শুক্তো থেকে বোয়াল মাছ, বেহুলা-লখিন্দরের বিয়ের মেনু জিভে জল আনতে বাধ্য

বেহুলা-লখিন্দরের বিয়ের অনুষ্ঠান চলে আটদিন ধরে। মনসামঙ্গল কাব্যের নয়টি অধ্যায় এই উৎসবে উত্থাপিত হয়। এক লোকশিল্পীর কথায়, মনসার আবির্ভাব, বেহুলা-লখিন্দরের বিবাহ এবং তার করুণ পরিণতি, চাঁদসদাগরের সর্বনাশ, শেষে চাঁদের মনসাকে প...

অমর প্রেমগাথা বা যুগে যুগে চলে আসা ভালবাসার গল্প বলতে একজনের নাম জ্বলজ্বল করে ওঠে, আর তা হলো বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনি‌। সমাজের চিরাচরিত প্রথা ভেঙে মৃত স্বামীকে জীবিত ফিরিয়ে আনতে লখিন্দরের ভেলাতে করেই অজানা উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়েছিল বেহুলা। বিধাতার লিখনকে পাল্টে দিয়ে অদম্য সাহস আর ভক্তির পরিচয়ে ফিরিয়ে এনেছিল তার স্বামীর জীবন। 'মনসামঙ্গল'-এর এই কাহিনি অমর প্রেমের আখ্যান হয়ে রয়ে গেল।

বেহুলা-লখিন্দরের প্রতীকী বিবাহ
তেরো শতক থেকে আঠারো শতকের মাঝে কোনও এক সময় জন্ম হয় বেহুলা-লখিন্দরের। 'মনসামঙ্গল' কাব্যে প্রথম এর উল্লেখ পাওয়া যায়। তাদের ভালবাসার গল্প মানুষের মুখে মুখে ফেরে। এই প্রেমকাহিনি যেন কখনই পুরনো হয় না, শুনতে শুনতে ক্লান্তি আসে না। বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনিও ঠিক তেমনই। বেহুলা-লখিন্দরের বিয়ে ছিল দেখার মতো। জানেন কি আজও বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোট গ্রামে বেহুলা-লখিন্দরের প্রতীকী বিয়ের আসর বসে।

'মনসামঙ্গল' কাব্যে মঙ্গলকোটের প্রাচীন নাম ছিল উজানি নগর। এই উজানি নগরের মেয়ে বেহুলাকে আজও জলপাড়া-গণপুর গ্রামের বাসিন্দারা মনে রেখেছে। তাই তাদের বিয়ে দেওয়ার রীতি আজও চলছে। প্রায় ৩০০ বছর ধরে এই গ্রামে এই বিয়ের আসর বসছে। এখন এই বিয়ের আসরকে তারা লোকসংস্কৃতি বা লোক উৎসবের অঙ্গ বলে মনে করে। এই জলপাড়া গ্রামে দেবী মনসার পুজো নিয়ে এক কাহিনি আছে। ঐতিহাসিক কাহিনি বলে, বহু বছর আগে এই জলপাড়া গ্রামে একটি পুকুর থেকে মনসামূর্তির আদলে একটি পাথরের টুকরো পাওয়া গিয়েছিল। গ্রামেরই এক বাসিন্দা স্বপ্নাদেশ পেয়ে পুকুর থেকে দেবী মূর্তিটি তুলে দেবীর পুজো করা শুরু করেন। আর দেবীকে যেহেতু কার্তিক মাসে পাওয়া গিয়েছিল, তাই তখন থেকেই এই উৎসব শুরু হয়। তবে বেহুলা লখিন্দরের প্রতীকী বিয়ে কবে থেকে চালু হয়েছে, তা নিয়ে স্পষ্টভাবে কেউ কিছু বলতে পারে না।

আরও পড়ুন: চামুন্ডার মূর্তি যেন জীবন্ত, শিহরণ আর ভক্তি মিলেমিশে থাকে এই সতীপীঠে

বেহুলা-লখিন্দরের বিয়ের অনুষ্ঠান চলে আটদিন ধরে। মনসামঙ্গল কাব্যের নয়টি অধ্যায় এই উৎসবে উত্থাপিত হয়। এক লোকশিল্পীর কথায়, মনসার আবির্ভাব, বেহুলা-লখিন্দরের বিবাহ এবং তার করুণ পরিণতি, চাঁদসদাগরের সর্বনাশ, শেষে চাঁদের মনসাকে পুজো করা এবং বেহুলার অষ্টমঙ্গলায় যাওয়া পর্যন্ত পুরো কাহিনি পালাগানের দ্বারা তুলে ধরা হয়। তারপর আটদিনের দিন গ্রামের একজন মহিলা মনসা দেবীর ঘট নিয়ে গ্রামেরই এক মনসার থানে যান। সেখানেই রীতি মেনে একটি পুরনো বটগাছকে লখিন্দর বানিয়ে এবং দেবী মনসাকে বেহুলা মনে করে তাদের প্রতীকী বিবাহ দেওয়া হয়। বটগাছের চারদিকে সাত পাক ঘুরে হলুদ সুতো পরিয়ে দেওয়া হয়। তারপর বটগাছকে সাক্ষী রেখে চলে বিবাহ অনুষ্ঠান এবং সবশেষে মন্দিরে ফিরে এসে মনসা পুজো করা হয়। এইভাবেই প্রায় ৩০০ বছর ধরে বেহুলা-লখিন্দরের প্রতীকী বিবাহ চলে আসছে।

বেহুলার বাসরঘর
বেহুলার কপাল পুড়েছিল এই বাসরঘরে এসেই। বিয়ের পর স্বামীকে নিয়ে বাসরঘরে প্রবেশ করে বেহুলা। তার শ্বশুর চাঁদসদাগর তার কনিষ্ঠ পুত্রকে বাঁচাতে কোনওরকম ত্রুটি রাখেননি। অভেদ্য এক লৌহপ্রাচীর নির্মাণ করিয়েছিলেন তিনি, যার কোনও ছিদ্র থাকবে না। কিন্তু বিশ্বকর্মাকে হুমকি দিয়ে একটি সূক্ষ্ম ছিদ্র রেখে দিয়েছিলেন দেবী মনসা। তারপর রাতে সকলে ঘুমিয়ে পড়লে বেহুলার চুল বেয়ে উঠে দেবী কালনাগিনী লখিন্দরকে দংশন করলে তার মৃত্যু ঘটে। এই কাহিনি আমরা সকলেই জানি। অনেকে এটাও জানি না যে, বগুড়া শহর থেকে ১০ কিমি উত্তরে এবং মহাস্থান গড় থেকে ২ কিমি দক্ষিণে অবস্থিত গোকুল গ্রামে আজও বেহুলার বাসরঘর দেখতে পাওয়া যায়।

অনুমান করা হয়, খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দী থেকে ১২০০ শতাব্দীর মধ্যে এই স্তম্ভটি নির্মাণ করা হয়। আনুমানিক ১৭২টি কক্ষ আছে এখানে। স্তম্ভটির উচ্চতা প্রায় ৪৫ ফুট। বেহুলার বাসরঘর একটি অকল্পনীয় মনুমেন্ট। তবে তা বাসরঘর না কি বৈদ্যমঠ, তা নিয়ে অনেক মতভেদও আছে, কিন্তু জনশ্রুতি আর ইতিহাসে এই স্তম্ভ বেহুলার বাসরঘর বলেই জনপ্রিয়।

বেহুলা-লখিন্দরের বিয়ের মেনু

অনেক তো বিয়ে, বাসরঘর দেখা হলো, এবার আসুন, ভোজটা একটু সেরে নেওয়া যাক। রাজারাজড়াদের বিয়ে বলে কথা, এলাহি আয়োজন হবে না, তা কী হয়। বাঙালি প্রথম থেকেই ভোজনরসিক বলে দুর্নামে জর্জরিত। প্রাচীনকালে বাঙালি নিজের বাড়ির চাল, ডাল, সবজি, দুধ, পুকুরের মাছ এইসব দিয়েই রান্না করে নিত। বাইরে থেকে কিছু আনতে হতো না। বেহুলা-লখিন্দরের বিয়েতে শুধু নিরামিষ পদই নয়, আমিষ পদও ছিল দেখার মতো। দেখে নেওয়া যাক, সেইসব পদ কী কী।

নিরামিষ পদ

বেত আগ তলিত করে বাইঙ্গন বারমাসি।

পাট সাগ তলিত করে উদিসা উর্ব্বসি।।

ঘৃতে ভাজিয়া কথ হেলের্চার সাখ।

জত্নে ভাজিয়া তোলে আর জত লাউয়ের আগ।।

মুগ দিয়া মুগ দাইল আর মুগের বড়ি।

ঘৃতে ভাজিয়া কত তুলিল সিঙ্গাড়ি।।

তিল দিয়া তিলুয়া আর তিলের বড়া।

তিল দিয়া রান্ধিলেক তিল কুমড়া।। 

বেহুলার বিয়ের নিরামিষ রান্নার তালিকা করলে পাওয়া যায়, ঘি কিংবা তেলে ভাজা বেতের কচি আগা, বারোমাসি বেগুনভাজা, তেলে ভাজা পাট শাক, ঘি দিয়ে ভাজা হেলেঞ্চা শাক, কচি লাউ শাকভাজা, মুগ ডাল, ঘিয়ে ভাজা মুগের বড়ি, তিলুয়া, তিলের বড়া, তিল দিয়ে মিষ্টি কুমড়ো, মেটে আলুর তরকারি, (মরিচ) লঙ্কাবাটা দিয়ে চই, পাকা কলার অম্বল বা টক, আদা দিয়ে রান্না করা শুক্তো। প্রায় ১৫ রকমের নিরামিষ রান্নার কথা পাওয়া যায়, যার মধ্যে বেশিরভাগ আমাদের খাদ্যতালিকায় থাকলেও কিছু হারিয়ে গেছে কালের গহ্বরে।

পদ্মপুরাণে বেহুলার বিয়ের রান্নায় শুক্তো পাওয়া যায়। কিন্তু বর্তমানে শুক্তো বলতে যেমন উচ্ছে, করলা, নিম, সিম, বেগুন ইত্যাদিকে বোঝায়, প্রাচীনকালে কিন্তু তেমন ছিল না। তখন শুক্তোকে ‘তিতো’ বলা হতো। সেকালে শুক্তো রান্নার নিয়ম ছিল– বেগুন, কাঁচা কুমড়ো, কাঁচকলা, মোচা দিয়ে গুঁড়ো বা বাটা মশলা বা বেসনের সঙ্গে বেশ ভালো করে মেখে বা নেড়ে নিয়ে ঘন ‘পিঠালি’ মিশিয়ে রান্না করা। পরে হিং, জিরে ও মেথি দিয়ে সাতলিয়ে নামিয়ে ফেলা হত।

আমিষ পদ

ভাজিয়া তুলিল কথ চিথলের কোল।

মাগুর মৎস্য দিয়া রান্ধে মরিচের ঝোল।।

রূহিতের মুণ্ডা দিয়া মাস দাইল করি।

আম দিয়া রান্ধিলেক আম্র কাতল।। 

মাছের যেন বাজার বসিয়েছিল কন্যাপক্ষ। চিতল, মাগুর, কই, মহাশোল, ছোট চিংড়ি, রুই, কাতলা, পোনা মাছ, পাবদা, বোয়াল, খলশে ও ইলিশ। তা দিয়ে যে তরকারি হয়েছিল, তা হলো– চিতলের কোল বা চিতলের পেটিভাজা, লঙ্কা দিয়ে মাগুর মাছের ঝোল, কই মাছভাজা, মহাশোলের অম্বল, ছোট চিংড়ির (ইচা) রসলাস, রুই মাছের মাথা দিয়ে মাসকলাইয়ের ডাল, আম দিয়ে কাতলা মাছ, পাবদা মাছ দিয়ে শুক্তো, আমচুর দিয়ে শোল মাছের পোনা, বোয়াল মাছের ঝাঁটি, খলশের অম্বল আর ইলিশ মাছ ভাজা।

খেয়াল করলে দেখা যাবে, লঙ্কা দিয়ে মাগুর মাছের ঝোল, রুই মাছের মাথা দিয়ে মাসকলাইয়ের ডাল, কই মাছভাজা, ইলিশ মাছভাজার মতো কিছু খাবার আমাদের রসনাকে তৃপ্ত করে চলেছে ৫০০ বছর ধরে।

খাসির মাংস তোলে ঘৃতেতে ছাবিয়া।

হরিণের মাংস কথ অম্বল রান্ধিয়া।।

মেসের মাংস জত সুর্দ্ধ চাইয়া লইল।

জত্ন করিয়া পাছে রান্ধে কবুতর।।

খাসি, হরিণ, ভেড়া, কবুতর আর কচ্ছপ– এই পাঁচটি মাংস রান্না হয়েছিল লখিন্দরের জন্য। এই রান্নাগুলি থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, সেসময় তরকারি রান্না করা হতো তেল ও ঘি দিয়ে।

পিঠা এবং মিষ্টান্ন

আলুবড়া চন্দ্রপুলি অদ্ভুত কাতলা।

ঘৃতে ভাজিয়া তোলে জত মনহরা।।

লাল বড়া চন্দ্রকাতি আর পিঠা রুটী।

দুগ্ধ চাহি পাত পিটা ভরিলেক বাটী।। 

লখিন্দরের জন্য ভাজা হয়েছিল বিভিন্ন পিঠে। তাতে রয়েছে– চন্দ্রপুলি, মনহরা, দুধ ক্ষীরশা, লাল বড়া, চন্দ্রকাতি, রুটি পিঠা, দুধ চুহি ইত্যাদি।

যদি সমস্ত খাবার পরিবেশনের একটা রূপরেখা তুলে ধরা হয় তাহলে দেখা যাবে, লখিন্দরের পাতে প্রথমে দেওয়া হয়েছিল তলিত অর্থাৎ তেলে ভাজা শাক। তারপর শুক্তো, এবং তারও পরে ঝাল খাবার। ঝালমশলা খাবারের মধ্যে আছে বহু ধরনের রান্না করা মাছ এবং মাংসের পদ। এরপর রয়েছে অম্বল, তারপর পিঠেপুলি। আর সবশেষে মুখশুদ্ধির জন্য আছে পান-সুপুরি। এই ছিল বেহুলা-লখিন্দরের বিয়ের মেনু। বলা হয়, কন্যাপক্ষের লোক আগেকার দিনে নিরামিষ পদই নাকি বেশি করে রান্না করতেন, ফলে নিরামিষ পদ টেস্ট করতে গিয়েই লোকের পেট ভরে যেত, যার ফলে মাংস-মাছ বেশি খেতে পারতেন কেউই। এটা নাকি কন্যাপক্ষের এক চালাকি ছিল।

 

More Articles