নববর্ষের টাইম ট্রাভেল || বাঙালির সময়ের ধারণা পাল্টাল কীভাবে?

শ্যামচাঁদ প্রথম যেবার ঘড়ি-চেইন আঁটিয়া স্কুলে আসিল, তখন তাহার কাণ্ড যদি দেখিতে! পাঁচমিনিট অন্তর ঘড়িটাকে বাহির করিয়া সে কানে দিয়া শুনিত ঘড়িটা চলে কি না! স্কুলের যেখানে যত ঘড়ি আছে সব ক'টার ভুল তাহার দেখানো চাইই চাই! পাঁড়েজি দরোয়ানকে সে একদিন রীতিমতো ধমক লাগাইয়া বসিল-“এই! স্কুলের ক্লকটাতে যখন চাবি দাও তখন সেটাকে রেগুলেট কর না কেন? ওটাকে অয়েল করতে হবে—ক্রমাগতই স্লো চলছে।” পাঁড়েজির চৌদ্দপুরুষে কেউ কখনো ঘড়ি ‘অয়েল' বা ‘রেগুলেট’ করে নাই। সে যে সপ্তাহে একদিন করিয়া চাবি ঘুরাইতে শিখিয়াছে, ইহাতেই তাহার দেশের লোকের বিস্ময়ের সীমা নাই। কিন্তু দেশভাইদের কাছে মানরক্ষা করিবার জন্য সে ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিল, “হাঁ, হাঁ, আভি হাম রেংলিট করবে।”
             (চালিয়াৎ, সুকুমার রায়, সন্দেশ ১৩২৪)

ইস্কুল ছুটির ঘন্টি কার না কৈশোরের সুখস্মৃতি। কিন্তু সে আওয়াজ তো সকলের সমান হক। সময়ের পরে ব্যক্তিমালিকানা জারি করার জন্য নিজের ঘড়ি না হলে চলে না। তাই শ্যামচাঁদ যেদিন প্রথম পকেটঘড়ি নিয়ে স্কুলে এসেছিল, তার এই অবিশ্বাস্য সৌভাগ্যে বেজুবান হয়ে পড়েছিল বাকি কচিকাঁচারা। তার সময়ের কাছে গোস্তাকি স্বীকারে বাধ্য হয়েছিল বাকি সময়েরা।

সময়ের আধিপত্য মোটেই সরল নয়। শ্যামচাঁদ ঠিক আমাদের মতোই, সময়ের হিসেব রাখত ঘণ্টা-মিনিট-সেকেন্ডে। প্রাগাধুনিক যুগে অবশ্য সময়ের চালচিত্রটা তেমন ছিল না। আজকে যেমন দিনকে আমরা চব্বিশটা ঘণ্টায় ভেঙে নিই, তখন সেটাকে ভেঙে নেওয়া হত আট প্রহরে, কিম্বা ষাট দণ্ডে। সেই দণ্ডের ষাট ভাগের এক ভাগ হল গিয়ে পল। আজকের হিসেবে পল মানে ২৪ সেকেন্ড। সেই পলের ১/৬০ ভাগের নাম বিপল আর বিপলের ১/৬০ ভাগ হল অনুপল।

তবে শুধু শাস্ত্রবেত্তা মহাপণ্ডিত নন, আম আদমি যে দিব্যি লায়েক ছিলেন সময়ের মামলায়, এমনকী, তার ডকুমেন্টেশনের গুরুত্বও বুঝতেন তাঁরা- তার প্রমাণ মেলে প্রাগাধুনিক সাহিত্যে। আজকের ছাপা বইতে যেমন লেখা থাকে প্রকাশের সাল, সেদিনের কবিরা তেমনই লিখে রাখতেন কাব্যসমাপ্তির দিনক্ষণ। কাহিনির মধ্যে নানা কিসিমের সময়-এককের উল্লেখ তো থাকতই, পাশাপাশি, তাঁদের অনেকেই যতখানি গুরুত্বের সাথে কাব্যটির ইতিহাস লিখে যেতেন আপন হাতে, তা সেদিনের মানুষজনের পাকাপোক্ত সময়চেতনার সাবুদ।

আরও পড়ুন: বাজারে কাগজ বাড়ন্ত, এই নববর্ষে খেরোর খাতার ব্যবসায় ক্ষতি

তবে দণ্ড-পল-অনুপল নিয়ে বিশেষ ঝামেলা ছিল না, কারণ মোটামুটি সব অঞ্চলেই এমন কয়েকটা একক ব্যবহার করে সময় চিহ্নিত করা হত। গণ্ডগোল দেখা দিত সাল নিয়ে। কারণ সেদিনের বাংলার এদিক থেকে ওদিক, পা ফেরাতে না ফেরাতে দেখা মিলত নতুন সব সাল-তারিখের। প্রায় চারশো বছর আগে, আলাওলের জন্ম হয়েছিল পুববাংলার ফরিদপুরে। বাপ ছিলেন ফতেহাবাদ পরগনার উঁচুপদের অমাত্য। একদিন পিতাপুত্র নৌ-সওয়ার হয়ে কাজে বেরিয়েছেন, এমন সময় নেমে এল হার্মাদি হামলা। পিতা শহিদ হলেন আর আলাওল পর্তুগিজ জলদস্যুদের হাতে বন্দি হয়ে পৌঁছালেন আরাকান। বহুভাষাবিদ, বহুশাস্ত্রজ্ঞ আলাওল সেখানকার কালক্রম আয়ত্ত করেছিলেন। আজকের মায়ানমার, সেদিনের আরাকানে ভাষা-ভাব-ধর্ম এসবের সাথে সাথে সন-তারিখের হিসেবও আলাদা। বহুশাস্ত্রজ্ঞ, হরেক জুবানে দড় আলাওল অতি দ্রুত শিখে নিলেন সেসব হিসেবনিকেশ। নইলে রাজ-মাহিয়ানা হাসিলে সমস্যা হবে যে। আরাকানে আগত কোনও বাঙালি যাতে সময়ের আঁক মেলাতে হিমসিম না খায়, তার জন্য আলাওল পরম যত্নে লিপিবদ্ধ করে গিয়েছিলেন ‘মুসলমানী শক’ থেকে ‘মগধি সনে’ পৌঁছনোর আসান রাস্তা, ১৬৬৪ সনে লেখা তাঁর তোহফা গ্রন্থে।

আসলে, ভারতীয় উপমহাদেশের নিজের মতো করে একটা সময়-আধিপত্য ছিল। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গিয়ে কলকে পেতে হলে, নতুন মুলুকের নানা রীতিনীতির সঙ্গে সময়ের হিসেবেও পোক্ত হতে হত। ধর্মমঙ্গলের কবি দ্বিজ রাজচন্দ্র সাফ কবুল করেছিলেন সেকথা-

মল্লরাজ্যে করি বাস মল্লের দেখি শক।
হাজার আটত্রিশ সালে লইল পুস্তক।।

মল্লরাজ্যে থাকতে হলে মল্লের শকেই জ্ঞাপন করতে হবে সময়- পরোক্ষে যেন সেকথাই জানাচ্ছেন রাজচন্দ্র।  তাঁর বয়ান যেন বুঝিয়ে দেয়, ক্ষমতাবান রাজাবাদশারা তাঁদের এলাকায় পরদেশি সময়গণনা বরদাস্ত করতেন না। আজব নয়, শশাঙ্কাব্দ, লক্ষণাব্দ, চৈতন্যাব্দ, দানিশাব্দ, নসরৎশাহী সন- প্রতিষ্ঠালাভেচ্ছু রাজনৈতিক বা ধর্মীয় গোষ্ঠী আর সবকিছুর মতো দখল পেতে চেয়েছে সময়ের!

আর এই হিসেবগুলো পাওয়ার জন্য সেদিনের আম আদমি নির্ভর করতেন মুখ্যত আকাশের ওপর। রবিশশীই সেদিনের সময়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপ শাহানশাহ। অর্থাৎ, মানুষের সঙ্গে সময়ের সম্পর্ক দৃশ্যমানতার। এই যে, দৃশ্যসময়, এর একটা বড়ো বদল এল উনিশ শতকে। দৃশ্যসময় থেকে মানুষ এল শ্রাব্যসময়ে। অ্যাদ্দিন মানুষ সময় বুঝত আকাশপানে দেখে, এখন ঠাহর করতে লাগল নানা কিসিমের যন্ত্রের আওয়াজে। অবিশ্যি, মানুষ তার হাজার বছরের সময় মাপার অভ্যেস অত সহজে ছেড়ে দেয়নি। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ পাঁজি। উনিশ শতকের গোড়ার দিকের পঞ্জিকায় সময় বিবৃত প্রহর-দণ্ড-পলের মতো এককে। কিন্তু বেশ দ্রুততার সাথে পঞ্জিকা নিজেকে বদলে নিচ্ছে, প্রথমে সেখানে প্রহরের পাশাপাশি হাজির হছে ঘণ্টা-মিনিট। পরে পরে সেটাই দখল নিচ্ছে সময়-এককের।

উনিশ শতকের শব্দময়তার ইতিহাস যেমনভাবে ধরা আছে ১৮৬২-তে লেখা কালীসিঙ্গির হুতোমি নকশায়, তেমনটা নেহাত বিরল। তার পয়লা পরিচ্ছেদেই খবর মেলে কত রকমের শব্দসংকেতের-

১। “বৈঠকখানায় মেকাবি ক্লাকে টাং টাং টাং ক’রে পাঁচটা বাজ্‌লো, …সহরের বাবুরা ফেটিং, সেল্‌ফ ড্রাইভিং বগী ও ব্রাউহ্যামে ক’রে অবস্থাগত ফ্রেণ্ড, ভদ্রলোক বা মোসাহেব সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে বেরুলেন।”

২। “এ দিকে গির্জ্জার ঘড়িতে টুং টাং ঢং টুং টাং ঢং করে রাত চারটে বেজে গেল- বারফটকা বাবুরা ঘরমুখো হয়েচে।”

৩। “গুড়ুম ক’রে তোপ প’ড়ে গেল! …দোকানীরা দোকানের ঝাঁপতাড়া খুলে গন্ধেশ্বরীকে প্রণাম ক’রে, দোকানে গঙ্গাজলের ছড়া দিয়ে, হুঁকার জল ফিরিয়ে তামাক খাবার উজ্জুগ কচ্চে।”

৪। “ক্রমে গির্জ্জের ঘড়িতে ঢং ঢং ঢং ক’রে সাতটা বেজে গেল। সহরে কাণ পাতা ভার। রাস্তায় লোকারণ্য, চারিদিকে ঢাকের বাদ্যি, ধুনোর ধোঁ, আর মদের দুর্গন্ধ।”

সেদিনের কলকাতার রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে বৈঠকখানা, মায় অন্দরমহল- সর্বত্র কানে আসছে শব্দসংকেত। তা-ই ঠিক করে দিচ্ছে আপিসগামী কেরানি, ইস্কুলমুখো ছাত্র, যৌনপিপাসার্ত বাবুদের জীবনযাত্রা। তবে খেয়াল করতে হবে, ১৮৬২, যখন এই নকশা লেখা হচ্ছে তখনও অবধি, ছোট-বড় নানা ঠাটের ঘড়ি (মায় পকেট ওয়াচ অবধি) বাজারে এলেও, আম আদমির সঙ্গে তার সরাসরি যোগ নেই। বাজল ক’টা? আপিস যেতে আর কত সময় বাকি?- এসব সওয়ালের জন্য টুং টাং ঢং ঢাং কান পেতে শোনা বই গতি ছিল না। সময়ের হদিশ পেতে ঠিক কতটা নির্ভর করতে হত কানের ওপর, তার সরাসরি উত্তর না দিয়ে বরং একটা চুটকি শোনা যাক।

একব্যক্তি শেষরাত্রে বাড়ী আসিলে তাহার কোপনাপত্নী তাঁহাকে কহিল “রাত ৩ টে বেজে গেল তবু কি তোমার বাড়ী বলো মনে পড়েনা?” –তিনটে! এই মাত্র একটা বেজেছে। --“তুমি মদ খেয়েছ নাকি? আমি এই জানলায় বসে শুনলেম্‌ ৩ টে বাজলো।” --না এই মোড়ের মাথায় যখন তখন আমি গনিলাম ৩ বার একটা বাজলো।
  (কৌতুক শতক, হরিশ্চন্দ্র মিত্র সংগৃহীত, ১৮৬২)

তবে শুধু উনিশ শতকী রসালো দাম্পত্যবিভ্রাট নয়, এহেন ভুলচুক হওয়ার সম্ভাবনা ছিল পদে পদে। আগেই বলা হয়েছে, পকেটঘড়ি ততদিনে আমদানি হলেও আম আদমির পকেটে হাজির হতে অনেক দেরি ছিল। মালকোষ মোটা যাঁদের, তাঁরাই ছিলেন সময়মাপনীর হকদার। ঘড়ি হাতাতে এমনকী খুনখারাবিও ঘটে যেত মাঝে-সাঝে। দুশো বছর আগে, ১৮২১ সনে, চন্দ্রকুমার ঠাকুরের স্বর্ণঘড়ি হারানোর বিজ্ঞাপন ফলাও করে ছাপা হয়েছিল 'সমাচার দর্পণ'-এ।

পকেটঘড়ি যে শুধু পয়সাওলাদের পকেটে শোভা পেত তাই নয়, সেটা ঔপনিবেশিক শাসনের জরুরি হাতিয়ারও ছিল। হুতোমে ফেরা যাক, “সুপারিন্টেণ্ডেন্ট রাস্তায় ঘোড়া চ’ড়ে বেড়াচ্ছিলেন, পকেট-ঘড়ি খুলে দেখলেন, সময় উতরে গেছে, অমনি মার্শাল ল জারি হলো, “ঢাক বাজালে থানায় ধ’রে নিয়ে যাবে।” ক্রমে দুই-একটা ঢাক ঘাড়ে ক’রে চুপে চুপে বাড়ী এলেন—দর্শকেরা কুইনের রাজ্যে অভিসম্পাত কত্তে কত্তে ফিরে গেলেন।” অর্থাৎ, নেটিভরা কীভাবে আমোদফুর্তি করবে, কখন শুরু করবে, থামবে বা কখন- এসবই নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হল গিয়ে ঘড়ি। সরকারি আইনকানুন, ল-অ্যান্ড-অর্ডার বরকরার রাখার সে অনিবার্য উপকরণ।

সুতরাং, শ্রাব্যসময় থেকে বিবর্তনের পরের ধাপে সময় এসে ঠেকল ব্যক্তিঘড়ির সূত্রে। এতদিন যা ছিল সুদূর গ্রহতারকার বিষয়, সেটা যখন মানুষের হাতের তালুর মধ্যে বন্দি হল, তখন তাঁরা ঠিক কতখানি তাজ্জব হয়েছিলেন, আজকে তার আন্দাজ পাওয়া মুশকিল। তবে ফি পকেটে ঘড়ি থাকলে তো হবে না, তার সঙ্গে থাকতে হবে একটা ‘ঠিক সময়’। দিনের শেষে হাতঘড়ি স্লো হলে সেই সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে সেটাকে ঠিক করে নিতে হবে। উনিশ শতকে, টেলিগ্রাফ, রেলওয়ে আসার আগে এমনতরো সার্বিক ঠিক সময়ের দরকার ছিল না। প্রত্যেক এলাকার নিজস্ব সময় ছিল। সমস্যা যেটা দেখা দিল, কলকাতায় যখন সকাল হয়, ঠিক সেই সময়টায় বেনারসে সকাল হয় না। হয় তার খানিকটা পরে। এখন সূর্য ওঠার ঠিক পরের সময়টাকে যদি সকাল সাতটা বলা যায়, সেই সকাল সাতটা নানা জায়গায় নানা সময়ে আসে। ধরুন, আপনি কলকাতা থেকে ট্রেন চড়লেন বেনারস যাওয়ার জন্য, সাতটা নাগাদ। পৌঁছলেন বারো ঘণ্টা পর, সন্ধে সাতটায়। কিন্তু আপনার ঘড়ি তখন সন্ধে সাতটা দেখালেও, বেনারসে হয়তো সেটা বিকেল পাঁচটা, কারণ সে তো আপনার এলাকার সময় মানে না। সেখানে কামকাজ চালাতে গেলে, অগত্যা আপনাকে ডায়াল ঘুরিয়ে নতুন সময়ের সঙ্গে ঘড়িটাকে মিলিয়ে নিতে হবে। এখন, কাঁহাতক নতুন নতুন স্টেশনে বারংবার নিজের ঘড়ির সময় বদলে নেওয়া যায়! রেলযাত্রার অনাবিল খুশিও তাতে ব্যাহত হয় অনেকখানিই।

উনিশ শতকে, ইউরোপ মুলুকের রেলকর্তাদের কাছে এটা বেজায় গর্দিশ হয়ে দাঁড়াল। প্রত্যেক স্টেশন যদি নিজের মর্জিমাফিক সময় হাঁকে- তাহলে আর যা-ই হোক ট্রেন চালানো যায় না। অতএব, নানা জায়গার সময়গুলোকে বাঁধতে হবে এক সুরে। ইউনাইটেড স্টেটস, যেখানে এই কাজ শুরু হয়, সেখানে প্রস্তাব দেওয়া হয় একটা বৈশ্বিক সময়ের। তবে সেটা ধোপে টেকেনি, মানুষ অনেক বেশি গা-সওয়া ছিল আঞ্চলিক সময়ের সঙ্গে। অবশেষে, বিশ্বকে বেশ কয়েকটা সময়াঞ্চলে (Time Zone) ভেঙে নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়, ১৮৮৩ নাগাদ। এভাবে সারা দুনিয়ার একটাই মান্য সময়ের বদলে প্রতিটা অঞ্চলের একটা করে মান্য সময় স্বীকৃত হয়। আজকের দেশনেতারা এমন এক দেশ, এক ভাষা/ধর্ম/সংস্কৃতির নিদান দেন, তেমনই সেখানে নানা দেশের নেতারা তাদের জন্য নির্দিষ্ট সময় ঠিক করে বাড়ি ফিরলেন। সেদিনের নেশন-নির্মাণ প্রক্রিয়ার সঙ্গেও জুড়ে গেল সময়।

ওয়াশিংটন শহরে ১৮৮৪ সালে যে ইন্টারন্যাশনাল মেরিডিয়ান কনফারেন্স বসেছিল, সেখানে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন ব্রিটিশ সরকারের বিশ্বস্ত সেনানী, লেফটেনান্ট-জেনারেল রিচার্ড স্ট্র্যাচে (১৮১৭-১৯০৮)। লড়াইফসাদের পাশাপাশি তাঁর নেশা ছিল হিমালয়ে ঘুরে বেড়ানো, মওকামতো ভূগোল আর উদ্ভিদবিদ্যার নানা তথ্য আহরণ। তাঁর দৌলতেই ভারতের বরাতে জোটে দুটো সময়। সেখানেই ঠিক হয়, বোম্বে হাঁটবে GMT (Greenwich Main Time)-র ৪ ঘণ্টা ৫১ মিনিট আগে। কলকাতা আরেকটু বেশি, ৫ ঘণ্টা ৩০ মিনিট ২১ সেকেন্ড। ওই দশকের শেষাশেষি, দুই সময়সীমানার মাঝামাঝি একটা অবস্থান হিসেবে মাদ্রাজ টাইমের সূচনা হয়। পরে পরে, ব্রিটিশ সরকার পোর্ট ব্লেয়ার নামেও একটা সময়াঞ্চল তৈরি করে। ১৯০৫ সনে দেখা যায়, প্রস্থ বরাবর ভারতের মাঝবিন্দু হল এলাহাবাদ। তাই সেখানকার সময় অনুযায়ী গোটা দেশে একটাই সময়াঞ্চল স্বীকার করা হল। পাশাপাশি রইল, বোম্বে আর কলকাতার সময়ও। এমনকী স্বাধীনতার পরেও, ১৯৪৮ অবধি ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড টাইমের পাশাপাশি রীতিমতো হাজির ছিল ক্যালকাটা টাইম, শহর কলকাতার একেবারে নিজস্ব একটা সময়। 

তবে মান্য ভারতীয় সময় (Indian Standard Time) হলেও আপন, আদতে শিকড়ছেঁড়া। উপমহাদেশের ব্যাপক সময়-বৈচিত্র্য গিলে খেয়েই তার বিস্তার। আসলে পয়লা বৈশাখ রইলেও সাংস্কৃতিক উদযাপন হিসেবে বহাল তবিয়তে, সময়-কাঠামো হিসেবে তার অস্তিত্ব অপসৃয়মাণ। খুব জোর সালতারিখ মনে রাখলেও, প্রহর-দণ্ড-পল হিসেবে সময়ের হিসেব রাখা বাস্তবে সম্ভব না। কারণ, এহেন সময়-বৈচিত্র গোলকায়নের পথের কাঁটা। তা সত্ত্বেও, পয়লা বৈশাখ তার যাবতীয় আবেগ-জৌলুস-নস্টালজিয়া সহ কীভাবে বেঁচেবর্তে রয়েছে, তার কারণ খুঁজতে গেলে ফিরে দেখতে হবে সময়ের কাহিনি, তার সঙ্গে জড়িত দৈনন্দিনতা, আধিপত্য ও বৈচিত্রের আখ্যান।

More Articles