মুহাফিজ্ : অমিত ঘোষ
Bengali Short Story: আমার কানের পাশের দাগটায়, যেটা এতকাল জন্মদাগ বলে জেনেছি, সেটায় আচমকা ব্যথা শুরু হল। ডাক্তার দেখে গম্ভীর হয়ে গেলেন।
স্টেশনে নেমে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। পূর্বা এক্সপ্রেস দেড় ঘণ্টা লেট, এখন বাজে সন্ধে সাতটা। স্টেশনের বাইরে এসে একটা রিকশা ধরে বললাম, "স্টার হোটেল।" মাথা নেড়ে চালাতে শুরু করলেন রিকশাওয়ালা। এখানে আমার পরিচয়টা ছোট করে দিয়ে রাখি। আমি সৈকত দাস, বাড়ি কলকাতা। আমার একটা ছোট ব্যবসা আছে, বিভিন্ন টয়লেটারিজ প্রোডাক্ট সাপ্লাইয়ের ব্যবসা আর কী। এই কাজেই এসেছি বিহারের এই শহরে। বক্সার। কলকাতা থেকে প্রায় ছ'শো কিলোমিটার। বক্সার হলো সাবান ম্যানুফ্যাকচারের একটা বড় কেন্দ্র। সেই সূত্রেই আমার এখানে আসা। হোটেলে গিয়ে সমস্যায় পড়লাম, রুম নেই, সব ভর্তি। ম্যানেজার একটা প্রস্তাব দিলেন। হোটেলের পিছনে ওঁদের একটা আউটহাউজ মতো আছে, আজ রাতটা যদি সেখানে কাটিয়ে দিতে পারি। কাল সকালে একটা রুম খালি হবে। শরীরটা এত ক্লান্ত ছিল, তাতেই রাজি হয়ে গেলাম।
আউটহাউজটা ছোট একতলা বাড়ি। মাত্র দুটো ঘর। আমাকে একটা ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে হোটেলের কর্মী বললেন, "স্যার এই ঘরটা আপনার, অ্যাটাচড টয়লেট আছে। রাতে খেয়ে শুয়ে পড়বেন, বেশি ঘোরাঘুরি করবেন না।" কথাটা ভালো লাগল না, জায়গাটার কোনও সমস্যা আছে নাকি? তবে তখন আর অন্য কোনও রাস্তা নেই, ঘোরাঘুরি করবই বা কোথায়- এই তো ছোট্ট জায়গা। হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। সাড়ে ন'টা নাগাদ একজন এসে ঘরে খাবার দিয়ে গেল, খেয়ে শুয়ে পড়লাম। তারপর কখন যে ঘুম এসে গেছে জানি না।
ঠক্ ঠক্ ঠক্
দরজায় টোকার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। ঘড়ি বলছে রাত একটা। চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, "কৌন?"
উত্তরে আবার টোকা পড়ল দরজায়। বাধ্য হয়ে দরজা খুলে দেখি এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছেন। সালাম করে বললেন, "সাব বেগম সাহেবা আপনার একটু সাহায্য চান।"
"মানে? কে বেগম সাহেবা? কী সাহায্য?" আমি আকাশ থেকে পড়লাম।
বৃদ্ধ লোকটি শান্তভাবে বললেন, "দয়া করে যদি এ ঘরে একটু আসেন!" বলে পাশের ঘরের দিকে ইশারা করল। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম ঘরের দরজা খোলা, ভেতরে আলো জ্বলছে। এঁরাও কি রুম না পেয়ে এই ঘরে এসে ঢুকেছেন! নিশ্চয়ই ভদ্রমহিলা কোনও অসুবিধায় পড়েছেন। দরজায় নক করে ঘরে ঢুকলাম। প্রথমেই চোখ পড়ল ঘরের সাজসজ্জার দিকে। এত পুরনো আসবাব! আর ঘরে মোমবাতি জ্বলছে কেন, ইলেকট্রিক বাল্ব কী হল!
হঠাৎ একটা গলার স্বর শুনে চমকে উঠলাম। "জনাব", এক মহিলার গলা। আভিজাত্যপূর্ণ সুমিষ্ট গলা, অথচ কথা যেন ভেসে আসছে বহুদূর থেকে। একটু ইতস্তত করে এগিয়ে গেলাম। দেখি সামনে পালঙ্কের ওপরে একজন মানুষ শুয়ে আছেন, আর তার পাশেই বসে আছেন ওই মহিলা। অবশ্যই মুসলিম, বোরখা পরে আছেন।
আরও পড়ুন- গৃহপ্রবেশ : সোহম দাস
"আপনাকে কষ্ট দিলাম, সেজন্য মাফি মাংছি।" আবার সেই বাতাসে ভেসে আসা স্বর, থমথমে রাতে অন্ধকার ঘরে সেই আওয়াজে কেন জানি না আমার বুক কেঁপে উঠল। মনে হল এ যেন এক অপার্থিব জগতে ঢুকে পড়েছি।
"আমার একটা গাড়ি দরকার, আপনি যদি একটু ব্যবস্থা করে দিতে পারেন।"
কোনওরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, "এত রাতে গাড়ি!"
"জ্বি জনাব। নবাব বে-তবিয়ৎ আছেন, আমি ওঁকে নিয়ে আজ রাতেই শহর ছাড়তে চাই।"
"নবাব! কোন নবাব?"
বিছানায় শায়িত লোকটিকে দেখিয়ে মহিলা বললেন, "ইনি, আমার খসম।"
"ফতেমা!" আমি আর কিছু বলার আগেই লোকটা বিছানায় উঠে বসে গর্জে উঠল, "কে এই বেৎমিজ? আমাকে চেনে না - সুবে বাংলার নবাব মীরকাশেমকে?"
"শান্ত হন, আপনি অসুস্থ। এ অবস্থায় যে করেই হোক আমাদের শহর ছাড়তে হবে। তাই গাড়ির ব্যবস্থা করার জন্য একে ডেকেছি।"
"তার মানে, আমাকে পালাতে হবে?"
"আর কোনও উপায় নেই নবাব।"
আমার বোধশক্তি ক্রমশ লোপ পাচ্ছিল। থমথমে রাতে সেই অনুজ্জ্বল আলোকে আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম।
এবার 'নবাব' বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, তারপর গর্বোদ্ধত পদক্ষেপে এগিয়ে এলেন দরজায় কাছে। আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজের মনেই যেন বললেন, "জানি। যেতে আমাকে হবেই। আজকের লড়াইতে আমাদের পুরোপুরি হার হয়েছে। সুজা-উদ-দৌল্লা আর শাহ্ আলম আগেই ভেগেছে। আমি জানতাম, এটাই হতে চলেছে। তবু একবার শেষ চেষ্টা করে দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু না, কোম্পানির বাহিনীর অসাধারণ রণকৌশলের কাছে আমাদের সম্মিলিত চেষ্টাও ব্যর্থ হল। এবার সব শেষ! ওই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবার বাংলার মসনদে বসবে, তারপর রাজত্ব করবে সারা ভারতে।" এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে নবাব চুপ করলেন। অক্টোবর মাসের শীতল রাত যেন পাল্লা দিয়ে নীরবে কেঁদে চলল।
হঠাৎ সেই বৃদ্ধ লোকটি কোত্থেকে যেন ছুটে এলেন, চোখে অপরিসীম আতঙ্ক। "হুজুর, আপনাকে এক্ষুণি যেতে হবে। ওরা আসছে।"
নবাব চমকে উঠলেন, "এখানে? জানল কী করে?"
আর কোনও কথাবার্তার আগেই শোনা গেল বন্দুকের গর্জন, ওই বৃদ্ধ মুহূর্তের মধ্যে রক্তাপ্লুত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। তারপর কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেখানে এসে দাঁড়াল এক দীর্ঘদেহী ইংরেজ। তার পিছনে আরও কয়েকজন। এদের সবারই পরণে অষ্টাদশ শতকের ইংরেজ বাহিনীর পোশাক। সামনের লোকটির দিকে তাকিয়ে নবাব সবিস্ময়ে বললেন, "মুনরো!"
"ইয়েস, আই অ্যাম হেক্টর মুনরো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লোকাল রিপ্রেসেন্টেটিভ, আজকের যুদ্ধে ইংরেজ বাহিনীর জেনারেল। ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট, নবাব মীরকাশেম। তোমাকে ক্যালকাটায় নিয়ে যাওয়া হবে। গভর্নর ভ্যান্সিট্টার্ট ওয়ান্টস টু পুট ইউ আন্ডার ট্রায়াল - ফর বিট্রেয়িং কোম্পানি।"
নবাবের চোখে যেন আগুন জ্বলে উঠল - "হ্যাঁ, আমি বিট্রে করেছি, কিন্তু কোম্পানির সঙ্গে নয়। আমি বিট্রে করেছি দেশের মানুষের সঙ্গে, আজ থেকে সাত বছর আগে, পলাশির প্রান্তরে। সেদিন যদি আমরা সিরাজের সঙ্গ দিতাম, তোমরা এই অবস্থায় পৌঁছতে পারতে না। কিন্তু এখনও এর শেষ হয়নি, আমি আজ চলে যাচ্ছি, কিন্তু ফিরে আসব।"
"ইউ আর গোয়িং নোহোয়্যার, নবাব। নোবডি ক্যান হেল্প ইউ।"
মুনরোর হাতে দেখলাম এক পুরনো চেহারার পিস্তল, সেটা পয়েন্ট করা নবাব এবং বেগমের দিকে। মুহূর্তের মধ্যে আমার মাথায় যেন আগুন জ্বলে উঠল, আমি ইংরেজ বাহিনীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, তারপর মুনরোর চোখে চোখ রেখে বললাম, "ইউ আর রং, জেনারেল। কেউ না থাকুক আমি আছি। নবাব, আপনি বেগমকে নিয়ে বেরিয়ে যান, আমি এদের দেখছি।" বলেই মুনরোর হাত থেকে পিস্তলটা এক ঝটকায় ছিনিয়ে নিয়ে তার মাথায় চেপে ধরলাম। এক নিমেষে পরিস্থিতি পাল্টে গেল, ইংরেজরা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। নবাব সেই সুযোগে বেগমের হাত ধরে বাইরে বেরিয়ে পড়লেন। তারপর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ঘোড়াটির দিকে এগোলেন।
মুনরো হিসহিসে কণ্ঠে বলল, "ইউ আর গন, ইয়ং ম্যান।" পরক্ষণেই পিঠে এক অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব করলাম, এক ইংরেজ সৈন্য তার বন্দুকে লাগানো বেয়নেটের ছুঁচলো ডগা আমার পিঠে ঢুকিয়ে দিয়েছে। ব্যথা অগ্ৰাহ্য করে চেঁচিয়ে উঠলাম, "নবাব, জলদি।" মুহূর্তের অসতর্কতায় মুনরো পিস্তলটা আমার হাত থেকে কেড়ে নিল, তারপর পাগলের মতো আদেশ দিল, "গেট দেম।" কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। ঘোড়া তার সওয়ারিদের পিঠে নিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল।
মাটিতে লুটিয়ে পড়া অবস্থায় আমি হাসতে শুরু করলাম, "নবাব চলে গেছেন। ইউ আর ডুমড।"
মুনরো চেঁচিয়ে উঠল, "হু আর ইউ ব্লাডি নিগার?" পিস্তলের ঠান্ডা নলটা কানের পাশে চেপে বসেছে।
বলতে চাইলাম, "সৈকত"। কিন্তু মুখ দিয়ে বেরোল, "শওকত। নবাবের মুহাফিজ, আপনাদের ভাষায় বডিগার্ড।"
কানের পাশে একটা পিস্তলের আওয়াজ, আর মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা। চিরঘুমে ঢলে পড়ার আগে অনেক দূর থেকে কিছু শব্দ ভেসে এল। "শওকত, মেরা শের, তোকে সুবে বাংলার নবাব মীরকাশেমের কুর্নিশ। বক্সারের লড়াই শেষ নয়, আমি ফিরে আসব, আবার লড়ব এই ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে। এটা এই পলাতক নবাবের ওয়াদা।"
ঠক্ ঠক্ ঠক্... ঘোড়ার খুরের আওয়াজ ম্লান হয়ে এল, আর সেই সঙ্গে বিলুপ্ত হয়ে গেল আমার চেতনা, আমি চোখ বুঁজলাম, কিন্তু কানের মধ্যে, মাথার মধ্যে কেবলই সেই আওয়াজ, ঠক্ ঠক্ ঠক্...।
আরও পড়ুন- বড়দিন : অলোকপর্ণা
ঠক্ ঠক্ ঠক্...!
হঠাৎ ঘুম ভেঙে ছিটকে উঠলাম বিছানায়। দরজায় আবার আওয়াজ। ঘড়িতে দেখলাম সকাল সাতটা। দরজা খুলে দেখি হোটেলের সেই কর্মী, রুম খালি হয়েছে, তাই ডাকতে এসেছেন। আমার চোখ পড়ল পাশের ঘরের দিকে, দরজা কালকের মতোই বন্ধ। জিজ্ঞাসা করাতে জানালেন, ওই ঘরটায় বিশেষ কেউ আসে না, মাঝেমধ্যে নাকি রাত্রিতে নানারকম আওয়াজ পাওয়া যায়, ব্যস আর কিছু জানা নেই।
কলকাতায় ফিরে এসে ব্যাপারটা মনের ভুল বা স্বপ্ন ভেবে উড়িয়ে দিতে পারতাম, বাধ সাধল একটা ব্যাপার। আমার কানের পাশের দাগটায়, যেটা এতকাল জন্মদাগ বলে জেনেছি, সেটায় আচমকা ব্যথা শুরু হল। ডাক্তার দেখে গম্ভীর হয়ে গেলেন।
জিজ্ঞাসা করলেন, "কতদিন আগে এটা হয়েছিল?"
"মানে?"
"মানেটা আপনি ভালই বুঝতে পারছেন সৈকতবাবু। এটা একটা পুরনো গুলির দাগ। জন্মদাগের ব্যাপারটা আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।"
আমি ধরা গলায় বললাম, "আর ইউ শিওর?"
"অ্যাবসোলিউটলি। এটায় এখন নতুন করে ইনফেকশন হয়েছে; বাট ইয়েস, ইট'স আ বুলেট উন্ড। যাক চিন্তার কারণ নেই, এই ওষুধগুলো এখনই..."
আমি আর শুনতে পেলাম না। কোথায় যেন হারিয়ে গেলাম। মানসচক্ষে দেখতে পেলাম প্রায় আড়াইশো বছরের পুরনো এক দৃশ্য। রাতের অন্ধকারে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির সৈন্যদের সামনে লুটিয়ে পড়ে আছে এক তরুণ যোদ্ধা, শরীর রক্তাক্ত, আর কানে ঠেকে আছে ইংরেজ সেনাপতির ফ্লিন্টলক পিস্তল। তার মুখটা আমার খুব চেনা, প্রতিদিন আয়নায় দেখতে পাই। ২০২১-এর সৈকত অথবা ১৭৬৪-র শওকত, বক্সারের যুদ্ধে পরাজিত নবাব মীরকাশেমের মুহাফিজ্।