ধূম জ্বর গায়েই পুজো! বেলুড় মঠের দুর্গাপুজোয় দ্বিতীয়বার রইতে পারেননি খোদ স্বামীজিই
Belur Math Durgapuja: স্বামীজির খুব ইচ্ছে পশুবলি হয়। কিন্তু সারদার প্রবল অমতে সেটি বাদ দিতে হল। এখনও বেলুড় মঠের পুজোতে ফলবলি হয়, কিন্তু পশুবলি নিষিদ্ধ।
বেলুড়মঠ। স্বামীজির বহু পরিশ্রমে তৈরি এই মঠটিতে সংবৎসর দুর্গাপুজো হয়ে আসছে। সেও আজ থেকে না, প্রায় একশো বিশ বছরের ওপর। বাংলার যে সমস্ত দুর্গাপুজো থিমের বাইরেও দীর্ঘ ঐতিহ্য বহন করে, এটা তার মধ্যে অন্যতম। এখনও সেই একই রীতিনীতি মেনে পুজো হয়। পুজো হয় যথেষ্ট জাঁকজমকের সঙ্গে। বেলুড়ের বর্তমান মন্দিরটিতে মিশে গিয়েছে মন্দির, মসজিদ, গির্জার স্থাপত্যরীতি। যদিও মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় ১৯৩৫-এ, তবে মঠটি স্থাপিত হয়েছিল তার অনেকদিন আগেই। বিবেকানন্দের হাত ধরেই এ মঠে দুর্গাপুজোর শুরু। আজ খানিক সেই ইতিহাস আলোচনা করা যাক।
১৮৯৭-এ কলম্বো হয়ে ভারতে ফিরলেন স্বামীজি। লক্ষ্য তখন দু’টি। দু’টি মঠ। আলমোড়ার কাছে হিমালয়ের কোলে মায়াবতী। সেখানে অদ্বৈত আশ্রম গড়ে তুললেন এবং বাংলার বেলুড়ে গড়ে তুললেন একটি মঠ। রামকৃষ্ণ যেমন বাঙালি সংস্কৃতি বুঝতেন পূর্বাপর, স্বামীজি তাঁরই সুযোগ্য শিষ্য। শক্তির আরাধনা, সে যে রূপেই হোক না কেন। কাজেই মঠে দুর্গাপুজো করার একটা ইচ্ছে তাঁর দীর্ঘদিন ছিল। শরীরে নানান রোগ। খুব বেশিদিন বাঁচবেন না বোধহয় অনুভব করছিলেন সে সময়েই। প্রিয় বেলগছতলাটিতে এসে বসতেন মাঝে মাঝে। সামনেই গঙ্গা। সেদিকে তাকিয়ে নাকি গাইতেন—
“বিল্ববৃক্ষমূলে পাতিয়া বোধন
গণেশের কল্যাণে গৌরীর আগমন
ঘরে আনব চণ্ডী, কর্ণে শুনব চণ্ডী
আসবে কত দণ্ডী, জটাজুটধারী।”
আরও পড়ুন-কেন ইনকিলাব ধ্বনি দিচ্ছেন ইরানের মেয়েরা! কীভাবে পাড়ি দিল ভগতের স্লোগান
দিন যায়। কাজের ভিড়ে মনের সাধ আর পূরণ হয় না। এই করতে করতে বছর চারেক কেটে গেল। ১৯০১ সালের মে কী জুন মাস। স্বামীজির পরম প্রিয় গৃহীশিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী এলেন মঠে। আলাপ আলোচনা চলছে। ইতিমধ্যে তাঁকে ডেকে বিবেকানন্দ বললেন, রঘুনন্দনের ‘অষ্টবিংশতি’ বইটি তাঁর চাই। যেভাবেই হোক, জোগাড় করে দিতে হবে। শরচ্চন্দ্রের কৌতূহল হল। “শিক্ষিত লোকে তো ও বই এখন ছোঁয়ই না, নাকি কুসংস্কারের ঝুড়ি! ও বই নিয়ে আপনি কী করবেন?” তখন স্বামীজি জানালেন, “এবার মঠে দুর্গোৎসব করবার ইচ্ছে হচ্ছে। যদি খরচ সংকুলান হয় তো মহামায়ার পুজো করব। তাই দুর্গোৎসব বিধি পড়বার ইচ্ছে হয়েছে। তুই আগামী রবিবার যখন আসবি ওই পুস্তকখানি সংগ্রহ করে নিয়ে আসবি।” তা শরতবাবু যথাসময়ে বইটি এনে দিলেন। চার পাঁচ দিনের মধ্যেই পড়া শেষ। শরতকে বলেছিলেন, “রঘুনন্দনের স্মৃতি বইখানি সব পড়ে ফেলেছি, যদি পারি তো এবার মার পূজা করব।”
এরপরে আর কোনও কথা হয়নি এ নিয়ে। দীর্ঘদিন গেল। পুজোর সময় প্রায় আসন্ন। হপ্তাখানেক আগে পর্যন্ত মঠে কোনও সাড়াশব্দ নেই, প্রস্তুতি নেই। পুজোর যখন আর চার-পাঁচদিন বাকি, স্বামীজি কলকাতা থেকে নৌকায় বেলুড়ে ফিরেই হঠাৎ “রাজা কোথায়? রাজা কোথায়?” বলে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। স্বামী ব্রহ্মানন্দ মঠেই ছিলেন। তাঁকে দেখতে পেয়েই বললেন, “এবার মঠে প্রতিমা এনে দুর্গাপুজো করতে হবে। তুমি সব আয়োজন করে ফেল।” ব্রহ্মানন্দের মাথায় হাত। মাত্র চার পাঁচটা দিন। ওই বিপুল আয়োজনের সময় বা সুযোগ— কোনওটাই তো দেখতে পাচ্ছেন না। এখন প্রতিমাই বা কোথায় পাওয়া যাবে, আর অনুষ্ঠানের আয়োজনই বা কীভাবে হবে!
শুরুর বিহ্বল ভাব কাটতে ব্রহ্মানন্দ স্বামীজির কাছে দুটো দিন সময় চাইলেন। তাতে আপত্তি নেই স্বামীজির। বললেন, “আমি ভাব-চক্ষে দেখেছি এবার মঠে দুর্গোৎসব হচ্ছে, প্রতিমায় মার পূজা হচ্ছে।” এ কথা শুনে ব্রহ্মানন্দ চমকে উঠলেন। সে কী! তিনিও যে সেদিন… দিন চারেক আগেই সেই বেলতলায় বসেছিলেন ব্রহ্মানন্দ। হঠাৎ দক্ষিণেশ্বরের দিকে থেকে একটি মেয়েকে আসতে দেখলেন। গঙ্গা পেরিয়ে ঠিক বেলতলায় এসে নারীমূর্তি মিলিয়ে গেল। তবে কি…? এইসব কথা শুনে মঠের সন্ন্যাসীরা নড়েচড়ে বসলেন। ব্রহ্মানন্দ নিজের দায়িত্বে ব্রহ্মচারী কৃষ্ণলালকে পাঠালেন প্রতিমার খোঁজে। যদিও আশা নেই। কিন্তু প্রতিমা ঠিকই মিলল। একটি অসামান্য প্রতিমা সেবার বাড়তি পড়েছিল। যাঁর বায়নায় গড়া, সে ভদ্রলোক আর খোঁজখবর নেননি। কাজেই সে প্রতিমাটিই আর একটা দিন দেখে, বায়না করে নিয়ে এলেন কৃষ্ণলাল।
সেবার দুর্গাপুজোর তিথি কার্তিক মাসে। অক্টোবর মাসে পুজো। কিন্তু কৌপিনধারী সন্ন্যাসীদের পুজো বা ক্রিয়া সংকল্প করার বিধান নেই। মা সারদাকে বেলুড়ে আনলেন স্বামীজি। মা উঠলেন নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে। সংকল্প হল তাঁর নামেই। স্বামীজির খুব ইচ্ছে পশুবলি হয়। কিন্তু সারদার প্রবল অমতে সেটি বাদ দিতে হল। এখনও বেলুড় মঠের পুজোতে ফলবলি হয়, কিন্তু পশুবলি নিষিদ্ধ। এদিকে মঠের উত্তরের জমিতে বিরাট মণ্ডপ বাঁধা হয়েছিল। ষষ্ঠীর বিকেলে নৌকায় করে প্রতিমা আসল। কিন্তু এর খানিকবাদেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। সঙ্গে তুমুল ঝড়। কিন্তু পুজো সেবার হবেই। এত ঝড়বৃষ্টিতেও একফোঁটা ক্ষতি হল না প্রতিমার বা মণ্ডপের। সমস্ত বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে পুজো শুরু হল। পুরোহিত হলেন ব্রহ্মচারী কৃষ্ণলাল। আর তন্ত্রধারক হলেন মঠেরই সন্ন্যাসী স্বামী কৃষ্ণানন্দের পিতা ঈশ্বরচন্দ্র ভট্টাচার্য। মা দুর্গাকে চিনির নৈবেদ্য দেওয়া হল, দেওয়া হল প্রচুর মিষ্টিভোগ। সেবার কাঙাল ভোজন চলেছিল দিন তিনেক।
আরও পড়ুন- বাগবাজারের পুজোয় ৫০০ টাকা চাঁদা দেন নেতাজি, লাঠিখেলার যে ইতিহাস অনেকেরই অজানা
মহাঅষ্টমীর আগের দিন থেকেই ফের প্রবল জ্বর স্বামীজির। মণ্ডপে যেতে পারছেন না। অবশেষে সন্ধিপুজোর সময়ে জ্বর গায়েই এলেন মণ্ডপে। রামলালদাদার কন্যাকে বেছে নিয়েছিলেন কুমারী পূজার জন্য। তাও হল। অসুস্থ শরীরেই পুজো করলেন বিবেকানন্দ। সে পুজোর পর ১০৮টি পদ্ম মা সারদার পায়ে দিয়ে জীবন্ত প্রতিমার পুজো হল। নবমীর দিন শরীর একটু ভালো। এক সময় রামকৃষ্ণ নবমীর দিন যে সব গান গাইতেন, স্বামীজিও সেই সব গানের দু’ একটি গাইতে লাগলেন। নবমীর পুজো শেষ হল। মা সারদা সেদিন যজ্ঞ করলেন। মা সারদার হাত দিয়ে তন্ত্রসাধক ঈশ্বরচন্দ্রকে পঁচিশ টাকা দক্ষিণা দেওয়ালেন স্বামীজি।
নবমী ফুরলো। দশমীর দিন লোকে লোকারণ্য। স্বামীজির শরীর আবার বেশ খারাপ। নিচে নামতেই পারলেন না। সমস্ত নিয়ম মেনে সন্ধেবেলায় সবার সাহায্যে গঙ্গায় দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জন হল। সেই শুরু। সেই থেকে আজ অবধি সে নিয়মের ব্যত্যয় হয়নি। স্বামীজির নিজের হাতে শুরু করা বেলুড়ের দুর্গাপুজো একই রীতি মেনে চলে আসছে আজও। বরং ১২১ বছরের ইতিহাস তাকে বাংলায়, বাঙালির বুকে এ অনন্য জায়গা করে দিয়েছে।