দুই বুড়োবুড়ি : গৌতম দে

Bengali Short Story: ইলিশ মাছের সঙ্গে মানুষ, মানুষের সঙ্গে ইলিশ মাছ। সব একাকার হয়ে ওঠে। কেউ কেউ আবার নানান ব্যাখ্যা করছে। অনেক দেশে নাকি এইভাবে মাছেরা আত্মহত্যা করে

নদীর স্রোতের বিপরীতে চলেছে রাশি রাশি ইলিশের সাঁতার। যত জল তত ইলিশ যেন! কেউ ভাবতেও পারেনি।জলের স্রোতের মধ্যে একেবারে হুড়োহুড়ি, গুঁতোগুঁতি পড়ে গেছে। জল আর দেখা যাচ্ছে না একটুও। কেবলই রুপোলি শস্য। ইলিশ আর ইলিশ। শত শত ইলিশ মাছের ঝাঁক। তার উপর সূর্যের আলো পড়ে চারদিক ঝিকমিক ঝিকমিক করছে! বেশিক্ষণ তাকানো যায় না সেদিকে। কই মাছের মতো সব যেন পাড়ে উঠতে চাইছে। উঠতে চাইছে গঙ্গার দুই পাড় বরাবর। কেন উঠতে চাইছে? কেউই বলতে পারছে না। একমাত্র ইলিশ বিশেষজ্ঞরা হয়তো বলতে পারবেন।

এই দৃশ্যটা চাউর হতে বেশি সময় লাগল না। বাতাসের থেকেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল বিভিন্ন লোকালয়ে। সবাই 'দেখি দেখি' করতে করতে বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। সবারই মনে বিস্ময়! বিস্ময়ের সঙ্গে খুশি। দু'টি শব্দ মিলেমিশে একাকার। সাধারণ মানুষ তো খুশি হবেই। বাজারে ইলিশের দাম আকাশছোঁয়া। সাধারণ মানুষ বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করতেও এখন ভয় পান। অথচ খবরে প্রকাশ, প্রতিদিনই টন টন ইলিশ ধরা পড়ছে জেলেদের জালে। তো আজ সাধারণ মানুষের খুশির বাঁধ ভেঙেছে। হুড়মুড়িয়ে নেমে পড়েছে ঘোলা জলে। "মাছ ধরিব আর খাইব সুখে"। এই একটিমাত্র স্লোগান সাধারণ মানুষের চোখেমুখে জ্বলজ্বল করছে। এ এক আজব ঘটনা! দুর্ঘটনা কিছুতেই বলা যাবে না।

গঙ্গার দুই পাড়ের বিভিন্ন শহরের মানুষরা বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। তারপর যে যার মতো গঙ্গার দুই পাড়ে এসে পড়ল। ঘাট-আঘাটায় নেমে পড়ল। কারও কোনও ভয়ডর বলতে কিস্যু নেই। একেবারে হইহই রইরই ব্যাপার স্যাপার। অনেকটা উৎসবের মতো। ‘দুয়ারে ইলিশ’ এসেছে গো! ‘দুয়ারে ইলিশ’ এসেছে! এখন এসব কথার কথা হয়ে উঠেছে জনমানসে। হাসিঠাট্টার পর্যায়ে চলে গেছে। বিভিন্ন ঠেকে কথাপ্রসঙ্গে এই কথাটি হাসতে হাসতে বলেও ফেলছেন কেউ কেউ।

গঙ্গার দুই পাড়ে একটা জোরালো উৎসবের আবহ ছড়িয়ে পড়েছে। একেবারে মেলা বসে গেছে। এখানে গরিব ধনীর কোনও ভেদাভেদ নেই। সবাই প্যান্ট আর শাড়ি গুটিয়ে জল কাদায় নেমে পড়েছে ইলিশ মাছ কুড়োতে। অনেকের বাজারের ব্যাগ ভর্তি হয়ে উপচে পড়েছে। তবুও তাদের ইলিশ কুড়ানোর বিরাম নেই। রাস্তার ধারে দামিদামি গাড়ির লম্বা লাইন। গাড়ির ডিকিতে ডিকিতে ভর্তি ইলিশমাছ। বাবুরা কিনছেন। বিবিরা হাসছেন। তাদের কেনার বিরাম নেই। অনেকেই আরও কিছু ইলিশের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ছেন ক্ষণে ক্ষণে, ওই ঘোলাজলে।

ইলিশগুলো কিন্তু খুব একটা ছোট নয় মনে হচ্ছে।

হুম ঠিক বলেছেন।

পাঁচশর নিচে তো নয়ই একেবারে।

এক কিলো, দুই কিলো, তিন কিলো সাইজের।

যাকে বলে ভরাপেট। এই সময় দলে দলে ইলিশ মাছেরা মিষ্টি জলে প্রসব করতে আসে মশাই!

জল কি আর মিষ্ট আছে ভিতুবাবু! বিষ। বিষ হয়ে গেছে।

কথাটা মন্দ বলেননি হিসিদা। মানে হিমাদ্রী সিংহকে সংক্ষেপে বন্ধুরা বলেন ‘হিসিদা’। সেইরকম ভাবে আবারও বলেন, ঠিকই বলেছেন।একদম পারফেক্ট কথা বলেছেন।

হাজার হাজার মানুষের মুখের হাসি এই গঙ্গার জলের সঙ্গে, বাতাসের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে যেন! গঙ্গার দুই পাড়ে মুহূর্তে অস্থায়ী দোকান গজিয়ে উঠল। বাতাসে ইলিশভাজার দুর্দান্ত গন্ধ। মুহূর্তে পাবলিকের আনা মাছ কম পয়সায় রান্না করে দিচ্ছে দোকানি। পাবলিক তারিয়ে তারিয়ে হাপুসহুপুস করে বেবাক খাচ্ছে ইলিশ মাছ ভাজা। হাসতে হাসতে খাচ্ছে। নাচতে নাচতে খাচ্ছে। আনন্দ করতে করতে খাচ্ছে। কেউ আবার উদ্দাম গলায় বেসুরো হিন্দি কিংবা বাংলা গান গাইছে।

আজ যেন একটা ঐতিহাসিক দিন অনেকের কাছে। কেননা 'দুয়ারে ইলিশ'! ন্যাজ নাড়ছে। অনেকেই নানাভাবে সেলিব্রেট করছে নিজেদের। নানা কায়দায় খুশি খুশি মুখে সেলফি তুলছে। একমাত্র সঙ্গী সেই ইলিশ মাছ। সেই সেলফিতে ইলিশ মাছের ভরপুর গন্ধ, ইলিশ মাছের অনিন্দ্য সুন্দর রূপ লেগে আছে যেন!

ইলিশ মাছ ভাজা খুশি মনে খেতে খেতে ঘোতনবাবু স্ত্রী পদ্মিনীকে (এই নামেই ডাকেন কখনও সখনও নন্দিনীকে। নন্দিনী হয়ে যায় পদ্মিনী। হিট ছবির নায়িকা। বিয়ের পঁয়তিরিশ বছর পরও! তার ওপর ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশের আগমন এই মরা গঙ্গায়। এই মুহূর্তে আর পাঁচজনের মতো তিনিও ভরপুর খুশিতে ডুবে আছেন) বললেন, "আমার এত বছর বয়স হল এমনটি দেখিনি। তুমি কি দেখেছ?"

না। ইলিশ মাছ ভাজা খেতে খেতে নন্দিনী বললেন।

বুঝলে পদ্মিনী, সবই তাঁর অনুপ্রেরণা। বলেই একচোট ছেলেমানুষের মতো হেসে নিলেন ঘোতন বিশ্বাস।

কত ইলিশ কুড়ালাম আমরা?

বিশ কিলোর মতো তো হবেই।

বাড়িতে গিয়ে ফ্রিজটা ফাঁকা করতে হবে। নন্দিনী মাছ খেতে খেতে আরও বললেন, সেখানে মাছ ঠুসিয়ে রাখব। নোনা ইলিশ তৈরি করব। সারা বছর ইলিশ খাব। আর রাক্ষুসে দামের কথা শুনতে হবে না। মনের সুখে ইলিশ মাছের নানান পদ রাঁধব। আর কবজি ডুবিয়ে খাব।

নন্দিনীর এই প্ল্যান শুনে ঘোতন বিশ্বাসের মনের মধ্যে পদ্মিনী কোলাপুরি নামটি বারবার ডিগবাজি খায়।

আরও পড়ুন- তিরচিহ্ন: যশোধরা রায়চৌধুরী

গঙ্গায় এই বিপুল পরিমাণ ইলিশ মাছের আগমনে ইন্টারন্যাশনাল খবর হয়ে যায়। ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া থেকে শুরু করে এবং সমস্ত পয়লা নম্বরের খবরের কাগজে প্রথম পাতায় বিগ হেডলাইনে প্রধান খবর হয়ে বেরোয়। সেই সঙ্গে গঙ্গার দুই পাড়ে সাংবাদিকরা ঝাঁপিয়ে পড়েন। পৃথিবীর সর্বত্র লাইভ টেলিকাস্ট হয়। পাঁচ-পাবলিকের ইন্টারভিউ নেয় বিভিন্ন মিডিয়া। প্রতিবেশি দেশ থেকে ইলিশ মাছের আমদানির প্রসঙ্গ উঠে আসে। তিস্তার পানি বন্টনের কথাও বাদ যায় না।

ইলিশ মাছের সঙ্গে মানুষ, মানুষের সঙ্গে ইলিশ মাছ। সব একাকার হয়ে ওঠে। কেউ কেউ আবার নানান ব্যাখ্যা করছে। অনেক দেশে নাকি এইভাবে মাছেরা আত্মহত্যা করে। কেন করে হয়তো কেউ জানে না। জানার কথাও নয়। টিভির খবরে সেই দৃশ্য দেখেছে অনেকেই। ঘোতন বিশ্বাসও দেখেছেন। সেই নিয়ে আলোচনাও হয়। সবটাই নিজের মতো করে। এই দৃশ্য যে আমাদের দেশে, মানে গঙ্গায় ঘটবে তা কেউ ভাবতেও পারেননি। বিশেষজ্ঞরা নানা মতামত ব্যাখ্যা করছেন ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায়।

মাছে ভাতে বাঙালি। সেই বাঙালির পাতে প্রিয় মাছ ‘ইলিশ মাছ’ আজ বঞ্চিত। বাজারে আগুন দাম। যার কাছে বিপুল পরিমাণ অর্থ আছে, সেই একমাত্র খেতে পারে। আমজনতার কাছে ইলিশ মাছ আজ অধরা, দূর গ্রহের বস্তু। অনেকটা স্বপ্নের মতো। প্রতিদিন ইলিশ মরসুমে সেই স্বপ্নের মৃত্যু ঘটে। স্বভাবতই প্রশাসন খুব খুশি। হাসিমুখের ছবি ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। এটা কি কাকতালীয় ঘটনা? হতে পারে। আবার নাও পারে। জনমানসে তর্ক চলবে, চলছেও।

অনেকের মধ্যে এই প্রশ্ন। আবার অনেকের মধ্যে এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে হাসি মশকরা চলছে, অবিরত। তবুও প্রশাসনের প্রধান বেশ হাসিমুখে বললেন, বোধহয় না। অন্য দেশের ওপর আর নির্ভর করতে হবে না আমাদের। আমরা মাছে ভাতে বাঙালি। ইলিশমাছ আমাদের প্রিয় মাছ। অনেকেই খেতে পারেন না। এখন আনন্দ করে খান। দেখছেন তো গঙ্গার বাতাসে কেমন ইলিশ ইলিশ গন্ধ। এই সুযোগে হাজার হাজার মানুষের লক্ষ লক্ষ টাকা আয় হচ্ছে। আমরা খুশি। আমাদের সরকার খুশি। সরকার আপনাদের সবরকমের সহায়তা করতে প্রস্তুত…।

আহা ইলিশ! বাহা ইলিশ!

এই সুযোগে ছোট বড় মাঝারি ব্যবসায়ীরা মাঠে নেমে পড়েছেন। নগদানগদি কিনে নিচ্ছেন বিপুল মাছ। গঙ্গায় জাল ফেলার দরকার নেই। যে পরিমাণ ইলিশমাছ মানুষের হাতে ধরা দিচ্ছে তা নেহাত কম নয়। গঙ্গার দুই পাড়ের অন্ধকার বিরাট বিরাট হ্যালোজেনের আলোয় ভরে গেছে। যত রাত গভীর হচ্ছে মানুষের ভিড় বাড়ছে। বেড়েই চলেছে। রাস্তার দু'পাশে হাজার হাজার এসি ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। নগদানগদি দামে কিনে নিচ্ছেন সেইসব মাছ কর্পোরেট ব্যবসায়ীরা। সমস্ত জায়গায় বাজার বন্ধ। সবাই জ্যান্ত ইলিশ মাছ সংগ্রহ করতে ব্যস্ত। প্রশাসন খুব খুশি। আজকের জন্য সরকারের প্রধান সব সরকারি অফিস, ইস্কুল, আদালত ছুটি ঘোষণা করে দিয়েছে।

আরও পড়ুন- সাইকেল: অমৃতা সরকার

আজ ঘরের গন্ধটা যেন অন্যরকম লাগছে পদ্মিনী। একপেট ঘুমিয়ে ঘোতন বিশ্বাস নরম স্বরে বলেন।

হ্যাঁ।

ঘরময় ইলিশ ইলিশ গন্ধ।

এইরকম ইলিশ খাওয়া সেই ছেলেবেলায় খেয়েছি। বলতে বলতে নন্দিনী বিছানায় উঠে বসেন। তারপর বড় বড় চোখ করে বলতে শুরু করেন, বাবা, এইয়া বড় ইলিশ মাছ এনে মার অপেক্ষায় থাকতেন না। সোজা কলতলায় চলে যেতেন। প্যান্টের পকেট থেকে পাঁচ পয়সা বের করে ভটাভট ইলিশ মাছের আঁশ ছাড়াতেন। তারপর গোটা মাছটা ভালোভাবে ধুয়ে মায়ের জিম্মায় দিয়ে দিতেন। মা কতরকম পদ রান্না করতেন। সারা পাড়া জেনে যেত, আজ আমাদের বাড়ি ইলিশ মাছ হচ্ছে। সেই মাছের তেল ভাজার সঙ্গে গরম ভাত কী যে উপাদেয় লাগত তা আর বলার নয়! আহা!

সেরকমই মনে হচ্ছে আমার। নন্দিনীর কথা শেষ না হতেই ঘোতন বিশ্বাস বলেন, আমরা যেন টাইম মেশিনে ফিরে গেছি সেই অতীতে। ঠিক কথাই বলেছ, আমার ছেলেবেলারও একই ছবি ছিল। রাতের সিগেরেট খেতে পাড়ার গলি অবধি গেছিলাম। পাড়ার বাতাসে ইলিশ মাছের গন্ধ। তারপর নন্দিনীর গা ঘেষে এসে দাঁড়ান ঘোতন বিশ্বাস। আবারও বলেন, দেখ, দেখ, আমার গা দিয়ে ইলিশ মাছের গন্ধ কেমন ভুরভুরিয়ে বেরুচ্ছে। তোমার গা দিয়েও পদ্মিনী।

হ্যাঁ গো, ঠিক বলেছ।

পাশাপাশি দুই বুড়োবুড়ি শুয়ে আছেন। বুড়োর মনে হয়, তারা যেন আর মানুষ নন, এই মুহূর্তে মাছ হয়ে গেছেন। ইলিশ মাছ। ইলিশ মাছ। রুপোলি শস্য। কিলবিল করছেন ঘরের মধ্যে। ঘরের চার দেয়ালের ভিতর সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছেন। সাঁতার কাটতে কাটতে ঘর থেকে বেরুলেন। তারপর যা দেখলেন আশ্চর্য হয়ে গেলেন। তাদের মতো সবাই বেরিয়ে এসেছেন ঘর থেকে। গঙ্গার ধারে এসে ঝুপঝুপ করে জলে ঝাঁপ দিচ্ছেন। গঙ্গায় একটুও জল নেই। একটুও…।

শুধু রুপোলি আলোর চাকচিক্যে চাঁদের জ্যোৎস্নাও ম্লান হয়ে যাচ্ছে।

More Articles