ফ্যাসিস্টদের বিচার চাই বাংলাদেশের মাটিতেই! বিক্ষোভের শিখাকে জ্বালিয়ে রাখার বার্তা বৈষম্যবিরোধীদের

Bangladesh Protest: সোমবার হাসিনার পদত্যাগের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তরফ থেকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, অভ্যুত্থানকারী ছাত্র নাগরিকের প্রস্তাবিত অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকারের কাছেই ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।

স্বৈরাচারী সরকারের নির্দেশে বাংলাদেশে গত কয়েকদিনের আন্দোলনে প্রাণ গিয়েছে অন্তত তিনশো জনের। সংরক্ষণবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বড় হতে হতে বিরাট আকার ধারণ করেছিল বাংলাদেশে। সেই আন্দোলনের হাতেনাতে ফল দেখা গিয়েছে সোমবার। অবশেষে পদ থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য হলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আন্দোলনের শুরুটা পড়ুয়াদের দিয়ে শুরু হল কার্যত গণবিক্ষোভের রূপ নিতে দেখা গেল বাংলাদেশের সাম্প্রতিক এই আন্দোলনকে। সোমবার তার ফলই মিলল হাতেনাতে। গণবিক্ষোভের মুখে পিছু হঠতে বাধ্য হলেন হাসিনা সরকার। এদিন পদত্যাগ করে কপ্টারে করে বোনের সঙ্গে দেশ ছাড়লেন শেখ হাসিনা। জাতির উদ্দেশ্যে বার্তায় বাংলাদেশের সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান। জানালেন অন্তর্বর্তী সরকার গড়ে দেশ শাসনের কথা। তার আগে বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন বাংলাদেশের সেনাপ্রধান। যদিও সেখানে আওয়ামী পার্টির কোনও সদস্য ছিলেন না। আর ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল।

এদিন জাতির উদ্দেশে ভাষণে দেশের মানুষকে শান্ত ও সংযত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে তিনি জানিয়ে দেন, বাংলাদেশের প্রতিটি হত্যার বিচার হবে। সংরক্ষণ বিরোধী আন্দোলন দিয়ে যে লড়াই শুরু হয়েছিল, সেই লড়াই শেষপর্যন্ত ছড়িয়ে গিয়েছে বাংলাদেশের প্রতিটি স্তরের মানুষের কাছে। ফ্য়াসিবাদমুক্ত এক সরকারের দাবিতে পথে নামেন তাঁরা। সংরক্ষণবিরোধী আন্দোলনকে দমন করতে নেমে পুলিশ, বাহিনী ও আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের হাতে যেভাবে বিক্ষোভকারী ও সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে গোটা দেশ। পথে নামেন বিভিন্ন তারকা ও বিশিষ্ট মানুষেরাও। সংরক্ষণবিরোধী আন্দোলনে প্রাণ গিয়েছিল অন্তত দু'শো জন নিরপরাধ মানুষের। যাদের মধ্যে বেশিরভাগই পড়ুয়া। সেই সব নিহতদের জন্য সুবিচার চেয়ে ফের পথে নেমেছিল মানুষ। গোটা বাংলাদেশের রাজপথ উপচে পড়ে। সেই আন্দোলনে নেমে ফের মৃত্যু হয় শতাধিক মানুষের। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সোমবার উত্তাল হয়ে ওঠে বাংলাদেশ।

আরও পড়ুন: অন্তর্বর্তী সরকার গড়ে আপাতত চলবে দেশ, জাতির উদ্দেশে ভাষণে যে বার্তা বাংলাদেশের সেনাপ্রধানের

হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন। কার্যত পূরণ হয়েছে বিক্ষোভকারীদের দাবি। ফ্যাসিবাদী সরকারকে ফেলে দিতে পেরেছে বাংলাদেশের গণবিক্ষোভ। আপাল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গড়েই দেশচালনা করা হবে বলে জানিয়েছেন সেনাপ্রধান। তার জন্য রাষ্ট্রপতির দরবারেও গিয়েছেন সেনাপ্রধান। তবে হাসিনার পদত্যাগের পরেও কিন্তু আন্দোলন থামানোর কথা ভাবছেন না বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীরা। বরং তাঁদের আরও একগুচ্ছ দাবি রয়েছে, যা পূরণ না হওয়া পর্যন্ত রাজপথ না ছাড়ার কথাই জানিয়েছেন তাঁরা। কোটা বিরোধী আন্দোলনে অজস্র মানুষকে বন্দি করেছিল বাংলাদেশ সরকার। তার মধ্যে অসংখ্য পড়ুয়া তো বটেই। কিছুদিন আগেই উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় বসতে চলা কয়েক জন বন্দিকে মুক্তি দিয়েছিল হাসিনা সরকার। যে সরকারের আমলে বাংলাদেশের এত উত্তাল পরিস্থিতি, সেই হাসিনা দেশ ছেড়েছেন ইতিমধ্যেই। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ভারতবর্ষের মাটিতে নামতে চলেছে হাসিনার কপ্টার।

তবে হাসিনা গদি ছাড়লেও দাবি এখনও শেষ হয়নি বিক্ষোভরতদের। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাঁদের একগুচ্ছ দাবি এখনও রয়ে যাচ্ছে। সেসব না মেটা পর্যন্ত রাজপথ ছাড়বেন না তারা। যদিও এই রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের পথ থেকে বিক্ষোভকারীদের সরে আসার পরামর্শ দিয়েছেন সেনাপ্রধান। তিনি বলেছেন, ‘‘ভাঙচুর, মারামারি, সংঘর্ষ থেকে বিরত থাকুন। ধৈর্য হারাবেন না। আমি নিশ্চিত, আপনারা যদি আমাদের কথামতো চলেন, আমরা যদি একসঙ্গে কাজ করি, তা হলে আমরা একটা সুন্দর পরিণতির দিকে এগোতে পারব।’’ দেশ শান্ত হলে কার্ফুর প্রয়োজন নেই বলেও জানান তিনি। কিন্তু পড়ুয়ারা যে এখনই আন্দোলনের পথ থেকে সরে আসছে না, তা কার্যত পরিষ্কার।

সোমবার হাসিনার পদত্যাগের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তরফ থেকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, অভ্যুত্থানকারী ছাত্র নাগরিকের প্রস্তাবিত অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকারের কাছেই ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। এর বাইরে কোনও সরকার তারা মেনে নেবে না বলেই স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি এদিন সন্ধের মধ্যে নিরপরাধ ব্যক্তি, রাজবন্দী ও গুমকৃত ব্যক্তিদের মুক্ত করতে হবে। একই সঙ্গে তারা জামিয়ে দিয়েছে, ফ্যাসিস্ট, খুনিদের বিচার এই বাংলাদেশের মাটিতেই করতে হবে। তাঁদের কোথাও পালানোর সুযোগ দেওয়া যাবে না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তরফ থেকে সমন্বয়কারীরা জানিয়েছেন, শুধু হাসিনা সরকারের পদত্যাগেই সন্তুষ্ট নয় তাঁরা। একই সঙ্গে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ করে নতুন বাংলাদেশ ও রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বিনির্মাণ করতে হবে সে দেশে। আর এই সব দাবির উপর যতক্ষণ না পুরোপুরি জয় মিলছে, ততক্ষণ পর্যন্ত রাজপথ ছাড়ছেন না আন্দোলনকারীরা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হিসেবে মো. নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ এই বার্তা সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছেন।

তবে এ কথা আগেও জানিয়েছিলেন আন্দোলনকারীরা।বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম ‘প্রথম আলো’ জানাচ্ছে, সাতটি বামপন্থী ছাত্র সংগঠন নিয়ে গঠিত ‘গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট’ রবিবারই গণমাধ্যমেএকটি যৌথ বিবৃতি দেন। সেখানে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ডাক দিয়েছিলেন অন্তর্বর্তিকালীন গণতান্ত্রিক সরকার গড়ার। আর সেই সরকার গড়বেন দেশের আপামর শ্রেণি-পেশার মানুষেরাই। বিবৃতিটিতে স্বাক্ষর ছিল জোটের সমন্বয়ক ও ছাত্র ইউনিয়নের একাংশের সভাপতি রাগীব নাঈম, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের (মার্ক্সবাদী) সভাপতি সালমান সিদ্দিকী, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি দিলীপ রায়, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের সভাপতি ছায়েদুল হক, ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি মিতু সরকার, বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি অঙ্কন চাকমা এবং বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলনের সভাপতি তাওফিকা মিয়ার।

আরও পড়ুন:অবশেষে ইস্তফা হাসিনার! বাংলাদেশ ছেড়ে বোনের সঙ্গে কোন দেশে আশ্রয়?

বিবৃতিতে এ-ও বলা হয়, কোটা সংস্কারের দাবিকে ঘিরে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলন দমন করতে বর্বরোচিত ‘জুলাই হত্যাকাণ্ড’ ঘটিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। পুলিশ, বিজিবি এবং র‌্যাবের সম্মিলিত বাহিনী হত্যা করেছে অসংখ্য ছাত্র-জনতাকে। এই সরকারের হাতে ছাত্র-জনতার রক্ত লেগে রয়েছে। তাই গোটা দেশের জনগণের এখন সম্মিলিত এক দফা, এক দাবি— অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে এই সরকারকে। এর পরেই বিবৃতিতে ‘অন্তর্বর্তিকালীন গণতান্ত্রিক সরকার’ গঠনের ডাক দেন তাঁরা। এই সরকারের প্রাথমিক কাজগুলি হবে আন্দোলনকারীদের নামে দায়ের হওয়া সমস্ত মামলা প্রত্যাহার করা, আটক সকলকে মুক্তি দেওয়া, গণহত্যা ও নির্যাতনের তদন্ত ও বিচার, ছাত্র-জনতা হত্যার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত সকলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অবিলম্বে খুলে দেওয়া এবং সর্বোপরি, ‘জুলাই হত্যাকাণ্ডে’ গুম-খুন, নিখোঁজ ও মৃতদের নামের তালিকা এবং প্রকৃত হিসাব প্রকাশ্যে আনা।

‘জুলাই হত্যাকাণ্ডে’র স্মরণে ৩১ জুলাইয়ের পর থেকে ৩২, ৩৩, ৩৪ করে দিন গুনছে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা। অর্থাৎ হিসাব মতো ৫ অগস্ট, ‘৩৬ জুলাই’ ঢাকা গণভবনের দিকে ‘লং মার্চ’-এর ডাক দেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তবে সেই দিনেই গণবিক্ষোভের জেরে গদি ছাড়তে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। ইতিমধ্যেই সেনাবাহিনী সেখানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গড়ার উদ্দেশে রাষ্ট্রপতির দরজায় গিয়েছেন। তবে পূরণ হবে কি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তরফে থাকা বিক্ষোভকারীদের দাবি? শান্তি ফিরবে শেষমেশ বাংলাদেশ? ফ্যাসিবিরোধী মানুষের সরকার পাবে শেষমেশ বাংলাদেশের মানুষ? সেটাই এখন দেখার।

More Articles