চক্রব্যূহ : সোমক রায়চৌধুরী

Bengali Science Fiction Story: ভেলোর গলায় বাঁধা কালো সুতোর মাদুলি-মার্কা বস্তুটি কে যেন সযত্নে খুলে নিয়েছে। গজদের বাড়ির ঠাকুরঘর সংলগ্ন এক চিলতে বাগানে, কিশোরের পায়ের ছাপ দেখা গেল

পাশাপাশি দুটো গ্রাম রাজডাঙা আর রামবাজার। দুইয়ের মধ্যে প্রবল সাংস্কৃতিক রেষারেষি দীর্ঘদিনের। তার প্রভাব পড়ে স্কুল ছাত্রদের মধ্যে ফুটবল ম্যাচেও। ম্যাচের কয়েকদিন আগে থেকেই দুই গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে উত্তেজনার পারদ চড়তে থাকে শব্দের গতিতে। মাঠ, রেফারি, টিমলিস্ট, ম্যাচের দিন নির্দিষ্ট করা নিয়ে খুচরো ঝামেলা, আপত্তি-চিঠি-চাপাটি চালায় দু'পক্ষই। আসলে দু’পক্ষই অপর পক্ষের উপর চাপ সৃষ্টি করতে চায়। এবার প্রবল বর্ষার মধ্যে ম্যাচের দিন ঠিক হয়েছে। রাজডাঙার হেডমাস্টারের ইনবক্সে এসে গিয়েছে রামবাজারের টিমলিস্ট! গেমস-টিচার কালীপ্রসন্নবাবুর সঙ্গে বসে সেই টিমলিস্ট গভীর মনযোগে পর্যবেক্ষণ করছেন হেডস্যার মাখনলাল বাঁড়ুজ্যে। ১৮-জনের টিমলিস্ট; ন’জন অবধি আপত্তির কোনও কারণই পাননি মাখনবাবু; তিনি নামগুলো পড়ছেন আর কালীপ্রসন্ন মাথা নেড়ে সম্মতি জানাচ্ছেন। সবই চেনা ছেলে এ পর্যন্ত, এই ছেলেগুলোর চেহারা থেকে খেলার স্টাইল সবই জানা কালীবাবু ও মাখনবাবুর। দশ নম্বরে এসে চোখ আটকে গেল মাখনবাবুর,

“হরি, এই হরিটা কে ভায়া?”

কালীবাবু অবশ্য বিশেষ দমলেন না, পাল্টা প্রশ্ন করলেন, “ও হরনাথ, একবার ফেল করেছে, এখন ক্লাস নাইনে, তবে বয়স ভাঁড়ানো; তা ওকে নিয়েছে?”  

“উঁহু, হরনাথ নয়, এই দেখ, স্রেফ হরি; জার্সি নম্বর ২১, ক্লাস ইলেভেন, বয়স ১৭, পজিশন: সেন্ট্রাল মিডিও লেখা! পদবিটা দেওয়ার বালাই নেই! অথচ বাকি সব নামে পদবি রয়েছে!”  

“হুম"। এবার মাথা নাড়েন কালীবাবু, "মেকআপের আড়ালে রেখে চমকানোর স্ট্র্যাটেজি! লাভ হবে না আমার কাছে! শেষ পর্যন্ত ওই হরনাথকেই ড্রেস করিয়ে মাঠে নিয়ে আসবে। তবে নামাবে না, বেঞ্চে বসিয়ে রাখবে। পরে বলবে পদবিটা না দেওয়া ভুল হয়ে গিয়েছে! এসব বুঝি না?”  

মাখনবাবু এবার চটপট তাঁর ডেস্কটপে মেইল খুলে একটা কমপ্লেন ঠুকে দিলেন টিমলিস্টে হরি নামক ছেলেটির পদবি না থাকার জন্য। সেকেন্ডের ভগ্নাংশে তা চলে গেল ম্যাচ রেফারির ইনবক্সে। মেইল 'সেন্ড' করার সময় স্বগতোক্তি করলেন “হরির নাম খাবলা খাবলা”! 

বৃষ্টি-ভেজা মাঠে এখন রামবাজার-রাজডাঙা ম্যাচের বিরতি! রাজডাঙা বেঞ্চে শ্মশানের স্তব্ধতা! শুধু তাই নয়, কালীবাবু আর তাঁর প্লেয়ারদের চোখমুখ হতভম্ব। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছেন হেডস্যর মাখনবাবুও! সমর্থকরা কালীবাবু ও তাঁর প্লেয়ারদের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করছে যথেচ্ছ! “বাপের জন্মে দেখিনি হাফটাইমের আগে পাঁচ গোল খেতে”। একজন প্রবীণ সমর্থক ভিড়ের মধ্যে থেকে বলে উঠলেন, “আমাদের সময় একবার ফার্স্ট হাফে তিন গোল মেরেছিলুম, আজ সেই রেকর্ড ভেঙে গেল! কালীবাবুর এবার রিটায়ার করুন!” আসলে রেজাল্ট, রামবাজার ৫-০ এগিয়ে; ইতি হরি! পাঁচটা গোলই এসেছে ২১ নম্বর জার্সিধারী সেন্টার হাফের পা আর মাথা থেকে! এছাড়াও হরির স্কিলে সারা মাঠ মুগ্ধ। তার পাসিং-শুটিং-রিসিভিং-হেডিং, বল সহ ও বল ছাড়া দৌড় সব কিছুই ঠাসবুনোটের। কেউ বলছেন, “আজ মাঠে একজন প্রিমিয়র লিগের প্রাক্তন তারকা আছেন, তিনি আজই হরিকে স্পট করে ফেলেছেন”। আর একজন বলছেন “শুরুতেই এতটা সুর চড়াবেন না! আর কয়েকটা ম্যাচ খেলুক আগে!”   

সমস্ত বিস্ময় আর আলোচনার কেন্দ্র হরি অবশ্য ভাবলেশহীন চোখ-মুখ নিয়ে বসে আছে রামবাজার বেঞ্চের সামনে, সহখেলোয়াড়দের মাঝখানে। তার দিকে এগিয়ে আসা জলের বোতল মাথা নেড়ে প্রত্যাখ্যান করে দিল। 

মাঠ থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে যিনি সবার অলক্ষ্যে দোতলার ছাদ-সংলগ্ন নিজের স্টাডিতে বসে আছেন; তিনি রামবাজার হাইস্কুলের অঙ্ক ও ইলেক্ট্রনিক্সের মাস্টারমশাই কবীর সিংহি। সিংহিবাবুর সামনে একটা ঝকঝকে ল্যাপটপের স্ক্রিন আর হাতে চকচক করছে একটা বড় ডায়ালের বেঢপ ঘড়ি। ওই ঘড়ির স্ক্রিনে তিনি হরির প্রতিটা মুভমেন্ট এতক্ষণ খুঁটিয়ে দেখছিলেন। এখন তাঁর চোখে-মুখে গভীর প্রশান্তি। ল্যাপটপের পাশে একগাদা প্যাড, যার প্রতিটা পাতায় গাণিতিক কচকচানি ও প্রচুর ছোট ছোট ডায়াগ্রাম আঁকা। এই ডায়াগ্রামগুলো এক একটা জটিল সিগনাল-নেটওয়ার্কে। ল্যাপটপে ভেসে আসে দু'জন বৃদ্ধ সাহেবের ছবি। কবীর করজোড়ে তাঁদের প্রণাম করেন। এই দুই ব্যক্তির সাহায্য ছাড়া বাংলাদেশের এই অজ পাড়াগাঁয়ে হরির প্রাণ প্রতিষ্ঠা করার সাধ্য তাঁর ছিল না। হরির বৃত্তান্ত আরেকজন খানিক জানেন, বিদেশে কর্মরত তাঁর গবেষক বন্ধু সাহেব খাঁ। সাহেবকে ইতিমধ্যেই হরির পারফরম্যান্স রেকর্ড করে পাঠিয়ে দিয়েছেন তিনি। ফুটবল খেলা ছাড়াও, হরির আর একটা বিশেষ কর্মক্ষমতা রয়েছে। তবে সেটা কবীর এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারেননি। ওই দুই বুড়োও তাঁকে খোলসা করে জানায়নি; স্রেফ কিছু ইঙ্গিত আর একটা সংকেত দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। এই সংকেত তাঁর কাছে দুর্বোধ্য, সাহেবও এখনও কিছু হদিশ দিতে পারেনি। তাই হরি সম্পর্কে সব থেকে বেশি ধোঁয়াশা কবীরের মনেই।  

এই সময়ে কবীর বাবুর তিরাশি বছর বয়সী মা এসে ঘরে ঢুকলেন এবং বেশ ঝাঁঝালো গলায় বললেন, “ওই ছোকরাটাকে আনলি, হরি না কী যেন, কোথায় গেল রে? দেখছি না বেলা বারোটার পর থেকে! ওকে দিয়ে ভেলোকে চোখে চোখে রাখতে হবে। এখান-সেখান থেকে হাজারটা অভিযোগ আসছে ভেলোর নামে!”  

ভেল‌ো হচ্ছে কবীর সিংহির পোষ্য সাদাকালো ছোপ ছোপ একটা বেড়াল। এখন ভেল‌ো বড় হয়ে গিয়েছে, কবীর আর তত নজর রাখেন না, আর সেই সুযোগে ভেলো সারাদিন গ্রাম চষে বেড়ায়। কার বাড়ির চ্যাঙাড়িতে কই মাছ এসেছে, কার বাড়িতে মুরগি ছানা দিয়েছে, এসব খবর  ইন্দ্রিয়গুণে ভেলোর নখদর্পণেঅপরের বাড়িতে হানা দিলে ভেলোর খাঁই যে রীতিমতো বৃদ্ধি পায়, তা কবীর বিলক্ষণ জানেন! টেবিলের এক কোণে পড়ে থাকা মোবাইল ফোনটা বার দু'য়েক বেজেই গেল। কবীর সিংহি একবার ঝুঁকে পড়ে স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে আর ভ্রুক্ষেপই করলেন না।  

আজ মাঠে বারবার দেখা গিয়েছে রামবাজার ২১ নম্বর জার্সির রিফ্লেক্স, অ্যান্টিসিপেশন ও পজিশন জ্ঞান বাকি খেলোয়াড়দের থেকে কয়েক ধাপ উপরে। আর এতেই হয়েছে বড় সমস্যা। শুধু হরির খেলার স্টাইল নয়, স্বয়ং হরিকেও খুঁটিয়ে অবজার্ভ করেছেন আজ মাঠের অনেকেই। এর মধ্যে গ্রুপ থিয়েটারের দুঁদে পরিচালক তিমিরবাবুও আছেন। শুধু এই প্লেয়ারের চেহারা বা ফিটনেস নয়, হরির শারীরিক ভাষা ও বিরক্তি প্রকাশের ভঙ্গিও তিমিরের মনে ধরেছে। লেফট আউট ও স্ট্রাইকার ঠিক পজিশনে না থাকায় বার দু'য়েক শরীর ঝাঁকিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছে হরি। তিনি ছকে ফেলেছেন এই ছেলেটিকে তিনি তাঁর পরের প্রযোজনায় একটা বিশেষ চরিত্রে গড়েপিটে নিয়ে ব্যবহার করবেনই। স্ক্রিপ্ট তাঁর নিজেরই, চরিত্রটিও তাঁর সৃষ্টি, কিন্তু বর্তমান অভিনেতাদের কাউকেই তাঁর মনে ধরছিল না!  

তিমির রামবাজার রিজার্ভ বেঞ্চের পিছন দিকে ঘুরঘুর করে, রামবাজার হাইস্কুলের ভূগোলের শিক্ষিকা, তাঁর প্রাক্তন প্রেমিকা দেবযানীর সঙ্গে খানিক গায়ে পড়ে কথা বলে, হরি সম্পর্কে কিছু তথ্য সংগ্রহ  করে ফেললেন। দেবযানীর চোখেও হরি সম্পর্কে একটা বিস্ময়বোধ লক্ষ্য করলেন, যদিও দেবযানী যতটা সম্ভব তা লুকিয়ে রাখার চেষ্টাই করছিলেন। যতটুকু জানতে পেরেছেন তিমির তা হলো; হরি নেহাত প্রয়োজন না হলে কথাবার্তা বিশেষ বলে না এবং সে অঙ্কের মাস্টার কবীরের খুব প্রিয়। সেই নাকি হরিকে রামবাজারের স্কুলে কোথা থেকে নিয়ে এসে ভর্তি করেছেন। খেলার আগেও নাকি হরিকে কবীরের বাড়ির লোহার গ্রিলের সদর দরজার সামনে মাস্টারমশাইয়ের কাছে টিপস নিতে দেখা গিয়েছে! পকেট থেকে মোবাইল বের করে কবীরের নম্বরে কল করেন তিমির। কবীরের সঙ্গে একই কলেজে সায়েন্স পড়েছেন তিমির, বছর কুড়ি আগে। কিন্তু চারবারের প্রয়াসেও কবীরের দিক থেকে কোনও সাড়া পান না! তাতে অবশ্য ওই তল্লাটের সেরা নাট্য-পরিচালক দমবার পাত্র নন! হরিকে তার চাই। তিমির ঠিক করলেন আজ আর হরি বা কবীর, কাউকেই ডিসটার্ব করবেন না এবং নিজের স্টুডিও অবধি নতুন চিত্রনাট্য ও হরির চরিত্রটা নিয়ে ভাবতে ভাবতেই হেঁটে ফিরবেন। এই একতরফা খেলায় রামবাজার এখন ৬-১ এগিয়ে এবং সেকেন্ড হাফে পায়ে বল ধরে হরি সম্পূর্ণ পেশাদার ফুটবলারের মতো অন্য খেলা খেলছে! “সো হরি ইজন’ট আ ফ্রিক; হি ইজ আ রিয়েল ওয়ান। আ রিয়েল ট্যালেন্ট”। পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একটা পাইপ বের করে, লাইটারে অগ্নিসংযোগ করে, ধোঁয়ার রিং হাওয়ায় নির্গত করতে করতে বললেন রাজডাঙা হাইস্কুলের ইংরেজির মাস্টার গজবাবু।  

হাঁটতে হাঁটতেই নতুন ট্র্যাজেডির শেষ অ্যাক্টটা বদলে ফেললেন তিমির। আরও জোরালো আবেদন থাকবে  শেষ দৃশ্যে। একজন তরুণ অভিনেতা দীর্ঘদিন ডিপ্রেশনে ভুগে পাগল হয়ে যাচ্ছেন, তাঁর প্রলাপেই নাটকের সমাপ্তি! হরিকে একবার পেলে তাঁকে নিয়ে পড়ে থাকতে হবে ওয়ার্কশপে বেশ কয়েকদিন। বাড়ির কাছকাছি এসেছেন এমন সময় একটা টেক্সট মেসেজ পেলেন তিমির। “হরিকে তোর নাটকের জন্য ভাবিস না। ও পারবে না। ওর এক্সপ্রেশন খুব খারাপ"। প্রেরক অবশ্যই কবির।

আরও পড়ুন- সাইকেল: অমৃতা সরকার

শেষ কথাটায় একটু খটকা লাগল তিমিরের। ভাবলেন, যার মস্তিষ্ক এত সচল, যার শারীরিক সক্ষমতা তাক লাগিয়ে দিল সারা মাঠকে, তার সম্পর্কে এই আগাম নেতিবাচক মন্তব্য কেন? কবীরকে সে হাড়ে হাড়ে চেনে, তাঁকে বুঝতে না দিলেও কবীর যে তার প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করেন তাও তিনি বোঝেন। তবে তার জন্য ইস্কুলের কোনও ছাত্রকে নাটকে অভিনয় করায় কখনও বাধা দেয়নি, বরং যখন পেরেছে এসে উপস্থাপনা দেখেছে, অভিনয়, নির্দেশনা বা আলোর প্রশংসা করেছে বেশিরভাগ সময়েই, বেশ খোলামনেই।  

 ২

কবীর সিংহির ছাদের ঘর।  

“তুমি আবার সিঁড়ি ঠেঙিয়ে ওপরে উঠতে গেলে কেন মা? সে না হয় আমি দেখছি। তা করেছে টা কী?” 

“কী আবার করবে? যা দামালপনা করে। তবে এবারেরটা একটু বাড়াবাড়ি বাপু! সটান রাজডাঙায় গিয়ে লোকের বাড়ির ঠাকুর ঘরে ঢুকে, দুধের বাটি উলটে, প্রসাদের থালা লণ্ডভণ্ড করে এলে গাঁয়ে চাউর হবে না?” 

“ঠাকুরঘরে হঠাৎ দুধের বাটি থাকবে কেন?” কবীর মুখ না তুলেই প্রশ্ন করেন।  

“রাখ তোর যুক্তি-তক্ক! পাড়া গাঁয়ে একবার রা পড়লে কত কতা রটে, কত রং চড়ে তা কি তুই বুঝিস না? সে বাড়ির মেয়ে হোক আর বেড়াল। আর ভেলোও তো আমাদের মেনি...” 

এবার কবীর না হেসে পারে না। “মেনি বলে এত কতা রটছে। সুর চড়ছে….”! 

বলে গেলাম। পরে বলিস না। এই নিয়ে একদিন যদি…,” বৃদ্ধা ছাদ পেরিয়ে সিঁড়ির দিকে অদৃশ্য হয়ে যান 

কবীর ডায়রিতে মন দেন। তাঁর অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ পড়ে রয়েছে, কিন্ত কাজটা করে উঠতে পারছেন না। এই জটিল কার্যসাধন তাঁর চিন্তাশক্তিতে কুলোচ্ছে না। তাঁর আপাত ঠান্ডা মাথায় একটু একটু করে উত্তাপ বাড়ছে। তার উপর অন্য চাপও রয়েছে। হরি সম্পর্কে যে বাড়তি কৌতূহল সৃষ্টি হবে, তা জানতেন, তাই তিমিরের ফোনে বিন্দুমাত্র অবাক হননিকিছু প্রশ্নের উত্তর আগাম ভেবে রেখেছিলেন, কিছু প্রশ্নের উত্তর তাঁকে এবার ঝট করে ভেবে ফেলতে হবে। উঠে পড়ে ফতুয়া ছেড়ে একটা কাচা ঢলঢলে পাঞ্জাবি গলিয়ে নেন কবীর। তারপর নিচে নেমে মোটা সোলের চামড়ার চটিটা পরে বেরিয়ে পড়েন লাল মাটির রাস্তায়। অশীতিপর মা কলতলায় কিছু ধোয়াধুয়ি করছিলেন, ছেলেকে বেরোতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “কখন ফিরবি রে কবু, গাড়ি নিয়ে যাচ্ছিস?” কোনও জবাব না দিয়ে কবীর হাঁটতে থাকেন উত্তর দিকেগাড়ি বলতে তাঁর মা তার এক বছর আগে কেনা লাল স্কুটিটা বুঝিয়েছিলেন। সেটা পড়েই থাকে সদর দরজার গা ঘেঁষে থাকা একটা পুরনো টিনের চালের নিচেই, সওয়ারির উদাসীনতায়। খাদান অবধি দেড়মাইল পথ হেঁটেই যাবেন, ঠিক করেই বাড়ি থেকে বের হয়েছেন কবীর মাস্টার।  

“ওটা কবীরের বেড়াল, আর ইউ শিওর?” স্ত্রীর তৈরি মালপোয়া প্লেট থেকে তুলে নিয়ে মুখে পুরে প্রশ্ন করলেন গজ। “না মানো তো তোমার মা আর ভূতোকে জিজ্ঞেস করে দেখো; ওই বেড়ালকে এই গ্রামে অনেকেই চেনে। গলায় আবার একটা মাদুলি না কী পরানো আছে শুনলুম, ওই চিহ্নি দেখেই হয়তো চিনতে পারে”। একটু ঝাঁঝিয়ে উত্তর দিলেন তাঁর স্ত্রী দেবযানী। গজ আর দেবযানী দুই ভিন্ন স্কুলে যথাক্রমে ইংরেজি আর ভূগোলের শিক্ষকতা করেন। বউয়ের উত্তর শুনে গজর ঠোঁটের কোণে হাসির ঝিলিক দেখা দিল। মৃদু স্বরে বললেন, “তা হতে পারে। কবীরটা উপর থেকে ভিজে বেড়াল আর ভেতরে ভেতরে ধুরন্ধর, পুষ্যিটাও সেই ধাত পেয়েছে”!  

এ প্রসঙ্গে একটা ছোট্ট ইতিহাস আছে, বর্তমানে তা যতই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাক না কেন। গজ-দেবযানীর বিয়ে হয়ে গিয়েছে পনেরো বছরের উপর, তাদের মেয়ে লীলাবতীর বয়স চোদ্দ, ছেলে শিবেনও এগারো পূর্ণ করে ফেলেছে। বর্তমানে একটু পড়তির দিকে হলেও গজ চৌধুরীরা এ তল্লাটের অন্যতম বর্ধিষ্ণু পরিবার। যাইহোক, একসময়ে তিমির-দেবযানী-কবীর একটা ত্রিকোণ পিরিতের কানাঘুঁষো চলত বটতলাগুলোতে। তিমির-দেবযানী আশনাই ছিল রীতিমতো, আর কবীর তলে তলে দেবযানীর পাণিপ্রার্থী ছিল। ছেলের মতি বুঝে কবীরের মা একবার দেবযানীর বাড়িতে সম্বন্ধ করতে যান। কিন্তু দেবযানীর পিতা, পোস্টমাস্টার শশধর মত দিতে পারেননি। কবীরকে তাঁর একটু খ্যাপাটে ধরনের ইস্কুল মাস্টার মনে হতো। আর মেয়ের যতই পিরিত থাক, যাত্রা-থিয়েটার নিয়ে মেতে থাকা বাউন্ডুলে তিমিরের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবেন না তিনি স্থির করেই রেখেছিলেন। চতুর্থ কোণ গজকে আমদানি করে ত্রিভুজকে চতুর্ভুজ করেন শশধরই। নতমস্তকে একদিন তাঁর বিশালাকার ছাতায় ঠকঠক করতে করতে পদব্রজে রাজডাঙার চৌধুরী বাড়ির দরজায় কড়া নাড়েন। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন মেয়ের হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাওয়ার সময় তোলা স্পেশাল ফটো। গজ মাস্টারের মা যা দেখে গদগদ হয়ে গিয়ে পাকা কথা দিয়ে বসেন। এর পরের মাসেই, পুরো তল্লাটকে ভূরিভোজ খাইয়ে গজ-দেবযানীর বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যায়। নিমন্ত্রিতদের তালিকায় শুধু বাদ গিয়েছিলেন তিমির। আর নিমন্ত্রণ রক্ষা করেননি শুধু কবীরের মা ও কবীর।  

দেবযানী শিক্ষিকা ও সুখী গিন্নি। তিমিরের সঙ্গে তাঁর আজও তলে তলে যোগাযোগ আছে। রাজডাঙায় শ্বশুরবাড়ি হলেও চাকরিসূত্রে রোজই রামবাজার যাতায়াত করেন তিনি। আজও খেলার মাঠে মিনিট দুয়েক তাঁদের ফুসুর-ফুসুর করতে দেখা গেছে। কিন্তু কবীরকে সেই আইবুড়ো বয়স থেকেই সযত্নে এড়িয়ে চলেন! কবীরের মাথা থেকেও এখন দেবযানী বিস্মৃত-প্রায় এক অধ্যয়। তাঁর মাথায় এখন অনেক চাপ। চাপের চোটে হাঁটার গতি বাড়তে থাকে। ছাতিম গাছের সারির মধ্যে দিয়ে হনহনিয়ে চলেছেন কবীর, গাছের ফাঁক দিয়ে পড়ন্ত বিকেলের আলো তাঁর দীর্ঘ ছায়া এঁকে দেয় লালমাটির রাস্তার উপর।  

এ তল্লাটের গ্রামগুলোয় এমন তিনটে ক্ষুরধার মস্তিষ্ক আছে যারা মোক্ষম জায়গায় হরিকে ধরে ফেলতে পারে। তাদের মধ্যে দু'জন যে আজ মাঠে ছিল, তার প্রমাণ কবীর পেয়েছেন। তবে তিমির এখনও ধোঁয়াশায়, এটা তিনি বুঝেছেন। আর রাধেশ্যাম বাবুর কাছ থেকে কবীর এখনও কোনওরকম প্রতিক্রিয়া পাননি। অর্থাৎ কিছুতেই আর নিশ্চিন্তে থাকা যাচ্ছে না। অন্ধকার খাদানের দিক থেকে এবার একটা ছায়ামূর্তি বেরিয়ে আসে।  

“খবর কী কর্তা?” ছায়ামূর্তি প্রশ্ন করে।  

“আজ রাতে ইমেজ পেয়ে যাব”; সংক্ষিপ্ত উত্তর দেন কবীর। “সেই অনুযায়ী মাস্টারপ্ল্যান...”। 

“কাজটা কবে হবে; হাতে কবে আসবে, বড় সাহেব তো; ওপরমহলের চাপ বোঝই তো…” 

আরে জটিল কাজে একটু সময় লাগে; ধৈর্য্য ধরতে বলোআমার ইয়েটা এনেছো তো…?” 

ছায়ামূর্তি একটা খয়েরি কাগজের খাম জামার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে বের করে, তারপর কবীরের ঈষৎ বাড়ানো হাতে চালান দেয়। “তৃতীয় কিস্তিযা বলেছিলেন তাই; বাকিটা কাজ হওয়ার পর”। কবীর খামটা পাঞ্জাবীর গুপ্ত পকেটে পুরে ফেলেন। ছায়ামূর্তি এবার শেষ প্রশ্ন করে, “ছেলে ঠিক আছে তো?” 

“হ্যাঁ”, বলেই কালবিলম্ব না করে কবীর উলটো দিকে হাঁটা দেন। তাঁর মস্তিষ্ককে এবার কম্পিউটারের মতো কাজ করাতে হবে, সব কিছু নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করতে হবে! অজান্তেই গুপ্ত পকেটে লুকনো খামের গায়ে একবার হাত বোলান! এতক্ষণে অন্ধকার পুরো গ্রাস করেছে রাঙামাটির গ্রামাঞ্চলকে। নিশ্চিন্ত বোধ করেন কবীর। আগামীকাল অমাবস্যা। পাঞ্জাবীর হাতা একটু গুটিয়ে হাতের বিশেষ ঘড়িটার একটা বিশেষ অক্ষর ও সংখ্যা মিশ্রিত সংকেতে বোতাম টেপেন। তারপর এগোতে এগোতে উত্তরের অপেক্ষা করতে থাকেনতিরিশ সেকেন্ডের মধ্যেই একটা ছোট্ট গ্রামীণ মানচিত্র ভেসে ওঠে ঘড়ির ডায়ালে, যার একটা বিশেষ জায়াগায় একটা লাল আলো জ্বলছে। কবীর সন্তর্পণে সেই দিকচিহ্ন অনুযায়ী হাঁটতে থাকেন। একটা পুকুরপাড় পেরিয়ে একটা ভাঙা মন্দির, কবীর তার কাছে গিয়ে ডাক দেন “হরি...”। এক বছর চোদ্দর বালকের ছায়ামূর্তি বেরিয়ে আসে। কবিরের ঠোঁটে হালকা হাসি ফুটে ওঠে, বালকের কাঁধে হাত রেখে বলেন, “চল, এখন আর কোনও ভয় নেই; দেখি ভেলোটা কী নিয়ে এল”! দু'জনে পাশাপাশি হাঁটতে থাকেন। 

আরও পড়ুন- লুকিয়ে থাকা রুটম্যাপ: সুমিত বন্দ্যোপাধ্যায়

পাশের ছায়ামূর্তিটি যে আড়চোখে তাঁকে নিরীক্ষণ করে চলেছে, তা অমাবস্যার আগের সন্ধের নিকষ কালো অন্ধকারে বুঝতে পারেন না কবীর। কিছু জটিল ডিসক্রিট ম্যাথামেটিক্সের অঙ্কের অ্যাপ্রোচ বা পন্থা বাতলাতে পেরে, কিছু ইলেক্ট্রনিক্সের সার্কিটের ব্যাখ্যা দিতে পেরে কবীর বড়জোর হরির সাময়িক মিডিয়েটর বা মধ্যস্থতাকারী হওয়ার সুযোগ পেয়েছে ওই দুই রহস্যময় বুড়োর কাছ থেকে। হরির সঙ্গেই এসছে দুটো রেডিয়াম ডায়ালের ঘড়ি, যার একটা এখন কবীরের হাতে, যার সাহায্যে হরির সঙ্গে সংকেত আদান-প্রদান করা যায়হরির গুণাবলী বা ক্ষমতার কিছুটা হদিশ সে পেয়েছে কিন্তু বাকিটা অমাবস্যার মতোই। কিন্তু যে তীব্র ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্খা তাঁকে চালিত করছিল, তাই অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার আগে তাঁকে ন্যূনতম ভেবে দেখতেও দিল না কিছু বিষয়ে 

পরদিন ভোর ছ'টা নাগাদ গজ-মাস্টারের বাড়ির পাঁচিলের বাইরের দিকে বাঁদিক ঘেষে ফণী মনসার ঝোপের কাছেই কবীরের প্রাণহীন দেহ আবিষ্কার করল চাকর ভূতো। সারা গ্রামে হুলুস্থুল পড়ে গেল। ভুবন ডাক্তারকে ঘুম থেকে তুলে ডেকে আনা হল! তিনি লাশ দেখে টেখে গভীর অবিশ্বাসের সঙ্গে মাথা নেড়ে বললেন, “সেরকম কিছু তো পাচ্ছি না! গায়ে কয়েকটা ছড়ে যাওয়ার দাগ আছে, কাঁটাঝোপে ঘষা লেগে হতে পারে! তবে হাজার হোক, মাঝরাতে রাস্তায় মৃত্যু তো, পুলিশ এসে পোস্টমর্টেম করবে!” সারা গাঁয়ে নানা গুজব ছড়িয়ে পড়ল আলোর গতিতে সবাই যেন রহস্য উপন্যাসের শেষ অধ্যয় রচনা করতে মত্ত। সব থেকে বেশি জমে ক্ষীর হল এই থিওরি যে, চাপা স্বভাবের কবীর সিংহি মনে মনে দেবযানীকে কামনা করে গেছেন দীর্ঘদিন, ভুলতে পারেননি। তাই তার শ্বশুরবাড়ির চৌকাঠে বিষ খেয়ে মরেছেন!  

এর মাইলখানেক দূরে বৃদ্ধ পুরুতমশাই নরহরি পণ্ডিতের উঠোনে ভেলোকে কৃতজ্ঞ চিত্তে একটা কালবোস মাছের টুকরো ভক্ষণ করতে দেখলেন তিমির। ঘটনার আকস্মিকতায় হন্তদন্ত হয়ে চৌধুরী বাড়ির দিকেই আসছিলেন, গুজবে কান দেওয়ার লোক তিনি নন। কিন্তু তাড়াহুড়োয় খেয়াল করলেন না, ভেলোর গলায় বাঁধা কালো সুতোর মাদুলি-মার্কা বস্তুটি কে যেন সযত্নে খুলে নিয়েছে। গজদের বাড়ির ঠাকুরঘর সংলগ্ন এক চিলতে বাগানে, কিশোরের পায়ের ছাপ দেখা গেল, যা দেবযানীর নাবালক পুত্রের পায়ের মাপের থেকে কিঞ্চিৎ বড়। আর সবার নজর যা এড়িয়ে গেল, তা হল বাঁ দিকের পাঁচিল ঘেঁষা আম গাছটার একটা ছোট ডাল উধাও হয়েছে। এছাড়া ঠাকুরঘরে, বাগানে, সারা বাড়িতে সব যেমনটা আগের রাতে ছিল, তেমনটাই আছে। স্থানীয় থানার দারোগা বিদ্যুৎবরণ নিচু গলায় ভুবন ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলছিলেন। গজকে দেখতে পেয়ে তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “পাঁচিলের গা দিয়ে কোনও বৈদ্যুতিন তার-ফার নেই তো? চোখে তো কিছু পড়ছে না। যাইহোক, বডি ময়নাতদন্তে পাঠাতে হবে। পেটে বিষ-টিষ কিছু যদি পাওয়া যায়!” তারপর একটু থেমে যোগ করলেন, “আমি আবার জানেন তো, সেন্ট-পারসেন্ট বিজ্ঞানমনস্ক। পাড়াগেঁয়ে গুজবটুজব ধাতে সয় না মশাই!” তিমিরের মাথায় অন্য সন্দেহ ঘুরছিল, দু'টি গ্রাম তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখেও হরির কোনও চিহ্ন পেলেন না। রাজডাঙা আর রামবাজারের ইতিহাস থেকে হরি কি চিরতরে মুছে গেল?  

কয়েক ঘণ্টা পর। মার্কিন মুলুকের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ো-ফিজিক্সের অধ্যাপক-গবেষক সাহেব খাঁ মধ্যরাতে একলা তাঁর স্টাডিতে বসে স্কচ হুইস্কিতে চুমুক দিচ্ছিলেন আর কী যেন ভাবছিলেন আনমনে। তাঁর ইনবক্সে একটা মেইল ঢুকল, মেইল-অ্যালার্টের শব্দে নড়েচড়ে বসলেন। রাত ঠিক বারোটা। সামনের খোলা ল্যাপটপে দেখলেন প্রেরক অজানা ব্যক্তিপ্রেরকের মিনিয়েচর ছবিতে এক বৃদ্ধের মুখ, আর সেই মুখে এক চিলতে ক্রূর হাসি। নামের জায়গায় কয়েকটা অ্যালফাবেট ও সংখ্যা! মেইলটা সাহেবের খাঁর মুখের চলতি ভাষায় লেখা। মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়তে শুরু করলেন,

জানি কী ভাবছ। কবীর তোমায় কিন্তু সব ঠিক বলেনি। জানি, নিজের বুদ্ধিতে কুলোবে না বলে অনেক কথা ও তোমার সঙ্গে ডিসকাস করত। তবে তোমাদের যৌথ বুদ্ধিতেও এ হরি-রহস্যের কিনারা করা সম্ভব হত না। দেখ ভাই, তোমরা কিছু অঙ্কের মেথডোলজি শিখেছ, পদার্থের কিছু তত্ত্ব-টত্ত্বও পড়েছ, তবে প্রয়োগের মাধ্যমে তাকে সেভাবে বিকশিত করেছ কি? তাই তোমাদের চিন্তাশক্তিরও সে বিকাশ হয়নি! নাও টেল মি, মিডিয়েটর যদি মাস্টার হয়ে উঠতে চায় তাহলে তার কী পরিণতি হওয়া উচিত? আর কেনই বা ওর সঙ্গে মাস্টার-স্লেভ সম্পর্ক তৈরির অপচেষ্টা করা বাপু? আমাদের যন্ত্র-মানুষও তো মানুষ! তার কিছু বিশেষ ফিলিংস আছে, যা কবীরের ঘটে ঢোকেনি! তোমাদের গ্রহের মানুষরা মাঝে মাঝে উচ্চাশায় অন্ধ হয়ে যায়; সিংহি-ব্যাটারও তাই হল! ও ভেবেই দেখল না ও নিজেই নজরদারিতে রয়েছে! হরি প্রথম দিন থেকেই ওকে ক্রমাগত অবজারভেশনে রেখেছে এবং সাংকেতিক ভাষায় আমাদের কাছে কবীর সম্পর্কিত বহু তথ্য প্রেরণ করে চলেছেএই অবজারভেশন ক্ষমতা কবীরের তুলনায় কয়েক হাজার গুণ বেশি! যা পেয়ে প্রথম দিনই আমাদের খটকা লাগে তোমার বন্ধুটি সম্পর্কে। আবার খুশিও হই; আমাদের ট্রায়ালের জন্য সাবজেক্ট আশাতীত হওয়াতে! প্রথম ট্রায়াল বলে আমরা ওর নিরীক্ষণ ক্ষমতা মিডিয়াম মোডে রেখেছিলাম, এবার সেটা আস্তে আস্তে বাড়াতে লাগলাম! ব্যস, গ্রামে কী চক্রান্ত চলছে বেরিয়ে পড়ল”। 

এ পর্যন্ত পড়ে সাহেব সামান্য ব্রেক নিলেন। সামনে পড়ে থাকা প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরালেন, উত্তেজনায় গলা শুকিয়ে আসছিল বলে হুইস্কির গ্লাসে একটা বড় চুমুক দিলেন। আবার পড়া শুরু করলেন, 

অবলা জীবের গলায় মাইক্রোক্যামেরা বেঁধে গজ মাস্টারের বাড়ির সিন্দুকের অবস্থান ট্র্যাক করে কবীর। ভেলোকে দিয়ে এই স্পাইং ও আগেও অনেকের বাড়িতে করিয়েছে, তবে কী উদ্দেশ্যে তা নিয়ে আমরা অহেতুক মাথা ঘামাইনি আর। যাইহোক, গজদের সিন্দুকের সোনাদানা, টাকাকড়ি যাই থাক, তার উপর অবশ্য কবীর বাবাজির কোনও লোভ ছিল না। ওর মূল মতলব ছিল একটা নীল নকশা ও জমির দলিল হাতানো আর তা এক বৃহৎ বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া! দুটোই পাথর-খাদান অঞ্চল সংক্রান্ত; গজর জ্যাঠামশাই বহু কাঠখড় পুড়িয়ে খাদানের প্রাকৃতিক ও জৈব সম্পদ সংক্রান্ত একটা রিপোর্ট ও নকশা তৈরি করান, নামী প্রতিষ্ঠানের জৈব-রাসায়নিক বিশেষজ্ঞদের দিয়ে। কবীর ও ওই তল্লাটের বিজ্ঞান চর্চা করা দু' চারজন বিষয়টা জানত, তবে ওই নকশা তাদের সম্পূর্ণ নাগালের বাইরে ছিলদলিলটাও ওই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের জমি-সংক্রান্ত, যার খবর কবীর সম্ভবত পায় ওই সংস্থার এক সরকারি দালালের মাধ্যমেখাদান অঞ্চলের যাবতীয় সম্পদ হস্তগত করার জন্য ওই সংস্থাটি মরিয়া, আর কিছু সরকারি হোমড়া-চোমড়া তাদের এজেন্টের কাজ করছে! কবীর সিংহি ছিল তাদের বিশ্বস্ত ঘুঁটি। হেঁ হেঁ, কিছু মানুষের লোভই তো তোমাদের সবথেকে বড় শত্রু! নকশা আর দলিল হাতিয়ে ওই সংস্থার হাতে তুলে দিলে কবীরের অ্যাকাউন্টে ঢুকত কয়েক কোটিআর আমরা কিনা প্রথমে ভেবেছিলাম স্রেফ বৈজ্ঞানিক কৌতূহল মেটাতেই ও পয়সা খরচ করে যন্ত্রপাতি আনিয়ে মিডিয়েটর হতে চাইছে! হরিকে হাতে পেয়েই সিংহির লোভ আকাশ ছোঁয়, চক্রান্তের জাল বুনতে শুরু করে। কিন্তু হরি মাত্র বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যেই ধরে ফেলে বিহিত করে দেয়। এবার বুঝলে কি হরির বিশেষ ক্ষমতাটা? ও কন্সপিরেসি ডিটেক্টর!  

যাইহোক, আমাদের ট্রায়াল সফল হয়েছে। তুমি আবার যা জানলে তা নিয়ে বিলিতি ইন্সটিটিউটে কোনও বেগড়বাঁই করতে যেও না যেনভালো থেকো। আর প্রয়োগের দিকে ঝোঁক বাড়াও, তাতে কিছু হলেও হতে পারে!” 

সাহেব সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে অ্যাশট্রেতে চিপে নিভিয়ে ফেলে দিলেন। বুড়োর মিনিয়েচর মুখের ছবির অভিব্যক্তি বদলে গিয়েছে, সেখানে এখন গভীর প্রশান্তি।  

সাহেব বারবার রিপ্লাই করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন!  

More Articles