কালু : সৌগত ভট্টাচার্য
Bengali Short Story: "একটা গুলির কত দাম জানিস? এইপার ওইপার করা হাঁড়িকামাতের কুত্তাকে মারিবার জইন্য একটা গুলিও অনেক দামেই পড়ে!"
বৃষ্টি একটু ধরেছে। প্রধান বাড়ি থেকে ধান ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে দৌড় দেয় কালু। চোখ-নাগালে ধানের রোয়াগুলি সবুজ হয়ে আছে। কালু একবার এই আল আবার ওই আল দিয়ে দৌড়াচ্ছে। আল থেকে ক্ষেতে নামলেই জল। চারপাশে পাট-পচা গন্ধ। কালু সবুজ ধান ক্ষেতের মাঝে একটা চওড়া কালো আলের উপর দাঁড়ায়। এই চওড়া আলের একদিকে বাংলাদেশের প্রধান পাড়া, মাস্টারের বাড়ি গ্রাম আর অন্য দিকে ইন্ডিয়ার হাঁড়িকামাত। কালো আলটাই দুই দেশের সীমানা, দুইদেশের দুইটা গ্রামের মধ্যে কোনও কাঁটাতার নেই শুধু আলের উপর ৬৪৮ সিমেন্টের খুঁটি দুটো দেশকে আলাদা করেছে। কালু চারপাশ দেখে, আবার দৌড় লাগায় হাঁড়িকামাতের দিকে।
হাঁড়িকামাত গ্রামের পুব দিকে বাংলাদেশের গ্রাম প্রধান বাড়ির চওড়া আল আর পশ্চিমে চেকপোস্ট আর কাঁটাতার এটাই কালুর এলাকা। হাঁড়িকামাতের পশ্চিমে ইন্ডিয়ার বসানো কাঁটাতারের বর্ডার ইন্ডিয়া দেশটা থেকেই হাঁড়িকামাতকে আলাদা করেছে। ভঙ্গি পাড়া আর হাঁড়িকামাতের মাঝখান দিয়ে কাঁটাতার চলে যাওয়ায় ইন্ডিয়ার গ্রাম হয়েও হাঁড়িকামাত পকেট গ্রাম হয়ে আছে, সবুজ ধানক্ষেতের মাঝে একলা একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো, যায় একপাশে কালো আল অন্যপাশে কালো কাঁটাতার, না সে বাংলাদেশের গ্রাম আবার ইন্ডিয়ার গ্রাম হয়েও কাঁটাতারের বাইরে। চ্যাংরাবান্ধা-মেখলিগঞ্জ-মাথাভাঙা থেকে হাট বাজার কাজ সেরে গ্রামে ঢুকতে গেলে রেজাউলদের বর্ডারের চেকপোস্ট পেরিয়ে ইন্ডিয়ার থেকেই ইন্ডিয়ার গ্রামে ঢুকতে হয়। রেজাউলের নানা মনিরুল বলত, "তারকাঁটা যেলা গাড়িল্ হাঁড়িকামাত আর ভঙ্গি পাড়ার মধ্যে দিয়া, ইন্ডিয়ারই তো দুইটা গেরাম আলাদা হইল্! হাঁড়িকামাতোক্ একটু গোল করিয়া ঘুরিয়া নিলে তো হামরাও না ভাঙ্গি পাড়ার মতোন ইন্ডিয়ার গেরাম হয়ে গেনি হয়।"
প্রধান বাড়ি থেকে দৌড়ে এসে কালু হাঁড়িকামাতের রেজাউলের বাড়ির দাওয়াতে বসে ঝিমোচ্ছিল। দুইটা মুরগি বাড়ির উঠানে ঘুরছে। কালুর সামনে মুরগিগুলি এলেই কালু বিরক্ত হয়ে ঘেউ ঘেউ করে। ভুট্টা দানা ছাড়াতে ছাড়াতেই আমিনা "আয় আয় আয়…" বলে মুরগিগুলিকে ডাকে। মুরগিগুলি আমিনার সামনে গেলে কালু আবার মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে। কালুর গায়ের রং গাঢ় বাদামি।
আরও পড়ুন- আয়না ভবন : সুমিত বন্দ্যোপাধ্যায়
কালু কারও বাড়ির পোষা কুকুর না, হাঁড়িকামাত গ্রামের কুকুর। কালু প্রতিদিন সকাল বেলায় ভাঙ্গি পাড়া চেকপোস্টের সামনে যায়। বিএসএফ জওয়ানরা সকালের ডিউটিতে যাওয়ার আগে চা-রুটি-বিস্কুট খাওয়ার সময় কয়েকটা রুটি বা বিস্কুটের টুকরা পায় সে। গত বছর মাঘ মাসে বিএসএফের বড় কর্তারা ইনস্পেকশনে আসলে হাঁড়িকামাতের চেকপোস্টের সামনে রংবেরঙের তাঁবু পড়েছিল মাঠে। কালু তাঁবুর পাশ দিয়ে ঘুরঘুর করত। কালু জানতো দুপুরের পর গেলে কিছু কাঁটা জুটবে। উর্দি পরা সিপাইটা কাঁধে বন্দুক নিয়ে তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। কালু আসলেই হাতের লাঠি দিয়ে তাড়া করে। সে তাড়া খেয়ে একটু দূর থেকে ঘেউ ঘেউ করতে থাকে তাঁবুর দিকে মুখ করে। কিছুক্ষণ ঘেউ ঘেউ করে ডাকাডাকির পর মাথা নিচু করে গন্ধ শুঁকতে থাকে। কিছুতেই সে তাঁবুর মাঠ ছেড়ে যেতে চায় না। তাঁবুর থেকে বিজাতীয় খাবারের গন্ধ হাঁড়িকামাতের বাতাসকে ভারী করে তোলে।
ইসমাইল কেন ওই দেশের মাস্টারের বাড়ি ছেড়ে হাঁড়িকামাতে চলে আসে কেউ ভালোভাবে জানে না। রেজাউলদের চাচাতো ভাই ছিল ইসমাইল। সে যখন ওই দেশ থেকে হাঁড়িকামাতে আসে কালুও ওর সঙ্গেই আল পেরিয়ে এই দেশে চলে আসে, কালুর তখন আট-নয় মাস বয়েস। কালুকে যদিও কোনও দেশেরই সীমান্তরক্ষীর নজর এড়াতে হয়নি। মাস্টারের বাড়ির লোকেরা অনেকে বলে, কালুর মা চার পাঁচটা বাচ্চা পয়দা করার এক সপ্তাহ পরই গাড়ি চাপা পড়ে মারা যায়, কালু মায়ের দুধ পায়নি। ছোট থেকেই অন্য মায়ের দুধ খেত মারামারি করে। কিছুদিন পর থেকে ইসমাইল ওকে ভাত দেওয়া শুরু করে। ইসমাইলের বাড়ির আশপাশে ঘুরে বেড়াত কালু।
"আয় আয় আয় কালুউউউ…", সাবিনা ডাকে। চোখের নজরে না থাকলেও কোথা থেকে যেন একটা মরা শালিক মুখে করে কালু সাবিনার সামনে এসে দাঁড়ায়। সাবিনা বলে, "এই জন্যই কয় কুত্তার প্যাট্, মুখত্ খাবার থাকিলেও এলা আরও ভাত গিলিবে!" কালু লেজ নাড়ায়। ইসমাইল মরে যাওয়ার পর গোটা একটা দিন মুখে খাবার তোলে নাই কালু, তখন ওর দুই বছর বয়স। ইসমাইল বুধবার করে চেকপোস্ট পেরিয়ে চ্যাংরাবান্ধার হাট করতে গেলে চেকপোস্ট অবধি যেত কালু। ফিরতে সন্ধ্যা হলে চেকপোস্টের সামনে দাঁড়িয়ে থাকত সে। হাঁড়িকামাত গ্রাম থেকে চেকপোস্ট পার হয়ে ঢোকা বার হওয়া এক ঝামেলার ব্যাপার। হাজার প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে কলজা থেকে জান বার হয়ে যায় ইসমাইল, রেজাউলদের। বাংলাদেশ আর হাঁড়িকামাতের মধ্যে যেহেতু কোনও কাঁটাতারের বর্ডার নাই তাই এই কড়াকড়ি। সন্ধ্যা পাঁচটায় বর্ডারের চেকপোস্টের গেট বন্ধ হয়ে যায়। একবার চ্যাংরাবান্ধা থেকে ইসমাইল ফিরতে পারে নাই সময় মতো, পরের দিন ফিরে আসার পর রেজাউল ইসমাইলকে বলেছিল, "কালু সারা আতি চেকপোস্টের গেটের অদি দেখিছিল!" ইসমাইল পরের দিন চেকপোস্ট পেরিয়ে গ্রামে ঢুকলে দুই পা জড়িয়ে ধরে।
বড় আলের ৬৪৮ নম্বর খুঁটির দিকে রোয়া গাড়ছিল রেজাউল। প্রধান বাড়িতে একই ভাবে নিচু হয়ে রোয়া গাড়েছে সেলিম। কোমরে হাত দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় সেলিম, রোয়াগুলি হাতে নিয়ে বলে, "তোমার ওদিয়া তো ভোট আসি গেল্ রে, হাঁড়িকামাত নিয়া কিছু ঘোষণা করলেক্ নাকি সরকার?" রেজাউল রোয়া গাড়তে গাড়তেই বলে, "সরকার হামার মতো মানষিলাক্ নিয়া আর ভাবে না, ভাবিলে কী আর হামরা অ্যাঙ্করিয়া নই রে। মোর বাপ এইরকম ছিল, মুই এইরকম আছো, হামার চোদ্দ গুষ্টি এইরকমে ছিল, তাও সোজা তারকাঁটার চেকোয়ারটা বেকা হইল্ না!" বৃষ্টি বাড়তে থাকে। সেলিম বলে, "তাও যতদিন আইল আছে ততদিন দেখাশুনা আছে, আইলের বদলে তারকাঁটা বসিলে কি আর অ্যাঙ্করি দেখাশুনা থাকিবে! নাকি ইদে তুই হামার গেরামত্ আইতে পারবি? লাবু কী করব্ তখন মাল নিয়া?" রেজাউল বলে, "এইটা কী বিচার বুঝিবারে পান্নি না, ভোটার থাকলেই বিরিজ হয়, রাস্তা হয়, আর হামার হাঁড়িকামাতোত্ মাত্র চোদ্দটা ঘর, কয়টা ভোট? কারেন্ট দিসে গেরামত্? বুঝিস না, সোলার জ্বালায় কি পাম্প হয় রে?" সেলিম জিজ্ঞেস করে "পাটের দাম কেমন যাছে মেখলিগঞ্জত্?"
"শালা নিজের দ্যাশের দুই গেরামের মধ্যেই তো তারকাঁটা পাতা, ওইটা পার হয়া তারপরে তো পাট বেচা বিক্রি! পাট নাগায় পচায় শুকায় ক্যারিং দিয়া ওদিয়া নিগির নাগে… আর তোর দ্যাশের সঙ্গে হামার দ্যাশের মধ্যে কোনও তারকাঁটা নাই, একটা আইল আর সিমেটের খুঁটি! বুড়িমারি হাটত্ পাট বেচা হামার খুব সোজা!" কথাগুলি যখন হচ্ছিল কালু রেজাউলের পেছনে এসে দাঁড়ায়। কোথা থেকে বৃষ্টিতে চপচপা ভিজে এসে গা ঝাড়ছে কালু, বারবার নিজের লেজ কামড়ানোর চেষ্টা করছে আর গোল গোল করে ঘুরে যাচ্ছে চওড়া কালো আলটার ওপর দাঁড়িয়ে। রেজাউল সেলিম দুই জনেই জানে এই চওড়া মাটির আলটা পার হওয়া যাবে না, ওইটা দুই দেশের সীমানা। "হামার ভোটোতে না বিধায়ক অ্যামপি হয়, কিন্তু হাঁড়িকামাতের কাথা কুনঠে না উঠে…" বলতে থাকে রেজাউল। বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে ওর কথা আস্তে আস্তে মিলিয়ে যেতে থাকে। গোড়ালি অবধি কাদা জলে ধানের রোয়া বুনতে বুনতে সেলিম ক্রমশ প্রধান বাড়ির দিকে চলে যায়, রেজাউল চলে আসে হাঁড়ি কামাতে নিজের বাড়ির দিকে, নিজের দেশের দিকে।
সামনেই ভোট। প্রতিবার নেতারা শহর থেকে এসে ভাষণ দিয়ে যায়–
"...অতএব শুনেন বন্ধুগণ এবার আপনাদের দিয়ে আমাদের কাজ করার সুযোগ দ্যান হাঁড়িকামাতের জন্য! আপনারা তো দেখলেন সরকার স্বাধীনতার এত দিন পরও এই হাঁড়িকামাতে ইলেকট্রিক লাইট আনতে পারল না। আপনারা দেখেন কাঁটাতারের এই পারে ভাঙ্গিপাড়া, ওদের কারেন্ট আছে। আলের ওই পারে বাংলাদ্যাশের প্রধান বাড়ি পঁচাত্তরের বাড়ি সব জাগাতে কারেন্ট আছে, তোমাদের, আপনাদের সোলার! বন্ধুগণ, এই কাঁটাতারের ভিতরে থাকার জ্বালা আমি বুঝি…. আমি শপথ করতেছি আমাকে ভোট দিয়ে জিতালে আমি দিল্লি গিয়ে দরবার করে হাঁড়িকামাত চ্যাংড়াবান্দা কুচবিহার জলপাইগুড়ি সব এক করে দিব। নিজের দেশে পরবাসী হতে হবে না। বোঝেন তো পরবাসী মানে? নিজের গ্রামে ঢুকবার জন্য আর কেউ কৈফিয়ৎ চাইবে না! কথা দিচ্ছি বন্ধুগণ তারকাঁটা বসবে পশ্চিম দিকের আলের জায়গায়, ৬৪৮ নম্বর খুঁটির জায়গায়…."
হাঁড়িকামাতের মানুষের সঙ্গে কালুও মিটিংয়ের মাঠে আসে। মিটিং শেষে কালু সেই মাঠের গন্ধ শুঁকে বেড়ায়। সেলিম রেজাউলকে সেইদিন বলছিল বিএনপি নাকি আওয়ামী লিগের মিটিংয়েও মাঝেমাঝে কালু গিয়ে খাবারের প্যাকেটের গন্ধ শোঁকে। মিটিং থেকে সবাই বাড়ি ফিরলে কালু সাবিনাদের বাড়ির দাওয়ায় চলে আসে।
আরও পড়ুন- সাইকেল: অমৃতা সরকার
কলাপারের পুকুরের সামনে দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যাল করে ফাঁকা মাঠের তাকিয়ে থাকে কালু, পুকুরের জলে ওর ছায়া পড়ে। এই পুকুরের পরেই ছিল সেই ষোলোটা বাড়ি, যারা যুক্তি করে কাঁটাতারের ওইপারের ইন্ডিয়ায় চলে যায়। এখান থেকে কিছু খাবার জুটতো কালুর। "আয় আয় আয়…" ডাক শুনতে পায় কালু। আমিনার গলা সে চেনে। আমিনা কয়েকটা রুটির টুকরা দেয়। কালু মুখ ফিরিয়ে নেয়। আমিনা বলে, "হারামজাদা কুত্তা বিস্কুট ছাড়া মুখোত্ স্বয়াদ আইসে না, যায় যায় বিস্কুট দিসিল সেই মুসকানরা তো ভাঙ্গি পাড়ায় চলি গেইসে। যা এইবার তুইও ভাঙ্গি পাড়ায়!" মুসকানদের আর্থিক সামর্থ ওদের ভাঙ্গি পাড়ায় বাড়ি বানাতে সাহায্য করেছে, সাবিনা আমিনারা এখানেই পড়ে আছে। ষোলোটা বাড়ি ভাঙ্গি পাড়ায় চলে গেলে কালুর শুধু বিস্কুট যায়নি, পেটের খাবারও অর্ধেক হয়ে গেছে।
পৌষ মাসে সন্ধ্যা হতে হতেই কুয়াশায় ঢেকে যায় চারদিক। ৬৪৮ নম্বর পোস্টের সামনে একজন জওয়ান নাইট ডিউটিতে যায়। কালু এখনও হাঁড়িকামাতে ফেরেনি। রেজাউল শোয়ার আগে ঘর থেকে বেরিয়ে টর্চ নিয়ে কালুকে খুঁজে আসে। এই কুয়াশায় টর্চের আলোয় কিছুই দেখা যায় না, তার মধ্যে ধান গাছগুলি লম্বা হয়ে উঠেছে, পাকা রং ধরছে। কালুর কোনও সাড়া শব্দ নাই, রেজাউল ঘুমিয়ে পড়ে। সকাল বেলায় কালুর আওয়াজেই ঘুম ভাঙে ওর। কুয়াশা ভেদ করে প্রধান বাড়ি থেকে লোক আসছে হাঁড়িকামাতে ধান কাটতে। রেজাউল ওদের মুখেই শুনতে পায় কালু মাস্টারের বাড়িতে এক অনুষ্ঠান ছিল সেখানে খেতে গেছিল। কালুর কানের পাশে একটা কাটা দাগ, সম্ভবত ফেলে দেওয়া কাঁটা, হাড় নিয়ে মারামারির সময় অন্য কুকুর ওকে কামড় দেয়, রেজাউল যখন দেখে রক্তের দাগ অনেকটা শুকিয়ে গেছে।
কালু কীভাবে যেন নিজের এলাকার সীমানা কতদূর আর ওর দখলদারি কতটা সেইটা বুঝে যায়। আগে বিএসএফ ক্যাম্পে অনুষ্ঠান হলে কালু ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকত। প্রধান বাড়ি মাস্টারের বাড়ি এলাকায় কোনও অনুষ্ঠান হলেই কালু সন্ধ্যাবেলায় আল পেরিয়ে চলে যায় ওই দেশে, গভীর রাতে হাঁড়িকামাত ফেরে। যাওয়ার সময় যতটা জোরে ছুটে যায় ফেরার সময় হেলেদুলে আল পেরিয়ে আসে, পেছনে তখন প্রধান বাড়ির শাদিতে আলো জ্বলছে। আলো দেখে নাকি গন্ধ পেলে কালু যায়, বলা মুশকিল।
আল দিয়ে মানুষ পারাপার নিয়ে বিএসএফ আর বিজিবির ফ্ল্যাগ মিটিং বসে। দুই দেশ, দুই গ্রামের মানুষের সঙ্গে কালুও দাঁড়িয়ে থাকে, গন্ধ শোঁকে। রেজাউলরা কোম্পানি কমান্ডারকে বলে, "হামার অবস্থাটা বুঝেন স্যার, হামরা না হনি নিজের দ্যাশের মানষি না হনি ওই দেশের… মৈধ্যত্ পড়িয়া আছি। ভুট্টার দাম পানি না… ভুট্টা গাছ নাগানো বিএসএফ থাকি বন্ধ করি দিল্, কছে কিনা গাছ নম্বা হইলে ছিকুরিটির অসুবিধা। ধানের ক্যারিং পোষায় না, পাটের দাম নাই, যার যার পকটত্ ক্ষমতা ছিল উমরায় তো ওইপারে যায়া ভাঙ্গি পাড়া বানাইল। হামার পেটত্ ভুক স্যার। কী করিমু তোমরালায় বিচার দেন!" মিটিং শেষের আগেই কালু ওই দেশে চলে যায়। আজও কি রাতে ওর কোথাও অনুষ্ঠান বাড়ি আছে? সকালেই বিএসএফ ক্যাম্পে খেয়েছে! "এইটাকে কয় কুত্তার প্যাট কিছুতেই ভোক মিটে না! খালি ভোক নাগায়…" দাঁতে দাঁত চিপে রেজাউল বলে…
সাবিনাই প্রথম দেখে কালুর ডান চোখের পাশে একটা গর্ত দিয়ে রক্ত পড়ে শুকিয়ে গেছে। প্রতিদিন ওর গায়ে মারামারির দাগ, খাবার নিয়ে মারামারি। কালুর হাঁটাচলা দেখে মনে হয় ডান চোখটায় ভালো দেখতে পায় না। সেদিন সকাল বেলায় রোজকার মতো ক্যাম্পে রুটি খেতে গেছিল কালু, এক কনস্টেবল লাঠি নিয়ে তেড়ে আসায় কামড়ে দিয়ে আল পেরিয়ে ওই পারে চলে যায়। কয়েকদিন বাদে ফিরে আসে কালু, এরপরই আমিনাকেও কামড়ায়। রেজাউলকে সেলিম সেদিন বলেছে ওপারেও নাকি অনেককে সে কামড়েছে। প্রধান বাড়ির লোকরা কালুকে দেখলেই ঢিল মারে আজকাল। ঢিল খেয়ে কালুও তাড়া করে। হাঁড়িকামাতের লোক বুঝে গেছে কালু পাগল হয়ে গেছে। সারাদিন মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়ায়, পুকুরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, খাওয়ায় মন নাই। একজন বিজিআর রাতের বেলা অন্ধকারে ৬৪৮ পোস্টের সামনে ডিউটি করছিল, কালু হঠাৎ তাকে পেছন দিক থেকে কামড়ে দেয়।
হাঁড়িকামাতে শীত পড়ে। সেইদিন ভোরের কুয়াশার অন্ধকার তখনও কাটেনি সাবিনা রেজাউলকে বলে, "কালু কি কান্দে?" শুধু রেজাউল-সাবিনা না কালুর কান্নার শব্দে ভোরবেলা ঘুম ভেঙে যায় গ্রামের অনেকেরই। গ্রামের লোকজন দেখে কালু মাঘের শূন্য ধানক্ষেত দিয়ে পাগলের মতো দৌড়ে যাচ্ছে আর হাঁপাচ্ছে। কী হয়েছে বোঝার আগেই কুয়াশা ভেদ করে ভাঙ্গি পাড়ার কাঁটাতারের দিকে দৌড়ে চলে যায় কালু, আর তাকে দেখা যাচ্ছে না ঘন কুয়াশায়, শুধু কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে। গ্রামের চারপাশ থেকে ভেসে আসছে মানুষের অস্পষ্ট গলার আওয়াজ আর কালুর কান্না। আবছা কুয়াশায় আলের দুই পারেই মানুষের অবয়ব নড়ছে, কালু দৌড়াচ্ছে। সাবিনা বোঝে, একটার পর একটা পাথর, ঢিল এসে লাগছে কালুর গায়ে পায়ে মাথায়। সে ঢিল খেয়ে একবার আল পার হয়ে ওইদেশে যাচ্ছে আবার বিজিবির ঢিল খেয়ে আল টপকে এই দেশে আসছে। ও এই কয়দিনে অনেক কয়জন গ্রামের লোক আর জওয়ানকে কামড়েছে। ওকে চারপাশ দিয়ে ঘিরে ফেলেছে লোকজন, সমানে একবার এদেশ, একবার ওইদেশ দৌড়ে যাচ্ছে। চারপাশে কুয়াশা কেটে আলো ফুটছে অল্প অল্প করে। খোঁড়াতে খোঁড়াতে কিউ কিউ করে কেঁদে আবার দৌড় লাগায় কালু, কামড়ের শাস্তি… কালুর কান্নায় ভরে উঠেছে হাঁড়িকামাত প্রধান বাড়ির আকাশ, বাতাস, সকাল, শীতের শূন্য মাঠ।
রেজাউলের পাশে আমিনা এসে দাঁড়ায়। শাড়ির আঁচল মুখে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে আমিনা বলে, "একটা গুলি করিলেই তো শ্যাষ হয়ে যায়… এই কষ্ট আর থাকে না!"
রেজাউল বলে, "একটা গুলির কত দাম জানিস? এইপার ওইপার করা হাঁড়িকামাতের কুত্তাকে মারিবার জইন্য একটা গুলিও অনেক দামেই পড়ে!"