গৃহপ্রবেশ : সোহম দাস

Bengali Short Story: মুরগি পালন মুরুগানদের অনেক বছরের ব্যবসা। নিজেরা অবশ্য মাংস খায় না। রোজ শেষরাতে তাদের সবকটা মোরগ এক-এক করে ডাকতে শুরু করে।

আজ গৃহপ্রবেশ।

মালিক বিজয় বীরেন্দ্রন নিজে চলে এসেছেন, তখনও চারপাশে ভালো করে আলো ফোটেনি। আয়োজনের খুঁটিনাটি তদারক করছেন। বেলা বাড়লে পরিবারের বাকি সদস্যরা এসে পৌঁছবে। এখন অল্প অল্প আলো ফুটছে চারিদিকে। দোতলার সিঁড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে উপরে উঠছিল একটা লোক। সাদা চুল আর কুঁচকে যাওয়া হাতের চামড়া দেখে বয়স সম্পর্কে একটা সম্যক আন্দাজ করে নেওয়া যায়।

সেই শীর্ণ হয়ে আসা দুই হাতের একটিতে ঝুলছে একটি বাদামী মোরগ, অন্যটিতে দাঁ।

দু’হাতের দুটো জিনিসকে সামলে রেখে বেশ সাবধানেই উঠছিল সে। উঠতে উঠতে তাকে খেয়াল রাখতে হচ্ছিল পায়ের দিকেও। মেঝেতে অজস্র তারের খণ্ডাংশ আর সিমেন্টের টুকরো চাঙড়। দেখেশুনে না উঠলে যেকোনও মুহূর্তে পা হড়কে যাওয়ার সম্ভাবনা, আর এই বয়সে পড়ে যাওয়া মোটেই সুখের বিষয় নয়। অথচ দু’হাত জোড়া থাকায় সিড়ির রেলিং ধরে যে উঠবে সে উপায় নেই।

লোকটার নাম অরবিন্দন। গত মাসেই সে বাহাত্তর পেরিয়েছে। পেশায় মিস্ত্রি। পাশাপাশি এই ধরনের অনুষ্ঠানে পৌরহিত্য করেও দু’পয়সা কামায়।

বাড়িটা এখনও সম্পূর্ণ তৈরি হয়নি। লিফটের কলাম তৈরি হয়ে গেলেও এখনও লিফট বসানো হয়নি। গ্যারেজের শাটার লাগানো হয়নি। এছাড়া, আরও নানা কাজ বাকি। গৃহপ্রবেশ পর্ব মিটে গেলে বাকি কাজ হবে। তারপর পাকাপাকি থাকা শুরু। দক্ষিণ ভারতের এই অঞ্চলে এমনই রীতি।

বাড়ির মালিক বীরেন্দ্রন স্যারের কড়া হুকুম, অনুষ্ঠানে কোনও প্রকার ত্রুটি যেন না হয়। অনেক বছরের সঞ্চয় ঢেলে দিয়ে, বড় যত্নে এই স্বপ্নমঞ্জিল বানাচ্ছেন তিনি। আচার-অনুষ্ঠানে এতটুকু গোলমাল হলে সব পণ্ড। সত্তরোর্ধ্ব অরবিন্দনের তাই দম ফেলার সময় নেই।

অনেক ঘুরে ঘুরে অবশেষে দক্ষিণ চেন্নাইয়ের মাদামবক্কমের এই প্লটটা খুঁজে পেয়েছেন বিজয় বীরেন্দ্রন। তিনি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, মাল্টিন্যাশনাল ফার্মের উচ্চপদ দখল করে আছেন। বছরে নয় নয় করেও দু'বার বিদেশ ভ্রমণ হয়ে যায়। জাপান আর সিঙ্গাপুর যে কতবার গেছেন, নিজেই তার হিসাব রাখেননি। বয়স এখন পঞ্চাশ পেরিয়েছে, আর বছর চারেক পরেই রিটায়ারমেন্ট, তার আগে নিজের শহরে সুবিধামতো একটা বাড়ি বানিয়ে নিতে চান। রিটায়ারমেন্টের পর আর এত দৌড়ঝাঁপ পোষাবে না।

মাদামবক্কম জায়গাটার বিশেষ পরিচিতি ধেনুপুরীশ্বর মন্দিরের কারণে। চোলরাজ দ্বিতীয় পরন্তক চোলের আমলের মন্দির, বয়স এখন হাজারেরও বেশি। কিন্তু বিজয় বীরেন্দ্রনের এ জায়গাটা বেছে নেওয়ার কারণ আশেপাশের পরিবেশ। তিনি এখন থাকেন টি. নগরে, মেন রাস্তার ওপরেই তাঁর চার কামরার সুসজ্জিত ফ্ল্যাট। টি. নগর ব্যবসায়ীদের জায়গা। হাজার থেকে কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে সেখানে। স্বাভাবিকভাবেই কোলাহলটা বেশি। মাদামবক্কম সেদিক থেকে অনেকটাই আলাদা। গাছপালা আর পাখির ডাক মিলিয়ে চারিদিক বেশ মনোরম। এমনিতেও চেন্নাই শহরের খ্যাতি তার সবুজের জন্য। সেই খ্যাতির সিংহভাগ না হলেও দশ শতাংশ কৃতিত্ব মাদামবক্কম দাবি করতেই পারে, সেই অধিকার তার আছে। রিটায়ারমেন্টের পর যথেষ্ট আরামেই কাটবে।

বাড়িটা চারতলা। বীরেন্দ্রনের বড় পরিবার। তিনি, তাঁর স্ত্রী, দুই ছেলে-মেয়ে, আপ্পা-আম্মা, মামা-আত্তাই। আপ্পা এখন ছিয়াশি, আম্মা ঊনআশি। মামা-আত্তাই নিঃসন্তান, বিজয়কেই নিজেদের সন্তান হিসেবে দেখেছেন তাঁরা, তাঁর কাছেই থেকেছেন। মামা আশি পার করেছেন, আত্তাই পঁচাত্তর। এই চারজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধার কথা ভেবেই ছাদ অবধি একটা লিফটও লাগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এত বছরের চাকরিতে টাকা তো আর কম করেননি। সাধের বাড়িটার পিছনে না হয় একটু বেশিই খসল।

শহরের নামকরা বিল্ডার কোম্পানিকে দিয়ে বাড়ির নকশা করিয়েছেন বীরেন্দ্রন। খেতাবধারী জ্যোতিষীকে দিয়ে বাস্তু পরীক্ষা করিয়েছেন। বাড়ির বাইরের রং পছন্দ করেছেন বিস্তর ভাবনাচিন্তা করে। অবশ্য ইন্টিরিয়র ডেকরেশনের ব্যাপারে স্ত্রী যমুনাই এগিয়ে এসে দায়িত্ব নিয়েছেন। স্ত্রীর বুটিকের ব্যবসা, ফলে নকশা-শিল্পের জগতের অনেককেই চেনেন তিনি। ঊনত্রিশ বছরের বিবাহিত স্ত্রীর রুচির উপর বিজয়ের যথেষ্ট ভরসা আছে, আর এই ঘর সাজানোর মতো ‘মেয়েলি’ বিষয়ে তাঁর চেয়ে যমুনাই বেশি উপযুক্ত বলে মনে করেন তিনি।

ইতিমধ্যেই কয়েকজন পরিচিত ব্যক্তি এসে দেখে গেছেন বাড়িটি এবং প্রত্যেকেই ঢালাও প্রশংসা করেছেন। এখন গৃহপ্রবেশের অনুষ্ঠানটা ভালোয় ভালোয় মিটলেই নিশ্চিন্তি।

আরও পড়ুন- লুকিয়ে থাকা রুটম্যাপ: সুমিত বন্দ্যোপাধ্যায়

অরবিন্দন সমস্ত কথাই জানে। স্যারের দু’খানা গাড়ি। একটা ফোর-সিটার মারুতি অল্টো, আরেকটা সেভেন-সিটার হন্ডা বিআরভি। মারুতির যে চালক, সে ছোকরার বয়স কম। বাইশ-তেইশ হবে। অরবিন্দনের সঙ্গে ভালোই ভাব আছে। তার মেয়ের ঘরের নাতিটাও প্রায় এর বয়সি। অরবিন্দনকে চা-চাট খাওয়ায়-টাওয়ায়, কখনো বা সম্বর-বড়া, চিলি ভাজি, পানিয়ারম।

ওই ছেলেটার কাছেই অরবিন্দন শুনেছে, স্যারের মাইনে নাকি বছরে চল্লিশ লাখের কাছাকাছি। ম্যাডামের বুটিকের ব্যবসাতেও প্রতি মাসে আয় দেড় লাখের উপর। সব মিলিয়ে বছরে এদের রোজগার কতটা, এবং সেখানে ক’খানা শূন্য বসালে ঠিকঠাক দাঁড়াবে, সেই হিসাবটা নিয়ে ভাবতে গিয়ে অরবিন্দন কুলকিনারা করতে পারেনি। তাই একবারের বেশি দ্বিতীয়বার আর সেই চেষ্টাও করেনি। আজকের কাজটা ভালোয় ভালোয় উতরে দিলে স্যারের কাছ থেকে মোটা টাকা বকশিশ পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। সেটা পেলেই হবে। অত হিসাবে তার কাজ কী!

সিড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে এসব কথাই ভাবছিল সে।

দোতলায় উঠে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে পড়ল অরবিন্দন। একটানা সিড়ি ভেঙে হাঁপ ধরে গেছে। তার উপর বাঁ হাতে ঝুলছে এত ভারী একটা মোরগ। দাঁড়িয়ে না থেকে বসতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু চারপাশের যা অবস্থা, বসার মতো একটু জায়গাও নেই। সাদা পাঞ্জাবিটা ঘামে ভিজে গেছে। দা-ধরা হাতটার কবজি দিয়েই কোনওরকমে কপাল আর গালের ঘাম মুছে নেয় সে। কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে আবারও সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করে।

হাতের মোরগটা মাঝেমাঝেই নড়েচড়ে উঠছে। গলা দিয়ে ‘কুঁক-কুঁক’ ধরনের একটা গোঙানির শব্দও করছে কখনও-কখনও। বেশিরভাগ সময়েই এদের মাথা উল্টো করে ঝুলিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, মাথায় রক্ত উঠে যায় কিনা কে জানে! অন্য অনেক কথার মতো অরবিন্দন এই কথাটাও কখনও ভেবে দেখেনি।

তাদের পাশের বাড়ির মুরুগানদের মোরগ এটা। মুরগি পালন মুরুগানদের অনেক বছরের ব্যবসা। নিজেরা অবশ্য মাংস খায় না। রোজ শেষরাতে তাদের সবকটা মোরগ এক-এক করে ডাকতে শুরু করে। এখনকার ঠিকানায় অরবিন্দনরা যখন প্রথম ভাড়া এসেছিল, তখন রোজই মোরগের ডাকে ঘুম ভেঙে যেত, এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। এই মোরগটাও ডাকে। এর ডাক সকলের চেয়ে জোরে। আজকেও ডেকেছে। কিন্তু কাল থেকে আর ডাকতে পারবে না – কথাটা ভেবেই মনটা আনন্দে ডগমগ করে উঠল।

বড় বজ্জাত স্বভাব এটার। এমনিতে মাদ্রাজি মোরগরা স্বভাব-তেজি, লড়াইয়ের সময়ে ভালো দাম ওঠে, ভারতের অন্যান্য জায়গায় এক্সপোর্ট হয়, কিন্তু এই মোরগটার তেজ স্বাভাবিকের চেয়ে কিঞ্চিৎ বেশিই। বাড়ির ত্রিসীমানায় অচেনা কাউকে দেখলেই গলার পালক ফুলিয়ে তেড়ে আসে। ঠুকরে দিতে চায়। যদিও অরবিন্দনকে ভয় খায় এটা। একবার ঠুকরে দিতে গিয়ে অরবিন্দনের পায়ের জোরালো লাথি খেয়ে ছিটকে পড়েছিল, সেই থেকে বাইরের লোকের মধ্যে একমাত্র তাকে দেখলেই উঠোনের অন্য পাশে সরে যায়। মুখ চিনতে মোরগদের ভুল হয় না। লাথি মারার ঘটনাটা নিয়ে মুরুগানদের সঙ্গে একপ্রস্থ ঝামেলাও হয়েছিল।

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে অরবিন্দন মোরগটার পায়ের হলুদ আঙুলগুলোর দিকে তাকায়, আঙুলের ডগায় ধারালো নখ। ওই নখ দিয়ে কতজনকে যে আঁচড়ে দিয়েছে, তার ঠিক নেই। মানুষ, কুকুর, বেড়াল, ইঁদুর, অন্য পাখি– সকলের সঙ্গেই শত্রুতা ওর।

দিন পনেরো আগেই অরবিন্দনের ছ’বছরের নাতনিটাকে ঠুকরে দিয়েছে শয়তানটা। ছোট ছেলের এই মেয়েটা দাদুর ভারী ন্যাওটা, যত আবদার দাদুর কাছেই। নিজের মনে খেলতে খেলতে ওদের উঠোনের দিকে চলে গিয়েছিল। তেজিয়ান মোরগটা বুঝি তক্কে তক্কেই ছিল। সঙ্গে সঙ্গে ‘কঁক-কঁক-কঁক’ করে ডেকে উঠে ছুটে আসে। ছোট্ট মেয়েটা ভয় পেয়ে দৌড়োতে গিয়ে পড়ে যায়, তখন হাতে ঠুকরে দিয়েছে। কচি গলার চিৎকার শুনে মুরুগানদের বউটা এসে ওকে উদ্ধার করে দজ্জাল মোরগটার হাত থেকে। সেই তারপর হাতে ওষুধ লাগিয়ে মেয়েটাকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে গেছে। তখনও সে ভয়ে থরথর করে কাঁপছিল। তারপর থেকে অরবিন্দন অপেক্ষায় ছিল একটা সুযোগের।

সুযোগটা যে এত তাড়াতাড়ি এসে যাবে, সে ভাবেনি। পেরুমলের কৃপাই বলতে হবে। দিন চারেক আগে বীরেন্দ্রন স্যার এসে গৃহপ্রবেশের জোগাড়যন্ত্র করতে বললেন। যা যা লাগবে, তার একটা ফর্দ করে দিতে বললেন। ফর্দ দেখার পর কয়েক হাজার টাকা আগাম দিয়েও গেলেন। আচার-অনুষ্ঠানের বিষয়ে বড়লোকদের হাত খুব খোলা।

বীরেন্দ্রন স্যারকে অরবিন্দনের বেশ ভালো লাগে। কত টাকার মালিক, কিন্তু কী ভদ্রলোক! ওই ড্রাইভার ছেলেটার মুখেই সে শুনেছে, স্যার প্রচুর দানধ্যান করেন, প্রতিবছর নিয়ম করে তিরুপতি যান। এসব শোনার পর স্যারের প্রতি তার শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেছিল।

শুভাশুভ-সংক্রান্ত বিষয়েও স্যার খুব একনিষ্ঠ। সারা জীবনের সঞ্চয়ের একটা বড় অংশ তিনি বাড়িটার পিছনে ঢেলে দিচ্ছেন, সেখানে কণামাত্র অমঙ্গলের আঁচ লাগতে দেওয়া যাবে না। বাস্তু মেনে বাড়ি করলেই তো শুধু হল না, অশুভ শক্তির দৃষ্টি যাতে কোনওভাবেই এ বাড়ির উপর না পড়ে, সেদিকেও তো খেয়াল রাখতে হবে।

“মোরগ বলি দিলে কোনও অশুভ আত্মার বাপের সাধ্যি নেই, আপনার বাড়ির দিকে তাকায়!” অরবিন্দন বলেছিল স্যারকে।

বলি দেওয়া মানে রক্তারক্তি কাণ্ড। কিন্তু এটাই সবচেয়ে উপযুক্ত পদ্ধতি অশুভ আত্মাকে ঠেকিয়ে রাখার। বীরেন্দ্রনের মনে ধরে গেল। কয়েক হাজার টাকার মধ্যে মোরগের দামও ধরে দিলেন তিনি।

তিনতলায় উঠে এসেছে অরবিন্দন। আর একতলা গেলেই তার গন্তব্য। কাটাকাটি যা হওয়ার, সব ছাদের কাছে হোক, বীরেন্দ্রন স্যারের নির্দেশ তেমনই।

আবার দাঁড়িয়ে পড়ল সে। ভোরের আলো ফুটে গেছে অনেকটা। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি করতে হবে সবকিছু, সময়ের এদিক-ওদিক হয়ে গেলে সব গোলমাল। মঙ্গল-অমঙ্গলের একটা ব্যাপার আছে তো।

একটু দম নিয়ে আবার উঠতে শুরু করল অরবিন্দন। মোরগটা কি বুঝতে পারছে কিছু? যে গলায় রোজ হরবখত ডাক ছাড়ে নিজের দাপট বোঝাতে, সেই গলাটা যে আর কিছুক্ষণ পরে থাকবে না, তা বুঝতে পারছে কি সে?

বীরেন্দ্রন স্যারের সঙ্গে কথা হওয়ার মুহূর্তেই সে ছকে নিয়েছিল নিজের পরিকল্পনা। সেদিন ফেরার পথে নিজের ঘরে না ঢুকে আগে মুরুগানদের বাড়িতে যায়। ওই মোরগটা তার চাই। মুরুগানদের বড় ভাই পাল্লুর কাছে প্রস্তাবটা রাখতে সে বলল– “মামা, মোরগটা হেবি ডেঞ্জারাস, এটা ঠিক। অনেককেই ঠুকরেছে, ওর জন্য লোকের কাছে কথা শুনতে হয়। তোমার সঙ্গেও সেবার ঝামেলা হয়ে গেল। কিন্তু ওটা সর্বক্ষণ থাকে বলেই উঠোনে বেড়াল-কুকুর ঢুকতে পারে না। বেচতে পারব না।”

কিন্তু অরবিন্দন নাছোড়বান্দা। বলল – “ভালো দাম পেলেও বেচবি না?”

পাল্লু দোনামনা করছিল। বউও সামনে ছিল। বউয়ের দিকে তাকাতে সে চোখ টিপে ইশারা করল। বলল – “তা বলো কত দিতে পারবে। দেড়-দু'হাজার হলে ভেবে দেখতে পারি।”

শেষ পর্যন্ত হাজার টাকায় রফা হল। অরবিন্দনের পকেটে সেদিন কড়কড়ে দু’হাজার আর পাঁচশো টাকার নোট। বীরেন্দ্রন স্যার অ্যাডভান্স দিয়েছেন। সেদিনই পাঁচশো টাকা দিয়ে দিল পাল্লুকে। ঠিক হল, গৃহপ্রবেশের দিন ভোররাতে এসে মোরগটাকে নিয়ে যাবে অরবিন্দন, বাকি টাকা তখন দেবে।

সেই মোরগ এখন তার হাতে। বন্দি, অসহায়, মৃত্যুস্পর্শী।

যত সিঁড়ি ভাঙছে অরবিন্দন, ততই ক্রমশ কমে আসছে মোরগটার পরমায়ু। আর কয়েক ধাপ উঠলেই ছাদ। সিঁড়ি যেখানে শেষ হচ্ছে, সেখানেই বলি দেওয়ার কথা। কিন্তু জায়গাটা বড্ড নোংরা, রাবিশে ভর্তি। এদিকটার কাজ এখনও পুরো হয়নি। প্লাস্টারও বাকি। পা দিয়ে সরিয়ে খানিক পরিষ্কার করে নিতে হবে, তারপরে আসল কাজ।

শেষ ধাপটায় উঠতে শুরু করল অরবিন্দন। বাঁ হাতটা দিয়ে আরও বেশি জোরে চেপে ধরল মোরগটার পা দুটো। এতক্ষণ মাথা নিচে করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে বলেই বোধহয় খানিক নেতিয়ে পড়েছে সে, নড়াচড়া করছে না সেভাবে। অরবিন্দনের কেমন একটা সন্দেহ হল। একবার তুলে দেখে নিল। না, দিব্যি চোখ চাইছে। মরেনি। এ ব্যাটা এত সহজে মরে যাওয়ার বান্দা নয়।

চারতলায় উঠে এল অরবিন্দন। ছাদের দরজার পাল্লার ফাঁক দিয়ে বোঝা যাচ্ছে ভোরের আলো ফুটে গেছে। ছাদের দরজার মুখোমুখি লিফটের দরজা বসবে। এখন শুধু গর্তটা করা আছে। দা টা এক জায়গায় রেখে রাবিশ, তারের টুকরোগুলো পা দিয়ে একপাশে সরাতে শুরু করল সে। সিঁড়ির রেলিংয়ের ধারে জড়ো করতে লাগল সেগুলোকে, ধুলো উড়ছে। আরও কয়েকটা বড় টুকরোকে সরালেই অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। তারপরেই মোরগটার ব্যবস্থা করে ফেলবে।

কাজ প্রায় হয়েই এসেছে, আর দুটো টুকরো সরাতে বাকি, হঠাৎ ডান পা-টা একটা টুকরোর ওপর পড়ে পিছলে গেল। বয়সের কারণে বডি ব্যালান্স কমে গেছে অরবিন্দনের, টাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে পড়ে গেল সে, আর এই ফাঁকে মোরগটার পা থেকে তার হাতের বাঁধন আলগা হয়ে গেল। সিঁড়ির দিকে অরবিন্দনের গড়িয়ে পড়া শরীর, মোরগটা তাই মুক্তি পেয়ে উড়ে গিয়ে বসল স্তূপাকৃতি করে রাখা রাবিশের ওপর।

ধর্মকর্মে এমন বাধা আসা বাড়ির লোকের জন্য ভালো লক্ষণ নয়, স্যার শুনলে রক্ষে থাকবে না আর। পড়ে গিয়ে কোমরে লেগেছে, কিন্তু সেসব নিয়ে ভাবার সময় নেই। অরবিন্দন সর্বশক্তি দিয়ে মোরগটাকে ধরার চেষ্টা করল। মোরগটা এমনিই দজ্জাল স্বভাবের, এতক্ষণে সে নিশ্চয়ই বুঝে গেছে, এখানে নেমন্তন্ন খাওয়াতে তাকে নিয়ে আসা হয়নি। এই লোকটাও সুবিধের নয়। অরবিন্দনের নাগাল এড়িয়ে সে লিফটের গর্তটার পাশ দিয়ে ছুটে পালানোর চেষ্টা করল। উদ্দেশ্য, চাতালের অন্য কোণে চলে যাওয়া।

সন্ত্রস্ত, নির্বোধ মোরগের এই ফন্দিটা খুব সহজেই ধরে ফেলল বাহাত্তর বছরের অরবিন্দন। গর্তের পাশ দিয়ে ছুটে পালানোর সময়ে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে পাখিটার ডানাদুটো খপ করে ধরে ফেলল সে। আর এটা করতে গিয়েই আরও একবার হড়কে গেল তার ডান পা।

পরমুহূর্তেই অরবিন্দন আবিষ্কার করল, তার পা আর মাটিতে নেই, কোন এক অজানা চৌম্বকীয় শক্তির টানে তার দেহ দ্রুত নিচের দিকে নামছে। মোরগটা তখনও হাতে ধরা, পালানোর চেষ্টায় ডানা ঝাপটাচ্ছে।

আরও পড়ুন- তিরচিহ্ন: যশোধরা রায়চৌধুরী

ভারী কিছু পতনের শব্দ, একজন বয়স্ক মানুষের আর্ত চিৎকার, আর একটা মোরগের ডাক– গ্রাউন্ড ফ্লোরের এলিভেটর কলামের দিক থেকে একসঙ্গে তিনটে আওয়াজ শুনে ছুটে এসেছিলেন বিজয় বীরেন্দ্রন স্বয়ং। সঙ্গে তাঁর অল্টো গাড়ির ছোকরা ড্রাইভার। যে ক্ষিপ্রতা নিয়ে ছুটে এসেছিলেন দু'জনে, অকুস্থলের দৃশ্য দেখে সেই ক্ষিপ্রতা মুহূর্তে উধাও।

মেঝেতে পড়ে রয়েছে পুরোহিত লোকটি, রক্তে ভেসে গেছে চারপাশ। লোকটার মুখ থেকে ভেসে আসছে একটা চাপা গোঙানির আওয়াজ। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, আর বেশিক্ষণ আয়ু নেই তার।

ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা মোরগ, গায়ে একটা আঁচড় পর্যন্ত নেই। অচেনা লোক দেখে তার গলার বাদামী পালক ফুলে উঠেছে। এই বুঝি তেড়ে আসবে।

 

More Articles