০১৩ সালে দলে দলে গিয়ে গলা ফাটাই শাহবাগে। জাফর ইকবাল সেই সময় আন্দোলনে আমাদের শামিল হন, স্লোগান তোলেন পাশে দাঁড়িয়ে। ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলনের দুঃস্বপ্নেও ফিরে যাই বার বার।’৭১-এর চেতনা নিয়ে যে ব্যবসা হয়, আমাদের যেভাবে নাকাল করা হয়, ওই আন্দোলনে আমার মতো অনেকের সত্ত্বাকে বিদীর্ণ করে দেওয়ার মতো দুঃখ থেকে বুঝতে পারি। কারণ একসময় যিনি পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলনে সেই জাফর ইকবালের অবস্থান ছিল ছাত্রদের বিরুদ্ধে। আমাদের পুলিশ ধাওয়া করল, বন্ধুরা আহত হল, মারা গেল। কয়েক মাস পর জানা গেল, ইচ্ছে করেই কোটা আন্দোলন করানো হয়েছে, নজর ঘোরানোর কৌশল হিসেবে। সেটি সত্য না মিথ্যা, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু আমাদের প্রজন্মের কাছে মৃতের পরিসংখ্যান হল একমাত্র সত্য। সেই থেকে আমাদের প্রধান আবেগ হয়ে উঠল অবিশ্বাস, বড়দের প্রতি অবিশ্বাস, চেতনা ব্যবসায়ীদের প্রতি অবিশ্বাস, আইনের উপর অবিশ্বাস।

আমি এবং আমার মতো ঢাকায় মধ্য এবং উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারে যারা বেড়ে উঠেছি, আমাদের অনেকেরই ২০১৮-'১৯ সালের আগে রাজনীতি নিয়ে অত শক্ত চিন্তা করতে হয়নি। আমাদের পেটে লাথি পড়েনি কখনও। গুলশান-বনানী-বারিধারার ঝাঁ চকচকে রেস্তরাঁয় আমরা জন্মদিনের উৎসব করেছি। দেশের রাজনীতিকরা যে একদম শুরু থেকে জনস্বার্থ না দেখে শ্রেণিস্বার্থ দেখে এসেছেন, প্রোটেক্টিভ বাবলের মধ্যে থেকে তা বুঝতে পারিনি আমরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গোটা বাংলাদেশের সব জায়গা থেকে মেধাবীরা পড়তে আসেন। সেখানে কোটা আন্দোলনের আকস্মিকতায় আমাদের যেন চোখ ফুটল। আমরা টের পেলাম, যে সোনালী ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছি, তা মিথ্যা। টের পেলাম যে, বাংলাদেশে কেউ কাউকে বিশ্বাস করেন না, কেউ না। সবাই ভাবেন, কেউ না কেউ তাঁকে ফাঁকি দিচ্ছেন। ধর্ম-ব্যাবসা আর জাতীয়তাবাদী কিছু ঠুনকো চেতনা ছাড়া কোন আদর্শ নেই কারও মধ্যে। আর এই চেতনাও তৈরি করা হয়েছে জুজুর ভয় দেখিয়ে। অমুক দেশ দখল করে নিতে চায়, তমুক ধর্মের মানুষ মুসলিমদের ক্ষতি করতে চায়- এমন বুলি আওড়েই চলে মগজধোলাই। ভয় দেখিয়ে মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি করা হয়েছে। ধর্ম, রাজনীতি, জেলা, সামরিক পরিবার, অসামরিক পরিবার, ব্যাবসায়ী পরিবার- বিভেদের এমন হাজারো মাপকাঠি খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু বিশ্বাস, মমতা, মেলবন্ধনের কোনও প্রচেষ্টা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

এর পরও কিছু স্বপ্ন এতই আরাধ্য হয়, যে মানুষের বিশ্বাসে টাল খায় না। বাংলাদেশের চাকরিপ্রত্যাশী তরুণদের এমন রাধ্য স্বপ্ন হল, বিসিএস অর্থাৎ বাংলাদেশের সিভিল সার্ভিসের চাকরি। দেশের সেবা করা, মাথা উঁচু করে সমাজে বাঁচার জন্য লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে বিসিএস-এর স্বপ্ন দেখেন। গুগলে খুঁজলে দেখা যাবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে প্রতিদিন কত পরিমাণ ছেলেমেয়ে লাইন দিয়ে ভোর থেকে অপেক্ষা করেন। সংখ্যাটা জানলে অবাক হয়ে যাবেন। এই একটি পরীক্ষা যেটি মেধার জোরে হয়, যেখানে সকলের ভাগ্যের চাকা ঘুরে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যেখানে কোটা না থাকলেও, প্রজন্মগত বিত্ত না থাকলেও জীবনযুদ্ধে জয়লাভ করা সম্ভব।

কোটা আন্দোলনের আলোচনায় এটা প্রায় বলাই হয় না যে, ২০২৪ সালের জুন মাসে প্রথমবার সোশ্যাল মিডিয়া মারফত জনগণের কাছে বিসিএস-এর প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার খবর পৌঁছয়। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে টাকার বিনিময়ে প্রশ্নপত্র খরিদ্দারদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার চক্রের কথা জানতে পারেন সকলে। যাঁদের কোটা নেই, কিন্তু বছরের পর বছর বিসিএস-এর জন্য প্রস্তুতি নিয়ে গিয়েছেন, এই ঘটনায় তাঁদের মনে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, তা আসলে বাইরে থেকে কল্পনাও করতে পারবেন না। তাঁদের অমোঘ স্বপ্ন জোর ধাক্কা খায়। বুঝতে পারেন, মেধাবী হয়ে লাভ নেই। অর্থ থাকলে সিভিল সার্ভিসের পদ কিনে নেওয়া যায়। কোটা থাকলে এগনো যাবে জীবনে। সৎ-দরিদ্র-মেধাবীদের সামনে কোনও সুযোগ নেই। আইআইটি-র প্রশ্ন ফাঁস হয় শুনলে যেমন হবে, এ তার চেয় অনেক বেশি হৃদয়বিদারক। কারণ বাংলাদেশের সাধারণ পরিবারগুলির কাছে বিসিএস-এর চাকরির চেয়ে বড় কোনও চাকরির স্বপ্ন নেই।

এবছর জুন মাসে বাংলাদেশে ইদ- উল-আযহা পালিত হয়। ইদের সময় মূল্যস্ফীতি বরাবরই বেশি থাকে। এবারও রেকর্ড ছাপিয়ে যাওয়া মূল্যস্ফীতিতে কোন হেরফের হয়নি। সেই আবহে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিসিএস প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবর ছড়িয়ে পড়ে হু হু করে। বাংলাদেশের মানুষ বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ায় খবর দেখেন, সংবাদমাধ্যমে নয়। যে সাংবাদিক বিসিএস-এর প্রশ্নফাঁসের পাঁচ-ছয় বছরের তদন্ত রিপোর্ট বের করেন, তিনিও সোশ্যাল মিডিয়াতেই প্রথম তার ঘোষণা করেন। ভাল-মন্দ সব খবর সোশ্যাল মিডিয়া থেকে মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল হয়ে যায়। তাই মধ্য জুন থেকে মধ্য জুলাইয়ের মধ্যে বাংলাদেশের মূল আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে দুর্নীতির মাধ্যমে টাকার পাহাড় জড়ো করার বিষয়টি।

একদিকে, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি, হাহাকার, অভাব, অশান্তি; অন্য দিকে, প্রধানমন্ত্রীর পিয়নের পকেটে ৪০০কোটি টাকা। একদিকে, ইদে কেউ ১৫ লাখ টাকা দিয়ে ছাগল কিনছেন; অন্য দিকে, টাকার অভাবে বিয়ে না হওয়ায় আত্মঘাতী হওয়া গ্রামের কৃষকের মেয়ে। অতি অল্প সময়ে এতগুলি বড় খবর কীভাবে প্রকাশিত হল, তা নিয়ে আমার মধ্যে এখনও বিস্ময় কাজ করে। এর নেপথ্যে অন্য উদ্দেশ্য আছে কি না, জানি না। একজন অরাজনৈতিক, সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমার পর্যবেক্ষণ, খবরগুলি সব সত্য, যা ক্ষোভের সবচেয়ে বড় কারণ। এই খবর বের না হলেও, সত্য এটাই থাকত, চাপা পড়ে থাকত। কিছুটা বের হয়ে এসেছে, যা ছাত্রছাত্রীদের কোটা সংস্কার দাবির আন্দোলনে স্ফুলিঙ্গের কাজ করেছে। কোটা সংস্কারের আন্দোলন তাই শুধু কোটা নিয়ে নয়, এইসব অন্যায়, অরাজকতা নিয়েও, যা সবার জানা খুব জরুরি, খুব জরুরি।

কোটা আন্দোলনের বীভৎসতার বর্ণনা আমি দেব না। অন্য অনেকে দেবেন, পড়ে নেবেন। আমি একজন তরুণ বাংলাদেশি, সদ্য প্রবাসী। ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলনের ফলাফল দেখে আমি এতই হতাশ হয়ে পড়েছিলাম যে, এবারের আন্দোলন যখন শুরু হয়, তেমন গুরুত্ব দিইনি। আমার প্রিভিলেজড, প্রোটেক্টিভ বাবলে থেকে আমি ১২ জুলাই মুগ্ধ হয়ে ফেসবুকের মাধ্যমে ঢাকায় নচিকেতার কনসার্টের ভিডিও দেখেছি। সমারসেটের রাস্তায় কফি হাতে হেঁটে যেতে যেতে গুনগুন করেছি 'দখিনা পবনেতে অন্ধ আবেগে থাকে না মন ঘরে'। বাংলাদেশে কোনও আন্দোলন কখনও সফল হবে, সেই নিয়ে আমাদের মনে কতখানি অবিশ্বাস বুঝুন। জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ঢাকায় নচিকেতার কনসার্ট হয়েছে ধুমধাম করে। হঠাৎ শুনলাম ছাত্র-ছাত্রীদেরকে 'রাজাকার' আখ্যা দেওয়া হয়েছে, সবাই ভীষণ রেগে গিয়েছেন। নিরীহ ছাত্রদের উপর গোলাগুলি বর্ষণ হচ্ছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ১৮ জুলাই থেকে বাংলাদেশ গোটা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।

২০২৪ সালে এসে, ১৭ কোটি মানুষের একটা দেশ যে ফোন, ইন্টারনেট সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে, এটা অকল্পনীয়। পাঁচদিন, টানা পাঁচদিন পারিনি দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম যা দেখাল, তা হল, বাতাবি লেবুর বাম্পার ফলন। আর ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে মিছিমিছি বের হতে থাকল যে, এই আন্দোলন জঙ্গিদের আন্দোলন। আমরা যারা দেশের বাইরে চলে আসতে পেরেছি, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে মৃত্যু দেখতে পেলাম। প্রিয়জনরা কেমন আছেন, আদৌ বেঁচে আছেন, না নেই, কোথায় খুঁজে পাব, সেই চিন্তা তাড়া করে বেড়াতে লাগল সারাক্ষণ।

বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক অনেক দূরে। ইন্টারনেট আংশিক ফিরে এসেছে। কোটা সংস্কার নিয়ে হাস্যকর এক রায় বেরিয়েছে বলে অনেকে ভাবছেন সব ঠিক হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কিছুই ঠিক নেই। কতজন মারা গিয়েছেন, কেউ জানে না। আমাদের বন্ধু-পরিজনরা প্রাণ হাতে করে কার্ফুর মধ্যে অফিস গিয়েছেন। যেখানে সেখানে হানা দেওয়া হচ্ছিল, ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল ছাত্রদের। রাস্তার মোড়ে মোড়ে সাধারণ মানুষের ফোন চেক করা হয়েছে। দেখা হয়েছে, তাঁরা সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু বলেছেন বা লিখেছেন কি না। কী অবিশ্বাস্য বাস্তবতা! টেলিনরের মতো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে যে, সরকারের নির্দেশেই তারা সব ধরনের যোগাযোগ ব্যাবস্থা বন্ধ করে রেখেছিল। অথচ সরকারি মন্ত্রীরা ফেসবুকে এসে পুড়ে যাওয়া তার টানাটানি করার ছবি আপলোড করে দারি করেছেন, দুর্বৃত্তরা ডেটা সেন্টার পুড়িয়ে দেওয়াতেই নাকি ইন্টারনেট কাজ করেনি, ফেসবুক বন্ধ হয়ে যায়! তাহলে আপনাদের ফেসবুক চলছিল কী করে? হাস্যস্পদ হওয়ার কোনও সীমা-পরিসীমা কেউ বাকি রাখেননি এবার।

ছাদে খেলা করা ছোট্ট শিশু থেকে গলির বৃদ্ধ সবজিওয়ালা, হতাহতের তালিকায় রয়েছেন সকলেই। কারও বয়স বা পেশা এমন নয় যে, তাঁরা জামাত বা বিএনপি অথবা আন্দোলনকারী ছাত্রনেতা হবেন। তাঁদের কেন খুন করা হল? স্বাধীন দেশের জনগণের উপর সেই দেশের সেনাবাহিনী কী করে গুলি চালায়? এসবের কোনও জবাব আমার কাছে নেই। অনেকে এই আন্দোলনকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ বলছেন। বাংলাদেশের বাস্তবতায় সেটি ব্যর্থ রোম্যান্টিসিজম ছাড়া কিছুই নয়। এই আন্দোলন ছাত্রছাত্রীদের মরিয়া হয়ে ওঠার আন্দোলন ছিল। এই মরিয়া ভাব, এই হতাশার কোনও সমাধান কারও কাছে নেই। '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়াদাওয়ার দায়িত্বে ছিলেন দেশের সাধারণ মানুষ। তখন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বৈষম্য এখনকার মতো ছিল না। এখন সাধারণ মানুষের নিজের পেটে অন্ন নেই, কাউকে খাওয়ানোর সামর্থ্যও নেই। চাকরি নেই, আশায় বুক বাঁধার মতো নেতা নেই কোনও। এই প্রজন্মের একজন প্রতিনিধি হয়ে বলতে পারি যে, আমরা কোনও রাজনৈতিক দলকে বিশ্বাস করি না। কেউ জনসাধারণের জন্য এমন কিছু করেননি যে, জনসাধারণ তাঁদের নিয়ে আশায় বুক বাঁধবেন। মুক্তিযোদ্ধারা সশস্ত্র ছিলেন। এখনকার নিরস্ত্র ছাত্রজনতার উপর সশস্ত্রবাহিনী গুলি চালিয়েছে। '৭১-এ গণহত্যা আর যুদ্ধ দুই-ই হয়েছিল, ২০২৪ এ দাঁড়িয়ে বাংলাদেশে যা হল, তা গণহত্যা।

নেতা ছাড়া আন্দোলন হয় না, সম্মিলিত লক্ষ্য ছাড়া যুদ্ধ হয় না। বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের এখন একটাই লক্ষ্য, একটাই স্বপ্ন, কোনও ভাবে এই দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়া। একটি বিষয় দিনের আলোর মতো স্পষ্ট, অর্থনৈতিক মুক্তি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মরীচিকার চেয়ে কম কিছু নয়। যাঁদের টাকা আছে, তাঁদেরই কেবল টাকা বাড়বে। শ্রেণিবৈষম্য, শ্রেণিশত্রুতা বাড়তেই থাকবে। স্বাভাবিক ভাবেই যাঁদের সুবিধা বাড়ছে, তাঁরা চাইবেন সব যেমন চলছে চলুক। যে দেশের রিকশাওয়ালা ছ'মাস ধরে আমিষ খেতে না পেয়ে কাঁদেন, সেখানকার নেতাদের হাতঘড়ির দাম ৩৮ লক্ষ টাকা; বেগমপাড়ার বাস্তবতা কারও জানতে বাকি নেই। বাংলাদেশে একটা কথা গত কয়েক বছর ধরে খুব প্রচলিত, 'দ্য গ্রেট বাংলাদেশি ড্রিম ইজ টু এসকেপ বাংলাদেশ', যাতে মেধা বা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির জোরে অন্য দেশে জীবন ও জীবিকার সন্ধানে পাড়ি দেওয়া যায়। আগামীতে দূরদেশ থেকে আমরা পরিবার-পরিজনের সঙ্গে কখনও হয়ত কথা বলতে পারব, কখনও হয়ত পারব না। হয়ত প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠবে জঙ্গিবাদ, দেশদ্রোহিতা।

More Articles