গুলি, রক্ত, মৃত্যু! কোটা আন্দোলনে উত্তাল বাংলাদেশে শহিদ ৬ জন কারা?
Bangladesh Quota Movement: চট্টগ্রামে এই হিংসায় তিনজনের মারা যান। মুরাদপুর থেকে ষোলশহর পর্যন্ত এলাকায় দফায় দফায় সংঘর্ষের এই তিনজনের প্রাণ যায়।
এ বাংলাদেশের চেহারা অচেনা ঠেকে। উত্তাল নয় শুধু, এই বাংলাদেশ রক্তস্নাত, ভীত, হিংসায় উন্মত্ত। সরকারি চাকরির সংরক্ষণ ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীদের প্রাণ গেছে, প্রাণ গেছে পথচলতি সাধারণ মানুষেরও। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুরজুড়ে ৬ জনের মৃত্যু দেখল বাংলাদেশ। মঙ্গলবার দুপুর থেকেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনকারী, বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও বাংলাদেশের সরকারের সমর্থক সংগঠনের কর্মীদের সংঘর্ষে আহত চার শতাধিক মানুষ। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া, রংপুর ও রাজশাহীতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন করা হয়।
সরকারি চাকরিতে 'কোটা' সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন বেশ অনেকদিন ধরেই চলছিল বাংলাদেশে। সেই আন্দোলনের অংশ হিসেবেই মঙ্গলবার বিকেলে দেশের সব ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল আন্দোলনকারীরা। তবে সকাল থেকেই আন্দোলনের অংশ হিসেবে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ করে ছাত্রছাত্রীদের বিক্ষোভ শুরু হয়। সড়ক অবরোধের জেরে অবধারিত যানজট সৃষ্টি হয়। ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে ট্রেন চলাচলও বন্ধ হয়ে যায়।
আরও পড়ুন- ৬ জনের মৃত্যু, স্কুল কলেজ বন্ধ! বিক্ষোভের আগুন যে দিকে ঠেলে দিচ্ছে বাংলাদেশকে
বিকেল থেকে এই আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরকারপক্ষের সংগঠনের কর্মীদের সংঘর্ষ শুরু হয়। চট্টগ্রামে এই হিংসায় তিনজনের মারা যান। মুরাদপুর থেকে ষোলশহর পর্যন্ত এলাকায় দফায় দফায় সংঘর্ষের এই তিনজনের প্রাণ যায়। নিহতদের মধ্যে একজন, ওয়াসিম আকরাম চট্টগ্রাম কলেজের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। বাড়ি কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলায়। চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন তিনি। নিহত বাকি দুজনের মধ্যে ফয়সাল আহমদ শান্ত (২০) ওমরগণি এমইএস কলেজের ছাত্র। আর ফারুক (৩২) রট আয়রনের মিস্ত্রি।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেই এই তিনজনের মৃত্যু হয়। এদের মধ্যে দু'জনের মৃত্যু হয় গুলি লেগে। অন্য আরেকজনের শরীরে মারধরের ছাপ ছিল স্পষ্ট। অন্তত ৪০ জনকে আহত অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাওয়া হয়।
কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা দুপুরে ষোলশহর রেল স্টেশনে জড়ো হওয়ার চেষ্টা করেন। সেখানে আগে থেকেই ছিলেন সরকারদলীয় বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা। আন্দোলনকারীরা ষোলশহর রেল স্টেশন এলাকায় অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করলে মুরাদপুর মোড়ে লাঠি নিয়ে তাদের ওপর হামলা হয়। আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। দুই পক্ষের মধ্যে ঢিল ছোড়াছুড়ি শুরু হয়, পাওয়া যায় বিস্ফোরণের শব্দও।
অন্যদিকে ঢাকা শহরে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে রাজধানীর মিরপুর রোডে ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের সামনে দুইজনের মৃত্যু হয়। মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকা কলেজের সামনে থেকে বছর ২৫-এর অজ্ঞাতপরিচয় এক যুবককে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
গত সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর দফায় দফায় হামলা চালিয়েছিল ছাত্রলীগ। প্রতিবাদে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মঙ্গলবার বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনের ডাক দেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। কোটাবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে মঙ্গলবার দুপুর থেকেই আন্দোলনকারীরা ঢাকা কলেজের কাছে সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। এতে মিরপুর সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আন্দোলনরত পড়ুয়ারা আর ছাত্রলীগের মধ্যে দফায় দফায় হিংসা বাড়ে। ঢাকা কলেজের সামনের রাস্তায় হেলমেট পরা এক ব্যক্তিকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। পাশেই ছিলেন লাঠি হাতে আরেক ব্যক্তি। আহত ওই ব্যক্তিই পরে হাসপাতালে মারা যান। ঢাকায় বিক্ষোভ দমনে লাঠি, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে সক্রিয় ছিলেন ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা।
নিহত আরেকজনের পরিচয়ও প্রথমে জানা যায়নি। সন্ধ্যার দিকে ওই যুবক রক্তাক্ত অবস্থায় সিটি কলেজের সামনে পড়ে ছিলেন। তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। মাথায় গুরুতর জখমের চিহ্ন ছিল ওই যুবকের। পরে জানা যায় তিনি মহম্মদ শাহজাহান (২৫), নিউমার্কেট এলাকার হকার। ঢাকা কলেজ, সায়েন্স ল্যাবরেটরিসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে আহত ৬০ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
আরও পড়ুন- একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়ে তোলপাড়! কেন রাস্তায় নামল বাংলাদেশের বিক্ষুব্ধ ছাত্রযুব?
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে এক যুবকের প্রাণ গেছে। মঙ্গলবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পার্কের মোড় এলাকায় সংঘর্ষে পুলিশসহ শতাধিক পড়ুয়া আহত হন। নিহত ওই পড়ুয়ার নাম আবু সাঈদ (২৫)। তিনি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বাদশ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। বাড়ি পীরগঞ্জ উপজেলার বাবুনপুর গ্রামে। গুলিবিদ্ধ ওই পড়ুয়াকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেই তার মৃত্যু হয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সোমবার সন্ধ্যায় আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। গভীর রাতে উপাচার্যের বাসভবন চত্বরে পড়ুয়াদের উপর পেট্রলবোমা ও দেশি অস্ত্র নিয়ে হামলা এবং মারধর করা হয়। পুলিশ এসে কাঁদানে গ্যাসের শেল ও ছররা গুলি ছোড়ে। এই ঘটনায় শতাধিক পড়ুয়া, ঘটনাস্থলে উপস্থিত চার-পাঁচজন শিক্ষক ও সাতজন সাংবাদিক আহত হন। এই ঘটনাগুলির পর মঙ্গলবার লাগামছাড়া হয়ে যায় বাংলাদেশের পরিস্থিতি।