বাঙালির জীবনের সারসত্য বোঝেননি পরেশ রাওয়াল, বুঝেছিলেন কালিদাস
Bengali Fish Culture: পরেশ রাওয়াল ও তাঁর সহযোগীরা জানেন না প্রত্যেক জাতেরই একটি আত্মপরিচয় থাকে। মহাকবি কালিদাস জানতেন।
আমি আদার ব্যাপারী, জাহাজে করে ফ্রান্সে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। সুতরাং ফরাসি সুন্দরীর ঠোঁট থেকে দ্রাক্ষারসের পেয়ালা সরিয়ে নিলে কী পরিণাম হবে তা অনুমান করতে পারি না কিন্তু বাঙালির হাত থেকে মাছের টুকরো সরিয়ে নিলে? জয় জগদীশ হরে!
পরেশ রাওয়াল হয়তো অভিনেতা আর সেই জন্যই তাঁর মনে রাখা উচিত তাঁতিরা তাঁত বুনেই খায়, সামাজিক এঁড়ে গরু কিনে তাঁদের বিশেষ লাভ হয় না। তবু রাজনীতি এক বিষম বস্তু। নির্বুদ্ধিতা তার ছায়া সহচরী। পরেশ তাই দেবদূতেরা যেখানে যেতে ভয় পায় সেখানে অক্লেশে একটি মন্তব্য করে বসলেন। হায়, তিনি তো জানেনই না বাঙালিরা শাক দিয়েই মাছ ঢাকে।
হাজার বছর আগেও চর্যাপদের হরিণীর মতো বউ লাল শাক আর মৌরলা মাছ দিয়ে ভাত বেড়ে দিলে বাঙালি চাষি অমরতাকে তাচ্ছিল্য করত। এই সেদিনও তো শরৎচন্দ্র তাঁর ছোট্ট লেখা রামের সুমতিতে জানিয়ে দিয়েছেন, রুই মাছের মুড়োর প্রতি বিধবার মনোভাব অনুমান করে লাভ নেই। তবু, পরেশ বাবু মাছ নিয়ে চঞ্চল হয়ে উঠলেন। তিনি জানেন না, মৎসপ্রেমিক হলে তিনি হয়তো আকিরা কুরোশওয়ার অবিস্মরণীয় নায়ক তোশিরো মিফুনের মতো চরিত্র হতেন, মাছ না পেলে যার শুটিং শিডিউল পালটে যায়।
আরও পড়ুন- ‘ইন্ডিয়ায় সহজে মাছ মেলে না’, তাই ওপার থেকে এল হাঁড়িভর্তি সরষে-ইলিশ
প্রসঙ্গত বলি, জীবনানন্দ দাস নাটোরের বনলতা সেন ভাবার জন্য কোন নারীর শরণাপন্ন হয়েছিলেন তা জানি না কিন্তু তিনি যে ক্ষিপ্র বেগে বাড়ির সন্নিকটস্থ লেক মার্কেটে বজুইরা ট্যাংরার খোঁজ করতেন সেই বিষয়ে বিস্তর সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে। বাঙালি কবিতা লিখলেও নিরামিষ হতে পারে না। ঘটি ও কলকাত্তাই ঈশ্বর গুপ্ত ‘গালভরা গোঁফদাড়ি তপস্বীর প্রায়’ তোপসে মাছের ভজনা করেছেন। উলটোদিকে ঢাকাইয়া বাঙাল বুদ্ধদেব বসু ‘জলের উজ্জ্বল শস্য’ বলতে ইলিশ মাছকেই বুঝিয়েছেন। এমনকী জাত নিরিমিষ হেঁশেলে বাঙালি বিধবা যে ধোঁকা নামের পদ ব্যবহার করে তা তো পরেশ রাওয়াল নামক পুরুষদের ভুল খিড়কির দরজা দেখিয়ে দেওয়ার জন্যই।
এভাবেই একবার জুনাগড় ফোর্টের সামনে অনতিতরুণ এক বিহ্বল দম্পতিকে দেখি। বলা নিষ্প্রয়োজন যে আমাকে বাঙালি বুঝতে পেরেই তাঁরা জিওল মাছের খোঁজ করেন। রাজস্থানের মরু শহরে জিওল মাছ জটায়ু ও ফরাসি স্যুরসিয়ালিস্টদের পক্ষেও হজম করা অকল্পনীয়; তবু কাতর কণ্ঠে মৃগনয়না জননীর নিবেদন ছিল তাঁদের শিশুকন্যার পেটটা মোটেই সুবিধার নয়। অতএব, ক্রমাগত শাকাহারের বদলে যদি একটি শিঙি মাছের ঝোল… ইত্যাদি। ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র থেকে বিয়ে প্রত্যাশী কেরানি সকলেই এন্টারোকুইনালবৎ থানকুনি পাতা ও শিঙি মাছের ঝোলকে ভবজলধিরত্ন ভেবেছেন।
ইংরেজরাও ফিশ অ্যান্ড চিপসকে খুচরো পয়সা ভাবে কিন্তু বাঙালির ভাবাটাই অন্যরকম। চিতল মাছের মুইঠ্যা খাওয়ার জন্য বিধাতা আলাদা রকমের জিভ দিয়ে বঙ্গ সন্তানকে ধরিত্রীতে প্রেরণ করেন এবং তাঁরা দৈবাৎ কবি হলে, এমনকী তাঁদের নাম জীবনানন্দ দাশ হলেও, তাঁরা ‘বাটামাছ ভাজে যেই তেলে’ তা কেনার জন্য চেতলা থেকে টালা পর্যন্ত অবিরাম পায়চারি করে যান। সুতরাং মৎস এক বিষম বস্তু।
আরও পড়ুন- সাড়ে সাত লক্ষ বছর আগেও মাছ রাঁধত মানুষ? যে ইতিহাস চমকে দিয়েছে গোটা বিশ্বকে
সমস্যা হচ্ছে এই যে, পরেশ রাওয়াল ও তাঁর সহযোগীরা জানেন না প্রত্যেক জাতেরই একটি আত্মপরিচয় থাকে। মহাকবি কালিদাস জানতেন। সেই জন্যই, শকুন্তলার অভিজ্ঞান অঙ্গুরীয় মাছের পেট থেকেই আবিষ্কৃত হয়। বাঙালির মাছের এই কোল আর গাদা কত না আদর করে মুখে দিয়েছে। তাঁদেরও তো শকুন্তলা ভাত বেড়ে দেয়। সেই ভাতে যদি একটু কালো জিরে দেওয়া ইলিশ মাছের ঝোল না থাকে তাহলে তো সমগ্র অপরাহ্ন পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজদৌল্লার মতো অসাড় বলে বোধ হয়। ওয়াজেদ আলি শাহ গলৌটি কাবাব খেতেন, নরম তুলতুলে। বাঙালি অল্প জলের পুঁটি মাছ, তাঁরা সংসদের রাঘববোয়ালদের অনায়াসে ফাঁকি দিয়ে কখনও বাগবাজারে কখনও গোয়ালন্দ ঘাটে ভেসে ওঠে। তাঁদের ভগবানও মৎসশরীরি। যাঁরা এই কথা বোঝেন না তাঁদের বাঙালি আর কী বোঝাতে পারে। অতীশ দীপঙ্করের দেশেই তো সবচেয়ে বেশি ইলিশ ভজনা হয়। বাঙালির মুড়ো-ল্যাজা সবই আমিষ গন্ধের। গান্ধীজি যখন বরিশালে জনসভা করতে গেছিলেন প্রায় শ’খানেক বছর আগে, তখন বাপুজিকে অন্ধকারে রেখে দেশসেবকরা অনেকেই বরিশালের বিখ্যাত কই মাছ খেয়েছিলেন তা তো আর গোপন কথা কিছু নয়। এমনকী, শাড়ির পাড়ের মতো এই আখ্যানের অন্তে বলি, ঔপন্যাসিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে যে আমাদের বাসায় আসতেন তার প্রধান কারণ বরিশালের বাঙাল আমরা মা লক্ষ্মীকেও ফুলকপি দিয়ে কই মাছ রান্না করে দিই। বাঙালির লক্ষ্মীলাভ আমিষেই। নিরামিষ রান্না খেতে গেলে বাঙালি নববধূ বেহুলা এমনকী ইন্দ্রের সভাতেও শান্তি পাবে না। নেহাত বাধ্য হয়ে বাঙালি বিজয়ে দশমীর দিন শেষবার ইলিশ মাছ খায়, বছরে আর সেই অপরাধ ভুলতে সরস্বতী পুজোর দিনই নধর জোড়া ইলিশ বাড়িতে নিয়ে আসে। বাঙালির বিদ্যালাভ-লক্ষ্মীলাভ সবই মৎসচর্চায়।
কথায় বলে- "সব পক্ষীই মৎসভক্ষী, মাছরাঙা কলঙ্কিনী"। শেষ পর্যন্ত বাঙালি গায়ে না হয় আঁশটে গন্ধ লেগেই রইল। তবুও আমাদের রান্নাঘর থেকে আওয়াজ উঠবেই, কলঙ্কী বলিয়া ডাকে সব লোক, তাহাতে নাহিকো দুখ। আর হাতিবাগানে বা ক্যানিংয়ে চিতল মাছ অথবা কুচো চিংড়ি দেখে আমরা জাতিগুষ্টিশুদ্ধ বলে যাবই, তোমারই লাগিয়া কলঙ্কের হার গলায় পরিতে সুখ।
কী আশ্চর্য, পরেশ রাওয়াল জীবনের এই সরল সত্যটুকু বুঝলেন না। রামের আর সুমতি হল না।