বাউল গান না শুনলে তৈরিই হত না রবীন্দ্রনাথের এই গানগুলো

ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে
ও বন্ধু আমার!
না পেয়ে তোমার দেখা, একা একা দিন যে আমার কাটে না রে ॥...


বাউলের দর্শন, কথা, সুর রবীন্দ্রনাথকে শুধু মুগ্ধ করেনি, প্রভাবিতও করেছে। তাই তাঁর বাউল অঙ্গের গানে সেই মুগ্ধতার ছাপ স্পষ্ট। ১৮৯০ সালে জমিদারি দেখাশোনার কাজে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আসেন কুষ্টিয়ার শিলাইদহে। সেসময় তাঁর পরিচয় হয় সেখানকার বাউলদের সঙ্গে। বাউল দর্শনের প্রতি মুগ্ধতায় কবি লেখেন এই কবিতাটি।


দেখেছি একতারা-হাতে চলেছে গানের ধারা বেয়ে,/ মনের মানুষকে সন্ধান করবার/ গভীর নির্জন পথে।/ কবি আমি ওদের দলে—/আমি ব্রাত্য, আমি মন্ত্রহীন।


১৮৯০ সালের শেষ ভাগ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এলেন শিলাইদহে। তিনি ঠাকুরবাড়ির জমিদারির এই অঞ্চলের দায়িত্বগ্রহণ করেন। তিনি শিলাইদহে আসার পর থেকে বাউল-ফকিরদের সঙ্গে পরিচিত হতে থাকেন। প্রথমে তিনি শিলাইদহ পোস্ট অফিসের পিয়ন গগন হরকরার (গগন দাস) গানের প্রতি আকৃষ্ট হন। তাঁর রচিত ও গাওয়া গান ‘কোথায় পাবো তারে/আমার মনের মানুষ যে রে’- এই গানে মুগ্ধ হন। কেবল মুগ্ধ হয়েই ক্ষান্ত হননি। নিজে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’- এই বাণীর সঙ্গে গগনের গানের সুর যোজনা করেন। রবীন্দ্র-গবেষকরা বলেন, গগন যে সুরে তাঁর মনের মানুষের গান গেয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ সেই সুর নিয়ে তাঁর সোনার বাংলা গানের সুর দেন। 

আরও পড়ুন: কুয়াশা দেখে এঁকে ফেলেছিলেন তাজমহল, অবিশ্বাস্য প্রতিভা ছিল অবনীন্দ্রনাথের

শিলাইদহে আসার পরই মূলত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে গগন হরকরা, গোঁসাই গোপাল, সর্বক্ষেপী বোষ্টমী, গোঁসাই রামলাল এবং লালনের অজস্র শিষ্যর সঙ্গে দেখা হয়। তিনি বাউল-ফকিরদের গান শুনে কেবল নিজেই আপ্লুত হননি, শিলাইদহ ও ছেউড়িয়া অঞ্চল থেকে অনেক বাউল গান সংগ্রহ করে প্রচার করেন। নিজে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সেগুলো প্রচার করার ব্যবস্থা করেন। এর ফলে তথাকথিত সুধী সমাজের মধ্যে বাংলাদেশের বাউল গান সম্পর্কে একটা ধারণা জন্মায়। এমনকী, বলা যেতে পারে, বর্তমানে বাঙালি মধ্যবিত্তর মধ্যে লালন ফকির যে আসনে আছেন, তার প্রাথমিক ভিত্তি তৈরি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।


লালন ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুখোমুখি সাক্ষাৎ নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতভেদ আছে। লালন শাহ ১৮৯১ সাল পর্যন্ত বেঁচেছিলেন। অন্যদিকে, রবীন্দ্রনাথ জমিদারি দেখাশোনা করতে কুষ্টিয়ায় আসা শুরু করেন ১৮৯০ সালের শেষদিকে। সেই হিসেবে তাঁদের দেখা হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। এই নিয়ে নানা মুনির নানা মত। একটা বিষয়ে গবেষকদের মধ্যে কোনও মতান্তর নেই যে, রবীন্দ্র-রচনায় লালনের গানের প্রভাব ব্যাপকভাবে পড়েছিল। 


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালন ফকিরের ২০টি গান প্রকাশ করেছিলেন, যা 'প্রবাসী' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া বক্তৃতায় লালনের ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ গানের ইংরেজি অনুবাদ বিদেশি শ্রোতাদের শুনিয়েছিলেন। বলা হয়ে থাকে, লালনের গান রবীন্দ্রনাথকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল। 


লালনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল কি না, সেই নিয়ে তর্কে না গিয়েও বলা যায়, লালন-অনুসারীদের সঙ্গে দেখা হয়েছে কবির। এই ব্যাপারে কণামাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। কবির এক চিঠিতে পাওয়া যায়, "তুমি তো দেখেছ শিলাইদহতে লালন সাঁই ফকিরের শিষ্যদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমার কীরূপ আলাপ জমত। তারা গরিব। পোশাক-পরিচ্ছদ নাই। দেখলে বোঝার জো নাই তারা কত মহৎ। কিন্তু কত গভীর বিষয় সহজভাবে তারা বলতে পারত।"


বাঙালির যাপিত জীবনের প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ছিল গভীর অনুরাগ। একান্ত চৈতন্যের মধ্যে বাঙালির মননের সন্ধান করেছেন। সেই অনুসন্ধানী দৃষ্টির মধ্যে বেশ বড় পরিসরে ধরা পড়েছে বাউলের জীবন ও সাধনা। বিশেষ করে তিনি নিরীক্ষণ করেছেন তাঁদের যাপিত জীবন। সেই সঙ্গে তাঁকে আকৃষ্ট করেছে বাউলের সাধন সংগীত। বিশেষ করে বাউল গানের জন্যই তিনি বাউলদের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। প্রতিনিয়ত তাঁকে তাড়িত করেছে বাউলের গান। বাউলের গানের সুর তাঁকে মোহিত করেছে। ভাবিত করেছে এই গানের বাণী। তাই তিনি আপ্লুত হয়ে বাউলদের নিয়ে মন্তব্য করেছেন- "বাউলের গান শিলাইদহে খাঁটি বাউলের মুখে শুনেছি ও তাঁদের পুরাতন খাতা দেখেছি। নিঃসংশয়ে জানি বাউলগানে একটা অকৃত্রিম বিশিষ্টতা আছে, যা চিরকেলে আধুনিক।... আমার অনেক গান বাউলের ছাঁচের, কিন্তু জাল করতে চেষ্টাও করিনি, সেগুলো স্পষ্টত রবীন্দ্র-বাউলের রচনা।"


বাউল বাংলার সংস্কৃতির অঙ্গ। ঐতিহাসিকভাবে এবং তত্ত্বগতভাবে বাংলার বাউল সাধনা উপনিষদ, বৌদ্ধ, বৈষ্ণব এবং ভারতীয় মধ্যযুগের সাধনার ধারার সঙ্গে যুক্ত। বাউলের বাণী ও সুর একান্তই বাংলার নিজস্ব সম্পদ। ‘বাউল’ শব্দটি প্রথম উচ্চারিত হয় শ্রীচৈতন্যদেবের মুখে। 'বাতুল’ শব্দ থেকে বাউল শব্দটির উদ্ভব। আবার অনেকের মতে বাউল এসেছে ব্যাকুল শব্দ থেকে। কেউ কেউ বলেন, 'বা' অর্থে আত্ম এবং 'উল' অর্থে সন্ধানী। অর্থাৎ, এই বাউল সাধকরা হলেন আত্মানুসন্ধানী উন্মত্ত সাধক।


প্রখ্যাত বাউল শিরোমণি লালন শাহ, পূর্ব বাংলা আর পশ্চিমবাংলার রাঢ় অঞ্চলের কিছু বাউলের দ্বারা ঋদ্ধ এই বাউলিয়া সংগীতজগৎ। বস্তুত বাঙালি মানসের প্রকাশক্ষেত্রের দু’টি জগৎ– বৈষ্ণব পদাবলি আর বাউল পদাবলি। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত রচিত কবিতায় যার উল্লেখ পাওয়া যায়–

কীর্তনে আর বাউলের গানে
আমরা দিয়েছি খুলি
মনের গোপনে নিভৃত ভুবনে
দ্বার ছিল যতগুলি।


লালনগীতির কোনও লিখিত রূপ লালন সাঁইয়ের স্বহস্তে না থাকার কারণে তাঁর শিষ্যদের কণ্ঠে বা খাতায় মূল ভাবাদর্শের রূপখানি অনেকাংশে বিকৃত হয়ে গেছে বলে অনেকে মনে করেন। লালনের দর্শন প্রচার করে যিনি বিশ্বমানসে প্রতিষ্ঠা করেছেন, তিনি অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ। আর সেই দর্শনে জারিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের কলম। তাই তিনি হয়ে উঠেছেন রবি-বাউল।

More Articles