বড়দিন : অলোকপর্ণা

Bengali Short Story: আমরা খিদে পেলে একে অপরের খাদ্য হব। তেষ্টা পেলে গলা ভেজাব আগুনে। নেশা জমাট বাঁধলে আমরা মেলায় যাব আর প্রচণ্ড বুদবুদ ওড়াব।

মৃদু কম্পনে বুঝলাম বিড়ালটা পিষে গেল।

মৃত বিড়াল পার করে গাড়ি এগিয়ে চলেছে শহরের দিকে। সেখানে কংক্রিট ব্রিজ আছে, আছে বিরিয়ানির দোকান, আছে ফিল্ম ফেস্টিভাল, আছে নাট্যোৎসবের প্রতিশ্রুতি, আছে নাট্যোৎসব উপড়ে তোলা কেক উৎসবের ভবিতব্য, আছে আলো, মাঠ, আছে বেয়াল্লিশ নামের পঁয়ষট্টি তলা একটা বিল্ডিং। পেটে এক মুখে আরেক নিয়ে শহরটা মদ্যপ অবস্থায় নদীর পাশে এলিয়ে পড়ে আছে।

গাড়িটা আমাদের প্রথমে নিয়ে যাবে ব্রেকফাস্ট খাওয়াতে। সেখানে আমরা বড়দিনের সকালে ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করে তবে বসার জায়গা পাব। তারপর এমন খাবার আমাদের প্লেটে এমন ভাণ করে সাজিয়ে দেওয়া হবে যে পরতায় না পোষালেও আমরা খাবারের সঙ্গে হাসিমুখে ছবি তুলব। এরপর আমাদের নিয়ে যাওয়া হবে চিড়িয়াখানায়।

তখন আমরা পেট ভরে বাঁদর, জিরাফ, শিম্পাঞ্জি, গণ্ডার, পরিযায়ী পাখি, বাঘ, কুমির আর শৌখিন গাধার মতো জেব্রা গিলব। গিলে ক্লান্ত হলে গাড়িটা আমাদের নিয়ে যাবে ভিক্টোরিয়ায়।

সেখানে যে পরী ঘোরার কথা দিয়েছিল, সে আর কখনও ঘুরবে না। পরীর না ঘোরা দেখব আমরা সদলবলে টিকিট কেটে। গাছভরা বাদুড় দেখব, তাদের উল্টে ঝুলে থাকা, একে অপরকে ডেকে ডেকে দেখাব। আমোদ পাব। আমোদ পেলে ভিড় ঠেলে বুক বাঁচিয়ে, পিঠ বাঁচিয়ে পালাব হাওড়া ব্রিজের দিকে।

আরও পড়ুন- কবিতা ও তার মাকড়সা: অলোকপর্ণা

দেখব, ব্রিজের নিচ দিয়ে এমন একটা নদী বয়ে যাচ্ছে যাকে পৃথিবী এক নামে চেনে আর শহরটা চেনে আরেক নামে। পেটে এক মুখে আরেক নিয়ে নদীটা শহরটার গা ঘেঁষে বখে যাচ্ছে।

তারপর আমরা দেখব ফুলের বাজার। দেখব, আগুনে রঙ নিয়ে গাঁদাফুলের সুগন্ধহীন ছাপোষা বেঁচে থাকা। ফুলের রূপ আর সুগন্ধের আত্মার মধ্যে দিয়ে এরপর গাড়িটা আমাদের নিয়ে যাবে প্রিন্সেপ ঘাট যেখানে গ্রিক আদলের স্তম্ভের পর স্তম্ভ দিয়ে একটা ছাদ ধরে রাখা হয়েছে অথচ কোনও দেওয়াল দেওয়া হয়নি। অতএব যে কেউ, যখন তখন, একটু দূর থেকেই উঁকি দিয়ে তার অন্তরাত্মা চেখে চলে যেতে পারবে নদীর তীরে।

সেখানে ছাপোষা নৌকো চড়ে, নৌবাহিনীর নৌকোও চড়ে। নৌকোয় চড়ে বসলে এমন একটা লাইফ জ্যাকেট দেওয়া হবে, যার আলগা বাঁধন থেকে থেকে আমাদের মৃত্যুর লোভ দেখাবে। অল্প অল্প করে, দুলে দুলে। যারা ভালোবাসায় নেই, তারা ভালোবাসার গান গাইব সেখানে জোর করে। আর মাঝি নৌকা বাইতে বাইতে থুতু ফেলবে নদীর জলে।

এরপর শহরের বুকে একটা খুনখার সন্ধ্যে নামবে।

আমরা খিদে পেলে একে অপরের খাদ্য হব। তেষ্টা পেলে গলা ভেজাব আগুনে। নেশা জমাট বাঁধলে আমরা মেলায় যাব আর প্রচণ্ড বুদবুদ ওড়াব। বুদবুদেরা মরে গেলে আমরা ওদের কথা ভুলে যাব, আমাদের মনেই থাকবে না যে একটু আগেও আমরা বুদবুদ ওড়াচ্ছিলাম আর ঠিক তখন মেলার জিলিপি খাব, ঘুগনিও। আমরা চাদর কিনব। চটি কিনব। একে অপরকে দেব উপহার, প্রতি উপহার।

আমরা একে অপরকে একটা ভাঙাচোরা দুর্গাপুজো দেব, একটা তাপ্পিমারা বড়দিন, একটা আত্মহত্যায় প্ররোচনামূলক একত্রিশে ডিসেম্বর।

আরও পড়ুন- জিহাদের বিষয়-আশয়: অভিষেক ঝা

তারপর একদিন গাড়ি আমাদের নিয়ে যাবে মিষ্টি হাবে। সেখানে গিয়ে আমরা যথেচ্ছ মিষ্টি খাব। হেসে গড়িয়ে পড়ব এর ওর গায়ে। পাশেই ইকো পার্ক যেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে নকল তাজমহল, নকল পিরামিড, নকল সব কিছু দেখতে পাওয়া যায় নামমাত্র মূল্যে।

এরপর গাড়ি আমাদের নিয়ে কোথায় যাবে ভেবে না পেয়ে ঘরে ফিরিয়ে আনবে। ফিরে এসে আমরা জামা কাপড় ছেড়ে ক্লান্ত মাথাটা বালিশের উপর ফেলে দিতেই একটা মৃদু কম্পনে বুঝতে পারব বিড়ালটা আমাদের গাড়ির তলায় পিষে যাচ্ছে।

একটু আগেই তাকে একছুটে রাস্তা পার হতে দেখা গেছিল। রাস্তার ওপাশে পৌঁছেই সে মনস্থির করে ফিরে আসার আর একটা মৃদু কম্পনের মধ্যে দিয়ে সে গাড়ির তলায় চাপা পড়ে।

বড়দিনের শেষে একটা মৃদু কম্পন বিছানায় আমাদের থেকে থেকে কম্পিত করবে। তবু আমরা চলা থামাব না। গতি কমাব না। বিড়ালের দেহের উপর দিয়ে চার চাকা নিয়ে আমরা এমন একটা শহর ঘুরে ঘুরে বেড়াব, যার জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে সকলের মতান্তর আছে।

 

More Articles