শব্দকল্পদ্রুম আর আ মরি বাংলা ভাষা

শব্দ ছুঁড়ে জব্দ করছে কেউ। কেউ আবার শব্দের সঙ্গে শব্দের সম্প্রদান করে ভালোবাসার কথা লিখছে আনমনে। বহু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, রণ-রক্ত-সফলতার চলাচল একসময়ে এসে থেমেছে শব্দের দুয়ারে। কে কী শব্দ বলবে, কে কোন শব্দ কখনও বলবে না, কে কোন শব্দকে আপন করে নেবে সহজেই, কে কোন শব্দকে অভিমানভরে দূরে ঠেলে দেবে তা বোঝা এক কঠিন খেলা। শব্দ নিয়ে কে আর ভাবছে এত! তবে ভাবতে হয়, যখন শব্দের দেশভাগ করে কেউ। যখন শতাব্দীপ্রাচীন মায়াবী শব্দের ব্যবহারের মধ্যেও ক্লেদ খুঁজে শব্দের ধর্মাধর্ম বিচারে নেমে পড়েন শব্দ-মৌলবাদীরা। তখন প্রশ্ন জাগে শব্দ কোথা থেকে আসে, কোন শব্দের ব্যপ্তি কতদূর। এ এক অবিরাম চলাচল,ঘুরে মরা, পথ তবু ফুরোয় না। তবু এটুকু বুঝি, ম্যাপ ধরে খুঁজলে তো বটেই, এমনকি শব্দের ব্যবহারের ধারা খুঁজলেও বোঝা যাবে, ভারতবর্ষ দেশ হিসেবে কেমন। একটেরে নয়, বহুত্ববাদের আখড়া এই দেশ। পরকে আপন করে নিজেকে সম্প্রসারিত করে চলাই ভারতের ধর্ম, এ কথা অনেকে ভুলতে বসেছে। কিন্তু শব্দের চলাচল যেন সে কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে। কীভাবে? সে গল্পই বলি।

 

ভারতবর্ষের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। জওহর শব্দটি কিন্তু সে অর্থে ভারতীয়ই নয়।  এটি একটি আরবি শব্দ। সৌদি আরবের রাজা ফাহাদের স্ত্রী ছিলেন জওহিরা। ভারতে আরবিদের গমনাগমন ভারতীয় সংস্কৃতিতে এই শব্দটি ঢুকিয়ে দিয়েছে।  আবার তাঁর নাম নিতেই মনে পড়ল, ভিডিওতে দেখেছি, জওহরলাল ১৯৬২ সালে চিন যুদ্ধের পর কেঁদে ফেলেছিলেন 'অ্যায় মেরে ওয়াতন কে লোগো' গানটি শুনে। এই 'ওয়াতন' শব্দটিই আরবি। আমরা কি তখন জিভ কেটেছি?  আসলে, শব্দ যে পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবহার করা হচ্ছে, সেখানে উক্ত অভিব্য়ক্তিটিকে তা স্পষ্টভাবে ধরতে পারছে কি না, সেটাই বিচার্য হওয়া উচিত বলে মনে হয়।

 

ধরা যাক হিন্দির কথা, যাকে ভুল করে 'জাতীয় ভাষা' বলে ফেলেন অনেকে।  গবেষকরা বলেন, হিন্দি শব্দের  ২৫ ভাগই হল আরবি। ওয়াক্ত, কলম, করিব, আমির, গরিব, দুনিয়া, কিল্লা, আখবারা, কুর্সি, শরবত, জরুরি, কবুল- এমন কত কী! বহু প্রশাসনিক শব্দ এসেছে আরবি থেকে। যেমন জিল্লা, তহশিল, পরগনা। পেগাসাস নিয়ে তোলপাড় হোক অথবা অন্য কোনও কম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, আদালত চত্বরে পা দিলেই আপনার কানে আসবে কিছু শব্দ। আপনাকে ডেকে নেবে মুহুরি। আপনাকে কথায় কথায় হলফনামা জমা দিতে বলা হবে। এইসব শব্দও এসেছে দেশকালের বেড়া ভেঙে। ওকালত, ফরিয়াদ, মহাসির, হারজি- কোর্টরুমে আকছার ব্যবহৃত হওয়া এইসব শব্দ মূলগত ভাবে আরবিই। আমরা কি এইসব শব্দকে আলাদা করে দেশভেদ করে চিনি, নাকি জীবনের বহমানতায় তা সম্পৃক্ত হয়েছে? দেশের মূল স্পিরিটটা বুঝতে হলে এই লক্ষণটা বোঝা জরুরি নয় কি?

 

এমনকী ভারতের কৃষিপণ্যকে যে ফলনের সময় অনুযায়ী দুই ভাগে ভাগ করা হয়, সেই খারিফ  ও রবি, এই শব্দ দুটিও তো আরবি থেকেই নেওয়া। কেউ কেউ বলেন, কেরল রাজ্যটিকে আরবি শব্দবিদরা 'খইর আল্লা'-এভাবে ভাঙেন। এর অর্থ' ইশ্বরের নিজস্ব তালুক'। উত্তর ভারতে ৫০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ প্রাকৃত ভেঙে অপভ্রংশ ভাষা তৈরি হয়। ১১০০ খ্রিস্টাব্দের আগে পরে ভারতে সুলতানি শাসনের ফলে ক্রমেই ফারসি ও আরবি মিশতে থাকে স্থানীয় অপভ্রংশের সঙ্গে। এই শব্দের মিশ্রণ আরও বাড়ে মুঘল আমলে। যেহেতু আকবর থেকে ঔরঙ্গজেব দক্ষিণ ভারতেও সাম্রাজ্যকে নিয়ে গিয়েছিলেন তাই শব্দ সংস্কৃতিও ছড়িয়েছে সেভাবেই।  ১৮০০ শতকে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন সূচিত হলে অপভ্রংশের উত্তরসূরী হিসেবে তৈরি হতে থাকে খরিবোলি। পূর্ব ভারতের তথাকথিত হিন্দু উচ্চশ্রেণি এই খরিবোলি ব্য়বহার করত। এরই সমান্তরালে গড়ে ওঠে উর্দু। এক নতুন কাজের ভাষা।

 

একই রকম ভাবে ফারসির কাছেও ঋণী হিন্দি ভাষা। হামেশা, হরদম, সফেদ, দূর, পাস, শায়দ, খারাব, রদ্দি, খুশ, হুশয়ার, জাওয়ান, তন্দরুস্ত, গরম, বিমার, আসান, গন্দা, ইমান্দার এমন চালু শব্দগুলি আদতে ফারসি। সিঙারাকে যেমন হিন্দিতে বলে 'সামোসা'। এই শব্দটিও ফারসি। আমিক খসরু. ইবন বতুতার লেখায় এই খাবারটির কথা আছে। আছে মেলাখেলার সঞ্চয় জিলিপির কথাও। শুধু হিন্দিই নয়, ভারতের বহু আঞ্চলিক ভাষাতেও আরবি ফারসির প্রবল প্রভাব লক্ষ করার মতো। গুজরাটির ক্ষেত্রে বলা হয়, মুলত তিন ধরনের গুজরাটির ব্য়বহার ছিল স্বাধীনতা পূর্ববর্তী গুজরাটে।  হিন্দি গুজরাটি, পারসি গুজরাটি এবং মহমেডান গুজরাটি। হিন্দি গুজরাটি ব্য়বহারকারীরা ছিলেন ব্রাহ্মণ ও শ্রেষ্ঠী।  হিন্দি গুজরাটিকে সামনে রেখে বাকি দুই ধরনকে ক্রমাগত চেপে দেওয়ার কাজ করেছেন অনেকে, এমনটা অভিযোগ করেন বহু ভাষাবিদ। হরফের ক্ষেত্রে গুজরাটে মূলত দেবনাগরীই ব্যবহৃত হয়। কিন্তু আমদাবাদ বা সুরাটে গেলে দেখা যাবে, বেশ কিছু মুসলিম পরিবার এখনও আরবি হরফই ব্যবহার করেন। এখনও বোরা গোষ্ঠীর ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জমায়েতে গুজরাটে যে ধরনের শব্দ ব্রিজ হিসেবে ব্য়বহৃত হয় তার বেশিটাই আরবি বা ফারসি ঘেঁষা। গুজরাটি ভাষা যে পুরোটাই সংস্কৃত নির্ভর, সেই মিথটি যে ভ্রান্ত, তা এখান থেকেই বোঝা যায়।

 

আসা যাক বাংলার কথায়। মুখে আ-মরি বাংলা ভাষা বলেন কিন্তু ছুতমার্গে ভোগেন এমন বহু লোকের জন্য একটি বিধিসম্মত সতর্কীকরণ ঝুলিয়ে দেওয়া জরুরি।  গবেষকদের মতে, বাংলা ভাষায় প্রায় সোয়া লাখ শব্দ আছে। এর মধ্যে ১০ হাজার আরবি-ফারসি, এক হাজার ইংরেজি ও ৪০০ তুর্কি শব্দ। কারও কারও মতে, বাংলার ৩০ শতাংশ শব্দই আদতে আরবি। মোটামুটি ভাবে বাংলায় আসা আরবি ফারসি শব্দকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়, যেমন- প্রশাসনিক ও আইন, ধর্ম সম্পর্কীয় শব্দ, শিক্ষা-সংক্রান্ত, সংস্কৃতি ও বিবিধবিষয়ক। প্রতিটি বিষয়েই বহু চালু শব্দ আরবদেশের জিন বুকে বহন করছে। আমরা জেনে বা না জেনে তাকে আপনও করে নিয়েছি। এটাই স্বাভাবিক। এভাবেই নদী বয়, ভাষা শ্বাসপ্রশ্বাস নেয়, ভাষা বাঁচে। কাজেই এই ভালোবাসায় যে বা যারা আঙুল তুলছে তাদের অভিপ্রায় নিয়ে প্রশ্ন তুলতে হয় বইকি। আবার এ কথাও স্মরণ করা জরুরি, শব্দের জাতবিচার কোনও নতুন প্রবণতা নয়। এরও এক সুপ্রাচীন পরম্পরা আছে। ইতিহাসটা জেনেই আপনাকে পক্ষ নিতে হবে। বিদ্যাসাগরের সময়ে সংস্কৃত কলেজেই পড়াতেন জয়গোপাল তর্কালঙ্কার। সমাচার দর্পণের প্রথমাবস্থায় সম্পাদকীয়-বিভাগে পণ্ডিত ছিলেন জয়গোপাল তর্কালঙ্কার।  জয়গোপাল ১৮৩৮ সালে ‘পারসীক অভিধান’ তৈরি করেন। আভিধানিকের অভিপ্রায়টি অবশ্য খুব একটা ভালো ছিল না। একে 'ডিডাকশান মেথড'-ই বলা চলে।  বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার থেকে সচেতনভাবে 'বিদেশি' শব্দকে বাদ দিতেই এই অভিধানটি তিনি তৈরি করেন। জয়গোপাল চাইতেন হিন্দুত্বের পুনরুদ্ধার। আর সেই কাজে ব্রতী হয়েই তাঁর দাওয়াই ছিল ভাষাকে পরিশুদ্ধ করা, স্রেফ সংস্কৃত উৎসজাত শব্দকেই ব্যবহার করা। কিন্তু সংস্কৃত নিজে কি ভারতীয় ভাষা, কোনও বিশেষ ধর্মের সঙ্গে তার যোগ কতটুকু? বহুকাল আগে মার্কেন্ডীয় কাটজু বলেছিলেন, সংস্কৃত সাহিত্যের ৯৫ ভাগের সঙ্গেই কোনও ধর্মের সম্পর্ক নেই। গবেষকরা দেখাচ্ছেন সংস্কৃত এসেছে আসলে প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষাবর্গ থেকে। এই ভাষাবর্গেরই অংশ প্রোটো-ইন্দো-ইরানিয়ান। জে পি মলারি এবং ডিকিউ অ্যাডামসের গবেষণায় উঠে এসেছে ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আগে দক্ষিণ কাজাখস্তানের একটা বড় অংশের বাসিন্দারা যে ভাষায় কথা বলতেন তাই সংস্কৃতের আদি রূপ। এদের একটা অংশ আগে সিরিয়ার দিকে যায়। অন্য অংশ পঞ্জাব হয়ে ভারতে পৌঁছয়। কাজেই ভারতের আগে সংস্কৃত লালিত হয়েছে সিরিয়ায়। ক্রমে তা বিবর্তিত হয়ে ভারতে সাহিত্যের একটি ধারাবিস্তার করেছে। সে ধারায় শতজলঝরণার ধ্বনি কান পাতলে আজও শোনা যাবে তা নিয়ে কারও দ্বিমত থাকার কথা না। তবে এ কথাও স্মরণযোগ্য, সেদিন জয়গোপালের সহকর্মী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও এই ভাষা ছুঁৎমার্গ ভালো চোখে দেখেননি। দেখেননি বলেই তো খাদ্য, বস্ত্র, অর্থনীতি, লোকাচার, সংস্কৃতি, স্থান নাম ভারতীয় জনজীবনের সর্বত্র আরবি ফারসির মতো ভাষা সহজাত ভাবেই ঢুকেছে বাংলার শরীরে, অন্যান্য ভারতীয় ভাষার শরীরেও। তা আর আরবি-ফারসি হয়ে থাকেনি, হিন্দি বা অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষা-সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে।

 

সময় গিয়েছে, আমরাও বদলেছি(?), তবে মনের অন্ধকার অংশে আজও আলো পড়েনি যাদের, তারা ভাষার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা খোঁজে, ভাষার গন্ধবিচার করে শব্দ বাদ দেওয়ার কথা বলে। ভাষা মরা নদীর মতো, ধুঁকতে ধুঁকতে এগোয়। থমকে থাকে। আসলে তো ভাষা এক রুগ্ন নারী, শরীর তত ভালো নয়, শুধু চোখে অনির্বাণ আলো। আমরাও মুখে যত বলি, তত তাকে ভালোবাসি কি?

 

তথ্য সূত্র : লেখকের নিজস্ব সংগ্রহ

More Articles