বাজারে কাগজ বাড়ন্ত, এই নববর্ষে খেরোর খাতার ব্যবসায় ক্ষতি

গতকাল ছিল চড়ক পার্বণ। বাংলা বছরের শেষ দিন। সেই উপলক্ষে ‘কলিকাতা কমলালয়’-এ উৎসবের ধুম বড় অল্প ছিল না। পাড়ার মোড়ে মোড়ে গাজন সন্ন্যাসীদের গলায় শোনা যাচ্ছিল হেঁয়ালির ছড়া-

শুনরে সন্ন্যাসী ভাই আমার বাখান

 উত্তর দিয়া তুমি যাও অন্যস্থান।

 এরণ্ড আর থাম খুঁটি, ভেরাণ্ডার বেড়া,

 তার মাঝেতে পড়ে আছে মস্ত এক নোড়া।

 বাটনা বাটিতে শিবের পুঁটকি হল ক্ষয়,

 সেই শিবকে গড় করিলে কি পুণ্য হয়?

বেলা বাড়তেই গাজনতলায় মেলা মানুষ ভিড় করে এলেন, উচ্চৈঃস্বরে বলে উঠলেন, ‘বলে ভদ্দেশ্বর শিবো মহাদেব।’ চিৎপুরের রাস্তা লোকে লোকারণ্য। গির্জার ঘড়িতে সাতটা বাজতেই সর্বাঙ্গে ছাই মেখে রাস্তায় সং বেরোল, মাথায় টিনের সাপের ফণার টুপি। ক্রমে রাত নামল, বেনেরা ঢুকল মদের দোকানে, পুলিশের তাড়া খেয়ে গাজনের দল আস্তানায় ফিরল। উৎসবের রঙ্গিলা মেজাজে ভাটার টান পড়ল। গাজন উৎসবের শেষে এবার বর্ষবিদায়ের প্রস্তুতি। হুতোম লিখছেন, ‘ইংরেজরা নিউইয়ারের বড় আমোদ করেন। আগামীকে দাড়াগুয়া পান দিয়ে বরন করে ন্যান– নেসার খোঁয়ারির সঙ্গে পুরাণকে বিদায় দেন। বাঙ্গালিরা বছরটী ভাল রকমেই যাক আর খারাবেই শেষ হক, সজনে খাড়া চিবিয়ে ঢাকের বাদ্দি আর রাস্তার ধূলো দিয়ে পুরাণকে বিদায় দ্যান। কেবল কলসি উচ্ছুগগু আর নতুন খাতাওয়ালারাই নতুন বৎসরের মান রাখেন।’ চড়ক পার্বণের পরের দিনটাই হল গিয়ে 'পুণ্যাহ', বাঙালির ‘নিউ ইয়ার’।

সন্ধে নামতেই একদল বাবু ইয়ার-বক্সি নিয়ে কলকাত্তাইয়া মজলিশে মদের ফোয়ারা ছোটাতে যাবেন। ব্রুহামে চেপে তাঁরা হাঁক পাড়বেন, ‘চলো পানসি বেলঘরিয়া।’ ভূমি-মালিকরা শুভ তিথি উপলক্ষে নিজেদের প্রজাদের মিষ্টিমুখ করাবেন, তাঁদের হাতে তুলে দেবেন নানা উপহার। গ্রামবাংলায় ছড়িয়ে পড়বে উৎসবের আনন্দ। বাঙালি জীবনের সঙ্গে ‘পুণ্যাহ’ শব্দটা জড়িয়ে গিয়েছিল বহু আগে। দীর্ঘদিন পর্যন্ত শব্দটার সঙ্গে বাঙালির পরিচয়ও ছিল। কালক্রমে তার শব্দভান্ডার থেকে পুণ্যাহ মুছে গেল, সেখানে জায়গা করে নিল ‘হালখাতা’। যদিও শব্দ হিসেবে ‘হালখাতা’ ‘পুণ্যাহ’-র চেয়ে প্রাচীন। ফারসিতে ‘হাল’ শব্দের অর্থ হল ‘নতুন’। কয়েক শতাব্দী আগেও পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে বাংলায় নববর্ষ পালনের রেওয়াজ ছিল না। বাংলার ব্যবসায়ীরা এদিন নতুন খেরোর খাতা খুলে হালখাতা পালন করতেন কেবল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ হালখাতার পরিবর্তে পুণ্যাহ প্রথা চালু করেন। বাংলার জমিদারদের ওপর দখল বজায় রাখতেই তিনি এই প্রথার প্রচলন ঘটান। পুণ্যাহ উপলক্ষে বাংলার জমিদাররা রাজদরবারে গিয়ে খাজনা জমা দিতেন। তারপর তাঁকে নজরানা হিসেবে দিতে হত সোনার মোহর, যার পরিবর্তে রাজদরবার থেকে জমিদারদের পদমর্যাদা অনুযায়ী পাগড়ি, পোশাক বা কোমরবন্ধ উপহার দেওয়া হত।

আরও পড়ুন: নববর্ষের টাইম ট্রাভেল || বাঙালির সময়ের ধারণা পাল্টাল কীভাবে?

ফলে, কালক্রমে ‘পুণ্যাহ’ নামখানা বিস্মৃতির মহাফেজখানায় পর্যবসিত করল বাঙালি। তার স্মৃতিতে ফের জায়গা করে নিল ‘হালখাতা’। তারপর থেকে বাঙালির নববর্ষের সঙ্গে ‘হালখাতা’ নামটাই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গেছে। উনিশ শতকের কলকাতায় হালখাতার দিন দু'ধরনের চিত্র দেখা যেত। শহরের বনেদিবাড়িগুলোতে এদিন হালখাতা উপলক্ষে জ্বলে উঠত আলোর রোশনাই। ভারতের নামকরা গাইয়ে-বাজিয়েরা সেখানে এসে উপস্থিত হতেন, শুরু হত শাস্ত্রীয় সংগীতের আসর। উত্তর কলকাতার প্রস্তরমূর্তি শোভিত বনেদিবাড়িগুলোর বৈঠকখানা থেকে সেদিন ভেসে আসত মারু বেহাগের টপ খেয়াল বা কেদারের সনদী বন্দিশ, ‘শিখে হো ছাল ভালা।’ উল্টোদিকে রাস্তাঘাটের দোকানগুলোতেও লেগে থাকত উৎসবের আমেজ। সেখানেও আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে আসা হত বহু শিল্পীকে। সন্ধে নামতেই খালি গলায় তাঁদের গান শুরু হত, বহু মানুষ ভিড় করে তা শুনতেন। এছাড়াও হরেক রকমের খাওয়া-দাওয়া তো ছিলোই। হরিমোহন পালের ‘রসিক’ নাটকে সেই সময়কার হালখাতার খাওয়া-দাওয়ার কিছু বর্ণনা পাওয়া যায়-

‘গদীবাবু।- খালি পেটে আপনি কয়টি মনোহরা খাইতে পারিবেন?

 পেটুক।- খালি পেটে মহাশয় একটি মাত্র মনোহরা ভক্ষণ সম্ভব। তাহার পর একশতটী।

গদীবাবু- হে-হে। আপনি বুদ্ধিমান বটে। আজি হালখাতার দিনে যতগুলি ইচ্ছা তথা একশতটী মনোহরা খান।’

কালে কালে বাঙালির পায়রা ওড়ানোর দিন ফুরিয়ে এল। মাছে-ভাতে থাকা বাঙালি খাটো ধুতি, মোটা কাপড়ের শার্ট আর চোখে গোল ফ্রেমের চশমা পরে ন'টা বাজলেই ছুটতে লাগল কেরানির দপ্তরে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হালখাতার চরিত্রও পাল্টে গেল। বিশ শতকের তিনের দশকে হালখাতা উপলক্ষে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আকাশবাণী কলকাতা। রবীন্দ্রোত্তর কবিদের মধ্যে সে সময়ে নজরুল ইসলাম প্রবল জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন। তিনি সেই অনুষ্ঠানে গান করেন। তখন কলের গানের যুগ। হালখাতার দিন কলকাতার বহু দোকানে দম ঘোরানো কলের গানে  শিল্পীদের কণ্ঠ শোভা পেত, পথ-চলতি মানুষজন বিস্মিত হয়ে তাকাতেন। হালখাতা উপলক্ষে খরিদ্দারদের মিষ্টিমুখ করানোর প্রথা উনিশ শতকের পরেও বজায় থেকেছে।

আজকের দিনেও হালখাতা উপলক্ষে সকাল থেকেই দোকানে দোকানে আমন্ত্রণপত্রের চিঠি হাতে মানুষের ভিড় লেগে থাকে। টাকাপয়সা কিছু বাকি থাকলে খরিদ্দাররা সামর্থ্যমতো তা মিটিয়ে দেন দোকানিকে, তারপর শুরু হয় মিষ্টিমুখের পালা। হালখাতার দিন কোনও জোরাজুরি নেই। ‘টেনিদা’-র একটা গল্প থেকে সংলাপ ধার করে বলা চলে-

দোকানদারেরা এ-সময় ভারি জব্দ থাকে – জানিস তো? যত টাকাই পাওনা থাক না কেন – মুখ ফুটে চাইতে পারে না। যত খুশি খেয়ে আয়, হাসিমুখে বলবে, আর দুটো মিহিদানা দেব স্যার?

এবারের হালখাতার হাল-হকিকত বিশেষ সুবিধের নয়। বাজারে কাগজ বাড়ন্ত হওয়ার ফলে খেরোর খাতার ব্যবসা কিছুটা বিপন্ন হয়েছে। তার ওপর কোভিডের ধাক্কায় ছোট এবং মাঝারি শিল্পের অবস্থা কাহিল। মানুষের হাতে টাকা নেই, ফলত অনেকেই গত দু'বছর হালখাতা করেননি। তবে, এই বছর কষ্ট করে হলেও বহু ব্যবসায়ী হালখাতা পালন করছেন। সোনালি-রুপোলি অক্ষরে লেখা আমন্ত্রণপত্র পৌঁছে যাচ্ছে খরিদ্দারদের বাড়ি বা হোয়াটসঅ্যাপের চ্যাটবক্সে। অর্থাৎ, সংকটের মধ্য দিয়ে গিয়েও বাংলার এক প্রাচীন প্রথাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন কিছু মানুষ। দুর্দিনে এটুকুই যেন আশার আলো। 

 

কৃতজ্ঞতা:
হরিপদ ভৌমিক
মহেন্দ্রনাথ দত্ত
কালীপ্রসন্ন সিংহ

 

 

 

More Articles