থমকে আছে চোখের নীচে : স্বাগতা চৌধুরী
Bengali Short Story: সন্দীপও মানি আর বাবিনকে পরবর্তী আঠাশ বছর ধরেও কিছুতেই বোঝাতে পারেনি যে, সে কোথাও যায়নি, ওখানেই ছিল।
ঘুম যখন ভাঙল তখন জানলার পর্দার ফাঁকটুকুও অন্ধকার। তিথি উঠে চোখেমুখে জল দিয়ে, জল খেয়ে, চুলে ঝুঁটি বেঁধে, নাইটি চেঞ্জ করে, কেপ্রি আর টপ গলাতে গলাতে তাকিয়ে দেখল, পর্দার ফাঁকের অন্ধকার স্বচ্ছ হয়ে উঠছে। পর্দা সরিয়ে বারান্দায় এল তিথি। সামনেই সি বিচ। পুরীর সৈকত এই ভোর সাড়ে তিনটেতেও নির্জন নয়। এই সৈকতের চরিত্র আলাদা। জীবনানন্দের লাইন মনে পড়ে। "চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন"। সমুদ্রে দাঁড়িয়ে সৈকতের দিকে উল্টোপানে তাকালেও একটা সমুদ্র দেখা যায়। ভীষণ প্রাণবন্ত জীবন। নড়ছে, চড়ছে, ঝিমিয়ে পড়ছে, উল্লাস করছে, হাঁপিয়ে পড়ছে, আবার ঢেউ উঠছে। বিপুল বিশাল তরঙ্গ। গোয়া গেছিল তিথি হানিমুনে। আরও আগে বকখালি, দিঘা বন্ধুদের সঙ্গে। কিন্তু এই প্রচণ্ড জীবনের ব্যস্ততা, এই উৎসব, সমারোহ আগে দেখেনি। ঘরের দিকে মুখ ফেরাল তিথি। মানি ঘুমিয়ে আছে টিপলুকে জড়িয়ে। নভেম্বরের শুরু। হালকা শীতের আমেজ। ব্লু স্টোলটা টেনে জড়িয়ে মানির কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, বেরোচ্ছি। তারপর দরজা টেনে দিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে সোজা বীচে।
এত ভোরেও বেসাতি শুরু হয়ে গেছে। শ্রীক্ষেত্র আদতে বাণিজ্য ক্ষেত্র। সোনালি বালির উপর একটা ছোটখাটো শহর। অ্যাসটেরিক্সের কমিক বইয়ের ছবিতে যেমন দেখা যায়। মাছভাজার আঁশটে গন্ধ, খেলনা, বেলুন, ব্যাগ, ছাতা, জুতো, বাঁশি, উট, ঘোড়া, কুকুর, বাঁদর, মানুষ, ঝিনুক, স্টারফিস, বেশ জমকালো ব্যাপার। সবচেয়ে মিঠে ব্যাপার হচ্ছে, এখানে মাঝে মাঝেই, শাঁখ বেজে ওঠে সমুদ্রের গর্জনের সঙ্গে মিলিয়ে। এই ভোরেও মাথায় গামছা বেঁধে ছেলেরা ঘুরছে হাতে থলে নিয়ে, শাঁখ, মুক্তো, পাথর বেচবে বলে। তিথি হাঁটল খানিক এলোমেলো। ঠান্ডা হাওয়ায় ভোরের শিরশিরে আমেজ নিল। তার পর বালিতে উবু হয়ে বসে দরাদরি করে একটা দক্ষিণাবর্ত শঙ্খ কিনল।
দক্ষিণাবর্ত শঙ্খ মঙ্গলদায়ক। সময় বদলায়। শুভ সংবাদ আনে। মানিকে দিতে হবে। মানির অবশ্য বক্তব্য, তাদের সময় থমকে গেছে।
দু'বছর আগে অ্যাক্সিডেন্টে সন্দীপের মৃত্যুর পর মানি সবকিছু থামিয়ে দিয়েছে, বাবিনও। বেড়ানো, সাজগোজ, মেলামেশা, পুজোআচ্চা সবই। এই পুরী তাদের আসার কথা ছিল তিন বছর আগে। সন্দীপের নামে সংকল্প করা ছিল। এই দু'বছর কোনওভাবেই রাজি করানো যায়নি মানি, বাবিনকে। বাড়ির সর্বত্র, কোণায় কোণায় সন্দীপের ছবি, ল্যাপটপ, ঘড়ি, অর্ধেক শেষ হওয়া ল্যাভেন্ডারের বোতল, তোয়ালে এমনকী তিথির ড্রেসিং টেবিলে সিঁদুরদানিটা পর্যন্ত একইরকম রাখা আছে। শুধু কোনওকিছুর ব্যবহার হয় না। যেন সন্দীপ ট্যুরে গেছে। কোনওদিন সকালে উঠে আগের মতোই চোখ খুলে দেখবে, ট্রাভেল ব্যাগ কাঁধে নিয়ে সন্দীপ হাজির। একদিনের বাসি দাড়ি গালে নিয়ে। রাতজাগা সফরে চোখ দুটো ক্লান্ত।
টিপলুর পাঁচ বছর হল। তাই পুরী বলেই জোর করে এদের নিয়ে এসেছে তিথি। পুরী, কোণারকে এই নিয়ে নয় বার এল মানি। এই প্রথমবার এল সন্দীপ ছাড়া। সি বিচে দাঁড়িয়ে তিথি দেখেছে মানির চোখে উদভ্রান্ত দৃষ্টি। যেন এখানে এসে সন্দীপকে দেখতে পাবে। সন্দীপের ছোটবেলা যেন এখানেই কোথাও আছে। অবশ্য মুহূর্তের জন্য, তারপরই মানি ব্যস্ত টিপলুর দুরন্তপনা সামলাতে।
আরও পড়ুন- আয়না ভবন : সুমিত বন্দ্যোপাধ্যায়
এদের নিয়ে বেরোলে অন্য কিছু নজর করা যায় না। তিথি তাই একা বেরিয়েছে সমুদ্রের অপূর্ব ভোর দেখতে। সোনারঙ চুঁইয়ে, গলে গলে টপ টপ পড়ছে আকাশ থেকে ধূসর জলে। রাসপূর্ণিমার মেলা চলছে এখন। তুমুল হইচইয়ের মধ্যে টপ করে সূর্য উঠে গেল, গোল বিরাট কমলালেবুর মতো। তিথি একটা রিকশা নিয়ে চলল জগন্নাথ মন্দির। ঢোকার আগে জুতো, ছাতা, ফোন সব রেখে যেতে হবে। জুতো রাখল। ফোন তিথি নিয়েই বেরোয়নি। এমনিতেও টিপলু কাল বিচ থেকে এসে ফোনটাকে নাগালে পেয়ে বাথরুমে কলের জলে স্নান করিয়েছে। বক্তব্য খুবই সরল। ওকে গা থেকে বালি ছাড়ানোর জন্য, বীচ থেকে এসে বাথরুমে কলের নীচে নাওয়ানো হচ্ছে। সুতরাং, ফোনও একই যুক্তিতে বীচ থেকে এসে স্নান করবে। মানির তর্জন, টিপুর ঠোঁট ফোলানো, কান্নাসহ চিৎকারে গমগমে বাথরুমের বেসিনের টইটই সাবানজলের সমুদ্রে, ভাসমান মোবাইল ও সঙ্গী পার্সটিকে কোনওরকমে উদ্ধার করে, ব্যাটারি খুলে, দু'ঘণ্টা ধরে রোদ্দুরে শুকোনোর পর ফোন চালু হয়েছে, কিন্তু ডিসপ্লেটার ব্যাকগ্রাউন্ড পুরো কটকী শাড়ির ডিজাইন হয়ে গেছে। টাকাপয়সাগুলো খানিক রোদে এটা ওটা চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল, তার পর ৫০০ আর ২০০০-এর নোটগুলো হোটেলের নীচের চায়ের দোকানের হিটারে সেঁকে আনা হয়েছে। টিপলু সারাদিন কিছু না কিছু দুষ্টুমি করতেই থাকে। প্রচণ্ড মনোযোগ চায়। সন্দীপও ঠিক এরকমই ছিল। সবাইকে থাকতে হবে, ওর সঙ্গে। হইচই করে থাকবে, জুড়ে জুড়ে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে।
তিথির হঠাৎ মনে হল সে একটা অন্য সময়ে চলে এসেছে। মহাভারতের যুগে। অদ্ভুতদর্শন, বয়স্ক অথবা তরুণ পাণ্ডারা রঙিন সম্বলপুরী ধুতি আর অঙ্গবস্ত্র জড়িয়ে, কপালে, বাহুতে তিলক কেটে ঘুরছে। ভিখিরি, পাগল, চোর, ভক্ত মিলিয়ে একটা পৌরাণিক, সমান্তরাল জগৎ। পুরীর মন্দির, লিঙ্গরাজ সবই রথের আকৃতি। মানির বক্তব্য অনুযায়ী, সবই মহাকাল, আদতে সময়কে ধরতে চাইছে। পুরনো মন্দিরসজ্জায় সব জায়গায় যুগের পরিবর্তনের চিহ্ন। মূলমন্দির আর নাটমন্দির ছাড়া অন্যগুলো সম্ভবত পরে তৈরি। নতুন মুখ। ভগবানের চেহারা চরিত্র ও আলাদা। বেলেপাথরের মেঝে থেকে ঠান্ডা উঠছিল। তিথি পুজো দেবে না এখন। ঘুরে ঘুরে সবটা দেখবে। মুক্তিমণ্ডপ বলে খোলা একটা উঁচু জায়গা রয়েছে দালানে। কালো, লম্বা, চিত্রিত থাম দিয়ে ঘেরা। সেখানে সার দিয়ে বয়স্ক পাণ্ডারা স্হবির হয়ে বসে বৃদ্ধ বাজপাখির মতো। শিকারি দৃষ্টি ঘুরছে দালানের উপরে। একজনকে দেখলে ওরই মধ্যে বসে শৃঙ্গার করছে। ছোট হাত আয়না দেখে দেখে তিলক কাটছে হলুদ রঙে। বাহুতে, কণ্ঠে আঙুল দিয়ে আঁকছে মঙ্গল চিহ্ন। এক কাঁচি হলুদরঙ, মন্দির পাড় ধুতি পরা, সুকুমার মুখ দেখা গেল। এ বোধহয় ট্রেনি। ট্রেনিং শেষে এও কুটিল চাহনির জ্ঞান বৃদ্ধ হয়ে যাবে। তিথি নিঃশ্বাস ফেলল। লিঙ্গরাজে কাল একটি ছেলেকে দেখেছিল। বয়স একুশ-বাইশ হবে। অল্প দাড়ি, পনিটেল। কটকি উড়নির ফাঁকে হাতে, বুকে, ঘাড়ে উঁকি মারছে ভয়াল দর্শন উল্কি। কানে হিরের স্টাড, গলায় চেইন, আঙুলে বড় বড় পাথরের গণ্ডা সাতেক আংটি, কব্জিতে চওড়া সোনার ব্রেসলেট। ফর্সা রঙ, শক্ত চোয়াল, আর ওই শকুন চাহনি। ওকে ওই কটকি শাড়ি ছাড়িয়ে জিন্স পরালে দিব্য রকস্টার। হাঁ করে দেখছিল তিথি। মানি টেনে সরিয়ে আনল।
- করছ কী, এরা সব পুণ্যবানের বংশধর। দ্বাপরে কৃষ্ণের সখা ছিল পুরীর পাণ্ডারা। দেবতাজ্ঞানে পুজো করতে হয়। তিথি চলে এল ঢোঁক গিলে। পুজোটুজো কঠিন ব্যাপার। তিথির পাপী চোখ ব্যবসাই দেখে, ধর্মের ব্যবসা। অবশ্য সৌম্যদর্শন, সাধুবাবা টাইপ পূজারিও আছেন। যাদের দেখলে অলৌকিক মঙ্গল প্রভায় বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়, আবার হয়ও না।
ভ্রমণে কোনও গাইড নেয়নি তিথিরা। নেবে কী? জগন্নাথ সংক্রান্ত সমস্ত কাহিনি মানির ঠোঁটস্থ, কণ্ঠস্থ। মন্দির কী করে হল, রাজা ইন্দ্রদুম্ন্য, বিশ্বকর্মা, জগন্নাথের ভোগ সংক্রান্ত গল্প সব, সব। জগন্নাথের দৃষ্টিভোগ হয়। বিশ্বকর্মা অর্ধসমাপ্ত মূর্তি বানিয়ে চলে গেছেন। হাত নেই, পা নেই। ভোগ হয় প্রহরে প্রহরে, ছাপান্ন আইটেম দিয়ে। এই ভোগেই পাণ্ডাদের বৃহৎ সংসার প্রতিপালিত। এখানে গল্পে, সুভদ্রা হচ্ছে সমুদ্রের বউ। সুভদ্রাকে নিয়ে যাবে বলে সমুদ্র অগুণতি ঢেউ নিয়ে আসে। আর সুভদ্রা, সমুদ্রের তর্জন গর্জনে ভয় পেয়ে দুই দাদার মধ্যে লুকিয়ে পড়ে। সমুদ্র ফুঁসে উঠলে, ঝড় এলে জগন্নাথ গিয়ে সমুদ্রকে বলেন শান্ত হতে। ঢেউ তখন ফিরে যায়। এই অবধি শুনে তিথি নড়েচড়ে উঠল।
আচ্ছা ভাই, বলেন তো ফণী ঝড়ে যখন পুরীধাম তছনছ হয়ে গেল, তখন জগন্নাথ ঠিক কী করছিলেন।
মানি গল্পটা গাড়িতে বলছিল টিপলুকে। এক মিনিট বাঙ্ময় নৈঃশব্দের পর গাড়ির ড্রাইভার প্রকাশ ভাই, ওড়িশার অধিবাসী গোমড়ামুখে বললেন, পাপ পূর্ণ হয়েছে। প্রলয়কাল আসন্ন, এসব তারই লক্ষণ।
মানি চোখ পাকিয়ে, ঠোঁট টিপে তাকাল তিথির দিকে। তিথি কুশভদ্রার মোহনা দেখছিল জানলা দিয়ে। ধূ ধূ বালি, স্থির, চকচকে, রুপোলি জলধারা, বালির দু'ধারে পাড়ের মধ্যে দিয়ে এঁকে বেঁকে সমুদ্রে মিশেছে, ছায়ারঙ দিগন্তে। অপার্থিব সৌন্দর্য। এত ধীর, গম্ভীর রূপের সামনে ধর্ম, জিরাফ সবই ম্লান। দেখা আর ফুরলো না।
কলকাতায় মায়ের কাছে কিছুদিন আয়ার কাজ করেছিল রেখা বোষ্টমী। গুণী মানুষ। সারাদিন ছটফটিয়ে কাজ করে সন্ধ্যাবেলায় গুণগুণিয়ে হরিণাম করত। চিকন গলায় গানও গাইত মিঠে। সে বলত, এত রূপ দেখলাম নিধি, দেখা আমার ফুরাইল না। এই কথাটা খুব কানে বেজেছিল তিথির। সত্যিই তো, দেখা ছাড়া আর কীই বা করার আছে। বাবা মা হুঁশ হওয়ার আগে থেকেই নেই। কাকা বাংলাদেশ থেকে বিক্রি করে এপারে পাঠিয়েছিল। বর ফেলে রেখে পালিয়েছে। তিন ছেলে-মেয়ে একাই বড় করল। ছেলেটা জেলে। বড় মেয়ের স্বামী পালিয়েছে। ছোট মেয়েটা আত্মহত্যা করেছে। সব দুঃখ বুকে নিয়ে রেখা বেঁচে আছে। চোখ মেলে দেখছে মাধবকে। কীসের আশায় কে জানে!
তিথি খুঁটিয়ে দেখছিল মন্দিরের গায়ের কয়েকশো বছরের পুরনো পাথুরে কারুকাজ। পাণ্ডারা তীর্থযাত্রীদের দাঁড় করিয়ে গল্প শোনাচ্ছে। তিথি খানিক শুনল। একাদশী ঠাকুরকে বেঁধে রেখেছে মন্দিরের পাশেই। পুরীতে একাদশী নাস্তি। ননীচোরা কৃষ্ণ, বেনুগোপাল কৃষ্ণ, ধেনুগোপাল এক কেষ্টরাজারি শতেক বাহার।
এই আধিপৌরাণিক দালানে অনেক বছর আগে হারিয়ে গেছিল সন্দীপ। মন্দিরের উপরের চাতালে ঘুরছিল মানি আর বাবি। পাণ্ডারা এখন যেমন, তখনও তেমনই ছিল। হাত পা নেড়ে পুরীর পবিত্র ইতিহাস বোঝাচ্ছিল। সিংহ দরজার কাছে ঘুরছিল সন্দীপ। মানি অনেকবার বলাতেও কিছুতেই উঠতে রাজি হয়নি। বাচ্চার মেজাজ, কী আর করা। মানি তখন প্রবল ভক্তিমতী। পাণ্ডার বক্তৃতা শুনতে শুনতে আড়চোখে দেখছিল, ছেলে নীচে কোথায় ঘুরছে। পলকের ফাঁকে, দু' মিনিটের ব্যবধানে তাকিয়ে দেখে ছেলে নেই। নেই তো নেই। সিঁড়ির নীচে, গলতায়, সিংহ দরজার ওপারে, কোথাও নেই। সিঁড়ির ধার বেয়ে ছেলে উঠছিল। দেওয়াল বেয়ে উঠে, শ্মশানের দিকে কিংবা রান্নাশালের দিকে, কিংবা মূল মন্দিরেই চলে গেছে হয়তো। পাণ্ডা, মানি, বাবিন উদভ্রান্তের মতো ছুটছে এদিক ওদিক। মন্দিরে ভিড় বাড়ছে ক্রমশ। আর এইটুকু জায়গা, অল্প সময়, এর মধ্যে বাচ্চা যাবেই বা কোথায়। প্রায় ১৫ মিনিট পর, মানি যখন পাথরে মাথা কুটতে উদ্যত, ছেলে তখন হেলেদুলে সিংহ দুয়ারের কাছ থেকে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল। পাণ্ডাই দেখে চিৎকার করে ওঠে প্রথমে। তার পর বাবিনের একটি প্রবল চড়। হতচকিত সন্দীপের মুখ, মানির প্রবল কান্না, পাণ্ডা আর অন্য লোকজনের হই হই মিটিয়ে বাইরে আসার পর আট বছরের সন্দীপের আশ্চর্য উক্তি, তোমরা কোথায় ছিলে? আমি তো এখানেই ছিলাম।
বড়রা যেহেতু বাচ্চাদের কথা কখনই তেমন বিশ্বাস করে না, সেইজন্য সন্দীপও মানি আর বাবিনকে পরবর্তী আঠাশ বছর ধরেও কিছুতেই বোঝাতে পারেনি যে, সে কোথাও যায়নি, ওখানেই ছিল। মানি বাবিন কেন তাকে দেখতে পায়নি, সেটাই আশ্চর্য। বয়স্ক পাণ্ডার বিখ্যাত উক্তি, "বাচ্চা বহুত সেয়ানা আছে," ছোট্ট সন্দীপকে খুবই রাগিয়ে দিয়েছিল। আছে না অছি কী যেন বলে ওদের ভাষায়!
এই ঘটনার ব্যাখ্যা সন্দীপ দিয়েছিল তিথিকে, বিয়ের পর পর রাত জেগে আড্ডা মারার সময়। ওর বক্তব্য এবং ব্যাখ্যা হচ্ছে সময় সারণী। ওই কুড়ি মিনিটের জন্য ওর সময় সারণী, মানি বাবির সময় সারণীকে অতিক্রম করে গেছিল। আদতে সে ওখানেই ছিল। কিন্তু অন্য সময়ে। তাদের নিজস্ব সময়গুলো আলাদা হয়ে গেছিল। ও নিজেও দেখেনি মানি বাবিকে। এখন কথা হচ্ছে, এটা ওর আগে হয়েছে কিনা কখনও, কেন এবং কীভাবেই বা হল, সেটা ও জানে না, মনে নেই। কিন্তু ও এটা বিশ্বাস করত। পরেও নাকি ওর এরকম অনুভুতি হয়েছে আরও দু' একবার। একই জায়গায় থেকেও অন্য সময়ে থাকার অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা। সন্দীপ এটা নিয়ে পড়াশোনাও করেছিল। ফিজিক্সের মেধাবী ছাত্র। নেট ঘেঁটে, বই কিনে, বই আনিয়ে এই সময় সারণী নিয়ে পড়েছিল। কীভাবে এক সময়ের ঘটনা আরেক সময়ের ঘাড়ে এসে পড়ে। একই সময়ে থেকে দুটো বা তার বেশি সমান্তরাল দুনিয়ায় কীভাবে অবস্থান করবে। তিথি খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। কোনও কিছুকেই তো ও তেমন গুরুত্ব দিল না এজীবনে। এই অবস্থান, আপাত অবস্থান, একটা আলগা সরের মতো ভাসছে যেন জীবন। এইজন্যই টিকে গেল বোধহয়। সন্দীপের মৃত্যুটা ওকে আরও আলগা করে দিয়েছে বাঁধন থেকে। ভাবটা এমন, চলে গেলেই হয়। শুধু টিপলু আছে বলেই আছে আর কী। এও তো একরকম একই জায়গায় থেকে অন্য সময়ে অবস্থান। তিথি মনে মনেই এসব আওড়ায়। অন্য লোককে বললে বিশ্বাস করবে না, অবিশ্বাসও করবে না হয়তো। সন্দীপের ব্যাখ্যার মতোই গুরুত্বহীন।
আরও পড়ুন- চক্রব্যূহ : সোমক রায়চৌধুরী
হোটেলে ফিরল তিথি দ্রুত পা চালিয়েই। বালি গরম হয়ে উঠছে। উত্তপ্ত হচ্ছে দিন ক্রমশ। ব্রেকফাস্ট করে, স্নান সেরে আবার মানি আর টিপলুকে নিয়ে বেরোল। মানি পুজো দেবে আজ। হোটেলের ঠিক করে দেওয়া পাণ্ডা রঞ্জনবাবু বেশ লোক। দ্বিতীয় দফায় তাঁর সঙ্গে সঙ্গেই ঘুরছিল টিপলু, মানি, তিথি। বাবিন এল না। সঙ্গে আরও দু'টি বাঙালি পরিবার। এবার তিনি অন্যদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। দেবদর্শনে প্রচুর ঠেলাঠেলি। ভক্তির জোয়ার সামলে চলতে হয়। দেবালয়ে ঢুকবার সিঁড়িতে একপ্রস্থ জনস্রোত। ঘন ঘন জয় জগন্নাথ ধ্বনি উঠছে। দক্ষিণ ভারতীয়া মহিলারা, খর্বকায়া, ১৬ থেকে ৮০ উজ্জ্বল কমলা-হলুদ-নীল কাপড়, রেখাচিহ্নিত হাত ভর্তি সবুজ কাঁচের চুড়ি, খড়িওঠা, কানে গিল্টিকরা টানা দুল, তামাটে রঙ, নাকে ছাইরঙ পাথুরে ফুল, মুখে চোখে ভক্তির চটচটে পাউডার, সিঁড়ি বেয়ে দল বেঁধে উঠছে, দেখতে লাগছে সারি বাধা পুতুলের মতো, সকালের রোদ চূড়িতে, নাকছাবিতে ঝলকে উঠছে। গা ঘেঁষাঘেঁষি মানুষী উষ্ণতায়, তিথির বেশ লাগছিল ঘুরে ঘুরে দেখতে। লোকজন দুমদাম মাথা ঠুকছে দেয়ালে খিলানে। হুড়োহুড়িতে এক মহিলা এসে তিথির ঘাড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন এবং পড়েই রইলেন। অনেকটা সময় ধরে এক নাছোড়বান্দা পুরুষ্টু অ্যালিগেটরের মতোই পিঠে চড়ে চললেন। প্রৌঢ়া এবং ওজনদার এই মহিলা, সঙ্গে বোধহয় কেউ নেই। হাঁফাচ্ছেন এবং দেবমূর্তি দর্শনের তীব্র উত্তেজনায় তিনি ভুলেই গেছেন যে, যার ঘাড়ে তিনি চড়েছেন, তারও অসুবিধা হতেই পারে। বা তিথিকে তিনি জড়বস্তুই ভাবছেন হয়তো।
প্রচণ্ড বিরক্তিতে তিথি ঝেড়ে ফেলার ভঙ্গিতে পিঠ সোজা করার চেষ্টা করল এবং ঘাড়টা ঘুরিয়ে তীব্রভাবে বলল, ধাক্কা দেবেন না, আমি উল্টে ধাক্কা দিলে কিন্তু সামলাতে পারবেন না। ভদ্রমহিলা গুজরাতি সম্ভবত, ভেবলে গিয়ে ছেড়ে দিলেন হাত এবং পরমুহূর্তেই হুমড়ি খেয়ে সিঁড়ির ধাপে লুটিয়ে পড়লেন। তিথি মুহূর্তে স্তম্ভিত এবং অনুতপ্ত হয়ে হাত বাড়িয়ে দিল তুলে ধরার জন্য। চারপাশে ভিড়ের চাপ বাড়ছে। একজন মানুষ যে পড়ে গেছে, সে যে পিষে যেতে পারে, ভগবানের দুয়ার প্রান্তে এসে ভক্তকূলের আর সে খেয়াল নেই। তারা প্রায় মাড়িয়েই ছোটে। মহিলার সম্ভবত অক্সিজেনের অভাব ঘটছে। তিনি ছটফট করছেন, হাত পা চালাচ্ছেন। কিন্তু উঠতে পারছেন না। তিথি ভিড়ের উল্টোমুখে ঝুঁকে মহিলাকে তুলে ধরল এবং তখনই মাথার ভিতরটা ফাঁকা হয়ে গেল, চোখে অন্ধকার। টিপলু হাত ছেড়ে গেছে। মানি চোখের আড়াল। এই ভিড়ে কীভাবে খুঁজে পাবে সে, কোথায় গেল! মানি আলাদা হাঁটছিল। টিপলু তিথির হাত ধরে ছিল। এই উন্মত্ত মানুষের ভিড়ে টিপলু কীভাবে বেরোবে। এই ভয় তার কতবার হয়েছে। কতবার যে ঘুম ভেঙে উঠে বসেছে এই দু'বছরে। টিপলু পাশে থাকতেও তার ভয় হয়। এই বুঝি সরে গেল পাশ থেকে। টিপলু লুকোচুরি খেললেও তার প্রাণ ছ্যাঁৎ করে ওঠে। আর এখানে যখন তার সর্বাধিক সতর্ক থাকার কথা, তখনি সে মুহূর্তের জন্য হলেও ভুলে গেল কী করে!
চারপাশে অপরিচিত লোকের স্রোত। তিথি প্রায় সাঁতরে মন্দিরের ভিড় পার হল। আগের বার এসেছে বলে এই জায়গাটা তার চেনা লাগছিল। মন্দির অফিসে গিয়ে বলতে হবে। কিন্তু মানি কোথায়? টিপলু যদি কোনও বদমাশ লোকের খপ্পরে পড়ে? শিরদাঁড়া ভেঙে পড়ছে মনে হচ্ছে তিথির।
মূলমন্দিরের বেরনোর দরজার কাছটা দেখল সে, এদিক ওদিক। যদি টিপলু মানির হাতে পড়ে, যদি ওরা কোথাও দাঁড়িয়ে থাকে। তার পর দেখতে দেখতেই অফিসের দিকে দৌড়ল। দেরি করা যাবে না। সময় নষ্ট করা যাবে না। একেকটা মুহূর্ত হাতুড়ির বাড়ির মতো পড়ছে মাথার ভিতর। ফোন নেই কারও সঙ্গে, খোঁজ নেবে কী করে। অসহায়, কী প্রচণ্ড অসহায় তিথি। দৌড়তে দৌড়তে নাটমন্দির ঘুরপাক খেয়ে দেখে আবার দরজার কাছে এসে গেছে। দিক গুলিয়ে গেছে। মন্দির অফিস দালানের অন্য প্রান্তে। সে আসলে এই রথের মতো দেখতে মন্দিরটাকেই চক্কর কাটছে বারবার ভুল করে। হাঁপিয়ে, দাঁড়িয়ে মাথা ঠিক করল। তারপর ঘুরে হাঁটা লাগাল। আর তারপরেই দেখল সেই চণ্ডীমণ্ডপের মতো জায়গাটার নীচে দালানে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক দেখছে মানি আর টিপলু। ঠিক চারটে পেল্লায় লাফে গিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরল তিথি।
মানি এবং টিপলু তো হাঁ। তিথি আরও হাঁ। তিথি হাঁউমাঁউ করে, আক্ষরিক অর্থেই হাঁউমাঁউ করে যখন জিজ্ঞেস করল যে, মানি টিপলুকে কোথায় পেল, এখানে কী করে এল ইত্যাদি, তাতে মানি এবং টিপলু হাঁ করেই জানাল, তারা তো গত দশ মিনিট ধরে এখানেই অপেক্ষা করছে। মানে, অত ভিড় দেখে মানিই টিপলুকে হাতে ধরে রেখে দিয়েছিল সিঁড়ির নীচেই। তিথিকে বলেও ছিল। তিথি গায়ে পড়ে যাওয়া লোক সামলাতে সামলাতেই নাকি হ্যাঁ বলে উঠে গেছে। মানি ভেবেছে, তিথি ঘাড় নেড়েছে যখন, তখন ঠিকই আছে। ওরা এখানেই অপেক্ষা করছে। তাহলে যে তিথি টিপলুকে জাপটে সিঁড়ি দিয়ে উঠল, তারপর আধঘণ্টা ধরে মন্দিরের এপার ওপার করল। এই জায়গাটাও দু'বার ঘুরে গেছে, তখন কেন চোখে পড়েনি?
মানি প্রবল অবিশ্বাসী দৃষ্টি হেনে বলল, এই যে বলি তুমি সর্বদাই ভাবের ঘরে থাকো, কোনদিন কী ঘটবে কে জানে। অর্ধেক কথা শোনো না। কিছু বলার নেই। তিথির অন্যমনস্কতার দোষ আছে। যাকগে, ফেরত তো পাওয়া গেছে। মানির হিসেবে সময়টা ৭-১০ মিনিট। তিথির হিসেবে সময়টা অন্তত ৪০ মিনিট।
বিকেলে আবার আসতে হবে কেনাকাটা করতে। জগন্নাথ ধামের উপর বই কিনবে। পুরীর লাঠি কিনে দিতে হবে টিপলুকে। বিরাট বিরাট পাথুরে ধাপের সিঁড়ি পেরিয়ে সিংদরজায় এসে ঘুরে মন্দিরটা আবার দেখল তিথি। অলৌকিক কিছু হয় না সাধারণের জীবনে। কিন্তু এক একদিন সময় সারণী পার হয়ে কেউ তো আসতে পারে। সময়কেই ধরে রেখেছে কত শ' বছরের পুরনো এই মন্দির, সূর্যের রথ। মহাকালের চিহ্ন ছড়ানো সর্বত্র। দেবদর্শন হয়নি। ভোজবাজি দর্শন হয়েছে।
টিপলু মাথা রেখেছে তিথির কাঁধে। গলা জড়িয়ে রেখেছে। তিথি একটু আলতো চাপ দিয়ে জড়িয়ে ধরল ভালো করে টিপলুকে। ওরা মন্দির থেকে বেরিয়ে রাস্তা পার হয়ে গেল গলির মুখ থেকে রিকশায় উঠবে বলে। সি বিচের ধারের রাস্তায় বেলেপাথরে সোনালি আলো পড়েছে। টিপলু খেলবে, স্নান করবে লোনা জলে। মানি আর তিথি বসে থাকবে বালুতে। আর সময় সারণীর ওপারে সেই সোনালি রোদওয়ালা, কমলালেবুর গন্ধওয়ালা চির হেমন্তের বারান্দায় সন্দীপ বসে থাকবে, দেওয়ালে ঝোলানো ছবির সেই মিঠে হাসিটা নিয়ে। কে জানে কবে পৌঁছবে তিথি সেই বারান্দায়!