সম্প্রীতির ভিতের উপর গড়ে উঠেছে বাংলার লোকসংস্কৃতি
সাক্ষর সেনগুপ্ত: বাংলার বিচিত্র সাংস্কৃতিক উপাদান জনজীবনের আঞ্চলিকতায় বিশিষ্টতা পেয়েছে। রূপবৈচিত্রের প্রবহমান ধারা আঞ্চলিক জীবন ও সংস্কৃতিকে বৈভবশালীও করেছে। যেমন, আঠারো ভাটির দেশ-পরিচয়ে সুন্দরবনের দুর্গমতা ও দারিদ্রমেশা জনজীবনের সাংস্কৃতিক অন্বেষণ নানা প্রসঙ্গেই আগ্রহের বিষয়। আবার রাঢবঙ্গ বা উত্তরের নানা ধরনের, বর্ণের, বৈচিত্রের এক দীর্ঘ সাংস্কৃতিক পরম্পরা পল্লী বাংলার ভিটেমাটির অঙ্গনে গড়ে উঠেছে, মনে করেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লোকসংস্কৃতি গবেষক আবুল আহসান চৌধুরী। আসলে এই লোকসংস্কৃতি বা লোকাচারের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে গ্রাম সমাজের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আবহ।
কেমন তার সামাজিক প্রতিফলন ? উদাহরণ দিয়ে বোঝালেন সমাজতত্ত্ববিদ ডঃ অদিতি বসু। গ্রামে হিন্দুদের দুর্গাপূজায় সাহায্য করেন মুসলমানরা। হিন্দুর শবদেহ কাঁধে করে শ্মশানে পৌঁছে দেন। মুসলমানদের উৎসবে যোগ দেন হিন্দুরা, পির-পিরানি, গাজি-বিবির দরগায় মানত করেন। উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়ায় ১২ ফাল্গুন গোরাচাঁদ পিরের উৎসবে বাড়গোপপুরের কালু ঘোষের পরিবার হাজত দেন। ঘুটিয়ারি শরিফে গাজি পিরের দরগায় বারুইপুরের রায়চৌধুরী বাড়ির মেয়েরা প্রথম সিন্নি চড়ান, মোমবাতি জ্বালেন। শাকশহরের বামুন পিরের দরগা থেকে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে তেল পড়া নেন চর্মরোগ, কাটা-পোড়ার ওষুধ হিসেবে। লক্ষ্মীকান্তপুর থেকে কুলপির দিকে দয়ারামের কাছাকাছি আছেন বামুন গাজি। সেপাই চেহারার অশ্বারোহী, মুখে দাড়িগোঁফ, হাতে লাগাম, পায়ে মোজা। শনি-মঙ্গলবারে তুমুল ভিড়। হিন্দু রাঢ়ী ব্রাহ্মণ ও মুসলমান দেয়াশি উভয়েই পুজো করেন। বাতাসা ভোগ, মুরগি উৎসর্গের প্রথা আছে। সুন্দরবনে জল-জঙ্গলজীবী হিন্দুদের যিনি বনচণ্ডী বা বনদেবী, তিনিই মুসলমানদের বনবিবি। নরেন্দ্রপুরের কাছে আছেন শিশুদের রক্ত-আমাশার দেবতা— মুসলমানের রক্তাখাঁ, হিন্দুর রতনগাজি। হিন্দুর সত্যনারায়ণ আর মুসলমানের সত্যপির যেন একেরই দুই রূপ।
দেবদেবীর এই বিমিশ্রণ গ্রামজীবনে সম্প্রীতির ভিত তৈরি করেছে। কোন হিন্দু দেবতা কোন পির-গাজিতে রূপান্তরিত, তা আছে ধর্ম ঠাকুরের গাজনে অনুষ্ঠানে ‘ঘর ভাঙার ছড়া’য়: “ধর্ম হৈলা যবনরূপী শিরে পরে কালটুপি, হাতে ধরে ত্রিকচকামান/ ব্রহ্মা হৈলা মহম্মদ বিষ্ণু হৈল পেগম্বর মহৈশ হৈল বাবা আদম।/ গণেশ হৈল কাজী কার্তিক হৈল গাজী ফকির হৈল মুণিগণ।।/ তেজিয়া আপন ভেক নারদ হৈল শেখ পুরন্দর হৈল মৌলানা।/ চন্দ্রসূর্য আদি যত পদাতিক হৈয়া শত উচ্চৈঃস্বরে বাজায় বাজনা।”
ইতিহাসের অধ্যাপক ডঃ অর্পিতা সেনগুপ্তের বক্তব্য, মধযুগে ব্রাহ্মণ্যধর্মের অত্যাচারে ধর্মত্যাগ করে মুসলমান হন নিম্নবর্মের হিন্দুরা। আবার নিম্নবর্গের মুসলমান বা ‘আতরফ’ থেকে যান; জোলা, মুদ্দাফরাস, তাঁতি, নিকিরি প্রভৃতি নানা পেশায়। সৈয়দ-শেখ-পাঠান প্রভৃতি উচ্চশ্রেণির মুসলমানরা আশরাফ’ভুক্ত হননি। মহম্মদ মনসুরউদ্দিনের হারামণি দ্বিতীয় খণ্ডের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ লেখেন: “এদেশে অধিকাংশ মুসলমানই বংশগত জাতিতে হিন্দু, ধর্মগত জাতিতে মুসলমান।” বঙ্গের ইসলাম আরবের শরিয়তি ইসলাম নয়, হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন আচার-সংস্কারে মিলেমিশে তৈরি লৌকিক ইসলাম। নিম্নবর্গের মানুষ কালক্রমে বহু পেশা গ্রহণ করেছেন। দর্জি বা পোশাকশিল্পীরা সাধারণত মুসলমান, হিন্দুও তা গ্রহণ করেছে। মাছের ব্যবসা মুসলমান নিকিরিরা করেন, বাগদি, তিয়র, জেলে-কৈবর্তরাও আছেন ওই পেশায়। ক্ষৌরকর্ম হিন্দু বৃত্তি হলেও, মুসলমানরাও সে কাজ করছেন। মুর্শিদাবাদের মুসলমান রাজমিস্ত্রিদের কদর আছে। লোকশিল্পে সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ শিল্পচেতনার ভূরি ভূরি প্রকাশ— নকশা, লোকচিত্র, নৃত্য-গীত, ধাতুশিল্পে। বাংলাদেশের লোকপণ্ডিত আবদুল হাফিজ লেখেন, “হিন্দু বাঙালি তার লক্ষ্মীর পা, ঝাঁপি কিংবা সরায় যে বক্তব্য রাখেন, বাঙালি মুসলমান জায়নামাজ ও মহরমের বিচিত্র মোটিফ-সম্পন্ন পিঠেতেও সেই একই বক্তব্য রাখেন।”
লোকসংস্কার ও লোকবিশ্বাসের সঙ্গে সুদূর অতীতের টোটেম, ট্যাবু ও জাদু-বিদ্যার সম্পর্ক অতি নিবিড়। জানাচ্ছেন নৃতত্ত্ববিদ্যার অধ্যাপক শান্তনু রায়। তাঁর মতে, সঙ্কট-শঙ্কা-অমঙ্গল দূরীকরণের পন্থা-পদ্ধতির সঙ্গে লোকবিশ্বাস ও সংস্কারের গভীর যোগ। ব্রত-মানত-বশীকরণ-জাদু-মন্ত্র-ঝাড়ফুঁক-টোটকা-তাবিজ ইত্যাদির মাধ্যমে ইচ্ছাপূরণ ও মুশকিল আসানের চেষ্টা চলে। এই ক্ষেত্রে যে আচার-পদ্ধতি তা অনেকাংশেই কোনও ধর্মীয় শাস্ত্রাচার অনুসরণ করে না। লোকবিশ্বাস ও সংস্কারে ধর্মের শাসন-গণ্ডি হামেশাই অতিক্রান্ত হয়ে যায়। গার্সি বা ওলাবিবি-ভিটেকুমোরের পূজা, পীর-দরবেশের দরগায় মানত— এ-সব ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমানের ভেদাভেদ লুপ্ত। মুসলমান কৃষকের মনসা-তুষ্টির পূজা কিংবা হিন্দু মাঝির ‘বদর বদর’ বলে যাত্রা শুরু এ-সব লোকসংস্কারের অন্তর্গত, যা প্রজন্ম পরম্পরায় প্রচলিত। বৃষ্টিকামনায় যেমন কোনও পল্লীবাসী কৃষিনির্ভর হিন্দু ‘আল্লাহ মেঘ দে পানি দে ছায়া দে-রে তুই’ এই গান গাইতে অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না, তেমনই হিন্দু দেব-দেবীর নাম নিয়ে সাপের মন্ত্র-উচ্চারণে মুসলমান ওঝারও কোনও দ্বিধা থাকে না। আসর-বন্দনায় ভক্তি-নিবেদনে আল্লাহ-ভগবান রসুল-দেবতা সম-পাঙক্তেয়, একই নিঃশ্বাসে উচ্চারিত।
বাংলার লোকাচারেও সম্প্রদায়-নির্বিশেষে অভিন্নতার সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। জন্ম, বিবাহ, মৃত্যু, কৃষিকর্ম এইসব নানা বিষয়ে প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত লোকাচার বাঙালির জনজীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। বন্ধ্যা নারীর সন্তান-কামনা, গর্ভবতী রমণীর ‘সাধভক্ষণ’, সন্তান জন্মের পর অনিষ্ট-ভঞ্জন সর্তকতা ও বিবাহের কিছু আচার লোকসমাজে অভিন্ন। কৃষি-সম্পর্কিত লোকাচারেও গভীর সাদৃশ্য আছে। বৃষ্টি-কামনা, বীজ-বপন, ফসল-রক্ষা, ফসল-তোলা ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে লোকাচার পালিত হয় তাতে কৃষিজীবী সমাজের ঐক্য-একাত্মতার আন্তরিক চিত্র ফুটে ওঠে। জানাচ্ছেন শান্তনু রায়।
আবুল আহসান চৌধুরী আবার অন্য একটি বৈশিষ্ট্যের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তাঁর বিশ্লেষণ,। বাঙালিসমাজ এক ঐতিহ্যপূর্ণ সমৃদ্ধ লোকসাহিত্যের গর্বিত উত্তরাধিকারী। ছড়া-ধাঁধা-প্রবাদ-মন্ত্র-কিংবদন্তি-লোকশ্রুতি-লোককথা-লোককাহিনি-গীতিকা ও গীতির এক বিপুল ঐশ্বর্য ভাণ্ডার নিয়ে গড়ে উঠেছে বাংলার লোকসাহিত্য। লোকসংস্কৃতির মূল কাঠামোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ এই লোকসাহিত্য। বাঙালি-মানসের, তার শিল্প-চিত্তের গভীর পরিচয় এখানে ফুটে উঠেছে। লোক সাহিত্যের অন্তর্গত শিল্প-নিদর্শনের মধ্যে লোক-সাধনাশ্রয়ী সম্প্রদায়-গীতি ব্যতিরেকে আর সবই সমাজে সমষ্টিগত সৃষ্টি, যা কালান্তরে প্রসারিত। প্রজন্ম পরম্পরায় লালিত এইসব রচনায় সমাজ-অভিজ্ঞতার স্মৃতি জড়িয়ে আছে, কখনও কখনও ইতিহাসের টুকরো ছবিও দুর্লভ নয়। অজ্ঞাতনামা লোককবিদের রচিত গানে পলাশী-যুদ্ধের স্মৃতি, নীল-বিদ্রোহের কথা, নানা গণ-আন্দোলনের চিত্র অম্লান হয়ে আছে। টিপু পাগলার বিদ্রোহ, তিতুমীরের সংগ্রাম, ক্ষুদিরামের আত্ম-বলিদান স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের প্রেরণায় লোককবির কাছে ধরা দেয়। বাঙ্ময় হয়ে ওঠে এক অনাবিল বৈশিষ্ট্যে, আদিগন্ত চরাচর থেকে ভুবনডাঙার মাঠে।
তথ্যসূত্র - লোকসংস্কৃতির বিষয়আশয় - আবুল আহসান চৌধুরী, বাঙালির ইতিহাস - আদিপর্ব, নীহাররঞ্জন রায়, বাংলার লোকসংস্কৃতির সমাজতত্ত্ব - বিনয় ঘোষ
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য প্রতিবেদকের নেওয়া