দৃশ্যাদৃশ্য যথা : জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়
Bengali Short Story: দু' জন পাশপাশি হেঁটে গেছিল কিছুক্ষণ আগেও। তারপর এক স্থানে এসে এক জোড়া পদচিহ্ন থমকে গেছে, কারও অপেক্ষায়
- দেখেছিলে?
- হুম...
- কিছু বলোনি তো?...
- বলিনি বুঝলে কী করে?
- কই? কিছু দেখলাম তো না?
- কথা কি দেখা যায়? শুনতে পাওনি। শুনতে পাও না... এতটাই দূরে, পৌঁছয় না বোধহয় আর শব্দগুলো। এত ভিড়, এত কোলাহল...
-
- আমি বা আমার বলা কথারা পৌঁছতে পারেনি... টিকে থাকতে পারেনি। সে আমারও ব্যর্থতা। ঠিকই।
- নিজেই বলছ, যা বলার।
- না... আমি খুশিই হয়েছিলাম। মন খারাপ অতিক্রম করে খুশি থাকা যায়। ফাঁকি না থাকলে খুশি থাকা যায়। কেন খুশি, আর কীসের কষ্ট... দুটোই আমি বুঝি।
- আর আজ? এখন?
- আরও বেশি খুশি! কী অপ্রত্যাশিত... কী আকস্মিক!... এত বছর ধরে সযত্নে রাখা একটা ছবি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি... জানো? খুশি হবো না!
- ছবি?
- হুম!... ভুলে গেছ?
- অনেক কিছুই ভুলে যাওয়া অভ্যেস করতে হয় মেয়েদের।
- আর অভ্যেস করো বলে ভুলতেও পারো না, বেশি করে মনে পড়ে যায়।
- হুম, আত্মকেন্দ্রিক হয়ে নিজেদের আলাদা জগতে মেতে থাকতে পারি না যে সব সময়ে... সবাইকে নিয়ে চলতে হয়। বুঝবে না।
- সত্যিই ভুলে গেছ?
-
- ছবিটার কথা?
-
- আকাশে এমনই গজগামিনী মেঘ। এমনই কোথাও তুমি দাঁড়িয়ে আছো... সাদা শাড়ির আঁচল উড়ছে। চুল খোলা, উড়ছে সামুদ্রিক বাতাসে। পায়ের কাছে এসে ফিরে ফিরে যাচ্ছে সমুদ্রর সফেন ঢেউ। ভেজা সমুদ্রতটে ফুটে উঠছে তোমার প্রতিবিম্বের অবয়ব।
-
- হাসছ?
- আর কি তেমন আছি?
-
- কী হল পুরুষ? মোহভঙ্গ? দেখছ কী চুপ করে?
- না... তোমার চুল বাঁধা... শাড়িটার রঙ ফিকে হলেও, সাদা নয়।
- ত্রুটি থেকে গেল... বলো?
-
- তুলে দেবে একটা ছবি? ওইটুকু ত্রুটি থাক না হয়?
-
- নাও... আমার ফোন থেকেই তোলো। আমার কাছেই থাকবে। তোমাকে লুকোতে হবে না, ডিলিটও করতে হবে না।
- তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছে জেনে ওর বিচলিত হওয়ার কথা নয়।
- ঠিক জানো?... জানো না পুরুষ। ওকে আমি দেখেছি...
- আর তোমার বেলা?
- সাইট ভিজিটে এসেছি, সেখান থেকে এই সী বিচে। কলিগ থাকে, ড্রাইভার থাকে, লোকাল লোকজন থাকে... কে ছবি তুলে দিল হু কেয়ার্স?
-
- তোমার কাছে যা এত কিছু... তা অন্য কেউ দেখে একবার ওয়াও বলে ভুলে যাবে। কেউ জিজ্ঞেস করলে... বলে দেব কিছু একটা!
-
- কী হল? মান্যতা? চিত্র সৌজন্যে লিখে দেব তোমার নাম?
-
- হাসতে হাসতে দীর্ঘশ্বাস ফেলা যদি শিল্প হয়... ইউ আর অ্যান আর্টিস্ট!
- ও কিন্তু আমার মোবাইলে তোমার ছবি দেখলেই বুঝতে পারবে... এই ছবি আমারই তোলা।
- আর মনে মনে শাপ শাপান্ত করবে এই ডাইনিকে!
- তুমি আর কতক্ষণ থাকবে এইদিকে? ফিরছ কবে?
- কী করবে জেনে? আসবে একদিন দেখা করতে? তুমিও তো একাই এসেছ... না?
-
- এসো না... মায়া বাড়বে। কষ্ট বাড়বে... আমাদের। আরও বেশি করে মিথ্যে বলবে খুশি থাকার প্রসঙ্গে। তুমি পারো... সত্যিই খুশি থাকও হয়ত। আমি পারি না... শুধু স্থির থাকতে হয়।
- তা ঠিক, মিথ্যে তো এসেই যায়। ঠিক এই মুহূর্তে তোমাকে বা আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করলে... দু'জনেই আড়াল করব, মিথ্যেই বলব। ‘সত্যি’ জটিলতা বাড়ায়, অনেক অবাঞ্ছিত প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। সব সত্য সবার জন্য নয়... এটা বুঝতে পারি এখন। আমার আর ব্যাখ্যা করতে ভালো লাগে না... ক্লান্ত লাগে!
- আমারও... ক্লান্ত লাগে খুব!
- মিথ্যে ব্যাপারটাও বড়ো অদ্ভুত। জনক রাজা স্বপ্নে চরম বিপর্যয় দর্শন করে ঘুম ভেঙে দেখলেন রাজাই আছেন, সব ঠিক আছে। রাজা জিজ্ঞেস করলেন, কোনটা সত্য? অষ্টবক্র মুনি সভায় ছিলেন... বলেন—
কোনওটাই সত্য নয়। রাজাও সত্য নয়, ভিক্ষুকও সত্য নয়... একমাত্র আপনি সত্য। একমাত্র আপনার চেতনা সত্য। যে সচেতন আপনি স্বপ্নের ভিক্ষুক জনক আর বাস্তবের রাজা জনক দু'জনের স্থিতিই উপলব্ধি করতে পারে— সেই জাগরূক সত্ত্বা একমাত্র সত্য।
-
- মিথ্যে আমি বলব না। আর সত্যি বললে এরা বুঝবে না। মেনেও নিতে পারবে না।
- আসলে... সেই তোমাকে ফিরে যেতে হবে। আমাকেও ফিরে যেতে হবে। মাঝের এই সময়টুকুই যা...
- তুমি কি জানতে? আমি কি জানতাম?... তাও আমরা এখানে, এখন।
-
- হাঁটতে হাঁটতে আমাদের দেখা হওয়া... একসঙ্গে হাঁটা... আবার আলাদা হয়ে যাওয়া।
- এই একসঙ্গে হাঁটাটাই সত্য। স্বপ্ন হোক আর বাস্তব। তোমার গল্পটা রিলেট করতে পারলাম এবার।
- তোমাকে ভোলা কোনওদিনই সম্ভব হবে না... এটাও সত্য জাহ্নবী। তুমি কোথায়, কার সঙ্গে আছো... তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ-- তুমি আছো। আমার জন্য...
- তুমি তাও ফিরে যাবে সংসারে। অন্য কেউ হয় যাবে। আর আমি?
- তুমি যে 'তুমি'!... জানতে তো... জানতে না?
- আমি দুর্বল নই... আক্ষেপও হয় না। কিন্তু এটাও সত্য। বুঝেছ আশা করি...
- আমার হয়। হয়ত কেউ একজন সঙ্গে থাকলে... অন্তত...
- খবরটা পেয়েছিলে তো... পাওনি?
- হুম...
- সবার সহ্য হয় না... কেউ কেউ ইকারাস হতে চেয়েছিল। আর তুমি গরুড়। অথচ...
- এমন রাশি রাশি 'অথচ' নিয়েই সব কিছু। এই অথচদের অপূর্ণতা হতে দিতে নেই। অন্ধকার হতে দিতে নেই। অন্তত তোমাকে মানায় না।
- বেশ... তাহলে, ফেরার সময়ে আমি আগে যাব উদ্দালক। তারপর তুমি। আমার চলে যাওয়া দেখবে... পিছু ডাকবে না।
- তথাস্তু...
-
- কী দেখছ ওদিকে?
- বৃষ্টি নামার আগে ছবিটা তুলে দেবে? চুলের ক্লিপটা খুলব?
- আর একটু অপেক্ষা করো, দক্ষিণ পশ্চিম থেকে ওই মেঘের পাহাড় আর একটু কাছাকাছি আসুক। আর একটু অপেক্ষা করো... কাছাকাছি আসুক প্রাগৈতিহাসিক ম্যামথের মতো ওই বজ্রগর্ভ মেঘগুলো।
- তথাস্তু...
--- --- ---
আরও পড়ুন-গুফ্তগু : জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়
এই সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলের একমাত্র শঙ্খচিল, এই অঞ্চলে শঙ্খচিলদের শেষ প্রতিনিধি, সিন্ধুচর— চুপ করে নারিকেল গাছের উপর বসে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আসন্ন বজ্রগর্ভ মেঘরাশির দিকে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আকাশে, দিবালোকে বোঝা যাচ্ছে না সেভাবে। শুধু অনির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে গুমগুম করে শব্দ করে মেঘ ডেকে উঠছে অনেক দূর থেকে। ঢেউয়ের উচ্ছ্বাস আর বাতাসের শব্দকে অতিক্রম করে শোনা যাচ্ছে জলদ-মন্দ্র, ক্রমে এগিয়ে আসছে। সামুদ্রিক বাতাসের বেগে ঘাড় আর পিঠের কাছে কিছু অবিন্যস্ত পালক, ফুরফুর করে উড়ছে। এই সব কিছু দেখতে দেখতেই মাঝে মাঝে মনে হয়– একদিন এই সৈকতেই পড়ে থাকবে তার কিছু পালক, তারপর সেসবও বালিতে মিশে যাবে। যারা চলে গেছে, তারা কেউ জানবে না, সে কেন যেতে পারল না এই উদার সাগরভূমি ছেড়ে। উদাস হয়ে দেখে, দু'জন মানুষের হাঁটতে হাঁটতে এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে চলে যাওয়া। কেউ থেমে যায়, কেউ এগিয়ে যায় একা। কেউ পিছু ডাকে, কেউ সাড়া দিতে সময় নেয়। অথচ থামে ঠিকই। তারপর একজন নিজের আঁচল শ্বেতকেতনের মতো সামুদ্রিক বাতাসে উড়িয়ে যেন আত্মসমর্পণ করল, আর তখনই বৃষ্টির জল পড়ে ঝাপসা হয়ে গেল সিন্ধুচরের দৃষ্টি। মাথা ঝাঁকিয়ে আবার ফিরে এল সিন্ধুচর, তার অপেক্ষার কেন্দ্রবিন্দুতে। তার একটি নির্দিষ্ট সময়ের অপেক্ষা আছে, নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য আছে সেই অপেক্ষার। তাকে সজাগ থাকতে হয়, দিনের এই সময়টা, যখন সমুদ্রের ঢেউ কিছু দূরে পিছিয়ে যায়। অনাবৃত হয়ে পড়ে সমুদ্রতট। এই সময় মৃগয়ার সময়, একাধিক প্রাণী নিজ নিজ সুবিধে মতো আহারের খোঁজে প্রবৃত্ত হয়। উদ্বেগ বাড়ে সিন্ধুচরের। শরীরের সকল স্নায়ু একসঙ্গে প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে।
একটা হঠাৎ আসা বড় ঢেউ এসে খানিকটা বালিস্তর সরিয়ে চলে যেতেই, সন্ন্যাসী-কর্কটটি ভিজে বালি সরিয়ে দ্রুত নিমজ্জিত হয়, বালুতটে মগ্ন মৈনাকের মতো। বৃদ্ধ সন্ন্যাসী-কর্কট ক্রৌঞ্চবর্মা, প্রায় দুই যুগ হয়ে গেল এই সমুদ্রতটে। সমকালীন কেউই আর নেই কেবল ওই পক্ষী সিন্ধুচর ছাড়া। জলের চরিত্র বদলে গেছে, সৈকতের প্রকৃতি বদলে গেছে, স্বজাতির অন্যরাও চলে গেছে এই সৈকত ছেড়ে, অন্যত্র কোথাও। বৃদ্ধ ক্রৌঞ্চবর্মা, একা পড়ে আছে, নিজের প্রজাতির জীবন্ত জীবাশ্ম হয়ে। তাকে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর এই ভাবেই দেখছে সিন্ধুচর। সন্ন্যাসী-কর্কটদের বসতি এক এক করে শেষ হয়ে যেতে দেখেছে কোনও সামুদ্রিক প্রাণী, পক্ষী অথবা মানুষের হাতে। তারপর রক্ত-কর্কটরাই শুধু রয়ে গেল এই সৈকতে। তাদের বংশ বিস্তার হয়। লাল চাদরের মতো সমুদ্রতটের একদিক থেকে একদিকে চলে যায় তারা অপরাহ্নে দল বেঁধে। সন্ন্যাসী-কর্কট একা, স্লথ, মাঝে মাঝে বালুচরে দৃশ্যমান হয়, তারপর আত্মগোপন করে। সেই কর্কটের কাছাকাছি অন্য কেউ এলেই সজাগ হয়ে ওঠে শঙ্খচিল। বিগত এক যুগ ধরে এই তার প্রাত্যহিক অভ্যেস, কর্তব্য- একমাত্র সন্ন্যাসী কর্কটটিকে পাহারা দিয়ে যাওয়া। এ ছাড়া তার এই সায়াহ্নের সন্নিকটে চলে আসা জীবনে আর কোনও উদ্দেশ্য নেই। দৈনিক একটি সামুদ্রিক ছোট মাছ জুটে যায়। ক্ষুধা কমে গেছে অনেকদিন। ডানার জোরও কমছে ধীরে ধীরে। কমছে শ্যেন দৃষ্টির জ্যোতি। তবুও, প্রতিদিন সেই এক খেলা—
আকাশে অন্য কোনও পাখি, অথবা সৈকতে কোনও প্রাণী, কিংবা স্থানীয় মানুষ, কেউ ক্রৌঞ্চবর্মার কাছাকাছি এগোলেই ক্ষিপ্র বেগে ধেয়ে আসে সিন্ধুচর। ছোঁ মেরে নিয়ে চলে যায় ক্রৌঞ্চবর্মাকে। দূরে কোথাও, অনেক উচ্চতায়, কোনও গাছের ডালে অথবা কোনও নির্মাণের গোপন কোণে। কিছুক্ষণ সেখানেই হাঁপায় দু'জনে। হৃৎপিণ্ডের গতি আর শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হতে সময় দেয় কিছুক্ষণ। ক্রৌঞ্চবর্মার বিশেষ কিছু করার থাকে না, অপেক্ষা করা ছাড়া। সিন্ধুচর চারিদিকে তাকায়। দু' তিনবার তীক্ষ্ণ স্বরে ডেকে ওঠে আকাশের দিকে মুখ তুলে। ডানার পালক পরিষ্কার করে তার নখর চঞ্চু দিয়ে। তারপর মাঝে মাঝে তাকায় দূরে… সৈকত, আছড়ে পড়া ঢেউ, আকাশের দিকে, আর মাঝে মাঝে ফিরে তাকায় ক্রৌঞ্চবর্মার দিকে। আর ক্রৌঞ্চবর্মা নিজের শঙ্খের ভেতর থেকে উঁকি দিয়ে দেখে সিন্ধুচরকে, দেখে আর মুগ্ধ হয়... বিস্মিত হয়। একসময়ে সিন্ধুচর আবার তাকে নখে আঁকড়ে তুলে নিয়ে চলে যায় সমুদ্র-সৈকতের দিকে, ক্রমে ঢেউয়ের কাছাকাছি নেমে এসে ছেড়ে দেয় স্বল্প গভীর জলে। জলের ভেতর, বালুতটে ডুব দিয়ে হারিয়ে যায় ক্রৌঞ্চবর্মা। চলে যায় সকল শিকারী আর কৌতূহলীর দৃষ্টির অগোচরে।
ক্রৌঞ্চবর্মা বুঝতে পারে হঠাৎ কেউ তাকে নখে করে ছোঁ মেরে নিয়ে চলে গেল আকাশের অনেকটা উপরে, যেখানে কোনও জলজপ্রাণীর পৌঁছনোর কথাই নয়, সেই অভিজ্ঞতা জীবনের সম্ভাব্য অন্তের ইঙ্গিত। অথচ সে বিহঙ্গের মতো সেই উচ্চতায় যায়, প্রতিদিন। প্রতিদিন সৈকত আর তার আশেপাশের সব কিছুকে অতটা উচ্চতা থেকে নিরীক্ষণ করে তার দুর্বল হৃদয় আর সীমিত দৃষ্টিশক্তি দিয়ে। ছোট-বড় ঢেউ, বালুতট, গাছপালা— সব কেমন অদ্ভুত লাগে সেই উচ্চতা থেকে! বুকটা ধুকপুক করতে থাকে অস্বাভাবিক গতিতে। প্রতিদিনই ঘিরে ধরে শ্বাসরোধ করা অনিশ্চয়তা, মৃত্যুভয়। শঙ্খচিল তো শমনও হতে পারে? কিন্তু প্রতিদিনই সে সিন্ধুচরকে যেন নতুন করে চেনে। এক যুগ পার হয়ে গেল, তাও— প্রতিদিন। তারপর আবার সে নামিয়ে দিয়ে চলে যায় সযত্নে। কয়েক মুহূর্তের রোমাঞ্চ শেষ হয়ে যায়। নোনা-জলে অথবা লবনাক্ত বালিতে হারিয়ে যায় ক্রৌঞ্চবর্মা। কোনও শিকারীর হাত থেকে প্রাণরক্ষা পায়, আরও একবার। আরও একবার ফাঁকি দেয় অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুকে।
আরও পড়ুন- সাইকেল: অমৃতা সরকার
এই তো, সৈকতের ভেজা বালির উপর দিয়ে দু'জোড়া পায়ের ছাপ চলে গেছে। কোনও কোনও ঢেউ কয়েক পা বেশি এগিয়ে তাদের আরও একটু অস্পষ্ট করে দিয়ে চলে যাচ্ছে মাঝে মাঝে। তাও বোঝা যায়, দু' জন পাশপাশি হেঁটে গেছিল কিছুক্ষণ আগেও। তারপর এক স্থানে এসে এক জোড়া পদচিহ্ন থমকে গেছে, কারও অপেক্ষায়, তারপর দিক পরবির্তন করে চলে গেছে পরিত্যক্ত জেলে-নৌকার দিকে, একা— সেই পদচিহ্ন আপেক্ষিক ভাবে আকারে বড়। অপর এক জোড়া পদচিহ্ন এগিয়ে চলে গেছে সৈকত থেকে দূরে, লোকালয়ের দিকে— সেই পদচিহ্ন কিছুটা ছোট। যে পদচিহ্ন ছোট, যে পদচিহ্নের স্পর্শে শ্রী ভাব, তারই বাম পদচিহ্ন থেকে জেগে উঠল ক্রৌঞ্চবর্মা। স্লথগতিতে বেরিয়ে এল বাইরে, বৃষ্টির সোঁদা গন্ধ পেয়ে। ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে তখন। সমুদ্রের দিকে উড়ে যাওয়া এক প্রকাণ্ড শঙ্খচিল দক্ষিণ পশ্চিম থেকে ধেয়ে আসা ঝোড়ো হাওয়ার ঝাপটায় টাল রাখতে না পেরে পিছিয়ে গেল কিছুটা, নেমে এল কিছুটা নীচে। কিছুটা টাল সামলেই ডানায় মেঘ-ভাঙা রোদ মেখে দিক-পরিবর্তন করে ধেয়ে এল ক্রৌঞ্চবর্মার দিকে।
সিন্ধুচরের সঙ্গে কখনও কথা হয় না, শুধু দৃষ্টি বিনিময় হয়। তবুও তার পালক, ডানা সব কিছু কেমন পরিচিত হয়ে গেছে এত দিনে। কঠিন খোলের উপর থেকেও পরিচিত ঠেকে ওই নখর স্পর্শ। ক্রৌঞ্চবর্মা তাকে এগিয়ে আসতে দেখে মনে মনে হাসল। কোথাও শঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল না— অন্য কেউ তাকে ধরতে তেড়ে আসছে কিনা। আত্মরক্ষার যথেষ্ট অবকাশ থাকলেও লুকিয়ে পড়ল না বালির ভেতর। সৈকতের একমাত্র প্রবীণ শঙ্খচিল, নিঃশব্দে নেমে এসে নিমেষে তুলে নিল জাতক ক্রৌঞ্চবর্মাকে।