নসু মোড়লের বাদা: হামিরউদ্দিন মিদ্যা
Bengali Short Story: একটা মাটির চালাঘর বানিয়ে নসু মোড়ল বাদাতেই পড়ে থাকে সারাটা দিন, সারাটা রাত। ছেলেপুলেরা খাবারটি পর্যন্ত বয়ে দিয়ে যায়। টিপকলও বসিয়েছে। কত রকম ফলের গাছ! কী নেই?
রাত গভীর হলে জানালার পাশের ঝাঁকড়া কুলগাছটা থেকে পেঁচাটা কয়েকদিন ধরেই বুকে কাঁপুনি-ধরানো ডাক দিচ্ছে। পাড়া-গাঁয়ের নানি-দাদিরা বলে, ও পেঁচা যখনতখন ডাকে না, বছরভর ও ঘুমিয়ে থাকে, যখন কোনও বিপদ আসে, তা আগাম টের পায়, আর বুকের রক্তকে হিম করে দেওয়ার মতো গভীর রাতে ডাক পাড়ে। যে ওই ডাক শুনতে পায়, তার কোনও ক্ষতি হবেই। নসু মোড়ল কয়েকদিন ধরেই খুব ভয়ে ভয়ে রয়েছে, একেই বাদাটা অন্ধকার, মূল গ্রাম থেকে কিছুটা দূরে, তার ওপর এই জনমানুষহীন জায়গায় চালাঘরে একলা শোয়া, সেখানে ওমন অশুভ পেঁচার ডাক শুনলে যত সাহসী মানুষই হোক, পিলে তো চমকাবেই।
নসু মোড়ল খবরটা শুনল বিকেলে খাঁদুর চায়ের দোকানে চা খেতে গিয়ে। কোম্পানির গাড়ি নাকি টহল দিয়ে গেছে। যে আশঙ্কটা এতদিন ধরে মনের ভেতর বিন্দু বিন্দু দানা বাঁধছিল, যে ভাবনা তার মনে জাগলে— সুখে বেঁচে থাকা, আয়েশ করে দিনগুজরান সব হারাম করে দিত, শেষমেশ সেই চিন্তাই ঘাড়ের ওপর খাড়া হয়ে নামল!
গাড়িটা এসেছিল দুপুরের দিকে। ক্যানেলের দখিন পাড় ধরে ঝাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে চলছিল, আর দু'-জন অফিসার গোছের লোক খোলা হুড দিয়ে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করতে করতে যাচ্ছিল। ল্যাদা সিঙ্ঘির ব্রিজের কাছে একবার গাড়িটা দাঁড়িয়েছিল, তারপর অফিসার দু’জন গাড়ি থেকে নেমে নসু মোড়লের বাদার পানে চেয়ে চেয়ে পায়চারি করেছিল খানিক, বাদার উত্তরে ক্যানেলের গাবায় বছরপাঁচেক আগে গজিয়ে ওঠা মুনিষপাড়ার দিকেও নজর বুলিয়েছিল লোকদুটো। নসু মোড়ল তখন বাদায় থাকেনি। কয়েকটা কলাগাছের কাঁদি নামিয়ে জুমড়াশোলের হাটে গিয়েছিল বেচতে।
আরও পড়ুন: মনপেলিয়া: উজান চট্টোপাধ্যায়
কেলে বাগদি ক্যানেল গাবায় মোষ চরাচ্ছিল, সে-ই স্বচক্ষে দেখেছে, আর গাড়িটা যখন ব্রিজের কাছে থেমেছিল, তখন নিচের বাঁধানো ঘাটে চান করছিল মুনিষপাড়ার কয়েকজন বউ-ঝি, ওরাও দেখেছে লোকদুটোকে।
নসু মোড়ল বলল, “তুই ঠিক দেখেছিস কেলে? গাড়িটাই কোম্পানির স্ট্যাম্প ছিল?”
“হ,চাচা,একদম ঠিক দেখেচি,পেছুনে-সামনে দু'-জায়গাতেই ক্যানেল কোম্পানির গোল ইস্ট্যাম ছিল। আর অমন ইস্ট্যাম্প দেওয়া গাড়ি তো জোয়ান কালেও অনেকবার দেখেচি, তখন জল ছাড়ার আগে দিনে দু’বার করে যাওয়া-আসা করতুক।”
চা খাচ্ছিল বুধন ঘোষ, সে বলল, “না দেখার কী আছে! যে বছর থেকে গেটে গেটে কোম্পানি পাহারাদার রাখলেক,তখন থেকেই গাড়ি আসা কমে গেলেক। সব তো ফোনে ফোনে খবর হয়ে যাচ্ছে এখন, কত কিউসেক জল ছাড়া হল,কত পাশ করতে হবেক। উপর মহলের বাবুদের আর আসার দরকার কী!”
“হ, তার লেগেই তো রাস্তাটা ফুটলেক। কোম্পানি এক টলি মোরামও ফেলেনি। ঝোপঝাড়ে বুজল,রাস্তার ইটগুলো দাঁত খিঁচিয়ে বেরিয়ে পড়লেক। যখন চাল ব্যবসা করেছি তখন ওই রাস্তা দিয়ে সাইকেলের পেছুনে আর ব-য়ে এক দেড় কুইন্টাল চাল নিয়ে বাজারে গেছি। এখন যা রাস্তার অবস্থা খালি সাইকেল নিয়ে গেলেই শরীলের হাড়-পাঁজরাগুলো লড়বড়ে হয়ে যাবেক।”
কেলে বাগদি বলল, “নসু চাচার হাতে পড়ে জায়গাটার ভোল বদলাল। মানুষ দুটো শাক-সবজি ফলিয়েও খেতে পাচ্চে।”
দামোদর নদ থেকে বেরিয়ে আসা একটা ক্যানেল, তার জলই এই এলাকার বিস্তীর্ণ একফসলি মাঠকে দু’ফসলি করে তুলেছে। চাষিদের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। আগের বুড়ো মানুষদের জিজ্ঞেস করো,হাত নেড়ে নেড়ে শুনিয়ে দেবে, “ধান আর হতুক কুথায় গো! ম্যাগের পানে চেয়ে চেয়ে একবার চাষ। তাও কুনু ভরসা ছিলনি। সব তো ডাঙা, টিলা এবড়ো-খেবড়ো ভূমি। শিয়াল ঘুরে বেড়াতুক,গো-বাঘা বাস করতুক। বাগালরা গরু-ছাগল ছেড়ে গাছতলায় নিশ্চিন্তে বসতে পেতুকনি। গো-বাঘায় কত যে ছাগল,বাছুরের নলি কেটে দিইচে!”
আলোচনাটা যখন চরমে পৌঁছেছে,তখন মণ্ডলপাড়ার হাসু হেঁট হয়ে ঢুকল দোকানে। হাসু বলল, “গিয়েছিলাম কাল পশ্চিমে। ওধারে মাটি কাটার গাড়ি লেগেছে। গাছপালা সব কেটে পরিষ্কার করে দিচ্ছে।”
খবরটা মুখে মুখে কয়েক বছর ধরেই ঘুরছে, ক্যানেলটায় নাকি কাজ হবে। বছরখানেক বোরো চাষে জল ছাড়বে না, তল-ওপর ঢালাই করে বাঁধানো হবে, পাড় দু’খান উঁচু করে পাকা সড়ক হবে। সে তো শুনেই আসছে সবাই, বোরো চাষের আগে একবার করে রটে যায়, জল ছাড়বে না, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না, কিছুদিন না পেরোতে পেরোতেই জল ছেড়ে দেয় ক্যানেলে। নসু মোড়লের তাই এতটা চিন্তা থাকেনি, কিন্তু কোম্পানির গাড়ি টহল দিয়ে গেছে শুনে মাথায় বাজ পড়ল।
খাঁদু চা দিতে দিতে ফোড়ন কাটল, “এত বড় ক্যানেলটা ঢালাই করে বাঁধাবে! এত টাকা কোম্পানির আছে?”
“কোম্পানির কি টাকার অভাব নাকি! বছরে জলকর খাজনা, সরকারি ভরতুকি সব নিয়ে কম রোজগার! কোম্পানি চাইলে কী না পারে।”
মুনিষপাড়ার বাবলু বলল, “ক্যানেলের পাড় ঢালাই হলে আমাদের ঘরবাড়িগুলো কি উঠিয়ে দিবেক?”
প্রশ্নটা শুনে সবাই বাবলুর দিকে চিন্তিত মুখে তাকাল। সত্যিই তো, এই কথাটা কেউ ভেবে দেখনি।
প্রতি বছর ধানকাটার সময় পশ্চিমের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে দল বেঁধে এই পুবে নাবাল খাটতে আসে কিছু মানুষ। বছরখানেক আগে সেরকমই কিছু মুনিষ ক্যানেল পাড়ে তাবু খাটিয়ে ছিল। তারপর যখন ধানকাটা শেষ হলো, চাষিদের খামারে ধান উঠে গেল, ঝাড়াই-মাড়াই করে ধান গোলায় উঠল, তখনও দেখা গেল লোকগুলোর ওঠার কোনও নামগন্ধ নেই। বরঞ্চ কেউ কেউ বাঁশ-খড় কিনে চালাঘর বানাতে আরম্ভ করল। জায়গাটা যেহেতু ক্যানেল কোম্পানির, গাঁয়ের মানুষ আপত্তি করল না। আর সবাই দেখল, ওরা থাকলে সুবিধায় হবে,সময়ে অসমে মুনিষ লাগলে পাওয়া যাবে। যারা বসত গড়ল, একে একে তাদের পরিবারের, গাঁয়ের অনেকেই আসতে লাগল এখানে। এখন একটা বিশাল বড় পাড়া হয়ে গেছে। মাটির বাড়ি ছাড়াও কেউ কেউ টিন-এডবাস্টেট দেওয়া পাকাবাড়িও তুলেছে।
হাসু মণ্ডল বলল, “কী যে করবেক কোম্পানিই জানে। তবে জেসিবি গাড়ি দিয়ে সব পরিস্কার দিচ্ছে,অনেক চওড়া হবে তো রাস্তাটা।”
নসু মোড়ল আর বসল না। চা-দোকান থেকে উঠে চলে গেল। দোকানে যারা চা খাচ্ছিল, সবাই দেখল মানুষটাকে। কেউ কেউ জিভ চুক চুক করল, “আহা গো! মোড়লের মনে চিন্তা ঢুকে গেছে। সত্যিই,অনেক মেহনত করে বাদাটা তৈরি করেছে মোড়ল। কী ছিল জায়গাটা,আর কী বানাল!”
দুই
বছরতিনেক আগে এইসব জায়গা ছিল খাঁ খাঁ রুক্ষ ভূমি। সরগাছ, বেনাঝোপ, বেঁচফল আর বুনো কুলের জঙ্গলে ভরা ছিল। শিয়াল, খটাশ, হেঁড়ল, নেউলের বাসস্থান ছিল। ডাহুক পাখিরা কোলে ছানাপোনা নিয়ে সকাল-সন্ধ্যায় কুয়া-আ-আ-আ কুয়া-আ-আ-আ… করে ডাক পাড়ত। ক্যানেলের দু'পাশ এখন আর চেনা যাবে না। পাড়গুলোয় সরু একফালি পারাপারের রাস্তা ছেড়ে দিয়ে, যে যতটুকু পেরেছে, আগলে নিয়েছে। কঞ্চি, বাবলা ডাল আর শিঁয়াকুলের বেড়া দিয়ে ঘিরে ছোট ছোট সবজিক্ষেত বানিয়ে মুলো, পালং, বেগুন, কাঁচালঙ্কা, পেঁয়াজের চাষ করছে। বেড়ার গায়ে দু’চারটে শিম, ঝিঙে, বরবটির লতা তুলে দাও, তা খেয়ে শেষ করা যাবে না।
এই যে পুরো অঞ্চলটা নসু মোড়লের বাদা নামে পরিচিত, এই বাদার পত্তনের কথা বলতে গেলে আমাদের খানিক পিছিয়ে যেতে হবে। কোনও কোম্পানি বা সরকারি ভেস্টের জায়গাকে কীভাবে নিজের দখলে আনতে হয়, সেটা প্রথম দেখাল এই নয়াগঞ্জের নসু মোড়ল। বছরদশেক আগে বর্ষার চাষের সময় ক্যানেলের জলে নসু মোড়ল স্নান করতে এসে জলের টানে একটা কাঁচা বাঁশের শিকড়সমেত গেড়ো ভেসে যেতে দেখে। কী মনে করে মোড়ল বাঁশ গেড়োটা তুলে পাড়ে নামিয়ে রাখে। পাড়ে তখন চাষিবাসি বেশ কিছু মানুষ গায়ে চবচবে সরষের তেল মেখে রোদে বসে গুল দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে নিজেদের মধ্যে বাতেলা ঝাড়ছিল। নসু মোড়লকে বাঁশ গেড়ো তুলতে দেখে একজন বলল, “কী হে মোড়ল, আ-ঝুরা বাঁশটা কার পেছুনে গুঁজবে?”
নসু মোড়ল হেসে জবাব দিয়েছিল, “বাঁশ দেওয়ার মানুষ আর পেলাম কই! ক্যানেলের পাড়েই কুথাও গুঁজে রাখি, ভাগ্যের সহায় হলে মরনকালে বাঁশে চড়ে গোরস্থানে যাব।”
“তুমার যত উদ্ভট চিন্তাভাবনা মোড়ল। তবে নাও কোদালটা,পুঁতে দিয়ে এসো।” বলে এক চাষি কোদালটা এগিয়ে দিয়েছিল।
ক্যানেলের পাড়েই, এখন যেখানটায় নসু মোড়লের ক্ষেত, সেখানে মাটিতে খাল কেটে শিকড়-বেরনো বাঁশ গেড়োটা পুঁতে দিয়েছিল মোড়ল। সেই বাঁশ লেগে গেল। গোড়ায় কোঁড়ল ছেড়ে ছেড়ে এক-দু’বছরের মাথায় একটা আস্ত বাঁশঝাড়ের রূপ নিল। কোম্পানির জায়গা হলেও কেউ আর ওই ঝাড় থেকে বাঁশ কাটতে সাহস পেল না। একজন কাটারির চোঁট মারলে অপরজন শাসিয়ে দেয়, “বাঁশ যে কাটছিস,মোড়লকে বলে কাটছিস? না বলে লোকের জিনিসে হাত দিস না বাপু।”
ব্যস, বাঁশঝাড়ের মালিক হয়ে গেল নসু মোড়ল। ঘরের ছাউনির বাতাকাঠ বলো, গোয়ালঘরের খুঁটি পাল্টাতে বলো, বাঁশের প্রয়োজন হলেই মোড়ল ওই ঝাড় থেকে বাঁশ কেটে নিয়ে যেতে লাগল। কেউ কোনও বাধা দেয় না। মোড়ল তখন ভাবল, বাহ! বুদ্ধিটা বেশ তো কাজে লেগে গেল, এবার ধীরে ধীরে এগোনো যাক।
মোড়ল প্রথমে কাঁটাযুক্ত বাবলাগাছের ডালপালা পুঁতে বেড়া দেওয়ার মতো ঘিরে ফেলল কিছুটা জায়গা। লোকে জিজ্ঞেস করলে বলত, “বাঁশঝাড়ের বাঁশগুলো সব শেষ করে দিচ্ছে গো,তাই একটু আড়াল দিয়ে রাখছি।”
পরে দেখা গেল, না, শুধু আড়াল দিয়েই মোড়ল থেমে নেই। রোজ অবসর সময়ে একবার করে কাটারি, হেতের হাতে নিয়ে ঝোপ-জঙ্গল পরিস্কার করছে নসু মোড়ল। বেনাঝোপে আগুন ধরিয়ে কয়েকদিনের মধ্যেই জায়গাটা সাফ করে দিল। গর্ত থেকে শেয়াল, নেউল, ছুঁচো, গুইসাপ যে যেখানে ছিল, চম্পট দিল। তারপর কোদাল, টাঙনা, গাঁইতি দিয়ে খুঁড়ে খুঁড়ে ওপরের এবড়ো-খেবড়ো আ-ফসলি মাটিকে ফেলে তলা থেকে বের করল উর্বর মৃত্তিকা। সেই মাটির রং দামোদরের মানাচরের পলিমাটিকেও হার মানাবে।
বর্ষাকালে ক্যানেলের ধারে ধারে আম-পেয়ারা, কাঁঠাল, নারকোল, হাইব্রিড পেঁপে বিভিন্ন ফলের গাছ লাগাল নসু মোড়ল। বড় বড় গাছ শিকড়-বাকড় মেলে মাটির ধ্বস ছাড়ার হাত থেকে রক্ষা করল। আর তলের সমতল জমিতে বিভিন্ন সবজি বুনে দিল। ঘাম-রক্ত ঝরিয়ে কয়েক বছরের মধ্যেই একটু একটু করে এগোতে এগোতে উত্তর পাড়ে ল্যাদা সিঙ্ঘির ব্রিজ থেকে চুয়া মাহিনা পর্যন্ত প্রায় এক কিমির মতো ক্যানেলের পাড় নিজের আয়ত্তে নিয়ে চলে এসেছে নসু মোড়ল।
একটা মাটির চালাঘর বানিয়ে নসু মোড়ল বাদাতেই পড়ে থাকে সারাটা দিন, সারাটা রাত। ছেলেপুলেরা খাবারটি পর্যন্ত বয়ে দিয়ে যায়। টিপকলও বসিয়েছে। কত রকম ফলের গাছ! কী নেই? সিজনে সিজনে ক্ষেতের ফসল,গাছের ফলপাকুড় হাটে তুলে।
তিন
নোটিশটা এল দিনসাতেক পর। মুনিষপাড়ার মানুষদের বাড়িঘর সব তুলে নিতে বলেছে। একমাসের মধ্যে বাসস্থান না তুললে কোম্পানির গাড়ি এসে সব ভেঙে দিয়ে যাবে,এমনই শাসিয়ে গেছে। হা হা করে উঠল সবাই। ঘরবাড়ি ছেড়ে, ছেলেপুলে, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, আসবাবপত্র নিয়ে কোথায় উঠবে সব!
অফিসারদের পায়ে পড়ে কান্না জুড়ে দিয়েছিল কয়েকজন, “আমাদের ব্যবস্থা কী হবেক গো বাবুরা? ঘর বাঁধার জায়গা পাব নাই? ক্ষতিপূরণ পাব নাই?”
“এ জায়গা তো তোমাদের নয়, কোন সাহসে তোমরা ঘর বাঁধলে? ঘর তোলার আগে কোম্পানির পারমিশন নিয়েছিলে?”
“আমরা গরিব মানুষ বাবু, দু’মুঠো পেটের ভাতের লেগে নিজেদের মুলুক ছেড়ে এখানে পড়ে আছি। আমাদের একটা ব্যবস্থা করে দিন।”
পা-টা ঝিনে সরিয়ে নিয়েছিল অফিসাররা। বলে গেল, “উপর থেকে অর্ডার এসেছে,আমাদের কিছুই করার নেই। তোমরা হাতে সময় পাচ্ছ, জিনিসপত্র নিয়ে ভালোয় ভালোয় উঠে পড়ো। ওপরদিকে গেলে দেখতে পাবে, জেসিবি দিয়ে কেমন সব ফুটিয়ে দিচ্ছে। এখানেও একটা কিছু থাকবে না। গাছপালা সব কাটা পড়বে।”
নসু মোড়ল বুঝল আর কিছুই করার নেই। মুনিষপাড়া উঠে গেলে তার বাদা থাকবে কী করে! রাস্তাটা তো বাঁকিয়ে অন্যদিকে নিয়ে যাবে না। ক্যানেলের পুরো পাড়টাই সে দখল করে বসে আছে।
কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল যে যা গাছ লাগিয়েছিল ক্যানেলে, সবাই নিজে নিজেই কেটে ঘর ঢুকিয়ে নিচ্ছে। কোম্পানি যদি লোক দিয়ে কাটায় একটা গাছেও হাত দিতে দেবে না। তাই ক্যানেলের দুই পাড়েই এখন কাটারি কুড়ুলের ঠকঠক শব্দ ছাড়া অন্য কোনও শব্দ নেই।
কয়েকজন নসু মোড়লকে পরামর্শ দিল, “এখনও হাতে সুময় আছে মোড়ল,বড় গাছগুলো কাটিয়ে নাও। কত খেটেখুটে, গায়ের ঘামকে ভুইয়ে ফেলে, দিনকে রাত করে তিল তিল করে গাছগুলোকে বড় করেছ,শেষে কোম্পানির জিম্মায় সব দিবে নাকি!”
নসু মোড়ল যেন বোবা হয়ে গেছে, কারও সঙ্গে কোনও কথাও বলে না এখন। কী আর করবে সে! গাছগুলো কি কাটার জন্য লাগিয়েছে! যখন আম-কাঁঠাল পাকে, পেয়ারাগাছে পেয়ারা ধরে, তখন তো শুধু নসু মোড়ল একা খায় না। যত রাজ্যের পাখপাখালি আছে, ইঁদুর, ছুঁচো, কাঠবেড়ালি আছে, সবাই হাজির হয় তার বাদায়। কতরকম পাখি আসে! নসু মোড়লকে পাখপাখালিরা ভয় পায় না। খুরপি নিয়ে সারাদিন বাগানে কাজ করে সে। তার সামনেই অনেক পাখি নেমে আসে। নসু মোড়ল নিজের মনেই তাদের সঙ্গে কথা বলে।
সন্ধ্যা হয়ে গেলে মোড়ল বাইরে আর থাকে না। বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে একেবারে চলে আসে বাদায়। এখন কলার সিজন। অনেক ছিঁচকে চোরের নজর তার বাদার দিকে। কয়েকদিন আগেই কাঁদিখানেক কলা কে যেন কেটে নিয়ে গেছে। দিনের বেলায় তাহলেও বাদার অন্যান্য ক্ষেতে লোকজন থাকে, কেউ ঢুকতে সাহস পায় না, কিন্তু সন্ধে নামলে যে যার ঘর চলে যায়, তাই বলতে গেলে পুরো বাদাটার দেখভাল নসু মোড়লকেই করতে হয়।
মাঝে সরু রাস্তা, দু’পাশে বাগান। রাংচিতার বেড়া দেওয়া আছে। বেড়ার গায়ে একটা বাঁশের দরজা লাগানো। নসু মোড়ল, সেটা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। চালাঘরের সামনে বাঁশের উঁচু মাচা। টিফিন কৌটোর থলিটা চালাঘরের পেরেকে ঝুলিয়ে দিয়ে মাচাতে বসল নসু মোড়ল। সামনে একটা ছোট পুকুর। পুকুর না বলে ডোবা বলাই ভালো। নসু মোড়ল দু'-চারটা লোক লাগিয়ে কাটিয়েছে ডোবাটা। কিছু দেশি মাগুরের ছানা ছেড়েছিল, মাছগুলো এখন ভালোই বড় হয়েছে। ডোবার পর সারি সারি ধানক্ষেত চলে গেছে তাদের নয়াগঞ্জ পর্যন্ত। রাস্তার ওপাশের বাগানটা ক্যানেলের পাড়েই। পাম্প লাগিয়ে ক্যানেল থেকে জল তুলে পাইপ দিয়ে এপাশের ডোবাটা সবসময় ভর্তি রাখতে হয়। তাতে এপাশের গাছপালা, সবজিক্ষেতে জল দিতে সুবিধা হয়।
পাখপাখালির দল সন্ধ্যার এই সময়টাতে কিচিরমিচির জুড়ে দেয়। মাচায় ঠ্যাং দুলিয়ে বসে বসে নসু মোড়ল তাদের ডাক শোনে। মনে অদ্ভুত এক প্রশান্তি আসে। যা কাউকে বোঝানো যায় না। নসু মোড়ল ভাবে, এই ডাক কি আর সে শুনতে পাবে? ক্যানেলের কাজ শুরু হলে সব তো তছনছ হয়ে যাবে। কাটা পড়বে তার নিজের হাতে লাগানো প্রত্যেকটা গাছ। আর বেশি কিছু ভাবতে পারল না সে।
রাতেও ঘুম আসছে না নসু মোড়লের। খালি বিছানায় এপাশ-ওপাশ করছে। মাঝে মাঝে টর্চ নিয়ে কলাবাগানের দিক থেকে ঘুরে আসে, এসে জল খেয়ে শুয়ে পড়ে, কিন্তু ঘুম আর আসে না।
রাত গভীর হলে ধরিত্রীর বুক শীতল হয়। আর সেই সময়েই দু’চোখের পাতা একটু বুজে আসে। সবে চোখটা লেগে এসেছিল নসু মোড়লের। হঠাৎ সেই পেঁচাটা ডেকে উঠল। বুকের রক্তকে হিম করে দেওয়ার মতো ডাক।
নসু মোড়ল তড়াক করে উঠে বসল বিছানায়। সারা শরীর ঘেমে গেল। পেঁচাটা পিছু ছাড়ছে না কেন তার! না কি আরও কোনও বড় ফাঁড়া আসতে চলেছে!
টর্চটা নিয়ে আগলটা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এল নসু মোড়ল। আকাশে ক্ষয়াটে চাঁদ। পাশে একখণ্ড ছেঁড়া কাঁথার মতো কালো মেঘ। ডোবার জলে চাঁদটা একবার মুখ দেখছে, মুখে কালো দাগ দেখে মনখারাপ করে আবার মেঘে মুখ ঢেকে নিচ্ছে। 'কুবুং' শব্দ করে ঘাই মেরে উঠল একটা মাছ। ধানক্ষেতের দিক থেকে বাতাস বয়ে আসছে শনশন শনশন। কুলগাছের দিকে টর্চটা জ্বালল নসু মোড়ল, দুটো ঘুঘুপাখি বসে আছে। একটা বাসায় ডিমে তাওয়া দিচ্ছে, আর একটা গাছের ডালে। টর্চের আলো পেয়ে ভয়ে ডানা ঝাপটে উঠল পাখিদুটো।
“কুথায় গেল শালার পেঁচা!” নসু মোড়ল নিজের মনেই বিড়বিড় করল। তারপর কলাবাগানের দিকে পা ফেলে এগোল। পায়ের পাশ দিয়েই সড়সড় করে ট্রেনগাড়ির মতো পেরিয়ে গেল একটা ছুঁচোর লাইন। সামনে থাকে মা ছুঁচোটা, তার পিছনে পরস্পরের লেজ ধরে ধরে লাইন দিয়ে চলে ছানাগুলো। কলাবাগানে এসে টর্চ টিপে দেখল একটা কলার কাঁদিতে বাদুড়ে কুটকুট করে কলা খাচ্ছে। ছোট ছোট চোখগুলো দিয়ে পিটপিট করে তাকাচ্ছে। কী ভীতু চাউনি! রাতের এই মায়াময় জগৎ নসু মোড়লের চেনা। সে বেশিক্ষণ থাকে না, তার মনে হয় সে যেন অনধিকার প্রবেশ করে ফেলেছে।
আবার ডেকে উঠল পেঁচাটা। কোন গাছ থেকে? রাস্তার ওপাশের বাগান থেকে না? নসু মোড়ল উঠে এল রাস্তায়, তারপর ক্যানেল ধারের বাগানে প্রবেশ করল। এপাড়ে বড় বড় কতগুলো কাঁঠাল গাছ আছে, আর পেঁপে গাছ। আতিপাতি করে পেঁচাটা খুঁজতে থাকে নসু মোড়ল। হঠাৎ ক্যানেলের জলের দিকে ঝুলে পড়া একটা কাঁঠাল গাছের ডালের দিকে নজর পড়ল। একটা পেঁচা বসে আছে। ধূসর আর কালো রঙের ছিঁট ছিঁট পালক,মুখটা ভয়ানক। নসু মোড়ল পেঁচাটার মুখে টর্চের আলো ফেলে স্থির দাঁড়িয়ে থাকল। চোখগুলো জ্বলজ্বল করছে, যেন আগুন ঠিকরে বেরচ্ছে। এমন পেঁচা নসু মোড়ল এর আগে কখনও দেখনি। পেঁচাটা মাথা দুলিয়ে তাকে মুখ ভেংচাল।
টর্চটা জ্বেলে রেখেই ধীরে ধীরে হেঁট হয়ে একটা ঢিল হাতে তুলে নিল নসু মোড়ল। তারপর, “দুর হ মাগি!” বলে গায়ে যতটা জোর ছিল, সজোরে ছুড়ে মাড়ল। ঢিলটা গাছের ডালে ধাক্কা খেয়ে টুকরো হয়ে ঘুরে এসে নসু মোড়লের কপালে ঠাঁই করে পেল। কপালে হাত দিয়ে বসে পড়ল নসু মোড়ল। ঢিল ছোড়ার সঙ্গে সঙ্গেই পেঁচাটা ফড়াক করে উড়ে গেছে, কিন্তু বাদা ছেড়ে একেবারেই চলে যায়নি। খানিকক্ষণ পর আবার দূরের কোনও গাছ থেকে ডেকে উঠল পেঁচাটা। নসু মোড়ল মুখ তুলে তাকাল। মেঘটা তখন পুরোপুরি ঢেকে ফেলেছে চাঁদটাকে।