পাড়ার সেইসব নববর্ষের সন্ধে ছিল ইন্দ্রজালের মতো
পয়লা বৈশাখ হোক, পয়লা জানুয়ারি হোক, পুজোআচ্চা হোক বা গরমের ছুটি- আমাদের ছোটবেলায় পুরো পাড়া মুখিয়ে থাকত যাতে এসব পার্বণের দিনে আমরা পাড়ায় থিয়েটার করতে পারি। যেহেতু আমাদের বাড়িতে একটা নাটকের চর্চা ছিল, আমার বাবা যেহেতু অভিনেতা ছিলেন, ফলত, আমরা চার ভাইই নাটকের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছিলাম। আমরা পাড়ায় একাধিক থিয়েটার করেছি, একাধিক সময়ে। বছরে অন্তত চার-পাঁচবার তো বটেই! তার মধ্যে অবশ্যই পয়লা বৈশাখও ছিল। আমাদের সময় তো পরীক্ষা অনেক আগে হয়ে যেত, ডিসেম্বর মাস নাগাদ। ফলে এই সময়টা একটা মেজাজ থাকত, ছুটির মেজাজ, পরীক্ষার চাপহীন মেজাজ। হাফ ইয়ারলি পরীক্ষার একটা ব্যাপার ছিল বটে, কিন্তু সেটাকে আমরা অত পাত্তা দিতাম না।
এই যে আমাদের চেনা মাঠটা আস্তে আস্তে পালটে যাচ্ছে, সেখানে বাঁশ পড়ছে, মঞ্চ তৈরি হচ্ছে, এবং সেই মঞ্চ নির্মাণের সাক্ষী থাকছি আমরা, আমরা এক জায়গায় মহড়া দিচ্ছি, এবং একদিন ওই মঞ্চের ওপর উঠে নাটক করছি- এই যে আমার চৌহদ্দির মধ্যেই আমি সবটাকে পালটে ফেলে পয়লা বৈশাখের এমন সন্ধেবেলায় মেতে উঠছি- এটা আমাদের কাছে একটা ইন্দ্রজালের মতো, ম্যাজিকের মতো ছিল! সেইসব সন্ধেগুলো মোহময় ছিল আমাদের কাছে।
আমাদের পরের প্রজন্মও এমন করে নাটক করেছে, কিন্তু সময় যত অতিক্রান্ত হল, তত ধীরে ধীরে এই ম্যারাপ বেঁধে নিজের চৌহদ্দির মধ্যে নাটক করা, এটা একটু পালটে গিয়ে কাছাকাছি কোনও অডিটোরিয়ামে অভিনয় হওয়া শুরু হল। আমার পাড়া যেখানে, পাইকপাড়া, তার কাছে ছিল হাতিবাগানের মঞ্চগুলো বা সাধারণ রঙ্গালয়গুলো। সেখানে অনেক অনুষ্ঠান হতে দেখেছি। সেটাও যে মন্দ লাগত, তা বলব না। তখন ঝড়বৃষ্টি-কালবৈশাখীর কারণে আমাদের পাড়ায় জলও জমত, ফলে প্রকাশ্য অনুষ্ঠানগুলোতে একটু সমস্যা হত। সেজন্য কেউ কেউ মঞ্চে চলে গেলেন। কিন্তু সেই মঞ্চ তো অন্য পাড়ায়, তা যেন ঠিক নিজের বলে মনে হয় না। এতদসত্ত্বেও সেসব দিনগুলো খারাপ ছিল না।
আরও পড়ুন: বিরিয়ানি নয়, নববর্ষে বাঙালির পাতে ছিল মাংসের পোলাও
তবে এই যে একটু দূরে চলে গেল বিষয়টা, পাড়ার বাইরে চলে গেল, এই যেন আরও দূরে যাওয়ার শুরু। পরে দেখলাম, পাড়ার এই অনুষ্ঠানগুলো যেন আমাদের মন থেকেই হারিয়ে গেল। এই যে আমরা যারা খাচ্ছি-দাচ্ছি, চকচকে ব্লেডে দাড়ি কামাচ্ছি, ঝাঁকের কই ঝাঁকে মিশে যাচ্ছি- সেই আমরা যে কখনও কখনও একজন অন্য মানুষ হয়ে উঠে সেটিকে প্রকাশ করতে পারি নাটকের মধ্যে, আমার প্রতিদিনের যে চেহারা, তার বাইরে গিয়ে- এই ইচ্ছেটাই পাড়ার ছেলেমেয়ে এবং তাদের অভিভাবকদের মন থেকে হারিয়ে গেল। তার নানাবিধ সামাজিক, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক কারণ আছে, হয়তো। কিন্তু মোদ্দায় দেখলাম, সেগুলো কেমন যেন উধাও হয়ে গেল। সেই হওয়াটা প্রথমদিকে বেশ যন্ত্রণা দিয়েছে বটে, কেন আগের মতো পাড়ার নাটক হয় না, এগুলো আমরা বলতাম-টলতাম, কিন্তু নিজেরাও তেমন কিছু আয়োজন করতে পারিনি। কিংবা মনে হয়েছে, কালের নিয়মে এমনটা ঘটাই স্বাভাবিক। বরং সেই সন্ধেতে টেলিভিশনের কোনও অনুষ্ঠানের দিকে মানুষের আকর্ষণ চলে গেল। বাড়ির বাইরের অনুষ্ঠান যে কেউ কেউ করেনি, তা নয়, কিন্তু সেখানে ততটা উৎসাহ দেখা গেল না।
কিন্তু এরপরেও একটা আশাব্যঞ্জক কথা বলতে পারি। আমি কিন্তু বেশ কয়েকবছর যাবৎ, হয়তো চার-পাঁচ বছর যাবৎ দেখছি, আমাদের পাড়ায় আবার বেশ কিছু জলসার আয়োজন হচ্ছে। হয়তো মঞ্চটা আগের চেয়ে অন্যভাবে বাঁধা হচ্ছে, হয়তো অনুষ্ঠানের চরিত্র পাল্টেছে, কিন্তু আমি দেখছি, এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা বসন্ত উৎসব করছেন, কখনও কখনও দেখছি তাঁরা পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে গানবাজনা করছেন, কিন্তু নাটক হয়তো সবসময় করে উঠতে পারছেন না। নাটক করতে গেলে যে একটা দীর্ঘমেয়াদি যূথবদ্ধতার অনুশীলন চাই, সেই সময়টা, এবং সেই মানসিকতাটা, আমার ধারণা, এখনও আবার নতুন করে তৈরি হয়নি, সেই চেতনাটা হারিয়েছে। একসঙ্গে থাকা, একে অন্যকে মূল্য দেওয়া- যেটা থিয়েটারের অন্যতম দাবি- তার কিঞ্চিৎ অভাব এইসময়ে রয়েছে। হয়তো ফেরত আসবে, এই যে পয়লা বৈশাখে গান এবং নাচ ছেলেমেয়েরা করছেন, সেটা হয়তো তাদের আবার নাটকের দিকে ঠেলে দেবে।
অতিমারী আমাদের যে দূরে দূরে থাকা শিখিয়েছে, তার উল্টোদিকে যে বেঁধে বেঁধে থাকা, শঙ্খ ঘোষের ভাষায় বলতে গেলে, তার মজাটাও কিন্তু মানুষ আবার আস্বাদন করতে চাইছেন। তাই হয়তো আবার পাড়ার আয়োজনগুলো ফিরে ফিরে আসছে, অন্তত আমার পাড়ায় তো তাই দেখছি।